গোল একটা ফুলে ওঠা পেটে হাত রেখে নতুন মুখের আগমনে প্রতিটি বাবা-মারই আকাঙ্ক্ষা থাকে কখন বাচ্চাটা কথা বলবে,কখন ছোট্ট দাঁতের ফাঁকে মুচকি হাসবে,কখন একটা হোচট খেতে খেতে হাটতে শিখবে ।দীর্ঘদিন প্রতীক্ষার পর নতুন মেহমান এলে তার জন্য কত আয়োজন-দাদী -নানীর আদর আর গল্প বলা,ভাই -বোনের স্নেহ আর পরম মমতায় ঘেরা আত্মীয়দের মিস্টি মুখ।নাম রাখার জন্য এর কাছে ওর কাছে যাওয়া আর পৃ্থিবীর সবগুলো আদরে তুলতুল গাল ভরে উঠা।কিন্তু আমার জন্য তো কারো প্রতীক্ষা ছিল না! কেউ আমাকে স্বাগত জানায়নি! আমাকে পাবার জন্য দেখার জন্য কারো মনে তো একবারো আশা জাগেনি।জন্মের পর কেউ কোলেও তুলে নেয়নি বরং ঘৃ্ণায় ধিক্কার দিয়েছে।অনেকে অস্পৃ্শ্য মনে করেছে,করুনা করে কেউ ডাস্টবিনে ফেলে দিতেও বলেছে।কেন??
আমার কি তুলতুলে গাল ছিল না?আমি কি জন্মের পর মায়ের কোলে মুখ লুকাইনি?আমি কি পৃথিবীর আলোতে বন্ধ করা চোখ একবার মেলতে চাই নি?হয়ত চেয়েছি কিন্তু আমার চাওয়াটা ছিল অজন্মার অভিশপ্ত চাওয়া।
হ্যা বেজন্মা হিসেবেই কোন এক অকারনে সবার না চাওয়ার মধ্যেই পৃ্থিবীতে আশা।যে আগমনে মায়ের খুশী পরিণত হয় বিভীষিকাতে ,সমাজের সুশীলতা পায় বিষাক্ত ছোবল--সেই ছোবলই আমি।
শুনেছি আমার জন্মের ইতিহাস।খুব বনেদি ঘরের মেয়ে ছিলেন আমার মা।নানা ভাই আদর করে ময়না ডাকতেন মাকে ।খুব রূপবতী আর দুধের মত ফর্সা ছিলেন বলে ভাই ডাকতেন পরী বলে।দুই ভাই বোনের মধ্যে আমার মা ছিলেন ছোট ।তাই আদরটাও তার ছিল বেশী।মামা আর নানাভাই দেখে শুনে সুশিক্ষিত পাত্রের সাথে মার বিয়ে দিলেন।সুন্দর সাজানো গুছানো সংসার আর সংসার ঘেরা স্বপ্নেরা এঁকে বেঁকে জীবনটাকে তখন উপভোগ্য করে তুলেছে।এক বছর পর তাদের একটা ফুটফুটে ছেলে হল।সে আমার ভাই,তখন ওর দুবছর হবে হবে।দেশে যুদ্ধ লেগেছে ।মা 'রা পরিকল্পনা করল গ্রামের বাড়ি যাবে ঢাকা ছেড়ে দিয়ে। যুদ্ধ তখন সবে শুরু হয়েছে মাত্র।বুদ্ধিজীবিদের ধর পাকর চলছে।ঢাকা শহরে কারফিউ তারপরও যে যেখান থেকে পারছে পালিয়ে যাচ্ছে।এপ্রিলের ৩ তারিখ ছিল সেদিন ।আমাদের বাবুর জন্মদিন ।ছোট্ট বাবুর জন্য তার বাবা একটা খেলনা নিয়ে খেলছিল।আমার মা ছিলেন রান্না ঘরে।কিছুক্ষন পর বুটের শব্দে ভরে গেল সিড়ি ঘর।দরকায় কড়া পড়ল।নিভীক কলমধারী লোকটা বাবুকে কোলে নিয়ে দরজা খুলতে গেল।এক নিমিষেই একদল পাকসেনা পুরো ঘরটা ভরে ফেলল।লোকটাকে একটা কথাও বলতে দিল না। পেটে সজোরে একটা লাথ্থি দিয়ে ফেলে দিল। কোল থেকে পরে গেল বাবু ।বাবুর কান্নার শব্দে মা চলে এল।মাকে দেখে লোভাতুর চোখগুলো চকচক করে উঠল। মা এর তখন হুশ নেই ।মা বাবুকে কোলে তুলে নিলেন।বাবা তখন মাটিতে গোঙাচ্ছেন আর উঠতে চেষ্টা করছেন।উপর্যুপুরি বুটের লাথ্থি তখন তার উপর।একসময় বেয়নেট আর বাট এর পর বাট পরল।রক্তাক্ত অবস্থায় একটাই অনুরোধ করে যাচ্ছিলেন তিনি--আমাকে যা খুশি কর যত চাও মারো--মেরে ফেল কিন্তু ওদের কিছু করো না।
সেনা অফিসারের কথাটা খুব পছন্দ হল, সে আস্তে আস্তে লাজহীনতাকে সাদরে বরণ করে নিতে থাকলো।আমার মার দিকে ক্রমশ এগিয়ে গেল।বাবুকে বুকে ধরে মা তখন চিৎকার করছে বাবার কাছে বাঁচাও বাচাও বলে।অসহায় বাবাটা নিরুপায় হয়ে যতবার মাথা তুলতে চাইল ততবারি বেয়নেট আর বুটে ক্ষত বিক্ষত হল।চিৎকার করে সে বলে উঠল-- আমাকে মেরে ফেল।কিন্তু ওরা বাবাটাকে মারল না। আমাদের আদরের বাবুকে মা এর কোল থেকে নিয়ে ছিটকে ফেলল অফিসার দেয়ালে।আর বাবার সামনেই অফিসার কুড়ে কুড়ে শ্লীলতাহানী করল আমার জন্মদাত্রীর।পরে ব্রাশ ফায়ারে ঝাজরা হল বাবা নামক লোকটার শরীর আর মা কে ওরা ধরে নিয়ে গেল ক্যম্পে।মা এর উপর প্রতিদিন চলত হাড্ডির লোভে কুকুরের মত ঝাপিয়ে পড়া পশুগুলোর নির্যাতন।কখনো একজন কখনো দুজন আর কখনো ১৫ জনকেও মনোরন্জন করতে হট হতভাগ্যি জননীর।মরে পড়ে থাকা একটা লাশ হয়ে পরে থাকতেন ,ঝাপসা হয়ে উঠা চোখে দেখতে পেতেন তখনও চলছে পশুগুলোর উল্লাস।একসময় যাবতীয় চাহিদা পূরনের পর যখন মার বুকের সপন্দন ও না শুনার উপক্রম হল তখন মাকে ওরা ফেলে দিল রাস্তায়।ভাগ্যের কি কি নির্মম পরিহাস...আমার মা মরলেন না।বিধাতা বোধহয় আরো দুভার্গ্য লিখে রেখেছিলেন তার ললাটে।একারনেই যুদধ শেষ হতে না হতেই জন্ম নিলাম "আমি "--নাম পরিচয়হীন এক বেজন্মা।
মা আমাকে ফেলে দেননি ডাস্টবিনে,আমার মুখে হয়ত বাবুকে খুঁজার চেষ্টা করছিলেন।এক পাহাড় কলঙ্কের স্তুপ মাথায় নিয়ে আমাকে রেখেছেন। কি পরিচয়ে আমার??কে আমার বাবা???কেন দুনিয়ায় আসার জন্য কেন এত প্রবঞনা আর লান্ঞনা সহ্য করতে হয় আমার মাকে?আয়নাতে নিজের চেহারা দেখলে একটা পশুর মুখ কেন ভেসে উঠে??এর জবাব কেউ দেবেন? একবার ভেবে দেখুন আমার কষ্ট ।আমার তো কোন দোষ ছিল না ....আমিওতো চেয়েছিলাম আর সবকটা মেয়ের মত বেড়ে উঠতে ...আমিও বাঁচতে চাই সবার মত...।
আমার মায়ের নিশ্বাসের বাতাসে যে পতাকা আজ পত পত করে উড়ে তার কাছে এ প্রশ্ন গুলি বাতাসের সাথেই মিলিয়ে যায়....আর আমি বেঁচে থাকি বাংলাদেশের একটা জীবন্ত ইতিহাস হয়ে......