মুম্বাইয়ের দিনলিপি: প্রতীক্ষানগর... (পর্বঃ এক)
সময়টা ২০১১ সালের জুনের শেষাশেষি...
আম্মাকে নিয়ে আমি উড়াল দিই ভারতের দিকে, সাথে সেজো মামা... MX টাইপ ভিসায় মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যখন পা রাখি তখন বেগুনি রঙা আকাশ নিয়ে ২৯ জুনের ভোর উপস্থিত। বাংলাদেশে থাকতেই ঠিক হয়, আম্মার চিকিৎসা মুম্বাইয়ের প্যারেলে অবস্থিত টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে করাবো। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে খোঁজ লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত এই টাটা মেমোরিয়ালকেই বাছাই করি। বাংলাদেশের অনেক চিকিৎসকও এই হাসপাতালটিকে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথের কাছাকাছি বলে আমাদের জানান। সেই হিসাবে আমি মনে মনে এক ঝকঝকে তকতকে হাসপাতাল কল্পনা করে নিই। কিন্তু...
হাসপাতালে পা পড়ার আগেই আমার ভুল ভেঙে যায়। মানুষে গিজগিজ করছে পুরো হাসপাতাল; বিশেষ করে OPD... বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে আম্মাকে ভর্তি করাই এবং বিশাল সিরিয়াল পরে আম্মাকে নিয়ে চিকিৎসকের সামনে হাজির হই... যেহেতু আমিই আম্মার রোগটা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানতাম, সেহেতু ডাক্তারকে আমিই সব ব্যাখ্যা করি... আর যেহেতু আমি হিন্দি (এবং উর্দু) একেবারেই পারি না, সেহেতু আমাকে সব ইংরেজিতেই বলতে হয়... এবং সেটা বলতে হয় অতি সতর্কতার সাথে। এমন এক ভিনদেশে আমার এক্সপেডিশন শুরু হয় যেখানে না পারি আমি তাদের মাতৃভাষা, না তারা আমারটা...
আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করি যে, ঝকঝকে তকতকে আসলে কিছু না; আসল জিনিস সেবার মানে। আর এটা এখানে বিশ্বমানের। সিরিয়ালের দীর্ঘায়ন আসলে কিছুই না, ওরা প্রত্যেক রোগীকে বেশ সময় নিয়ে দেখে। সাথে এটাও বুঝে গেলাম, এখানে আসা প্রত্যেক রোগী কোন না কোন ক্যান্সারে আক্রান্ত... এবং এটাও বুঝে গেলাম আরো কিছুদিন বাদে যে, আসলে এটা অনেকের জন্যেই শেষ ঠিকানা অথবা শেষ সময়ের পরিসীমা বেঁধে দেওয়ার জায়গা...
আম্মাকে যখন আউট প্যাশেন্ট থেকে ইন প্যাশেন্ট করলো তখন আবিস্কার করলাম আরেক জগত। একেকদিন একেক ওয়ার্ডের বিভিন্ন রকমের রোগী দেখতাম। কেউকে দেখতাম হাতে ধরা একটা বোতল নিয়ে আমারই সাথে লিফটে উঠতে যেই বোতলে সাথে সংযুক্ত নলটি মাথা কিংবা গলার ভিতর দিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে... আমি এই ধরণের রোগীদের থেকে বেশ দূরে থাকতাম, এমনকি পারলে লিফট থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে দোতলা থেকে দশ তলায় আম্মার কেবিনে যেতাম। কারণ, আমার মনে হত যে, কোন কারণে যদি আমার জন্যে ওর হাতে ধরা ঐ বোতলটায় টান লেগে যায় তো নলটা ভিতর থেকে ছিঁড়ে বের হয়ে আসবে। একবার এক ছোট্ট বাবুকে দেখেছিলাম যার পেটের ভিতর থেকে তরল কি যেন বের হয়ে আসছে আর সে ব্যথায় চিৎকার করে কাঁদছে। সেই বেলা আমি আর কিছু খেতে পারিনি।
কেমো দেওয়ার জন্যে আম্মার ডান হাতে যখন PICC বা PIC লাইন লাগানো হয় তার কিছুদিন পরে আমাকে ডেকে নেওয়া হয় হাতে ঐ ক্যাথেটারের উন্মুক্ত অংশ পরিস্কার করার ট্রেনিং দেওয়ার জন্যে... এখনো মনে আছে, জাস্ট একবার ভুল করে ডান হাত দিয়ে মাথা টাচ করায় আমাকে আবারো পাঁচ মিনিট সময় নিয়ে দুই হাত ভালোভাবে ধুতে হয়। বলা হয়েছিল যে, ক্যাথেটারের উন্মুক্ত অংশ যেন কিছুতেই Infected না হয়। Infection হলে হাতের চারপাশে সবুজ বা হলুদ রঙ ধারণ করবে। খুব সতর্কতার সাথে সেটা পরিস্কার করতাম। এখনও মনে আছে, ব্যান্ডেজ খুলে আম্মার হাতের ঐ জায়গা যখন পরিস্কার করতাম তখন মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে ভুলে যেতাম।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৩:১৪