ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই বাজারের দু-একজন জানতে পারল যে বাজারের পাগলিটা মা হয়েছে। ঘটনাটি প্রথম দেখেছে বাজারের নৈশপ্রহরীরা। শীতের রাতে সকলেই যখন লেপ-কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমে কাতর ঠিক তখনই হয়তো পাগলীটা এক মানব শিশুর জন্ম দিল। কেঊ তার চিৎকার বা কোন অন্য কোন শব্দ শুনতে পায়নি, এমনকি বাজারের প্রহরীরাও। বিশাল বড় বাজার, একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের কিছুই ভালোভাবে দেখা বা শোনা যায় না। ফজরের অযানের অগে শেষবার চারিদিক ভালোভাবে দেখতে এসে প্রহরীরা এই ঘটনা আবিষ্কার করে।
পাগলীটা থাকত বাজারের উত্তর-পূর্ব কোনের একটা ভাংগা টিনের ঘরে, যার সামনে কোন বেড়া নেই, অন্য তিনপাশের বেড়া গুলোর অবস্থাও ভালো না, শীতের রাতে উত্তর দিকথেকে অসা বাতাস হুহু করো ঢোকেপরে। এরই মধ্য কিছু খর বিছিয়ে পাগলী তার বিছানা তৈরি করেছে। এই ঘর ও জমি নিয়ে মামলা থাকায় কেঊ এই দিকে খুব একটা আসে না।
নৈশপ্রহরীরা প্রতিরাতে দুই বার এই দিকে আসে তাদের দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে। প্রথমবার যখন এসেছিল তখন পাগলী সজাগ ছিল, ঘুমায়নি। পাগলী প্রায় রাতেই অনেক রাত পর্যন্ত সজাগ থাকে, তাই এটা নিয়ে প্রহরীরা তেমন কোন মাথা ঘামায় নি।
শেষ রাতে যখন শেষবার উত্তর - পূর্ব দিকে দেখতে এল তখন একটা চাপা ঘুঙ্গানির শব্দ তাদের কানে আসল। প্রথমে ঘুঙ্গানির শব্দ কেউ কানে নেয় নি। তারা মনে করেছে পাগলিটা হয়তো এই শব্দ করছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে একটা সদ্য জন্মানো শিশুর কান্নার শব্দ তাদের কানে আসল। এইবার সবাই থমকে দাড়িয়ে বিষয়টা ভালো ভাবে বুঝার চেষ্টা করল। তখন একজন প্রহরী বলল " পাগলীতো পোয়াতি আছিল, কিছু অইল নিহি? " তার সাথে থাকা অন্য দুই জনের একজন বলে উঠল "অইবারও পারে, ল দেহি "। তারা তারাতারি টর্চলাইট জ্বালিয়ে ঘরের দিকে গেল। ঘরের বাইরে থেকে দেখল পাগলী মেঝেতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে আর তার পায়ের কাছে সদ্য জন্ম নেয়া এক মানব শিশু। এই শীতের রাতে এই ঘটনা দেখে তিনজন প্রহরীই প্রথমে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। ঠিক তখনই বাজারের মসজিদের মাইক থেকে ফযরের ধ্বনি ভেসে এল, আযানের শব্দে তাদের মস্তিষ্ক আবার সচল হলো। একজন প্রহরী কাছে গিয়ে আরো ভালোভাবে দেখল ব্যাপারটা, এরপর অন্য দুই জনকে ডেকে বলল " গিয়া দ্যাক হুজুর ঘুম থ্যাইক্যা ওটছে, হ্যারে গিয়া ঘটনা ক দেহি"।
মসজিদের হুজুর, ধার্মিক, সুভাষী, ধীর মস্তিষ্কের এবং ভদ্র মানুষ। অনেক দিন ধরেই এই বাজারের মসজিদে আছেন। আজ পর্যন্ত কেউ তাকে খারাপ কিছু বলতে পারেনি। বাজারের পাগলীকে তিনি স্নেহ করতেন। কারো বাড়ি দাওয়াত থাকলে তিনি সেখান থেকে পাগলির জন্য কিছু খাবার চেয়ে নিয়ে আসতেন। পাগলী ছোট খাট অসুখের সময় তিনি ঔষধ কিনেও দিয়েছেন। পাগলীর যখন জামাকাপড় ছিড়ে যেত, যখন সে প্রায় উলঙ্গ হয়ে বাজারে ঘুরে বেড়াত তখন হুজুর সাহেব মানুষের কাছে চেয়ে জামাকাপড়ের ব্যাবস্থাও করে দিতেন। পাগলীর পেটে যখন মানব শিশু ধীরে ধীরে বড় হতে থাকল আর সেই সাথে তলপেটও তখন হুজুর এই তিন প্রহরীকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিল তারা কেউ এই কাজের জন্য দায়ী কি না? সকলেই তা অস্বীকার করেছিল। এর পর হুজুর আর কাউকে কিছু বলে নি।
একজন প্রহরী হুজুরকে গিয়ে বলতেই হুজুর বলল " তুমি যাও আমি নামাযটা পড়েই আসতেছি"।
পাগলি যখন এই বাজারে আসে তখন তার বয়স ১৫-১৬ হবে। স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো ছিল না। হয়তো তার চেহারা খারাপ ছিল না, কিন্তু ময়লা আর ধুলার আবরণে তা ঢাকা পরে গিয়েছে। কথা খুব একটা বলত না, মাত্র একটি শব্দ ব্যাবহার করেই সে মনের ভাব অবলীলায় প্রকাশ করতে পারত। যেমন ক্ষুধা লাগলে সে শুধু ভাত বলত। সেটা যেকোন ধরনের খাবারই হোক না কেন সবই তারকাছে ভাত। কেঊ তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে মুখ ভরাট নি শব্দ হাসি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকত। কেউ তাকে কখনো কাদতে দেখেনি। কোন উচ্চবাচ্য সে করতনা কখনো শুধু মাঝে মাঝে একাএকা অস্ফুট শব্দে কি যে বলত তা কেউ কোন দিন বুঝে উঠতে পারে নি। পাগলী বাজারের কাউকে খুব বেশি জ্বালাতন করত না। যখন ক্ষুধা লাগত তখন কোন দোকানের সামনে গিয়ে দুই তিনবার ভাত ভাত বলত। দোকানদার হয়তো তাকে পাউরুটি বা একটি কলা দিত, সে হাসতে হাসতে চলে যেত।
পাগলীকে অনেক সময় অনেকেই তার নাম জিজ্ঞাসা করেছে, কিন্তু কেউ তার নাম জানতে পারেনি। তার নাম-ধাম কেউ জিজ্ঞাসা করলে সে তার দিকে তাকিয়ে শুধু হাসত৷ তাই তাকে শুধু পাগলী বলেই ডাকত।
সে যখন বাজারে আসে তখন তার স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো ছিল না। বাজারের সকলের সমান্য ভালোবাসা তার উপর বর্ষিত হলে অল্প কয়েক দিনের মধ্যে তার স্বাস্থ্য ভালো হয়ে শুধু তাই নয় বছর খানেকের মধ্যে তার শারীরিক বিভিন্ন পরিবর্তনও দেখা গেল, একজন কিশোরী নারীতে পরিণত হত। একজন নারীর যেই পরিবর্তন পুরুষদের টানে সেই পরিবর্তন।
সমাজ-সভ্যতায় লজ্জা বলে যে কিছু আছে সেই ধারণা এই পাগলীর ছিল না। তাই মাঝে মাঝে তার ছেড়া লজ্জাবরণির মঝদিয়ে নারীর নারীত্ব দেখা যেত। তার এই রুপদেখে কারো মনে কামনা জাগত কি না, সেটা বলতে পারব না, কিন্তু অনেকেই বিব্রত বোধ করত। তাই তার কোন না কোন ভাবে কাপড়ের ব্যবস্থা করে তাকে পরিয়ে দিত৷
ভালোইতো চলছি....
এরপর হঠাৎ বাজারের কেউ খেয়াল করল পাগলীর পেট ধীরে ধীরে ফুলে উঠছে। এক কান দু কান করে বাজারের সবার কাছেই ঘটনাটি ছড়িয়ে পরল। বিব্রতকর ঘটনার কেউ সামনা সামনি কিছু না বললে কান কথা হতে লাগল। সবার মনেই অব্যক্ত প্রশ্ন কে করল?
নামায শেষে হুজুর কয়েকজন মুসুল্লি নিয়ে ঘটনা স্থলে পৌছে গেল, গিয়ে দেখন একজন প্রহরী তার গায়ে গরম কাপড় দিয়ে ঢেক দিয়েছে। পাগলী তখন মরার মতো পড়ে আছে তার পাশেই সেই শিশু। হুজুর একজন মহিলাকে ডাকতে বললেন যে দাইয়ের কাজ করে।
খুব তারাতারিই দাইয়ের ব্যাবস্থা হয়ে গেল, দাই গাগলীর কাছে গিয়ে তার শরীরে হাত দিয়ে দেখল তার শরীর হিমশীতল, দাই আর দেরি না করে হুজুরের কাছে সব বলল। হুজুরের দুই চোখের কোন সামান্য অশ্রুর ঝলক দেখা গেল। হুজুর শিশুটিকে আলাদা করতে বলল।
শীতের কুয়াশা ভেদ করে তখনো সূর্য ঠিকমতো বিকশিত হয় নি। প্রচন্ড ঠান্ডা আর অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে সে একটি মানব শিশু জন্ম দিয়ে গেছে। একজন পৃথিবীর আলো দেখতে দেখতে আরেক জন আলো দেখা বন্ধ করে দিল। এখানে জন্ম-মৃত্যু সমান, জনসংখ্যার উপর কোন প্রভাব না রেখেই পৃথিবীর দাবী ত্যাগ করে চলে গেল পাগলী। যেই পাগলীকে কেউ কখনো কাদতে দেখেনি, আজও তার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল না।
জানি না সেই রাতে কি হয়েছিল? কোন এক অমানুষের কামনার শিকার হয়ে নিষ্পেষিত হয়েছিল। সেখানে অন্য কোন কারণ ছিল না। ছিল শুধু কাম। সেই কামের কামনায় বলী হলো সে।
#ধর্ষণ কে যারা ইনিয়েবিনিয়ে মেয়েদের দোষ বলেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন পাগলী মা হলো কি ভাবে?
#বাজার ও পাগলীর মা হওয়ার ঘটনা সত্য।
আমি গল্প লেখক নই, তাই পড়ে গল্প মনে না হলে ক্ষমা করবেন।