কতগুলো প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি...
১/ আচ্ছা, আর কত প্রাণ গেলে কতিপয় 'মানুষ' একটুখানি হলেও সচেতন হবে?
২/ শতাধিক প্রাণের অকালপ্রয়াণ কি কেবলই ট্র্যাজেডি, নাকি কিছু অপরিকল্পিত কার্যকলাপের ফলে ঘটা এক পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড?
৩/ নিমতলী ট্র্যাজেডির চার বছর পরও কোথায় সেই প্রস্তাবিত কেমিক্যাল পল্লীর বাস্তবায়ন?
৪/ বেঁচে যাওয়া অগ্নিদগ্ধদের কি অবস্থা? কে নিচ্ছে তাদের খবর?
৫/ আর কত প্রাণ গেলে মানুষের প্রাণের দাম আরেকটু বাড়বে?
এভাবেই "আর কত প্রাণ গেলে"র চক্রে আবর্তিত হতে থাকবে আমাদের প্রশ্ন; কিন্তু বিবর্তনের দেখা আর পাওয়া যাবে না।
আজ ৩ জুন। নিমতলী ট্র্যাজেডির চার বছর পূরণ হল আজ। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ এক অগ্নিকান্ডে শতাধিক প্রাণের অকালপ্রয়াণের শোকাবহ দিন। নারী ও শিশুসহ মোট ১২৩ জনের মৃত্যু হয় এই বিভীষিকার তাণ্ডবে। কেউ মা-বাবাকে হারিয়ে এতিম, কেউবা স্বামীশোকে মুহ্যমান, কেউবা আজও প্রাণপ্রিয় সন্তানের ছবি আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন, কারো জীবন কাটছে কুঁচকে যাওয়া পোড়া চামড়ার অসহ্য যন্ত্রণায়। সবকিছুই আছে, জীবন পেয়েছে গতি, ফিরে এসেছে চাঞ্চল্য; কিন্তু ফিরে আসেনি কাছের সেই প্রিয়জন, নাড়িছেড়া প্রিয় ধন, বাড়ি থেকে বের হয়েই দেখা পাওয়া প্রতিবেশীগণ। সবই আছে কিন্তু সবাই নেই।
নিমতলীর নবাবকাটরার ৪৩/এ বাড়ির নিচের রাসায়নিক গুদাম থেকে ২০১০ সালের ৩ জুন ৮টা ৫৫ মিনিটে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত। পাঁচতলা এ বাড়িটির তৃতীয় তলার ভাড়াটের মেয়ে রুনার বিয়ের পান-চিনির অনুষ্ঠান উপলক্ষে নিচে রান্না হচ্ছিল। ধারণা করা হয়, রান্নার আগুনের উত্তাপে পাশেই গুদামে রাখা দাহ্য রাসায়নিক কোনোভাবে বিস্ফোরিত হয়। পলকে সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের সর্বত্র। কামানের গোলার মতো আগুনের কুণ্ডলী উড়ে গিয়ে পড়ছিল। সরু গলি দিয়ে যেন বয়ে যাচ্ছিল আগুনের স্রোত। ফলে না পারছিল গৃহবন্দী অসহায় মানুষ বেরিয়ে আসতে, না পারছিল ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স সেখানে পৌঁছাতে। ফলে নরক নেমে নিমতলীর কালো আকাশে। বিভীষিকার অমানিশা শেষে দেখা যায় লাশ আর লাশ। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লাশ। লাশ আছে ঘরে, বাইরে, দোকানে, সেলুনে, রাস্তার উপরে। পরদিন সকালের (৪ জুন) মুষলধারের বৃষ্টি কাদা, কয়লা আর অঙ্গার অস্থিমজ্জার সাথে মিলে তৈরি করে বেদনার ঘন কালো স্রোত।
নিমতলী ও আশেপাশের কয়েকটি এলাকায় এখন কোন রাসায়নিকের গুদাম নেই। কিন্তু লালবাগ, মিটফোর্ড, বাবুবাজার, সূত্রাপুর, কায়েতটুলী, আগা মসি লেন, আবদুল হাদী লেন, সুরিটোলা, সিক্কাটুলীসহ কিছু ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাসায়নিকের গুদাম, কারখানা- সবই আছে। (তথ্যসূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, ৩ জুন ২০১৪, পৃষ্ঠা ৩) তাহলে এখন এইসব অঞ্চল থেকে রাসায়নিক গুদাম সরানোর উপায়...? আরো কতগুলো নিমতলী ট্র্যাজেডি???!!! কবে বোধের উদয় হবে আমাদের!!!
কোথায় সেই কেমিক্যাল পল্লী?
শেষ হয় নিমতলী অগ্নিকান্ডের সব ভয়াবহতা। একই সাথে আরম্ভ হয় গতানুগতিক ভাবধারায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের তোড়জোড়। তদন্ত কমিটি হয়, রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়, আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থ অন্যত্র সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ইত্যাদি আরো অনেক কিছু করা হয়। কিন্তু আজ অবধি বাস্তবায়নের ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি প্রস্তাবিত কেমিক্যাল পল্লীর। এর ধারণাপত্র তৈরিতেই পার হয়ে গেছে চার চারটি বছর। প্রস্তাব করা হয়, পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম সরানো হবে কেরানীগঞ্জের সোনাকান্দা মৌজায় প্রায় বিশ একর জমির উপর ছয় তলাবিশিষ্ট ১৭টি ভবনে। এক হাজার ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটি শেষ করা হবে ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে। যে দেশের সিংহভাগ কাজে আঠারো মাসে বছর গণনা করতে হয়,সেখানে উল্লিখিত সময়ের ভিতর কাজ সম্পন্ন করার আশা নেহায়েতই এক দুরাশা বললে খুব একটা ভুল হবে না। (তথ্যসূত্রঃ দৈনিক সমকাল, দৈনিক প্রথম আলো)
তবে নিমতলী যেমন নিয়ে গেছে অনেক কিছু, তেমনি দিয়েও গেছে...
রুনা, রত্না ও আসমা। মা-বাবা আর স্বজন হারানো এই তিন কন্যা নতুন পরিচয়ে আজ সংসার করছে। তারা তিনজনই আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর ২০১০ সালের ৯ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গণভবনে এই তিনজনের বিয়ে দেন। তাদের স্বামীদের স্ব স্ব যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরিরও ব্যবস্থা করে দেন। চার বছরের পরিক্রমায় এই তিন কন্যা আজ কেবল স্ত্রী নয়, কারো কন্যা নয় বরং কিছু নাড়িছেঁড়া ধনের জননীও। মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে তার এই তিন কন্যার খোঁজখবর নেন, বিভিন্ন উৎসব, আনন্দে উপহার পাঠান। আর তাই শত বেদনা, কষ্ট, দুঃখ আর ঢিলেমি সত্ত্বেও মলিন মুখে ফুটে উঠতে চায় এক টুকরো আবেগমাখা আনন্দ। এই আনন্দ যেন শতকাল অমলিন থাকুক এই প্রার্থনাই করি সতত।
এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে...
বিষয়ঃ অগ্নি নির্বাপণ ও ইভাকুয়েশন
রানা প্লাজার দুঃসহ স্মৃতি বুকে নিয়ে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সে যাই কম্যুনিটি ভলান্টিয়ারের ট্রেনিং নিতে। আমি ছিলাম ৩৮৫তম ব্যাচের ছাত্র। সেখানে আমাদের ভূমিকম্প, ভবন বিধ্বস্ত ও অন্যান্য আরো অনেক বিষয়ের সাথে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে শেখানো হয় অগ্নি নির্বাপণ ও ইভাকুয়েশনের বিভিন্ন পদ্ধতি। এই শিক্ষা কেবল কাগজে-কলমে নয়, বরং হাতে-কলমে শেখানোর মাধ্যমে প্রত্যেকের অন্তরে গেঁথে দেওয়া হয়। অন্তত আমার মধ্যে গেঁথে গেছে এটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। আসুন, আপনাদের সাথে আমার শেখা সেইসব বিষয়গুলো একটু শেয়ার করি। আশা করি, খারাপ লাগবে না আমার কথা...
আগুন। মানব অগ্রযাত্রার মাপকাঠি। আবার মানব সভ্যতা ধ্বংসেরও মাপকাঠি। আমাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে আগুনের গুরুত্ব। হোক তা উপকারের অপরিসীমতায় কিংবা ধ্বংসের লীলাখেলায়। অধুনা সভ্যতা মানুষকে দিয়েছে গতি, ছুটে চলার নিরন্তর তাগিদ। আর এই ছুটে চলার মিশনেই মানুষ কখনো কখনো এমন কিছু ভুল করে যে তার ফলাফল নিদারুণ একমুখী দুঃখময়। আগে এমন ছিল যে কোথাও আগুন লাগলে তা সহজেই নিভিয়ে ফেলা যেতো। কিন্তু এখন তা অনেকটা দুর্লভ উদাহরণে পরিণত হয়েছে। উঠতি নগরায়ন আর ‘সর্বগ্রাসী’ শিল্পায়ন আমাদের জীবনকে মাঝে মাঝেই যে চরম বিপদে ফেলে দেয় তার একটা জ্বলজ্বলে উদাহরণ হতে পারে অগ্নিকান্ড। পুনর্বার চিন্তা করুন বিস্মৃত নিমতলী কিংবা তাজরীন গার্মেন্টসের অঙ্গার দেহগুলোর কথা। তাদের করুণ পরিণতির জন্য কিন্তু আগুন দায়ী ছিল না (!!!) ছিল কিছু মানুষের অবিমৃষ্য আচরণ। তাই বলে তো আর সেইসব ‘মানুষদের’ ধরে ধরে মেরে ফেলা কোন সমাধান হবে না; আমাদের উচিৎ হবে আগুন লাগার কারণগুলোকে জানা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলো মানা। আসুন জানি এবং মানি...
দাহ্যবস্তু (যেমন জ্বালানি) + অক্সিজেন + পরিমিত (Optimum) তাপ = আগুন। অর্থাৎ আগুন লাগার কালপ্রিট মূলত এই তিনজন। এই তিন বদমাশ একটা ত্রিভুজচক্রের দ্বারা আগুন তৈরি করে। এখন কোনভাবে যদি এই ত্রিভুজের কোন একটি বাহুকে সরিয়ে দেওয়া যায় তো আগুনের খেল খতম। আমাদের ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের নির্ভীক, অকুতোভয় অগ্নিযোদ্ধাগণ সর্বদা আগুন নেভানোর সময় প্রাণপণ চেষ্টা করেন এই তিনবাহুর যেকোনো একটিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। তিন প্রক্রিয়ায় এটা করা যায়।
১/ তাপকে প্রশমিত করার মাধ্যমেঃ একে বলা হয় শীতলীকরণ (Cooling) প্রক্রিয়া। সাধারণত পানি দিয়ে এটা করা হয়।
২/ দাহ্যবস্তু দূরীভূতকরণের দ্বারাঃ এটাকে বলা যায়, আগুনকে অভুক্ত (Starving) রাখার প্রক্রিয়া। বিভিন্ন জায়গায় গ্যাস লিক হয়ে যে আগুন লাগে সে সময় এই পদ্ধতিতে আগুন নির্বাপণ করা হয়। অর্থাৎ দাহ্যবস্তু তথা গ্যাসের উৎসকে সরিয়ে ফেলা।
৩/ অক্সিজেনকে সরিয়ে ফেলাঃ এই পদ্ধতিকে বলা হয় শ্বাসরোধী পদ্ধতি। অনেকে আবার একে ব্ল্যাঙ্কেটিং প্রসেসও বলে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে অক্সিজেনকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
অক্সিজেনের অভাবে আমাদের যা হয় আগুনেরও ঠিক তাই হয়। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে... কোথায় কোথায় যেতে পারে দেখি আপনারা আইডিয়া করতে পারেন কিনা। ঠিক ধরেছেন, রান্না করতে গেলে অনেক সময় হাঁড়ি বা পাতিলে আগুন ধরে যায়। তখন ভয় না পেয়ে কি করবেন, জানেন? নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে একটা ঢাকনি ঐটার উপর দিয়ে দেবেন। ব্যস, খেল খতম। আবার মনে করুন, একটা নির্দিষ্ট কক্ষে আগুন লেগেছে; এই আগুন আশেপাশে ছড়ানোর সম্ভাবনা আছে। তখন একেবারেই কোন উপায় না থাকলে যা করবেন, সেই ঘরের দরজা বা জানালা বন্ধ করে বেরিয়ে আসবেন। তবে এটা প্রথম পছন্দ না কিন্তু; মাথায় রাইখেন কি বললাম।
আগুন হল একটি অবিচ্ছিন্ন প্রজ্বলন প্রক্রিয়া যা অবিশ্রাম তাপ ও আলো প্রদান করে। কিন্তু কথা হচ্ছে, আগুন কত প্রকার?- এই প্রশ্ন শুনলে অনেকেই বলবেন এটা কেমন কথা! আগুন তো আগুনই। সব আগুনই তো ধ্বংসাত্মক। না, কথাটা পুরোপুরি ঠিক না কিন্তু। প্রাচীন মার্শাল আর্টে এমন এক আগুন ব্যবহার করা হয় যা দিয়ে যেকোনো ক্ষত, আঘাত কিংবা জখম ভালো করে ফেলা সম্ভব। রহস্যময় সেই আগুন ও তার ব্যবহারের প্রসঙ্গ থাক। আমি আমাদের প্রাসঙ্গিক আগুনের প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনায় আসি। দাহ্যবস্তুর বিভিন্নতার উপর আগুন মূলত চার প্রকার।
A শ্রেণীর আগুনঃ কঠিন পদার্থ থেকে সৃষ্ট আগুন। যেমন- কাঠ, বাঁশ, কাপড়, কাগজ, ইত্যাদি। এ ধরণের আগুনে জ্বলন শেষে কয়লা, অঙ্গার অবশেষ থাকে। এ শ্রেণীর আগুন নির্বাপণের জন্য পানি উত্তম। এখানে পানি দ্বারা তিন বাহুর মধ্যে তাপকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। এই অগ্নি নির্বাপণ পদ্ধতিকে বলা হয় কুলিং বা তাপ সীমিতকরণ।
B শ্রেণীর আগুনঃ তরল পদার্থ থেকে সৃষ্ট আগুন। যেমন- পেট্রোল, অকটেন, কেরোসিন, ইত্যাদি। এই ধরণের আগুন নেভানোর জন্য ফোম, কার্বনডাই অক্সাইড, ডি সি পি (ড্রাই কেমিক্যাল পাউডার), ইত্যাদি। এই ধরণের আগুনের ক্ষেত্রে কম্বল পদ্ধতিও প্রয়োগ করা যায়। অর্থাৎ কম্বল দিয়ে ভিক্টিমের শরীর জড়িয়ে ফেলা। এখানে মূলত অক্সিজেনকে ভ্যানিশ করে আগুনকে নিশ্চিহ্ন করা হয়ে থাকে। একে বলা হয় স্মুদারিং বা অক্সিজেন সীমিতকরণ।
C শ্রেণীর আগুনঃ গ্যাসীয় পদার্থের আগুন, যেমন- মিথেন, প্রোপেন, এল পি গ্যাস, ইত্যাদি। আমাদের বাসাবাড়িতে এই ধরণের আগুন সবচেয়ে বেশি লাগে। ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিটের থেকে যে আগুন লাগে সেটা এই শ্রেণীর। নির্বাপণের মাধ্যম হিসেবে কার্বনডাই অক্সাইড, ডি সি পি কিংবা পানি সর্বোত্তম।
D শ্রেণীর আগুনঃ অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম কিংবা কপারের মতো মেটাল বা ধাতব পদার্থ থেকে সৃষ্ট আগুন। এই প্রকার আগুন নির্বাপণের জন্য ডি সি পি, বালু, শুস্ক মাটি, চুনাপাথর কিংবা সোডা অ্যাশ ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখা জরুরী, খুবই জরুরী যে এই ধরণের আগুন নির্বাপণের জন্যে পানি উল্টো বিপদ ডেকে আনে। কারণ অতিরিক্ত তাপে পানি বিশ্লিষ্ট হয়ে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে পরিণত হয়। আর আমরা সবাই জানি যে, অক্সিজেন নিজে জ্বলে না ঠিকই কিন্তু অন্যকে জ্বালায়; অন্যদিকে হাইড্রোজেন বেচারা নিজেই জ্বলে। এখন চিন্তা করে দেখুন পানি ব্যবহার করলে কি হবে। স্রেফ পানি বিভাজিত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটাবে।
এছাড়া "মূলত" প্রকারের বাইরেও আরেকটা প্রকার আছে। সেটা হল K শ্রেণীর আগুন। এটি মূলত রান্নাঘরকেন্দ্রিক আগুন। রান্না করতে গিয়ে যে আগুন লাগে সেটাকে এই ক্লাসে রাখা হয়।
অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্রঃ যাকে আমরা অনেক সময় ফায়ার এক্সটিংগুইসারও বলে থাকি। আগুন নেভানোর জন্য চার ধরণের এক্সটিংগুইসার পাওয়া যায়।
ওয়াটার টাইপঃ এটির কালার লাল হয়ে থাকে।
ফোম টাইপঃ এটির কালার কমলা বা হলুদ রঙের হয়ে থাকে।
গ্যাস টাইপঃ এটির কালার হয় কালোরঙা। এখানে মূলত কার্বনডাই অক্সাইড থাকে নির্বাপক হিসেবে। দামি বস্তু যেমন কম্পিউটার, জুয়েলারি কিংবা দামি ক্যামেরায় আগুন লাগলে কার্বনডাই অক্সাইড নির্বাপক হিসেবে ব্যবহার করা উচিৎ। এমনকি ডাইনিং টেবিলে কোনোভাবে আগুন লেগে গেলো; তখনও কিন্তু এই কার্বনডাই অক্সাইডই ব্যবহার করা উচিৎ। যুক্তি হিসেবে বলা যায় যে, এখানে অন্য কিছু যেমন পানি, ফোম কিংবা ডি সি পি ব্যবহার করলে আগুন নিভবে ঠিকই কিন্তু শখের ক্যামেরাটি নষ্টও হয়ে যাবে। আর মেটালে তো পানি দেওয়া যাবেই না।
পাউডার টাইপঃ এটির কালার নীলরঙা। এখানে নির্বাপক হিসেবে ডি সি পি থাকে। কিন্তু এই ডি সি পিটা কি আসলে? এটি সোডিয়াম বাইকার্বনেট, পটাশিয়াম বাইকার্বনেট কিংবা অ্যামোনিয়াম ফসফেট। পাইডারটি বিদ্যুৎ অপরিবাহী এবং মোটামুটি সব ধরণের আগুন নির্বাপণে ব্যবহার করা যায়। এই জন্য একে মাল্টিপারপাস ফায়ার এক্সটিংগুইসার বলা হয়ে থাকে।
ওহ, একটা কথা বলতে তো ভুলেই গেলাম। একমাত্র ফোম এক্সটিংগুইসারের ক্ষেত্রেই স্থির রেখে কাজ করতে হয়। অন্যগুলো ব্যবহারের সময় অনুভূমিকভাবে (Side by side or horizontally) ব্যবহার করতে হয়। এছাড়া আরও কিছু সতর্কতা না বললেই নয়। এই যেমন
সবসময় বাতাসের অনুকূলে ব্যবহার করা;
যথাসম্ভব আগুনের কাছাকাছি থেকে ব্যবহার করা, এক্ষেত্রে ভালো হয় আস্তে আস্তে আগুনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। তবে অবশ্যই একটা কথা মনে রাখতে হবে- নিরাপদ দূরত্বে থেকে;
ড্রাই কেমিক্যাল পাউডারের ক্ষেত্রে একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যাতে শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে এটি ঢুকে না যায়;
সরাসরি মানুষের শরীরে ব্যবহার না করা, ইত্যাদি।
এখন সবার কাছে তো আর ফায়ার এক্সটিংগুইসার নেই। আমরা দামি ঝাড়বাতি কিনে ঘর আলোকিত করি, মেঝে টাইলস করে তাতে পিছল খেয়ে কোমর ভেঙেও আমরা দিলখুশ, আলীবাবা ডোর কিনে এমন নিরাপত্তা বানাই যে চোর তো ঢুকতে পারেই না, আমরাও মাঝে মাঝে ঢুকতে পারি না। কিন্তু ফায়ার এক্সটিংগুইসার? এর কি কোন দরকার আছে আদৌ! যারা এমনটা ভেবে এই 'দামি' যন্ত্রটি কেনেন নি তাদের তরে-
যদি পরনের কাপড়ে আগুন লাগে তো ভুলেও দৌড় দেবেন না। এতে আগুন আরো বাড়বে। তার বদলে থামুন, শুয়ে পড়ুন এবং গড়াতে থাকুন। অর্থাৎ থেমে যান, মাটিতে শুয়ে পড়ুন, দুই হাত দিয়ে মুখতা ঢেকে সামনে পেছনে গড়াগড়ি করতে থাকুন যতক্ষণ পর্যন্ত না আগুন নিভে না যায়। মুখ ঢাকার কারণ কিন্তু মুখকে আগুনের হলকা থেকে বাঁচানোর জন্য যে শুধু তা কিন্তু নয়। আগুন যেন কোনোভাবে নাক বা মুখ দিয়ে শ্বাসনালীতে যেতে না পারে। মনে রাখবেন, আগুনে অন্যসব অঙ্গ পুড়ে গেলেও বেঁচে থাকা সম্ভব কিন্তু শ্বাসনালী হলে... খুব কঠিন... বাঁচিয়ে রাখাটা।
ভবন কিংবা কক্ষ যদি ধোঁয়ায় ভরে যায় তো নাকে মুখে একটা কাপড় চেপে ধরুন। এসময় যতটা সম্ভব নিচু হয়ে বের হবার চেষ্টা করুন। হাত ও পায়ের উপর হামাগুড়ি দিয়ে ধিরস্থিরভাবে বের হয়ে আসুন। মনে রাখবেন, মেঝে থেকে ৩০-৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত ধোঁয়া থাকে না।
সিঁড়িতে আগুন লাগলে ভুলেও দরজা খুলে বের হতে যাবেন না। সিঁড়িতে লাগা আগুন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে
উলম্বভাবে উপরে উঠতে থাকে আর উঠার সময় প্রত্যেক দরজায় কমবেশি আঘাত করে যায়। এখন সে যদি কোনোভাবে কোন দরজা খোলা পায় তো কেল্লাফতে। তাই উপদেশ হিসেবে দরজা বন্ধ রাখুন এবং শান্ত থাকুন।
এখন কথা হচ্ছে- আপনার ঘরের দরজা বন্ধ আছে। কিন্তু আপনার আশেপাশে কোথাও আগুন লেগেছে তখন কি করবেন? যদি দেখেন দরজা এবং দরজার হাতল গরম তো বুঝবেন আগুন খুব কাছে। তখন ভুলেও দরজা খুলতে যাবেন না। এসময় যা করনীয় তা হল- ডাক্ট টেপ, ভেজা তোয়ালে বা কাপড় দিয়ে দরজা কিংবা তার আশেপাশের সব ফাঁকফোকর ও বাতাসের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া। পারলে জানালার বাইরে কোন উজ্জ্বল কাপড় ঝুলিয়ে দিন যা দেখে অগ্নি নির্বাপণকারীরা আপনাকে সনাক্ত করতে পারবেন। আর যদি দেখেন দরজার হাতল ঠাণ্ডা তো বুঝতে হবে আগুন কাছাকাছি নেই। তখন আতংকিত না হয়ে সাবধানে বেরিয়ে আসুন।
এখন মনে করুন রান্নাঘরে তেল বা গ্রিজ থেকে আগুন লেগে গেলো। কি করবেন? আগুনের উপর বেকিং সোডা বা লবণ ঢেলে দেবেন। আর রান্না করার সময় কড়াইতে আগুন লাগলে? দ্রুত ঢাকনি দিয়ে ঢেকে দেবেন। স্মুদারিং বা অক্সিজেন সীমিতকরণের বেসিক। জ্বলতে থাকা কড়াইতে কোনোভাবেই পানি ঢালবেন না কিংবা ফায়ার এক্সটিংগুইসার ব্যবহার করবেন না।
বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে একটা কথা। জানি বিপদের সময় এই কথা কেউ মনে রাখবে না। তাও বলি। ধরি, দশতলা বিশিষ্ট একটা বিল্ডিঙের সপ্তম তলায় (6th floor) আগুন লেগেছে। এখন বিভিন্ন তলা বা ফ্লোর থেকে মানুষ বেরিয়ে আসার ক্রমধারা হল এরকম- সবার আগে সপ্তম তলার মানুষজন। তারপর আট> নয়> দশ। এরপর ছয়> পাঁচ> চার> তিন এবং সবশেষে দ্বিতীয় ও প্রথম তলার মানুষজন। কিন্তু আমরা কি করি? থাক আর বললাম না সে কথা। কারণ, বলে লাভ নাই।
এখন আরেকটা ক্রমধারার কথা বলি। এটা সবার মানা উচিৎ। যেকোনো বিবেকবান মানুষই এটা মানতে চাইবে। দ্রুত নির্গমনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারঃ
গর্ভবতী মা ও শিশু> বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তি> প্রতিবন্ধী ব্যক্তি> মহিলা> পুরুষ।
শেষতক সবার উদ্দেশ্যে একটা কথা, একটা অনুরোধ। আমরা একটু সচেতন হই। একটু সচেতনতা আমাদের জীবনকে অনেক নিরাপদ করতে পারে। আমার এই গতানুগতিক কথা হয়তো অনেকের কাছে একঘেয়ে লাগতে পারে। তাও বললাম। কারণ এটা আমার দায়িত্ব। কারণ এখন আমি ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের একজন স্বেচ্ছাসেবক। আগে যেকোনো দুর্যোগ, বিপদ আর ঘনঘটায় এগিয়ে যাওয়াটা ছিল ঐচ্ছিক; এখন তা হয়ে গেছে বাধ্যতামূলক। আল্লাহ্র কাছে আমার একটাই ফরিয়াদ যেন আমি আমার অর্জিত তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক জ্ঞানের দ্বারা জীব ও জড় উভয়েরই উপকার করতে পারি। আর সবার কাছে আমার চাওয়া- আপনারা সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন যাতে কোনদিনই যেন আমাকে আমার অর্জিত শিক্ষা কোথাও কাজে লাগাতে না হয়। আর যদি হয়ই তাহলে যেন আমি আমার সর্বোত্তম চেষ্টাটা করতে পারি। জীবনবাজি রাখার বিষয়টা না হয় নাই বললাম।
ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের প্রয়োজনীয় নাম্বার
ফোনঃ ৯৫৫৫৫৫৫
শর্ট কোডঃ ১০২, ১৯৯
মুঠোফোন নাম্বারঃ ০১৭৩০ ৩৩৬৬৯৯
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ওয়েবসাইট
ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের আরো কিছু প্রয়োজনীয় নাম্বার
অনেকের কাছে অজানা এরকম একটা তথ্য আপনাদের সাথে শেয়ার করি। ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের এক অফিসার আমাকে এই তথ্যটি দিয়েছিলেন। যেকোনো সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স খবর পাওয়ার উইদিন থার্টি সেকেন্ডসে গাড়ি নিয়ে ফায়ার স্টেশন ছাড়ে। এখন প্রশ্ন হল, তাহলে ঘটনাস্থলে আসতে এতো দেরি হয় কেন? উত্তর সোজা... কৌতূহলী জনতা, যানজট, চিকনা রাস্তা, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
-----
ভূমিকম্পঃ রেড অ্যালার্ট ফর মাই মাদারল্যান্ড, বাংলাদেশ
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৪ দুপুর ১:৫৯