১৯৪৩ সালের ৩০ শে এপ্রিল,
ফ্রান্সের হুয়েলভা উপকুলীয় অঞ্চলের সৈকতে এক জেলে খুঁজে পান ব্রিটিশ উর্দি পরা একটি লাশ । যার ঠিক হাতের সাথে বেখাপ্পাভাবে চেইন দিয় বাঁধা ছিল একটি কালো রঙের সরকারি ডকুমেন্ট ব্রিফকেস । ব্যাপারটা যেন এমন, সে নিজেকে হারাতে রাজি আছে কিন্তু সেই ব্রিফকেসকে নয় । সেই জেলে লাশটাকে উদ্ধার করে অর্পন করলেন হুয়েলভার নৌ অধিদপ্তরের কাছে । নৌবাহীনি ব্রিটিশ ঐ উর্দিধারীর লাশ ব্যবচ্ছেদ করলেন নৌ হাসপাতালে । ব্যবচ্ছেদ করবার পর দেখা গেল পুরো ফুসফুস পানিতে ভরে গিয়েছিল অর্থাৎ পানিতে ডুবেই মারা গেছে ঐ ব্যক্তিটি । লাশটির পোশাক থেকে পাওয়া গেল তার পরিচয়পত্র । তার নাম উইলিয়াম মার্টিন, তিনি ব্রিটিশ নৌবাহীনির একজন মেজর পদের অফিসার । লাশটির পোশাকের পকেট থেকে আরও পাওয়া গেল একটি প্রেমপত্র , পিতার তরফ থেকে একটি চিঠি ও ব্যাংকের তরফ থেকে বকেয়া পরিশোধের একটি চিঠি । আর তার হাতের সাথে বাঁধা ঐ ডকুমেন্ট ব্রিফকেস থেকে পাওয়া গেল একটি কনফিডেন্সিয়াল সামরিক নথি ।
মেজর মার্টিনকে যথাযথ সামরিক সম্মান প্রদানোত্তর হুয়েলভার সামরিক সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্থ করা হয় ।
এরপর ৩ মে তে ফ্রান্স নৌবাহীনি ব্রিটিশ নৌবাহীনির কাছে একটি রেডিও মেসেজ পাঠায় যে তারা মেজর উইলিয়াম মার্টিনের লাশ খুঁজে পান হুয়েলভার সমুদ্র সৈকতে ৩০ শে এপ্রিলে । এবং সেইদিন দুপুর বারোটায় তাকে সমাধিস্থ করা হয় স্থানীয় গোরস্থানে । কিন্তু তার ব্রিফকেস ও নথির ব্যাপারে কোন কিছু জানায়নি ফ্রান্সের নৌবাহীনি কর্তৃপক্ষ । পরেরদিন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর দপ্তর থেকে রেডিও মেসেজে বলা হয় যে মেজর মার্টিনের সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক চিঠি বা নথি ছিল সেটা কী তার সাথে পাওয়া গেছে নাকি যায়নি , যদি পাওয়া যায় তা যেন তাঁদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয় ! ফ্রান্স নৌকর্তৃপক্ষ মেসেজটি পাবার পর সাথে সাথে নথিটি পাঠায়নি । বেশ কিছুদিন বিলম্বে ১১ মে তে নথিসুদ্ধ পুরো ব্রিফকেসটি পাঠিয়ে দেয়া হয় লন্ডনে ।
চার্লস কলমন্ডলে
ইউয়েন মন্টেগু
লন্ডনে ব্রিফকেসটি পৌঁছামাত্র তা গ্রহণ করেন দুজন ইন্টেলিজেন্স অফিসাার । একজন হলেন নৌ ইন্টেলিজেন্সের চৌকষ অফিসার ইওয়েন মন্টেগু ও অন্যজন হলেন ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থা এম আই ৫ এর একজন ধুরন্ধর অফিসার চার্লস কল্ডমন্ডলে। দুজনে মিলে ব্রিফকেসটা নিয়ে গেলেন ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থার মূল রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট “কিউ” সেকশনে । সেখানে গিয়ে ব্রিফকেস খুলে দেখা গেল যে ভেতরের সামরিক চিঠিটি একদম অক্ষত অবস্থায় আছে । এমনকি খামের ওপরের সীলমোহরটিরও কোন নড়চড় নেই । কিন্তু তবুও তারা আশ্বস্ত হলেন না । খাম খুলে চিঠি খুলে তারা বুঝলেন চিঠিটি পড়া হয়েছে কারণ চিঠির ভেতরে একটি চোখের পাঁপড়ি ছিল , সেটা সেখানে নেই । এরপর আরও পরীক্ষা করে জানা গেল চিঠিটি খুলে পড়া হয়েছে । গোপনীয় তথ্য জেনে গেছে কেউ , অথবা শত্রুপক্ষ ।
এই কথা জানবার পর দুই অফিসারের মুখে কোন ভয় কিংবা উৎকণ্ঠার ছায়া দেখা গেল না উল্টো ঠোঁটের কোণায় ফুটে উঠল সাফল্যের হাসি । কারণ মাছ টোপ গিলেছে । সফল হতে চলেছে গুপ্তচর ইতিহাসের সবচেয়ে সফল মিশন অপারেশন মিন্সমিট । যা বাঁচিয়ে দিয়েছিল অনেক ব্রিটিশ সৈনিকের প্রাণ !
কী ছিল এই মিশনের পেছনের গল্প ? কেমন ছিল এই দুর্ধর্ষ অভিযান ? তাই জানাচ্ছি আজকের লিখায় !
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সিসিলি মিত্রপক্ষের কাছে হয়ে উঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান , এর ভৌগলিক অবস্থান ও এর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে । আর তাই আফ্রিকার বিজয়ের পর মিত্রবাহিনী বিশেষ করে ব্রিটিশ সরকারের তীব্র আগ্রহ দাঁড়ায় সিসিলি দখল করা । কারণ এতে করে যুদ্ধে যেমন এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া সম্ভব , ইতালিকে পরাস্থ করা সম্ভব তেমনি সাথে সাথে কোণঠাসা করা সম্ভব হিটলারকে । কারণ হিটলারের অন্যতম দোসর ছিলেন ইতালির মুসোলিনি । কিন্তু মিত্রবাহীনির কাছে যেমন সিসিলি গুরুত্বপূর্ণ তেমনি হিটলারের কাছেও এটি গুরুত্বপূর্ণ । তাই সরাসরি এই সিসিলি আক্রমণ সম্ভব নয় মিত্রবাহীনির কাছে । এইজন্য নয় যে তা অসম্ভব , এটা এইজন্য যে হিটলারও তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে সিসিলিকে জয় করতে , এতে করে জয় হলেও বিরাট ক্ষয়-ক্ষতি হবে মিত্রবাহিনীর ক্ষেত্রে । তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যুদ্ধ হবেই , আক্রমণ করা হবে সিসিলিতে তবে এর আগে হবে আরেকটি আক্রমণ , “ প্রবঞ্চনার আক্রমণ ” ! আর তাই এই আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয় চার্লস কলমন্ডলে এবং ইয়েন মন্টেগুকে । এরাই ছক তৈরী করেন ইতিহাসের সফলতম এক গুপ্ত অপারেশনের , যার নাম “ অপারেশন মিন্সমিট ” !
কিন্তু কীভাবে হবে এই আক্রমণ ?
ব্যাসিল থম্পসন , প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের গোয়েন্দা প্রধান । তিনি “ গুপ্তচর শিকারি ” হিসেবে খেতাব অর্জন করতে পেরেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিজের অবদানের জন্য । তিনি শত্রুকে ধোঃকা দেবার জন্য কিংবা গুপ্তচরবৃত্তি করবার জন্য বেশ কিছু পদ্ধতি আবিষ্কার করেন ।
জন গডফ্রে
পরবর্তীতে দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধ সময়কার নেভাল গোয়েন্দা প্রধান অ্যাডমিরাল জন গডফ্রে ও তাঁর সহযোগী ইয়ান ফ্লেমিং ( জেমস বন্ডের স্রষ্টা ) মিলে যুদ্ধে নৌবাহিনী কী করে শত্রুপক্ষকে ধোঁকা দেবে কিংবা নিজেদের গোয়েন্দা কার্যক্রম চালাবে তাই নিয়ে একটি নির্দেশনা তৈরী করেন যা “ ট্রাউট ম্যামো ” নামে পরিচিত । অনেকেই মনে করে থাকেন যে আসলে এইসব নির্দেশনাগুলো তৈরী করেছেন ফ্লেমিং নিজেই যদিও প্রকাশ পায় গডফ্রের নামে ( বলে রাখা ভালো , এই গডফ্রের চরিত্র থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে ফ্লেমিং তৈরী করে জেমস বন্ডের “এম” চরিত্রটি ) । সেই নির্দেশনার ২৮ নং নির্দেশনাটি ব্যাসিল থম্পসনের সেই পদ্ধতির থেকে ধারা করে ও নতুন সংস্করণ করে প্রকাশ করা হয় । সেটা ছিল এমন যে :- “ একটি লাশকে সামরিক পোশাক পরিয়ে কোন বিমান থেকে শত্রুর সমুদ্র সৈকতে ফেলে দিতে হবে । তার পকেটে থাকবে কিছু তথ্য সম্বলিত কাগজ পত্র । আর এটা দিয়েই ধোঁকা দেয়া হবে শত্রুকে । ”
ইয়ান ফ্লেমিং
ফ্লেমিংয়ের এই নির্দেশনাটি খুব পছন্দ হয় চার্লস কলমন্ডলের । কর্তৃপক্ষ চাইছিল শত্রুকে ধোঁকা দিয়ে ভিন্ন দিকে চালিত করতে । আর তা কীভাবে করবে তা নির্ধারণ করতে হবে এই দুজনকে । সাধারণত এইসব কাজে ব্যবহার করা হয় ডাবল এজেন্টদের যারা দুইদলের হয়ে কাজ করে থাকে কিন্তু ভালো ইনাম পেলে পড়ে যেকোন একপক্ষের হয়ে কাজ করে এবং অন্যপক্ষের তথ্য ফাঁস করে দেয় অথবা ভুল তথ্য দিয়ে প্রতারিত করে । প্রথমে তাই সবার পছন্দ ছিলো ডাবল এজেন্টকে ব্যবহার করা । কিন্তু চার্লসের মতে ডাবল এজেন্ট ধরা পড়লে অত্যাচারের কারণে সব স্বীকার করে নিতে পারে , কিন্তু একজন মৃত মানুষের মুখ দিয়ে কী স্বীকার করানো যাবে ? তাই তিনি বেছে নিলেন ট্রাউট ম্যামোর ২৮ নং নির্দেশনাটি ।
চার্লসের এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ শুরু করে দিলেন মন্টেগু । তারা দুজনে মিলে সদস্য যোগাড় করে একটি জানালাবিহীন রুমকে তাঁদের অফিস বানিয়ে ( যা রুম ১৩ নামে পরিচিত ) নেমে পড়লেন কাজে । প্রথমেই তাঁদের প্রয়োজন ছিল একটি বেওয়ারিশ লাশ । আর তা পাওয়াও গেল । গ্লিন্ডার মাইকেল নামক এক ভবঘুরে বাস্তুচ্যুত মানুষকে পাওয়া যায় গুদাম ঘরে , ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে পড়ে ছিল সে । পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও মারা যান । সিদ্ধান্ত নেয়া হলো এর লাশটাকেই ব্যবহার করা হবে । তবে মন্টেগু চাইলেন একটি সৈনিকের লাশ হলেই হবে না । এমনভাবে সব সাজাতে হবে যাতে করে কোন প্রকার সন্দেহ যেন শত্রু পক্ষের না থাকে । তাই মন্টেগু চাইলেন বিশদভাবে চিত্রপট সাজাতে ।
একজন সৈনিকের কেবল একটি পেশাগত জীবন নয় একটি ব্যাক্তিজীবনও থাকে । সবসময় সে সেই ব্যক্তিজীবনের চিহ্ন বহন করে চলে সবক্ষেত্রে । এমনকি যুদ্ধের ময়দানেও সে সেইসবকে হাতছাড়া করে থাকতে চায় না । মন্টেগু চাইলেন যে এই নকল সৈনিকের লাশেরও একটি ব্যক্তিগত জীবন থাকবে যদিও সেটা হবে তার মতই নকল ।
সেই নকল আইডি কার্ড
তৈরী করা হলো মেজর পদের একটি নকল আইডি কার্ড । আর তার নাম দেয়া হয় উইলিয়াম মার্টিন । তবে আইডি কার্ডে যে ছবি দিতে হবে তা পাওয়া যাবে কোধায় ? কারণ মাইকেলের কোন ছবি তাদের কাছে ছিল না , আর থাকলেও কোন কাজ হত না কারণ সামরিক পোশাক পরা একটি ছবি আইডি কার্ডে ব্যবহার করতেই হবে । সেই উপায় বের করলেন মন্টেগু । একটি সেমিনারে যোগ দিতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন রেডিও ইঞ্জিনিয়ার ও এম আই ৬ এর ডাবল এজেন্ট রনি রিডকে । যার চেহারার সাথে মাইকেলের চেহারার অদ্ভুতভাবে মিল ছিল কেবল মাত্র তার চুল ছিল অনেকটাই পাতলা ! তবে তার সামরিক পোশাক পরা ছবি যখন দেখা গেল তখন বোঝা গেল তেমন একটা পার্থক্য করা সম্ভব নয় ।
রনি রিড
মন্টেগু চার্লসকে বললেন যে যদি মেজর মার্টিনের সাথে একটি ব্যাংক থেকে আসা চিঠি , বাবার থেকে আসা একটি চিঠি ও প্রেমিকার টিঠি ও ছবি থাকে তবে কী মার্টিনকে আরও বেশি বাস্তবিক মনে হয় না ? চার্লসের থেকে যখন সম্মতি পাওয়া গেলে মন্টেগু একটি ব্যাংকের ম্যানেজার থেকে বলে কয়ে একটি টাইপ করা চিঠি যোগাড় করলেন যেখানে লিখা ছিল যে ব্যাংক মার্টিনকে আদেশ করছেন তাদের ওভারড্রাফটের বকেয়া পরিশোধ করবার জন্য । ব্যাংক ম্যানেজারের থেকে চিঠিটি পাবার পর মন্টেগু এবার তৈরী করলেন একটি চিঠি যা ছিল মার্টিনের কাছে লেখা তার কল্পিত বাবার চিঠি । আর শেষমেশ তৈরী করলেন একটি প্রেমপত্র । তবে আরেকটু বাস্তবিক দেখানোর জন্য মন্টেগু চাইলেন একটি তরুণীর ছবি । কিন্তু যেন তেন ছবি হলে তো আর হবে না । একটু সুন্দরী কারও অথবা নিদেন পক্ষে এমন মায়াবি কোন মেয়ের ছবি যাকে দেখলেই মনে হবে শহুরে মেয়ে এবং শিক্ষিতা ,যাতে করে একজন সেনা অফিসারের সাথে যায় মেয়েটা । তার চেয়েও বড় কথা হলো ছবিটা হতে হবে এমন যে এর আর কোন কপি কারও কাছে থাকবে না ।
গ্লিন্ডার মাইকেলের লাশক সামরিক পোশাক পরানো অবস্থায়
এম আই ৫ এর ডাবল এজেন্ট সেকশনের একজন নারী কর্মচারী ছিলেন জিন লেসলি । এই লেসলির ছবি যোগাড় করেন ঐ দুই গোয়েন্দা অফিসার । চার্লস লেসলিকে ভালোভাবে জেরা করে নিশ্চিত হয়েছিলেন যে এই ছবির কোন কপি আর কারও কাছে আসলেই আছে কিনা । নিশ্চিত হবার পর এই ছবিই ব্যবহার করবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । এছাড়াও মার্টিনের ওয়ালেটে দেয়া হল একটি এনগেজম্যান্ট রিংয়ের বিলসহ(যেটা তার কল্পিত প্রেমিকার জন্য ছিল) আরও কিছু টুকটাক জিনিসপত্র যা একজন সৈনিকরে কাছে থাকা বেশ স্বাভাবিক ।
জিন লেসলির সেই ছবি যা ব্যবহার করা হয়েছিল
এরপর তৈরী করা হলো মূল বিষয়টি । একটি জাল সামরিক ডকুমেন্ট যাতে লিখা ছিল মিত্র বাহিনী খুব শীঘ্রই গ্রীস আক্রমণ করতে চলেছে । এবং তার জন্য যেন সেই অঞ্চলের দায়িত্বরত কমান্ডার তৈরী থাকে , বিপুল পরিমাণ সেনা সেখানে পাঠানো হবে তাই তারা যেন সবদিক থেকে প্রস্তুত থাকে । এরপর ডকুমেন্টটির মাঝে রাখা হলো একটি চোখের পাঁপড়ি এরপর খামের ভেতর ডকুমেন্টটি ঢুকিয়ে সীল মেরে দেয়া হলো । মার্টিনের সাথে এই ডকুমেন্টের ব্রিফকেস ও সেইসব নকল চিঠি ও ওয়ালেট দিয়ে তাকে সামরিক পোশাকে সাজিয়ে একটি ক্যানিস্টারের ভেতরে পুরে পৌঁছে দেয়া হলো নৌবাহিনীর একটি সাবমেরিনে । আর এই পৌঁছে দেয়ার কাজটাও করেন চার্লস ও মন্টেগু নিজেই । এরপর মার্টিনের লাশ ঠিকঠাকমত পৌঁছে যায় ফ্রান্সের হুয়েলভা সৈকতে । তারপরের ঘটনা তো বলাই হয়েছে পূর্বে !!
কিন্তু কেন তারা তাদের এই “প্রবঞ্চণার আক্রমণের” ক্ষেত্র হিসেবে ফ্রান্সকে বেছে নিল ?
ফ্রান্স নিরপেক্ষ হিসেবে নিজেকে প্রচার করলেও পর্দার আড়ালে তারা ছিল ফ্যাসিবাদীদের দোসর । তাই জার্মান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আবহেঁয়া (abwher) এর সাথে তাদের সাথে ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ । একটা গুরুত্বপূর্ণ বলে কোন কিছু যদি তাদের হাতে যায় সেটা যে কয়েক হাত ঘুরে জার্মানদের হাতে যাবে না এমনটা ভাবাই যেত না । ব্রিটিশরা খুব ভালো করে জানতো ফ্রান্সে জার্মানদের সাথে দহরম মহরম সম্পর্ক ছিল তাদের মধ্যে । তাই সব দিক চিন্তা করে তারা এই সিদ্ধান্ত নেয় ।
ওদিকে জার্মানরা খুব ভালো করে জানতো যে ব্রিটিশদের কিছু যদি খোয়ানো যায় আর সেটা যদি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয় তো যেভাবেই হোক মরিয়া হয়ে বি্রটিশরা সেটা উদ্ধার করবে ও সেই অনুযায়ী কাজ করবে । তাই মন্টেগু ও চার্লস অনবরত ফ্রান্স নৌবাহিনীর কাছে এমনভাবে ম্যাসেজ পাঠাতে থাকে যেন তারা ঐ নথি মতে মরিয়া , আর কোনভাবে সেটা ফাঁস হলে সব শেষ । মন্টেগু আর চার্লস এর অভিনয়ে আশ্বস্ত হয় ফ্রান্স ও জার্মান গোয়েন্দা সংস্থা । তারাও ঐ মিথ্যা ডকুমেন্টকে বিশ্বাস করে এগিয়ে যায় ।
তবে মন্টেগু ও চার্লস একদম নিশ্চিত ছিলেন না যে জার্মানরা তাদের ফাঁদে পা দিয়েছে । তাই তারা ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করে যাচ্ছিল ১০ জুলাই ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত । সেদিন মিত্রবাহিনী সিসিলি আক্রমণ করে । সেদিন অপারেশন মিন্সমিট এর পুরো দল অপেক্ষা করছিল তাদেরই ঘাঁটি রুম -১৩ এ । সেদিন তারা ছিল অত্যন্ত উদ্বীগ্ন কারণ শত্রুরা প্রতারণার টপ গিললেও সেই অনুযায়ী কাজ করছে নাকি তারাও অন্য ফাঁদ পেতে রেখেছে । এতদিনের পরিশ্রম সফল হতে তো ?
সেদিনই রেডিও বার্তা এল যে এল যে মিত্রবাহিনী স্বল্প বাধার মুখোমুখি হয়ে শেশমেশ সিসিলির সৈকতে ঘাঁটি গাড়তে পেড়েছে । এর মানে এই হলো যে এই প্রবঞ্চণার আক্রমণ অবশেষে সফল হয়েছে । তা যদি না হতো তবে মিত্রবাহিনী বিরাট বাধার সম্মুখীন হতো । অপারেশন মিন্সমিটের এই সফলতার কারণে মিত্রবাহিনী ১৭ই আগস্ট সিসিলি জয় করে নেয় । এরপর ধীরে ধীরে প্রতিভাত হতে শুরু করে বিশ্বযুদ্ধে জয়ের মাল্যাধিকারী হবে কে তা !
অপারেশন মিন্সমিট সম্পর্কে পুরো পৃথিবী অজ্ঞাত থেকে যায় ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত । সেই সালে মন্টেগু প্রকাশ করেন তার বই “The man Who never was” , যেখানে তিনি জনসাধারণের কাছে উন্মুক্ত করেন এই গুপ্ত অপারেশনের কথা । তবে সেখানে চার্লস সহ সকলের নাম গোপন রাখা হয় । এরপর বেন মেসিনটায়ার পরবর্তীতে প্রকাশ করেন তার বই “ অপারেশন মিন্সমিট ” ! সেখানেই বিস্তারিত প্রকাশ পায় চার্লস সহ সকলের পরিচয় । যে জিন লেসলির ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল পাম হিসেবে তিনি ২০১২ সালে মারা যান । সম্ভবত তিনিই ছিলেন সর্বশেষ সদস্য যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি সফল স্পাই অপারেশনের সাক্ষী ছিলেন ।
প্রায় প্রতিটি যুদ্ধেই সফলতার পেছনে আছে কয়েকটি গোপন সফল যুদ্ধের কাহিনী আমরা এর কেবল কিছুটাই জানতে পারি ।
রচনাকারী: নিবর্হণ নির্ঘোষ !
তথ্যপঞ্জি:
* The Man Who Never Was- Ewen Montagu.
* Operation Mincemeat: How a Dead Man and a Bizarre Plan Fooled the Nazis and Assured an Allied Victor- Ben Macintyre.
* Click This Link
* Click This Link
* Operation Mincemeat- Wikipedia.