বাঙালির কাছে বোধহয় বৃষ্টিটা খুব পছন্দের । কবি থেকে লেখক , কথক থেকে পাঠক , প্রেমিক কিংবা খাদক সবার কাছে বৃষ্টি মানেই এক স্বর্গীয় আবহাওয়া । আর অলসদের কাছে তো এটা স্বর্গাতীত কিছু । বৃষ্টি একটি প্রেমময় আবহাওয়া হলেও এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে আর তা নগর জীবনে বেশি দৃশ্যমান হয় । তেমন একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো জলাবদ্ধতা । বৃষ্টি সে হোক ইলশেগুঁড়ি কী ঝমঝমা ঝম রাস্তায় পানি জমে যে নিদেন পক্ষে ছোটখাটো হাওড় বাওড় তৈরী হবে না এমনটা কখনওই দেখতে পাওয়া যায় না । বলা যায় বৃষ্টির সাথে বঙ্গনগরীগুলোতে জলাবদ্ধতার এক অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক নিহিত আছে ।
এই দেশে সেই শিশুকাল থেকে এই পৌরুষকাল পর্যন্ত দেখে এসেছি যে বৃষ্টি হলেই কমসে কম হাঁটুজল থাকবেই পুরো রাস্তা জুড়ে । রাস্তার সাথে সাথে বাড়িঘরও ডুবে যায় নিমিষেই । গাড়ি চলবে না চললেও ভাড়া হাঁকবে চড়া, স্কুল হয়ে যাবে বন্ধ, তবে অফিস আদালত হবে না বন্ধ ফলে বিশাল মাপের মানুষ পানি কেটে যাবে কর্মস্থলে । নোংরা পানিতে কাপড় চোপড় ভিজিয়ে অফিস করবে । পানিবাহিত রোগে কুপোকাত হয়ে হাসপাতালে যে যাবে সেই উপায়ও নেই ! মানে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা !!
তো এই জলাবদ্ধতার নিরসনের কোন পদক্ষেপ নিতে আজ পর্যন্ত নিতে দেখা যাচ্ছে না পৌরকর্তৃপক্ষকে । প্রতিবার শহর ডুবে গেলে কর্তৃপক্ষ থেকে আশ্বাস পাওয়া যায় কিন্তু পরের বর্ষায় আবার যখন তা তা থৈ থৈ নেত্য চলে পুরো শহর জুড়ে তখন আর কিছুতেই বিশ্বাস থাকে না । যেহেতু এই বিপর্যয়ের কোন সুরাহা হচ্ছে না তখন এই বিপর্যয়কে সাদরে বরণ করে নেয়াই উচিত । কারণ , “ কী আর করা খাইছি যখন ধরা !”
আবহমান নগর জীবনে জলাবদ্ধতা যখন একটি স্বাভাবিক ঘটনা তখন একে আরও বর্ণিলভাবে স্বাভাবিক করে নিলে আপত্তি থাকবে কেন ? আমি বলতে চাইছি যে এখন থেকে এই জলাবদ্ধতাকে ঐতিহ্য বলে ঘোষণা করা হোক । এতে করে আমরা মামা নেই বলে কানা বগাকে মামা বানিয়ে মামার উপযোগ পেতে পারবো । একবার ঐতিহ্য বলে গণ্য করলে আমাদের এখানে ভোগান্তি কমবে না তা নয় বরং এই ভোগাস্তিকে আমরা আনন্দের জন্য সাময়িক কষ্ট বলে চালিয়ে দিতে পারবো ।
ঐতিহ্য বলে ঘোষণা করা হলে এই ঐতিহ্য পালনে এগিয়ে আসবেন সাংস্কৃতিক জগতের মানুষজন । নাচে গানে বরণ করা হবে বর্ষার নাগরিক জলাবদ্ধতাকে । এইদিনে উদীচি থেকে শুরুকরে ছায়ানট বজরায় চড়ে নগরের দূর্গন্ধময় সাময়িক নদীতে ভাসতে ভাসতে গাইবে জলাবদ্ধতা নিয়ে দারুণ কোন গান । রবীবাবুর জলাবদ্ধতা নিয়ে কোন গান আছে কিনা জানা নেই । তবে মাকসুদ সাহেব যখন আছেন তিনি “মেলায় যাইরে” এর মত একটা ফাটাফাটি গান বানিয়ে ফেলতে পারবেন । পুরো শহর এই গান গাইতে গাইতে নাচবে । মন্দ হবে না !
ঐতিহ্য পালনের জন্য সমস্ত অফিস আদালত সেদিন বন্ধ থাকবে সুতরাং পানি কেটে আর অফিসে যেতে হবে না । ভার্সিটির পরীক্ষা সেদিন থাকবে না । স্কুল তো বন্ধ থাকবেই । নায়ক নায়িকারা সেদিন নোংরা পানিতে দাপাদাপি করবে ( এই দৃশ্যটাকে কী ভালো বলা যায় ?) । টিকটকাররা কুলসন সেমাই মার্কা চুল নেড়ে ভিডিও বানাবে । প্রেমিক প্রেমিকারা নৌকা নিয়ে প্রেমলীলা করবে তা দেখে মুরব্বিরা নাক সিঁটকাবে । নৌকায় চড়া হিজাবি রমনীদের দেখে রাস্তার দুপাড়ে দাঁড়ানো যুবকেরা ভারতভূষণের মত মোহাম্মদ রফির বিখ্যাত গান “ তু গঙ্গা কী মঁজ ম্যায় ” গানটি গাইবে । বলা যায় না সিনেমার মত নৌকা তাঁদের কাছে ভিরলে ভিরতেও পারে, নৌকার ওপর আস্থা এখানে প্রযোজ্য !
এই দিনে ব্যবসায় বাণিজ্যও ভালো হবে । পহেলা বৈশাখে যেমন পান্তা ইলিশের রমরমা বাণিজ্য চলে তেমনি এইদিন চলবে মুড়ি-মুড়কির বাণিজ্য । হরেক রকমের শুকনো খাবার এইদিনে ঐতিহ্যের স্বাদ নিয়ে ভক্ষণ করা হবে । এক বাটি মুড়ির দাম হবে আকাশচুম্বি । এইদিনে সব যানবাহন বন্ধ থাকবে কেবল জলভাসিত যান ছাড়া । স্পীড বোটের আলাদা কদর থাকবে ভোঁ করে গিয়ে সবাইকে ভিজিয়ে দেবার জন্য ।
শেষমেশ টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকগণ “ অ্যাঁ অ্যাঁ ” করতে করতে এক কথা ছত্রিশবার বলে সরাসরি সম্প্রচার করবে এই ঐতিহ্য পালন । কর্তৃপক্ষও এইদিনে থাকবে খোশমেজাজে , গর্ব করবে তারাও এই ঐতিহ্যে সামিল হতে পারবে বলে ।
কেমন হবে ? খারাপ হবে না মোটেই । এতে করে কর্তৃপক্ষের আর কোন চাপ থাকবে না । বিরাট বিরাট প্রকল্পের আশ্বাস দেখিয়ে দূর্নীতি হবে না । জলাবদ্ধতা নিয়ে টিভিতে ক্যাচাল টকশো হবে না । ফেসবুকে জ্বালাময়ী পোস্ট আসবে না । আহা কী সুন্দর সময় । ভাবা যায় ?
আমার মনে হয় এই করে আমরা এই সমস্যার সুন্দর সমাধান করতে পারবো । সমাধান বললে অনেকে মান করবেন জানি কিন্তু সমস্যাকে আপন করে নিলে সেটা আর সমস্যা থাকে না , তো এটাকে সমাধান বলা যায় না ?
আসুন আর দেরী নয় অতি শীঘ্রই আমরা গড়ে তুলি আমাদের নতুন ঐতিহ্যকে । আর বিশ্বকে দেখিয়ে দিই আমরা কী !!