পিটার সারস্টেড
একটি মেয়ে , যে কিনা বর্তমানে (মানে সেই ষাটের দশকে) ব্রিটিশ ধনী ও অভিজাত শ্রেণীদের একজন হয়ে ওঠে । যার পরনের পোশাক থেকে শুরু করে অঙ্গশোভাকারী অলংকার সব কিছুতেই হালের অভিজাত ফ্যাশনের আভাস । যার চেনা জানা লোক হলো এমন ব্যক্তি যাদের পুরো দুনিয়া এক নামে চেনে । যাদের সাহচর্য মানেই যেকোন মানুষের জন্য সৌভাগ্যজনক । মেয়েটির জন্মদিন কিংবা বিশেষ কোন দিবসে তেমন মানুষদের থেকে আসে দামি ও সম্মানবৃদ্ধিজনক উপহার । এক কথায় এই মেয়েকে বলা যেতেই পারে এই বস্তুবাদী জগতে একজন সুখী কিংবা বলা যেতে পারে সকলের কাঙ্খিত জীবন উপভোগকারী ভাগ্যবতী কেউ । স্বীকার করাই যায় এমন জীবন চাইবে না এমন মেয়ে পাওয়া দুষ্কর !
হয়তো আরাধ্য যে সুখের হাতছানি নারীদের তাড়া করে বেড়ায় সেই সুখ জয় করে নিয়েছে এমন মেয়ে হিংসার কারণ হতেই পারে সকলের কাছে । কিন্তু তবুও থেকে যায় এমন কিছু যা ভ্রু কুঁচকে দিতে পারে আমাদের কিংবা কপালের ভাঁজে তৈরী করে দিতে পারে একটা প্রশ্নবিদ্ধ চিহ্ন ! আর আমাদের ভাবাতে পারে যে সুখ বলে আসলে কিছু নেই । আর যদি থাকেও তবে সে দুঃখের চাইতেও বড় নয় এবং সেই সুখের পেছনেও দুঃখ ওত পেতে থাকে ! সেই দুঃখের আভাস পায় না তার আশেপাশে থাকা কোন মানুষ কিন্তু দূর থেকে বসে থাকা এক যুবক তা টের পায় হরদম । আর সে জানে কোথায় তার দুঃখের ঠিকানা আর কীভাবেই বা এর অবসান হবে !
এমন মেয়ে আমাদের আশেপাশে অনেকেই আছে । আরও সোজা করে বললে এই ব্লগেই আছে কিংবা আপনার পাশেরজন ! হ্যাঁ পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় আছে এমন মেয়ে । আর তাদের প্রতিনিধিত্ব করে অঞ্জনের মালা কিংবা পিটার সারস্টেডের ম্যারি ক্লেয়র । হ্যাঁ এতক্ষণ যে মেয়েটির কথা বলছি তা হলো পিটার সারস্টেডের ম্যারি ক্লেয়রের কথা যা পশ্চিমবঙ্গে এসে হয়ে গেছে মালা । এখনও অনেক ছন্নছাড়া যুবকের প্রেম-বিরহের সাথী যে গান । আর অনেক যুবতিদের কাছে যা কেবল স্মৃতি হাতড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বর্তমানেই অন্ধের মত ডুবে থাকার সারথি !
১৯৬৯ সালে প্রকাশিত পিটার সারস্টেডের একটি অ্যালবাম যার মধ্যে একটি গানের শিরোনাম হলো Where You Do Go To My Lovely ? প্রকাশিত হবার পর পরই এই গানটি অনেক শ্রোতাপ্রিয় হয়ে ওঠে । সাধারণত সেই সময়ের সব গান ছিল প্রেমিকার কাছে প্রেমিকের প্রেমাবেদন কেমন তা প্রকাশকে ঘিরে কিংবা প্রেমবিরহের বিষয় নিয়ে । সেইসময় এমন একটা গান শ্রোতাদের অন্যরকম স্বাদ এনে দেয় । যদিও সেই সময় ছিল পৃথিবীতে নতুন নতুন গানের ধরনে পরিচিত হবার রেওয়াজ বছর ঘুরতে না ঘুরতে একেক ব্যান্ড একেক ধাঁচের ও শৈলীর গান প্রকাশ করছিল যা আবার একটি অন্যটি থেকে আলাদা । এবং সেসব কেবল প্রেম ঘিরেই ছিল না , আরও অন্য বিষয় নিয়েও তৈরী হত গানগুলো!
তবে পিটারের এই গান সবার কাছে খুব সমাদর পায় । কারণটা খুব সোজা । এখানে একটি গল্প বলা আছে । আর সেই গল্পটাই মানুষকে আপ্লুত করেছে আবার কাঁদিয়েছেও ।
গানটি যেমন শ্রোতাপ্রিয় হয় তেমনি অনেক গালগপ্পও তৈরী হয়ে যায় । সবার মুখে মুখে চলতে থাকে যে আসলে কোন মেয়ের কথা বলা হয়েছে ? সোফিয়া লরেনের না তো ?
হ্যাঁ গানটির মধ্যে যে গল্প বলা আছে তাকে যদি বাস্তবের কারও সাথে মেলাতে হয় তবে প্রথমেই যার নাম আসে তিনি হলেন সোফিয়া লরেন !
বিখ্যাত এই নায়িকার বাবা , যিনি কি না সেই সময়ের বেশ অভিজাত পরিবারের একজন ছিলেন । তিনি তার প্রেমিকা মানে সোফিয়ার মাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করেন । ফলে সোফিয়া লরেনের জীবন হয়ে পড়ে ভীষণ দূর্বিষহ ।তিনি তার মা আর তার দুই ভাই সমেত বাস করে ন্যাপলসের কাছাকাছি একটি অঞ্চলে । আর পিটারের গানে আমরা দেখতে পাই যে , গানের প্রায় শেষাংশে তিনি বলছেন :
I remember the back streets of Naples
Two children begging in rags
Both touched with a burning ambition
To shake off their lowly-born tags, they tried
এতটুকুতে বোঝাই যায় যে আসলে এটা সোফিয়া লরেনের জীবনের সাথে মিলে যায় । কিন্তু পিটার বললেন অন্য কথা । একবার তিনি বলেছিলেন যে এই গান সোফিয়ার থেকে অনুপ্রাণিত নয় তবে তার ছায়া এই গানে আছে । তবে কার থেকে অনুপ্রাণিত এই গান ?
পিটার তা বলেছেন । পিটারের জন্ম ভারতে , তার বাবা চাবাগানের কর্মকর্তা ছিলেন । পরে তারা বিলেতে পাড়ি জমান । ১৯৬৬ তে প্যারিসে তার পরিচয় হয় আরেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে অনিতা আতকে । এক সময় প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন , প্রণয় থেকে পরিণয় । কিন্তু অনিতা ছিলেন ডেন্টিস্ট , এদিকে পিটার গায়ক । কোন এক অমোঘ কারণে ৫ বছর পর তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায় । এই অনিতাকে উদ্দেশ্য করেই তিনি এই গানটি লিখেন ও সুর করেন । যদিও এই গানে ছায়া রয়ে গেছে অনেক মেয়েদের , যাদের জীবনটা ঝাঁ চকচকে কিন্তু তার নিচেই আছে কষ্ট !
অঞ্জন দত্ত
এদিকে পশ্চিমবঙ্গে ১৯৯৩ সালে পুরনো গিটার নামে একটি অঞ্জন দত্তের একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয় আর তার মধ্যে একটি গান হলো মালা ! এই গানটা পিটারের গানের বাংলা সংস্করণ বলা চলে । বিলেতি গানের বাংলা সংস্করণ পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছিল সেই ৭০-র দশক থেকে (যদি ভুল না করে থাকি তো)। সেই ধারাবাহিকতায় অঞ্জনও এই গান তৈরী করেন । যদিও এই গানে আলাদা এক আবেদন তৈরী হয়ে যায় ।
অঞ্জনের গানে আমরা দেখতে পাই , মালা নামের একজন তরুণী যিনি এখন বেশ ধনী কারও স্ত্রী এবং সেই সুবাদে বেশ বিলাসী জীবনযাপনকারী একজন ! যার সংসারটা সানন্দার পাতায় বর্ণিত সাজানো গোছানো, যার কথা বলা মধুবালার মত , যার চালচলন সোফিয়া লরেনের মত , যার সাথে বিশেষ সখ্যতা আছে ইমরান খানের ! যার জন্মদিন ১২ই মেতে , আর জন্মদিন মানেই বিশাল বিশাল সব উপহার, স্বামীর থেকে পাওয়া বিলাসী জীবন । অনেকটাই বলা যায় সেই পিটারের ম্যারি ক্লেয়রের মত মালা ! কিন্তু এখানে আলাদা এক চমক আছে । পিটার কিন্তু ম্যারি ক্লেয়রের কোন জন্মদিনের তারিখ উল্লেখ করেননি । এবং বলেননি ম্যারি তার জীবনে ছিল কি না বা হারিয়ে গেছে কি না । তবে অঞ্জনের গানে তা পাওয়া যায় । ১২ই মে , যে দিন এন্টালি সিনেমার পেছনের বস্তির মৌললীর মালার জন্মদিন সেইদিন হারিয়ে যায় মালা কোন এক যুবক থেকে !
পিটারের গানে যেমন দেখা যায় এক যুবক জানে কোথায় ম্যারি ক্লেয়রের কষ্টটা ঠিক তেমনি অঞ্জনের গানেও পাওয়া যায় । তবে অঞ্জনের গানে মালা দাঁড়িয়ে যায় অপরাধীর এক মূর্তি হিসেবে । এক যুবার ভালোবাসাকে মাড়িয়ে নিজেকে বিলাসে বিক্রি করে দেবার অপরাধে ! আর মালাকে যে যন্ত্রণা তাড়া করে বেড়ায় তার পেছনে যে এই সে নিজেই দায়ী তাই মনে করিয়ে দেয় অঞ্জন ! আর বুঝিয়ে দেয় তার যন্ত্রণার উপশম আছে তার কাছে !!
দুটো গানই নিজ নিজ জায়গা থেকে আলাদা আবেদন রাখে ও রেখে চলেছে । একটি পুরো বিশ্ব জুড়ে আরেকটি কেবল বাংলা ভাষাভাষিদের কাছে । হয়তো অনেকের জীবনে একবার জরিপ চালালে দেখা যাবে ম্যারি ক্লেয়র বা মালা একজন নয় অগণিত ! আর তারা হয়তো ভুলে থাকতে চায় তাদের পুরনো জীবনকে , আর এই যে জ্বলজ্যান্ত সত্যকে ভুলে থাকবার প্রচেষ্টা এবং এর ফলে যে অনুতাপ ও যাতনা তার উপশম বয়ে নিয়ে বেড়ায় অঞ্জন, পিটার অথবা নাদিম( এই নামটা যুক্ত হবার পেছনে যে কারণ তা অন্য পোস্টে জানা যাবে) !
আসছে ১২ই মে, আপনার কী জানা আছে কোন মালার কথা ? আর আপনার কাছেই কী আছে তার যাতনার উপশম ?
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০২৩ রাত ১০:৫৩