মানব জীবনে জীবন যাত্রার যে আবর্তন তাতে অধিকাংশ কাল আমরা পাড় করি অন্য মানবদের সাথে কোন না কোনভাবে কাল ক্ষেপন করে । সেটা সামাজিকতার কারণেই হোক কিংবা নিজের প্রয়োজনে অথবা পার্থিব দায়িত্বের দায়ে , অস্বীকার করার উপায় নেই মানুষ সবচেয়ে বেশি সময় কাটায় মানুষের সাথেই ! আর নগর জীবনে তো এর মাত্রা অনেক বেশিই বলা যায় । আমরা না চাইলেও আমাদের মধ্যেই ঘুরপাক খাই নাগরিক নগর বিলাসে ! সামাজিক জীবনে আমাদের সমলিঙ্গের সাথে সম্পর্ক গড়াটা বেশ স্বাভাবিক তেমনি এই আধুনিক নগর জীবনে বিপরীত লিঙ্গের সাথে সাময়িক কিংবা দীর্ঘকালীন প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক সব রকমের সম্পর্ক গড়াটাও বেশ স্বাভাবিক । সম্পর্ক যে কেবল জৈবিক হবে এমন না , আবার খুব যে সামাজিক হবে এমনও না । বেশ অদ্ভুত কিছু সম্পর্ক গড়েই যায় জীবনের প্রবাহমানতায় !মানবকুলের এক নগন্য মানব হয়ে আমিও এর বাইরে নই । আমারও এই মানব জীবনে হুট করে এক তরুণীর সাথে একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল , আর তা যে অদ্ভুত ছিল তা আমি নির্বিবাদে স্বীকার করব অন্তত আমার ক্ষেত্র থেকে !!
আমার স্নাতক শিক্ষা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিক কাজ বাদে আর কোন কাজেই আমি অংশগ্রহণ করতাম না । সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখবার এক অদম্য প্রয়াস আমাকে তাড়িত করতো কোন না কোন ভাবে নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে রাখবার ও স্ব-রুদ্ধ থাকবার জন্য । তাই সকলের কাছে আমি যেমন বিরক্তিকর ছিলাম তেমনি আবার ছিলাম ব্রাত্যও । এতে অবশ্য আমার খুব একটা খারাপ লাগতো না বরঞ্চ ঝামেলাহীন এক জীবন যাপন করে বেশ ভালোই দিন কাটিয়েছি আমি শুধুমাত্র আমার স্থবির সময়গুলো বাদে । ঠিক সেই সময় আমার মত এক বিদঘুটে ব্যক্তিত্বের যুবার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল এক নারীবাদী তরুণীর সাথে , নাম তার নূপুর ।
ক্লাসে তার মত মেজাজি আর কোন মেয়ে ছিল বলে মনে হয় না । একদম উন্নাসিক আর আগাগোড়া অহমিকার আলোয়ান গায়ে চরিয়ে চলা ফেরা ছিল তার পরিচয়ের সবচেয়ে স্পষ্ট দিক । তার রুক্ষ আর নির্লিপ্ত আচরণের কারণে ছেলেরা তার কাছ খুব একটা ঘেঁষতো না তার ওপর আবার নারীবাদী । উনিশ থেকে সাড়ে উনিশ হলে কখন আবার কী না কী বলে বসে বা করে বসে এই ভয়ে সব ছেলেরাই তার থেকে দশহাত দূরে অবস্থান করতো । তবে মেয়েদের মাঝে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল সে । এমন একটা মেয়ের সাথে আমার সখ্যতার প্রথম দিকটা খুব স্বাভাবিক ছিল , সাধারণ সহপাঠীদের মধ্যে যেমন কথা হয় তেমন ভাবেই । প্রথম দিক থেকেই আমি তাকে আপনি সম্বোধন করেই কথা বলতাম এবং শেষ পর্যন্ত সেভাবেই আমি তার সাথে আলাপ করে গেছি !
আমাদের মধ্যে সখ্যতা বেশ গাঢ় হয় বাতিঘরে এক মজার ঘটনার মধ্য দিয়ে । সেই থেকে আমি লক্ষ্য করতাম আমার সাথে কথা বলতে গেলে সে তেমন আচরণ করতো না যেমনটা ক্লাসের অন্য ছেলেদের সাথে করতো । আমার সাথে কথা বলবার সময় মনে হতো কোথাও কোন ভুল হচ্ছে যতটা রুক্ষ বলে মনে হয় অতটা রুক্ষও নয় এই মেয়েটি । নিজের ব্যক্তিগত বিষয়গুলো এমনভাবে বলতো যেন আমি তার খুব আপন কোন বন্ধু , এমনকি তার প্রিয় মানুষের সাথে সাম্প্রতিক বিচ্ছেদ নিয়েও খোলামেলা আলাপ করেছিল সে ( এবং এও স্বীকার করেছিল এভাবে আর কাউকে সে খুলে সব বলেনি ) । আমার সামান্য কথাতেই সে হাসতো , আমার যন্ত্রণায় রেগে আগুন হলেও আবার ক্ষ্যাপতে গেলে ঠিকই সহ্য করতো কখনও এমনও হয়েছে শেষমেশ বলে বসত , “ সাহিদ অনেক হয়েছে এবার তো আপনি ক্ষান্ত দিতে পারেন , তাই না ! ’’ তার কথায় সায় দিয়ে আমি ক্ষান্ত দিতাম বটে তবে তা মাত্র কিছু সময়ের জন্য এরপর আবার যেই কে সেই , আবার রেগে আগুন হওয়া আবার সহ্য করা , পুনরাবৃত্তি হতেই থাকতো !!
করোনাকালীন সময়ে তার সাথে আমার আলাপ হত বেশি । আমাদের কথাবার্তা অধিকাংশ সময় এই প্রশ্নতেই ঘুরপাক খেত যে কবে পৃথিবী আবার স্বাভাবিক হবে ? মুক্তভাবে শ্বাস নিতে পারবো আবার আর কখনইবা আমরা নিরাপদে উল্লাস করে বাঁচবো , নিভৃতে বাঁচা মরার দ্বন্দ্বে নয় !! একের পর এক লাশের খবর , মানুষ থেকে মানুষের বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা , নিজর প্রিয়জন থেকেই দূরে থাকা , জীবিকার স্তব্ধতা সব ছাড়িয়ে সব উদ্বিগ্নতা মাড়িয়ে আমাদের কথা চলত । আর একটু একটু করে বাড়তে লাগল আমার খুঁটিনাটি খুনসুঁটি আর তার কপট রাগ , আর এক নিগূঢ় সখ্যতা কিংবা নিকটত্ব !!
আমার ভবঘুরে নিরস জীবন যাত্রার প্রতি তার বেশ আগ্রহ ছিল । প্রায়ই জিজ্ঞেস করতো “ আপনি কী সত্যিই এভাবেই আজীবন থাকবেন ? ” তার প্রশ্নে আমার উত্তরটা সব সময়ই একই থাকতো , “ হ্যাঁ ” । অনেক সময় খেয়াল করেছি সে আমার উত্তরের পর একদম নিশ্চুপ হয়ে যেত । তার নীরবতা থেকে আমার মনে একটা ভয় জন্ম নিত । সে কী আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে ? আমার যে জীবন যাত্রা তাতে এমন ঘটনা ঘটা মানেই হলো মহাপ্রলয় !! তাই বেশ কিছুদিন তার থেকে পালিয়ে পালিয়ে থেকেছি । একটা সময় সে হয়তো বুঝে গিয়েছিল , তাই একদিন তার নারীবাদী সুলভ ঝগড়া করে আমার সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিল । একদিক থেকে আমার ভেতর স্বস্তি জন্মালো এই ভেবে যে যাক বাঁচা গেল আবার অন্যদিক থেকে একটা অস্বস্তি জন্মালো । কেন যেন এর পর থেকে আমার মনটা খারাপ থাকতো , ভেতরে একটা চাপ অনুভব করতাম , বারবার মনে হত এভাবে এড়িয়ে যাওয়াটা কী ঠিক হয়েছে ? যদি এড়িয়ে না যেতাম তবে কী ঠিক হত ? দ্বিধা-দ্বন্দ্বে সময় কাটাতাম । বেশি অস্বস্তি লাগলে আমি লিখতে বসতাম । লিখতামও , কখনও কিছু একটা দাঁড়াত কখনও আবার কিছুই দাঁড়াতো না তবুও নিজেকে শান্ত রাখতে লিখেই যেতাম ।
আমার খুব প্রিয় একটি চলচ্চিত্র হলো “ কিছু সংলাপ কিছু প্রলাপ ” ( এই চলচ্চিত্রেই ব্যবহৃত হয় ধাঁধাঁর থেকেও জটিল তুমি গানটি ) । এই চলচ্চিত্রের তিনটি চরিত্র মূখ্য ছিল অরূপ , অনন্যা ও নিউটন । নূপুরকে আমি প্রায়ই বলতাম আমার অরূপ হতে ইচ্ছে হয় আবার নিউটনের মত ভাবুক আটপৌরে হতে ইচ্ছে হয় শুধু অনন্যার মত কেউ নেই আমি সত্য না মিথ্যে তা তালাশ করবার মত । আমি জানি না নূপুর নিজেই অনন্যা হয়ে আমাকে খুঁজেছিল কিনা কিংবা আমাকে বুঝতে চেয়েছিল কিনা । তবে তার কারণে আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমি আসলে একই সাথে অরূপের মত রহস্যময় আবার নিউটনের মত ভবঘুরে । তার এক বান্ধবীর মারফতে জেনেছিলাম আমার প্রতি তার আগ্রহটা নিছক নয় যা সন্দেহ করেছি তাই । তবুও আমি একে কোনভাবেই গ্রহণ করতে চাইনি । আমার কাছে মনে হয়েছে ব্যাপারটা সত্য নয় হয়তো যতটা গাঢ় বলে মনে হচ্ছে , হয়তো এটা নিছক অজানাকে জানবার তীব্র কৌতুহল ! আবার এও হতে পারে আমার অরূপ আর নিউটন হবার ইচ্ছাই আমাকে তার আগ্রহকে স্বীকৃতি দিতে চাইছে না !!
প্রায় এক বছর পর তার সাথে আবার আমার কথা শুরু হয় তারই প্রচেষ্টায় । যদিও সেই আগের মত সখ্যতা আমাদের আর ছিল না । এখনও এমন আছে । দেখা হলে খুব একটা কথা হয় না । তবে চোখাচোখি হলে খেয়াল হয় সে আমার দিকে খুব অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে যেন আমার এই ভবঘুরে আর নির্লিপ্ত জীবনকে সে বিদ্রুপ করছে কোন এক দুঃখ আর ঘৃণা নিয়ে । এই দিকটা আমার খারাপ লাগে , অস্বস্তি হয় । মাঝে মাঝে নিজেকে বেশ বিরাট মাপের অতিপ্রাকৃত বলে মনে হয় , পুরুষ হয়েও এক তরুণীর পাণিপ্রার্থনার প্রতি পিঠ ফিরিয়ে দিয়ে আমি কী আমার সীমাবদ্ধতাকে জয় করিনি ? আবার মনে হয় আমি কী অন্যদের থেকে আসলেই আলাদা ? আমিও কী আর দশটা মানুষের মত নই ? তবে আমার এই কাজটা কী ঠিক হলো ?
এই দোলাচল নিয়ে আমি চলতে থাকি , আসলে ঐ যে আমি অরূপ ও নিউটন দুটোই হতে চেয়েছি হয়তো সেই কারণে আমার ভেতরে দ্বৈতসত্তার এক আদিম যুদ্ধ চলতেই থাকে । এখন অবশ্য আমি এই বিষয়টাকে বেশ উপভোগ করি , ধাঁধাঁর থেকেও জটিল আমি আমার আমিকে জয় করেছি আবার আমার আমিতেই পরাজিত হয়েছি । দারুণ না ? প্রথমে বলেছি না যে তার আর আমার সম্পর্কটাকে অদ্ভুত বলে মনে হয় ! এর কারণটা হলো তার আর আমার মাঝের সম্পর্কটা ঠিক জৈবিক নয় আবার সামাজিক নয় আবার নিছক বন্ধুত্ব নয় । হয় এই তিনটির সংমিশ্রণ অথবা অন্য কিছু ! তবে যাইহোক না কেন আমি বলব যা হয়েছে ঠিকই হয়েছে । এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে সব কেন সাধারণ হতে হবে ? কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাউকে না কাউকে নূপুর হওয়া আর কাউকে না কাউকে অরূপ ও নিউটনকে ধারণ করে চলাটা ভালো নয় কি ? না হলে জীবন আর বৈচিত্র্যময় হবে কী করে বলুন !!!
বিঃদ্রঃ লেখাটা সত্যি হলেও গল্প কিংবা হয়তো প্রলাপ হাহাহাহাহাহা!