আমাদের অনেককেই হয়তো প্রাচীন গ্রীক পুরান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে অনেক গল্পই অনায়েসে বলে দিতে পারবেন। গ্রীক মিথ গুলোকে আপনার কাছে এমন ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে- পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মিথ এই গ্রীক মিথ, ফলে আপনি সেগুলো পড়ার লোভ সমলাতে পারেন নি। তাই পড়ে ফেলেছেন এবং আমি নিশ্চিত যে ভালোও লেগেছে। গ্রীক বা রোমান মিথগুলো অধিকাংশই ধর্মীয় প্রেক্ষিতে রচিত । আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু ধর্মের সাথে অনেক গুলো মিথ রয়েছে। এই মিথ গুলো সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? আমার মনে হয় গ্রীক মিথ যতটুকু জানি তার চেয়ে অনেক কম প্রাচীন ভারতীয় মিথ গুলো সম্পর্কে জানি। আমি কয়েক দিন ধরে ভারতীয় মিথ পড়ছিলমা- আমি সেখান থেকেই আপনাদের সাথে পর্ব আকারে এই মিথ গুলো শেয়ার করতে চাই
অপ্সরা:
সংস্কৃত শব্দ অপ্ ( বাংলা অর্থ জল বা পানি) হতে এদের উৎপত্তি তাই এদের অপ্সরা বলা হয়। এরা নাচে-গানে পারদর্শী ছিলেন। এই কারণেই এদের ইন্দ্রের সভা গায়িকা ও নর্তকী হিসেবে দেখা যায়। অপ্সরাদের অধিপতি ছিলেন কামদেব। অপ্সরাদের সংখ্যা মোটামুটি ৬০ কোটি।
অপ্সরা নৃত্য
দেবাসুরের সমুদ্র স্নানের সময়ে এরা সমুদ্রের ভিতর থেকে অসংখ্য নারীর সথে উঠে আসেন। কিন্তু কোন দেবদানবই তাদের গ্রহণ করতে রাজী হয় নি, তাই তারা সাধারণ নারী হিসেবেই গন্য হতে থাকেন। এছাড়াও মনুসংহিতায় তাদের জন্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে যে - সাতজন মনুর( মনু হতেই মানুষের সৃষ্টি) সৃষ্টি তারা।
দেবতারা এই অপ্সরাদের নানা ভাবে কাজে লাগাতেন। আমরা সবাই জানি যে, অপ্সরারা মুণি-ঋষিদের ধ্যান নষ্ট করতেন। কিন্তু কেন দেবতারা এই অপ্সরাদের মুণি-ঋষির পেছনে লাগাতেন??? হ্যা- কারণ হলো:- বৈদিক যুগে কঠোর তপস্যার বলে কোন কোন ক্ষেত্রে মুণি-ঋষিরা দেবতাদের চাইতেও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতেন। যাতে তারা দেবতাদের চেয়ে বেশি ক্ষমতা শালী হয়ে উঠতে না পারে তাই তারা অপ্সরাদের লেলিয়ে দিতেন। লেলিয়ে দেয়ার সবচাইতে বড় উদাহরণ হলো - শকুন্তলা। আমরা মনে হয় সবাই শকুন্তলা গল্পটি আমরা প্রায় সবাই পড়েছি। তো শুকুন্তলার জন্ম হয় এক ঋষির ধ্যাণভঙ্গের কারণে। ঋষি বিশ্বমিত্রের তপোস্যাতে দেবতারা উদ্বীগ্ন হয়ে পড়লে তার ধ্যাণ ভঙ্গ করার জন্য দেবতারা মেনকাকে পাঠায় । মেনকার রূপ-যৌবনে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বমিত্রের ধ্যান ভঙ্গ হয়ে যায় এবং তাদের মিলনের ফলে শকুন্তলার জন্ম হয়।
শিল্পীর চোখে বিশ্বমিত্রের ধ্যান ভঙ্গে মেনেকার ভূমিকা
অপ্সরাদের সৌন্দর্য ও যৌন আবেদনের কথা সব সময়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। অপ্সরারা মায়ারূপীনী, সেইজন্য নিজেদের দেহের পরিবর্তন করতে পারতো। অর্থববেদে আছে, এরা পাশা খেলতে খুব ভালোবাসতো এবং পাশা খেলায় খুব পারদর্শী ছিল। অপ্সরাদের মধ্যে উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী, সুকেশী, মঞ্জুঘেষা, অলম্বুষা, বিদ্যুৎপর্ণা, সুবাহু, সুপ্রিয়া, সরসা, পুঞ্জিকস্থলা, বিশ্বাচী উল্লেখ যোগ্য।
ভারতীয় পুরানের অপ্সরাদের মধ্যে অন্যতম উর্বশী ও পুরুবার প্রেমের কথা নিয়ে প্রথম পর্ব সাজানো হয়েছে:
উর্বশী অপরূপ রূপলাবণ্যময়ী স্বর্গের অপ্সরী। উর্বশীর কি ভাবে জন্ম হয়েছে তা নিয়ে নানা ধরনের মত প্রচলিত আছে। কারো কারো মতে উবর্শী নারায়ণের উরু ভেদ করে জন্মগ্রহণ করেন তাই তার নাম উর্বশী। আবার একথাও বলা হয় সমুদ্র হতে উর্বশীর জন্ম। এটাও প্রচলিত যে উর্বশী সাতজন মনুর সৃষ্টি।
উর্বশী ও পুরুবার প্রেম কাহিনী:
ঋগ্বেদে উর্বশী ও পুরুবার প্রেম কাহিনী সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানা যায়। কিন্তু সম্পূর্ণ কাহিনী পাওয়া যায় শতপথব্রাহ্মণে। উর্বশী ও পুরুবার প্রেম কাহিনীটি হলো-
একদিন ইন্দ্রের নৃত্যসভায় রাজা পুরুবা আমন্ত্রিত হন। নৃত্যের জন্য উবর্শীকে অনুরোধ করলে তিনি নৃত্য শুরু করেন। কিন্তু উর্বশী রাজা পরুরবার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার দিকে দৃষ্টি দিলে উর্বশীর নৃত্যের ছন্দ ভঙ্গ হয়। ফলে ইন্দ্র উর্বশীকে অভিশাপ দেন। এবং তাকে পৃথিবীতে সাধারণ মানুষ হিসেবে বসবাস করতে হবে।
উর্বশী এই অভিশাপ শোনার পরে দেবতা ইন্দ্রের কাজে একটি আর্জি করেন। উবর্শী মত্যলোকে পুরুরবার স্ত্রী হিসেবে থাকতে চান। দেবতা ইন্দ্র তার এই মনোবাসনা পুরুণ করেন কিন্তু এখানে ইন্দ্র কয়েকটি শর্ত দিয়ে দেন। শর্তগুলো অনেকটা এই রকম যে- দিনে তিনবার পুরুরবা উর্বশীকে আলিঙ্গন করতে পারবে। উর্বশীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে পুরুরবা কখনো উর্বশীর সাথে মিলিত হতে পারবেন না এবং উর্বশী কখনো পুরুরবাকে নগ্ন অবস্থায় দেখতে পারবে না।
উর্বশী এই শর্তগুলো মেনে নিয়ে মত্যলোকে পুরুরবার স্ত্রী হিসেবে বসবাস করতে রাজী হলেন। এই ভাবে পুরুরবার স্ত্রী হিসেবে উবর্শী বহু বছর পার করে দেন। বহু বছর গত হবার পর স্বর্গের সভাসদগন স্বর্গে উর্বশীর অভাব অনুভব করলেন। এখন কি ভাবে তাকে ফিরিয়ে আনা যায় সেই পথ খোজতে থাকেন। অনেক চিন্তা ভাবনার পরে তারা একটি বুদ্ধি বের করলেন।
তো স্বর্গের সভাসদরা উর্বশীর শয়ন কক্ষে দুইটি মেষশাবক বেধে দিয়ে যান স্বর্গের উপহার হিসেবে। এই মেষশাবক দুইটি সবসময়ই উবর্শীর শয়ন কক্ষেই থাকত। তো একদিন রাতে এই দুইটি মেষশাবকের মধ্যে একটি চুরি করে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন স্বর্গের সভাসদরা। মেষশাবক চুরি করার সময় উর্বশী টের পেয়ে যান। উর্বশী রাজাকে অনুরোধ করেন চোর ধরে আনার জন্য। রাজা উর্বশীর কথায় হন্তদন্ত হয়ে নিদ্রা থেকে উঠে পরেন। এই সময় রাজা উলঙ্গ অবস্থায় ছিলেন। রাত ছিল বিধায় রাজার উলঙ্গ অবস্থা উর্বশী দেখতে পাচ্ছিলেন না। এই সময় স্বর্গের সভাসদরা এটা বুঝতে পেরে দ্রুত বজ্রের সাহায্যে বিদ্যুতের সৃষ্টি করলেন এবং তার আলোয় ঘর ভরে উঠল। এই সময় উর্বশী রাজার নগ্ন অবস্থা দেখে ফেলে। ফলে উর্বশী তার শাপ মুক্ত হয়ে সাথে সাথে অদৃশ্য হয়ে যান।
শিল্পীর চোখে অপ্সরা উর্বশী ও পুরুরবা এর বিদায়ের দৃশ্য।
উর্বশীকে হারানোর শোকে রাজা পুরুরবা দেশে দেশে ঘুরেবেড়াতে লাগলেন। ধীরে ধীরে উর্বশীকে পুনরায় পাবার আশা ক্ষীণ হতে লাগল। কিন্তু একদিন কুরুক্ষেত্রের নিকটে আরো চারজন অপ্সরীর সাথে উর্বশীকে দেখে পেলেন স্নানরত অবস্থায়। রাজা উর্বশীকে বার বার অনুরোধ করতে লাগলেন ফিরে আসার জন্য। কিন্তু উর্বশী কোন ভাবেই রাজী হচ্ছিল না। এই ভাবে বেশ কয়েক দিন যাওয়ার পর একদিন উর্বশী বলেন- বছরের শেষ রাতে আসলে আমি তোমার সাথে শয্যা গ্রহণ করব। এর ফলে আমাদের একটি পুত্র সন্তান জন্ম হবে। তো রাজা পুরুরবা বছরের শেষ রাত্রিতে এসে উর্বশীর সাথে শয্যা গ্রহণ করলেন এবং তাদের একটি পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করল। এভাবে প্রতিবছরের শেষ দিন উর্বশী ও পুরুবার মিলন হতে থাকল এবং প্রতিবছর একটি করে পুত্র সন্তান জন্ম নিতে থাকল। বলা হয় যে উর্বশী ও পুরুবারা পুত্র সন্তানের সংখ্যা পাচ জন।
একদিন উর্বশী এসে পুরুবারকে বললেন যে- দেবতা তোমার মনের ইচ্ছে পুরুণ করবে, তবে একটা শর্ত আছে। পুরুরবা শর্ত শুনতে চাইলেন। উর্বশী বলল- স্থায়ী ভাবে মত্যলোক ছেড়ে স্বর্গলোকে এসে সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করতে হবে। এই জন্য তাকে একবার মৃত্যুকে গ্রহণ করতে হবে। পুরুরবা এই শর্তে রাজী হয়ে গেলেন। এরপর থেকে উর্বশী ও পুরুরবা এক সাথে আবার বসবাস শুরু করলেন।
উর্বশীকে নিয়ে আরো কয়েকটি মিথ প্রচলিত আছে- এর মধ্যে অন্যতম হলো
## মহাকবি কালিদাসের ‘বিক্রম উর্বশী’ নাটকে উল্লেখ করেছেন- কেশী দৈত্য উর্বশীকে হরণ করলে পুরুরবা উর্বশীকে উদ্ধার করেন। এর ফলে উর্বশী ও পুরুরবা উভয়ে প্রেমে আসক্ত হয়। স্বর্গে অভিনয়কালে ভুল ক্রমে পরুরবার নাম উর্বশী উচ্চারণ করায় দেবতাগন উর্বশীকে অভিশাপ দেন মত্যে পুরুরবার স্ত্রী হবার জন্য। পুত্রের মুখ দেখার পর উর্বশী অভিশাপ থেকে মুক্ত হন। পরে দেব গায়ক নারদের বরে উর্বশী ও পুরুরবার মিলন চিরস্থায়ী হয়।
ভারতের বিখ্যাত সূর্যমন্দিরে এভাবেই হাই-রিলিফ টেরাকোটায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অপ্সরা নৃত্যের দৃশ্য।
## পদ্মপুরানে বলা হয়েছে যে, বিষ্ণু ধর্মপুত্র হয়ে পর্বতে তপস্যা করছিলেন। ইন্দ্র তার তপস্যায় ভীত হয়ে তাতে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য কয়েকজন অপ্সরার সাথে বসন্ত ও কামদেব কে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু তারা এই তপস্যা ভঙ্গ করতে ব্যর্থ হলে পুনরায় কামদেব অন্যান্য অপ্সরার উরু থেকে উর্বশীকে সৃষ্টি করে উর্বশীকে বিষ্ণুর নিকট পাঠিয়ে দেন। এই সময় উর্বশী বিষ্ণুর ধ্যন ভঙ্গ করতে সফল হন। এই সময় ইন্দ্র উর্বশীর উপর সন্তুষ্ট হন এবং তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে পাবার ইচ্ছে পোষণ করেন।উর্বশী এতে রাজী হয়ে যায়। কিন্তু পরে মিত্র ও বরুণও উবর্শীকে পাবার ইচ্ছে পোষণ করলে উর্বশী তাদের প্রত্যাখ্যান করেন। এই মিত্র ও বরুন উর্বশীকে অভিশাপদেন যে- উর্বশী মনুষ্যভোগ্যা হয়ে মত্যলোকে জন্ম গ্রহণ করবে। এর ফলে উর্বশী পুরুরবার স্ত্রী হিসেবে মত্যলোকে জন্ম গ্রহণ করেন।
#############################################
আরো দেখতে পারেন:-
কান্ডারি অর্থব ভাই এর একটি ব্লগ আছে : অপ্সরা নৃত্য কথন শিরো নামে । এটিও দেখতে পারেন।