চারশত খ্রীষ্টাব্দের কোন এক সকাল। আলেক্সান্দ্রিয়ার রাস্তাগুলো সবেমাত্র জেগে উঠতে শুরু করেছে। কোলাহল জমে উঠছে। তেমনি কোন এক রাস্তায় হেটে যাওয়া পথচারীদের মাঝে হঠাৎ গুঞ্জন উঠেছে। তীব্র বেগে একটা ঘোড়ার গাড়ি ছুটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। সবার দৃষ্টি সেই গাড়ির দিকে। কারও দৃষ্টিতে শ্রদ্ধা, কারও চোখে বিস্ময় আবার কারও চোখেমুখে তাচ্ছিল্য আর বিদ্রুপ খেলা করে। কিন্তু ঘোড়সওয়ার এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। তার চারপাশে যেন অদৃশ্য এক দেওয়াল। সে দেওয়াল ভেদ করার সাধ্য কোন অনুসন্ধানী দৃষ্টির নেই! আলেক্সান্দ্রিয়ার রাস্তার একটা সাধারণ দৃশ্য এটি। কিন্তু তবুও পথচারীদের কাছে এই দৃশ্য কখনও পুরনো হয় না। কারণ ঘোড়সওয়ার যে একজন নারী! সবসময় মাথা নিচু করে চলা, সাজসজ্জা, আদর-আহলাদে ডুবে থাকা একটা সম্প্রদায়ের কেউ যখন উদ্ধতভাবে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যায় তখন না তাকিয়ে উপায় কি!
আলেক্সান্দ্রিয়ার সেই দুর্দান্ত ঘোড়সওয়ারী আর কেউ নয়, আমাদের অতি পরিচিত হাইপেসিয়া । অতি পরিচিত বললাম এই কারণে যে হলিউডি মুভি “Agora ”এর কারণে অনেকেই আমরা এই নামটার সাথে পরিচিত। যদিও মুভিটাতে বাস্তবতার চাইতে ফিকশনকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, তারপরও হাইপেসিয়ার জীবনের শেষ সময়টুকুকে বেশ ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে। কে এই হাইপেসিয়া? কী তার পরিচয়? সে এমনকি করেছে যে তাকে আমরা এত বছর পর এসে স্মরণ করছি !
এর উত্তর জানার জন্য আমাদেরকে দৃষ্টি দিতে হবে আজ থেকে বহু বছর আগে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীর্থভূমি আলেক্সান্দ্রিয়ার দিকে। সে বড় অস্থির সময়। আলেক্সান্দ্রিয়ার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়িতে শুধুই অস্থিরতা। ক্ষমতাসীন পাগান ধর্মের অনুসারীদের জন্য সাধারণে সমাদৃত খ্রীস্টান ধর্ম হুমকি হয়ে উঠছে। দুই ধর্মের অনুসারীদের মাঝে রক্তক্ষয়ী সংঘাত না হলেও জনমানুষের মনে উত্তেজনার পারদ দিনকে দিনকে দিন উপরে উঠছে। প্রতিদিনই সাধারণ খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের দ্বারা সম্ভ্রান্ত পাগানদের লাঞ্চিত হবার খবর আসছে। জনগণ তখন এক অর্থে দুই ভাগে বিভক্ত। এসব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে আছে, এমন লোক হয়তো তখন খুঁজলেও পাওয়া যেত না! অথচ সেই সময়েই হাইপেসিয়াকে দেখা যেত আপন জগতে ডুবে থাকতে। কখনও সে তাঁর ছাত্রদের পড়াচ্ছে, কখনও সে নিজের কক্ষে বইয়ের মাঝে ডুবে আছে, আবার কখনও তাকে দেখা যেত যুক্তিতর্কে লিপ্ত থাকতে তাঁর বাবার সাথে! ও হ্যা, তাঁর বাবাও একজন নামজাদা লোক, উনার নাম থিওন । এমন না যে, হাইপেসিয়া এই পাগান- খ্রিস্টান স্নায়ুযুদ্ধ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। তবে, তিনি নিজে গোড়া পাগান ধর্মে বিশ্বাসী হয়েও(যেটা মুভিতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে) এই ধরনের কোলাহলকে স্বজ্ঞানেই এড়িয়ে যেতেন এই জন্য যে, তাঁর ধারণা ছিল তিনি যদি কোন পক্ষের পক্ষে শুধু কথায়ই না, আকারে-ইঙ্গিতে কিছু বললেই তাঁর ছাত্রদের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি হবে। জ্ঞানচর্চার প্রতি ক্ষতিকারক এই ধরনের বিভাজন কিংবা এরকম যেকোন কিছু থেকেই উনি উনার ছাত্রদের দুরে রাখতেন। তাছাড়া সেসময়ে তাঁর বাবা এবং তাঁর নিজের যে শক্তিশালী সামাজিক অবস্থান ছিলো, সেটাও তাঁকে সরাসরি পক্ষাবলম্বন থেকে বিরত রেখেছিলো। শুধুমাত্র ছোট্ট এই ভুমিকা থেকেই হাইপেসিয়ার ধীশক্তি এবং তেজস্বিতার একটা ধারণা পাওয়া যায়।
এবার নজর দেওয়া যাক, বিজ্ঞানের ইতিহাসে হাইপেসিয়া কেন একটা উজ্জ্বল নাম সেদিকে। আজকের যুগে আমরা এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি তার মাঝে হাইপেসিয়ার আছে বিশাল অবদান। হাইপেসিয়ার আগে অনেক মনীষীই সুর্যের চারদিকে পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহের ঘূর্ণনের কথা বলে গিয়েছিলেন, কিন্তু তারা কেউ এর নিখুঁত গাণিতিক ব্যাখ্যা দিয়ে যেতে পারেননি। হাইপেসিয়াই প্রথম পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহের সূর্যের চারিদিকে পরিভ্রমণের একটা গাণিতিক ব্যাখ্যা দাড় করানোর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। এই কাজ করতে গিয়ে উনি জ্যামিতিতে নতুন এক বিভাগের জন্ম দিয়েছিলেন- যার নাম আমরা এখন দিয়েছি “The study of conics”। হাইপেসিয়ার বাবা থিওন ছিলেন একজন বিখ্যাত গণিতবিদ। তাঁর দ্বারা উৎসাহিত হয়েই সম্ভবত হাইপেসিয়ার ”জ্ঞানের জগতে এই গাণিতিক পরিভ্রমণ” সম্ভব হয়েছে। থিওনের কাজগুলো ছিলো মুলত arithmetic বা বীজগণিত নিয়ে। হাইপেসিয়া তাই বাবার পথ ধরে প্রথমে বীজগণিতের “number theory ” নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তীতে তাঁর অতি কৌতুহলী বিজ্ঞানী মনকে শান্ত করার জন্য “Movement of planetary bodies” এর দিকে সরে গিয়েছলেন। তবে হাইপেসিয়ার মুল কাজগুলোর অনেককিছুই আর এখনকার বিজ্ঞানীদের হাতে এসে পৌছেনি।
হাইপেসিয়া যে শুধু একজন বিজ্ঞানীই ছিলেন এমননা, বরং তাঁর সময়ের অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মত তিনিও একজন জন্মগত দার্শনিক ছিলেন। তিনি তাঁর ছাত্রদের প্ল্যাটো এবং প্লটিনাসের দর্শন শিক্ষা দিতেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, “দর্শন থেকেই বিজ্ঞানের উৎপত্তি”।তাঁর এই দার্শনিক তত্ত্বের আলাদা একটা নামও আছে “Neoplatonism ”। এবং বিজ্ঞানের সেই প্রাথমিক যুগ থেকে এখনকার এই আধুনিক যুগে এসেও তাঁর কথা প্রমাণ হয়েই যাচ্ছে। এমনকি এই ঊনবিংশ শতকের বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনও বিজ্ঞান আর দর্শনের সম্পর্ককে খুব সুন্দরভাবে তাঁর একটা উক্তিতে তুলে ধরে গিয়েছেন, “Imagination is greater than knowledge”। এবং Imaginationই হচ্ছে সকল দার্শনিক তত্ত্ব এবং সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ভিত্তি।
এখন শুধুমাত্র “Conic”নামে একটা সেকশনের ভিত্তি স্থাপন করার কারণেই কি হাইপেসিয়া এত বিখ্যাত একটা নাম? না ঘটনা একদমই তা নয়। হাইপেসিয়ার ইতিহাসের পাতায় একটা উজ্জ্বল নাম হওয়ার মুল কারণ আসলে দুটি-
১) হাইপেসিয়া একজন নারী,
২) হাইপেসিয়ার মৃত্যু এবং এটা নিয়ে ইতিহাসবিদ ও খ্রিস্টান ধর্মবেত্তাদের লুকোচুরি।
প্রথম পয়েন্টটা দিয়েই কিন্তু এই লেখাটা শুরু হয়েছে। তখনকার সময়ে একজন নারী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করছেন, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে বলিষ্ঠভাবে তাঁর মতামত প্রকাশ করছেন- এই দৃশ্য খুবই বিরল ছিলো। এমনকি এই লেখাটার পুরো অংশে সবসময় “হাইপেসিয়ার ‘ছাত্র’ ” কথাটা উঠে এসেছে, কারন আক্ষরিক অর্থেই সেই সময়ে “ছাত্রী” খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য কাজ ছিলো। মেয়েরা পড়বে বা শিখবে এই ধারণাটা সেই সময়ে এখনকার মত এত ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেনি।এত বাধা-বিপত্তি পার হয়ে নিজেকে সমাজের একজন গুরুত্ব পূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাটাই “হাইপেসিয়া” কে মনে রাখার জন্য যথেষ্ট। তারউপর তিনি ছিলেন গণিত নিয়ে কাজ করা প্রথম নারী !
নিচের ছবিতে Agora মুভিতে উপস্থাপিত রুপে হাইপেসিয়াকে দেখা যাচ্ছেঃ
এবার দ্বিতীয় পয়েন্টটার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। হাইপেসিয়া ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত নাম। তাঁর মৃত্যু ঘটনা নিয়ে সেই ৪০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এখন পর্যন্ত বিতর্ক হয়ে আসছে। অধিকাংশ ইতিহাসবিদদের বর্ণিত ইতিহাস থেকে যেটা জানা যায়, হাইপেসিয়ার মৃত্যু আলেক্সান্দ্রিয়ার রাস্তায় রাস্তায় চলা পাগান এবং খ্রিস্টানদের দ্বন্দ্বের ফসল। এবং সব লেখা পর্যালোচনা করে তাঁর মৃত্যু এবং তার পূর্ববর্তী ঘটনাকে সহজ সরল ভাষায় সাজালে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে-
পাগান আর সাধারণ খ্রিস্টানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তখন চরমে। একটা ঠান্ডা যুদ্ধ চলছিল তাদের মাঝে। তাদের এই যুদ্ধ যতটা না বুদ্ধিভিত্তিক কিংবা ধর্মীয়, তার চাইতে বেশী ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের। এর মাঝেই Cyril নামের একজন ক্রিসচিয়ান বিশপের উত্থান হয়। প্রথমে শুধু একজন সাধারণ বিশপ হিসেবে আলেক্সান্দ্রিয়ায় প্রবেশ করলেও পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাওয়ার চেস্টা করতে থাকে। তার পথের কাঁটা হিসেবে কাউকে পেলেই তাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তার চেস্টার কমতি ছিলনা, এমনকি তার বিপক্ষ একজন খ্রিস্টান হলেও। তখন রাজসভায় সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিটি ছিলেন Orestes , যে কিনা ছিলেন হাইপেসিয়ার প্রাক্তন ছাত্র। হাইপেসিয়ার প্রতি তার দুর্বলতা এবং সাথে সাথে Cyril এর প্রতি তার ঘৃণার কথা ছিল সর্বজনবিদিত। Cyril ও অনেকবার Orestes কে বাগে আনার চেস্টা করে ব্যর্থ হয় এবংশেষমেশ Orestes এর দুর্বল জায়গায় আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি নেয়। বলা চলে, তখনই হাইপেসিয়ার মৃত্যু ঘন্টা বেজে উঠে ! যদিও Cyril কে এইজন্য অনেক চাতুর্যের আশ্রয় নিতে হয়েছিলো (সেই সমাজে হাইপেসিয়ার প্রভাব ছিলো এমনই যে অনেক গোঁড়া খ্রিস্টানও হাইপেসিয়াকে চরম শ্রদ্ধা করত !) সে বিভিন্ন ধর্মীয় সমাবেশ কিংবা সভায় পরোক্ষভাবে হাইপেসিয়ার বদনাম করে বেড়াতে লাগল। নারী যেখানে ভোগের বস্তু (!), সেখানে তাদেরই একজন কি করে সমাজের উঁচু তলার মানুষদের পরামর্শদাতা হবে ? এছাড়াও Cyril হাইপেসিয়াকে “ডাইনি/ জাদুকর” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিলো। তার মতে হাইপেসিয়া একজন যাদুকর যে কিনা তার মোহময়ী কথাবার্তা আর সুরের জাদুতে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ পুরুষদের বশীভুত করে রাখছে! প্রথমে তার এমন দাবী পাত্তা না পেলেও, দিনের পর দিন চালিয়ে যাওয়া কুৎসা একসময় সত্য হিসেবেই আলেক্সান্দ্রিয়ায় প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। এরই ফলস্বরুপ একদিন হাইপেসিয়া রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একদল Parabalani (এদের ভুমিকা ছিলো অনেকটা খ্রীস্টান ক্রসেডারদের মত) তাঁকে আক্রমণ করে। আক্রমণের তোপে ঘটনাস্থলেই হাইপেসিয়ার মৃত্যু হয়। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, হাইপেসিয়াকে মেরে ফেলার পর বিবস্ত্র করে তাঁর লাশ টুকরো টুকরো করে আলেক্সান্দ্রিয়ার রাস্তায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। (এখানটায় “Agora” মুভিতে পুরোপুরি ফিকশনের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে)
হাইপেসিয়াকে নিয়ে বিতর্ক কিন্তু এই মৃত্যু সময় এবং মৃত্যুর কারণ নিয়েই ! অনেকদিন ধরেই খ্রিস্টান ধর্মবেত্তা কিংবা পোপের সংগী-সাথীরা এই হাইপেসিয়ার মৃত্যুজনিত মীথকে (আসলে সত্য ঘটনা) অতিরঞ্জিত বলেই প্রচার করে আসছিলো।এর কারণ সেই পুরনো ধর্ম বনাম বিজ্ঞান বিবাদ। একটা সময় গীর্জার নেতৃত্বে বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকেদের উপর যে অত্যাচার চালানো হয়েছিলো তা সর্বজনবিদিত হলেও পোপের পক্ষ থেকে সবসময়ই এধরনের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। একদম কাছাকাছি সময়, গত ঊনিশ শতকে এসে তারা ইতিহাসবিদদের কাছে হার মেনে নেয়। খ্রীস্টান যাজক বনাম বিজ্ঞানী- এই লড়াইয়ের কিছু চুম্বক অংশ নিয়েই ড্যান বয়েল তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস “দ্যা ভিঞ্ছি কোড” রচনা করে গেছেন।
হাইপেসিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত লিখতে গেলে শেষ করা যাবে না। শুধু আন্তর্জালেই হাইপেসিয়া সম্পর্কে অনেক ওয়েবসাইটে অনেক ভালো ভালো লেখা আছে। এছাড়াও এই পর্যন্ত অনেক বই লেখা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে অনেক গল্পকার তাদের গল্পে শক্তিমান কোন নারীর চরিত্র অংকন করতে গেলেই নামকরণের জন্য “হাইপেসিয়া”-র দ্বারস্থ হয়েছেন। এবং এখনও এই আধুনিক যুগে এসেও শিক্ষানুরাগী নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই অণুপ্রেরণাদায়ী একটা চরিত্র হিসেবে “হাইপেসিয়া” টিকে আছে।