প্রাচীনকাল থেকেই পেইন্টার এবং ফটোগ্রাফাররা নিজেদের সেলফ পোর্ট্রেইট এঁকে/তুলে আসছেন। সত্যজিং রায়ের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্হ যখন ছোট ছিলাম এ মায়ের সাথে সত্যজিৎ রায়ের তোলা একটা সেল্ফ পোর্ট্রেইট আছে যেটা উনি শাটারের সাথে সুতা বেঁধে তুলেছিলেন।
কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোর আবির্ভাব আর জনপ্রিয়তার সাথে সূচনা হয়েছে এক নতুন ধারার ফটোগ্রাফির, যাকে বলা হচ্ছে সেলফি(Selfie)।
সেলফি কাকে বলে
ফেসবুক, টুইটার বা অন্য কোন সোশ্যাল নেটওয়ারিং সাইটে আপলোডের উদ্দেশ্যে কোন ব্যাক্তি যখন নিজেই নিজের কোন ছবি তোলেন তাকেই বলা হয় সেলফি। সাধারণত মোবাইল, ট্যাব বা এ ধরনের ডিভাইস দিয়েই সেলফি বেশি তোলা হয়।
সেলফি প্রধানত দুই ভাবে তোলা যায়:
১) হাত সামনে নিয়ে ফ্রন্ট বা রিয়ার ক্যামেরা দিয়ে
২) আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
সেলফি তোলার জন্য নির্দিষ্ট কিছু পোজ আবিষ্কৃত হয়েছে, যেমন ডাকফেস, কিসিফেস। সময় পেলে এ নিয়ে পরবর্তিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। সেলফির এডিক্টদের প্রিয় সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট হচ্ছে ইনস্টাগ্রাম।
সেলফি তোলা নিয়ে বইও বের হয়েছে, যেমন: How to Take the Best Selfies (Smartphone Photography with Sarah Sloboda)। বইটা আমাজনে কিনতে পাওয়া যাচ্ছে, আমি এখনো নেটে খুঁজে পাইনি, কেউ লিন্ক পেলে কাইন্ডলি শেয়ার করবেন।
সেলফি কুইনস
সেলফি কুইনস বলতে সেইসব সেলিব্রিটিদের বোঝানো হচ্ছে যারা সেলফি তোলাকে শিল্পের(!) পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। হলিউডের সেলফি কুইনদের মধ্যে কিম কারদাশিয়ান আছেন এক নম্বরে ।এছাড়া রিহানা, মাইলি সাইরাস, লেডি গাগা, জাস্টিন বিবাররাও সেলফি কুইন হিসাবে পরিচিত।
বাংলাদেশে প্রথম সেলফি তোলা শুরু করেন মডেল মেহজাবিন। অন্যান্য অনেক তারকা যেখানে ঠিক ভাবে ফেসবুকই ইউজ করতে পারেন না সেখানে মেহজাবিন প্রতিদিনই নিত্যনতুন সেলফি আপলোড করে থাকেন যেগুলো গুণে/মানে হলিউড সেলেবদের চাইতে কোন অংশে কম নয়।
কিভাবে মেহজাবিনের মত সেলফি তুলবেন
ফটোগ্রাফার/কপিরাইট: মেহজাবিন চৌধুরি
মেজজাবিনের সেলফিগুলোর দেখার পর স্কুল,কলেজ/ভার্সিটি ফার্স্ট ইয়ারে পড়া মেয়ে এবং অনেক ছেলেদের মনে একটাই জিজ্ঞাসা, কিভাবে এরকম সেলফি তুলবো ? আসুন দেখি:
১। সঠিক এঙ্গেল নির্বাচনঃ
যারা মেহজাবিনের সেলফিগুলো দেখেছেন তারা একটি বিষয় লক্ষ্য করে থাকবেন, উনি সবসময় একটা নির্দিস্ট কোণ থেকে, প্রায় ১০ ডিগ্রি এঙ্গেল এ সেলফিগুলো তুলে থাকেন। অর্থাৎ উনি বের করেছেন যে এই এঙ্গেল থেকে তুললেই ওনাকে সবচে সুন্দর দেখায়। আপনাকেও এভাবে বিভিন্ন এঙ্গেল ছবি তুলে আপনার বেস্ট এঙ্গেল টা খুজে বের করতে হবে। এখানে সাফল্যের জন্য প্রচুর ছবি তোলার কোন বিকল্প নেই, প্র্যাকটিস প্র্যাকটিস এন্ড প্র্যাকটিস। হ্যান্ড স্ট্রেচড এবং মিরর দুই স্টাইলই ট্রাই করতে ভুলবেন না। সাধারনত আমরা দুইভাবে ছবি তুলি হরাইজন্টালি অথবা ভার্টিক্যালি, কিন্তু সেলফি তোলার সময় সাধারণত এগুলো পরিহার করা হয়। চেষ্টা করুন অদ্ভুত সব এন্গেল এ ছবি তুলতে, যেমন কোনাকুনি। এর পাশাপশি কখন ছবিটা তুলছেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি নিজেকে ফর্সা দেখাতে চান ঘুম থেকে ওঠার পরপর এবং গোসলের পরে সেলফি তোলার চেষ্টা করুন, আশা করি সাফল্য পাবেন।
২।লাইট:
ফটোগ্রাফির সবচে গুরুত্বপুর্ণ বিষর হল লাইট, সেলফিও তার ব্যাতিক্রম নয়। এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলুন যেখানে আপনার মুখের সামনে আলোর একটা বড় উৎস আছে, যেটাকে বলে সফট লাইট। জানালা, টিউব লাইট, মনিটরের আলো সফট লাইটের ভাল উৎস। মুখের উপর টর্চ লাইট ধরবেন না, কারণ এর আলো তীব্র, আপনার এক্সপ্রেশন দিতে অসুবিধা হবে এবং গাঢ় ছায়া পড়বে। লোকজন বাথরুমে প্রচুর সেলফি তোলে কারণ বাথরুমের মুখের ঠিক বিপরীতে টিউব লাইট থাকার দেখতে বেশ ফর্সা লাগে। এক্ষেত্রে অসুবিধা হচ্ছে পিছনে টাইলস দেখা যাওয়ায় কাঙ্খিত কমেন্টসের (সুইট, এনজেল) চাইতে অনাকাঙ্খিত (পঁচানি) কমেন্টস বেশি পড়ে, যাতে সেলফি তোলার মূল উদ্দেশ্য হাসিল হয়না। এক্ষেত্রে সমাধান হচ্ছে ব্যাকগ্রাউন্ড ব্লার করে দেওয়া যা পোস্টের পরবর্তি অংশে আলোচিত হবে।
৩।এক্সপ্রেশনস/ডাইভারসিটি:
আপনার সেলফি হাজার প্লাস লাইক পাবে কিনা তা নির্ভর করছে আপনার এক্সপ্রেশন এর উপর। আগেই উল্লেখ করেছি শুধুমাত্র সেলফির জন্য কিছু পোজের জন্য হয়েছে, তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেগুলো খুব বেশি সামন্জস্যপুর্ণ নয়। এক্ষেত্রে আবারও আপনাকে মেহজাবিন এর কাছে ফিরে যেতে হবে। তার সেলফিগুলো দেখুন এবং আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রপ্ত করার চেষ্টা করুন। মূল বিষয়টা হচ্ছে আপনি নিজেকে বিখ্যাত একজন মডেল ভেবে নেবেন একজন বিভিন্ন রকম মুখভঙ্গি করবেন, ভাববেন একজন সাদা চামড়া ফটোগ্রাফার আপনাকে বিভিন্ন পোজ দিতে বলছেন। এছাড়া হাসি,কান্না,কচি খুকি(মুখে একটা আন্গুল দিয়ে), মনমরা, চোখ টেপা ইত্যাদি অনেকগুলো ছবি দিয়ে কোলাজ করতে পারেন। এক্ষেত্রে সাফা কবিরের কিছু কাজ আছে যা থেকে শিখতে পারেন।
এরপর আসছে বৈচিত্র্য বা ডাইভারসিটি। আপনি চাইবেন না লোকে শুধু আপনার একটা ছবিতে লাইক দিয়ে চলে যাক, আপনি চাইবেন যান তারা যেন আপনাকে ফলো করে। এজন্য শুরুতেই ফেসবুকে ফলো অপশনটা এনাবল করে দিন। এখন এই আকর্ষণ ধরে রাখার জন্য আপনাকে বিভিন্ন কনসেপ্টে ছবি তুলতে হবে। এক্ষেত্রে যদি আপনার বাসায় বিড়াল থাকে তাহলে আপনি অনেকটা এগিয়ে গেলেন। বিড়ালের জন্মই হয়েছে সেলফি তোলার জন্য। যদি বিড়াল না থাকে তাহলে আজকেই কাঁটাবনে গিয়ে একটা কিনে আনুন, হ্যা ওরা বিড়াল বিক্রি করে। এটা হবে আপনার জন্য খুবই ভাল একটা বিনিয়োগ। বিড়ালের সাথে বিছানায় বিভিন্ন পোজে ছবি তুলুন। এছাড়া অন্য যেকোন পোষা প্রাণি, পিচ্চি বাবু, স্টাফড পুতুলকে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলতে পারেন। এছাড়া বিভিন্ন দিন উপলক্ষ্যে বিশেষ ছবি, যেমন শুক্রবারে মাথায় কাপড় দিয়ে, বাবা দিবসে বাবার সাথে, মা দিবসে মায়ের সাথে। এছাড়া বিএফএফ(বেস্ট ফিমেল ফ্রেন্ডস) দের সাথে জড়াজড়ি করে সেলফি তুলতে পারেন। আপনি যদি বাসায়/ঘুমানোর সময় টি-শার্ট পরে ঘুমান সেসময় তোলা সেলফিগুলো আলাদা জনপ্রিয়তা পাবে, কিন্তু এ ধরনের সেলফি এখনো খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না তাই এগুলো পোস্ট করলে বিভিন্ন ওড়না পেজে শেয়ার করা হবে।
এডিটিং
সেলফিও অন্যতম গুরুত্বপূর্ন অংশ হচ্ছে এডিটিং(আসলে এটাকে বলে পোস্ট প্রসেসিং, বোঝার সুবিধার জন্য এডিটিং ব্যাবহার করা হচ্ছে)। আপনি যদি আ্যপলের মোবাইল বা কোন এন্ড্রয়েট সেট ব্যাবহার করেন তাহলে কাজটা বেশ সহজ হয়ে যায়, তবে এগুলো না থাকলেও আপনি কিভাবে একই ইফেক্ট দিয়ে সেলফি পোস্ট করবেন তাও আলোচনা করা হবে। মেহজাবিন সাধারণত সাধারণ আ্যপলের মোবাইলের ফ্রন্ট ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে ইনস্টাগ্রাম এ্যাপ দিয়ে এডিট করে পোস্ট করে থাকেন। তবে এছাড়া বেশ কিছু ভাল এ্যাপ আছে যা আপনাকে মানসম্পন্ন সেলফি পোস্ট করতে সহযোগিতা করবে। নিচে জনপ্রিয় কিছু এ্যাপের নাম উল্লেখ করা হল যা সারা বিশ্বের সেলফি এডিক্টরা নিয়মিত ব্যাবহার করে থাকেন:
ক্যামেরা+ : ক্রপ,বর্ডার, লাইটিং, ফিল্টার
ভিন্টেজ: ছবিতে ভিন্টেজ লুক আনার জন্য
ডিপ্টিক: কোলাজের জন্য
ব্লেন্ডার: একাধিক ইমেজ ব্লেন্ড করার জন্য
ইনস্টাগ্রাম: মসৃন ত্বক, ফিল্টার।
পরবর্তী পোস্টে থাকছে কিভাবে আ্যপলের মোবাইল বা এন্ড্রয়েট সেট ছাড়া ছবি তুলবেন এবং ছেলেরা কিভাবে সেলফি তুলবেন