৩ ডিসেম্বর, ১৯৮৪ সাল। নর্মদা নদীবিধৌত একরাতের ভুপাল। শীতের কুয়াশায় আচ্ছন্ন ঘনবসতিপূর্ণ এক নির্জন জনপদ। দিনান্তের ব্যস্ততার শেষে ক্লান্ত নগরীর বাসিন্দারা গভীর নিদ্রায় মগ্ন। রাতের রহস্যময় শান্ত অবকাশ যে সেদিন মৃত্যুসকাশে করুণ অধ্যায় রচনা করবে তা ভাগ্যবিধাতার অমোঘ বিধানে লিখা ছিল হয়তো। তা না হলে ঘুম থেকে অসময়ের জাগরণ কেন চিরঘুমের দেশে যাত্রা করবে! কেনই বা শত সহস্র আত্মার ভাগ্যাকাশে এক বিভীষিকাময় করাল রাত অপেক্ষা করবে! বিংশ শতাব্দী যেসব তিক্ত, বেদনাবিধুর ঘটনায় তার ইতিহাসের পাতা ‘অলংকৃত’ তথা কলঙ্কিত করেছে মধ্যপ্রদেশের ভুপাল গ্যাস ট্র্যাজেডি তার মধ্যে অন্যতম হবার অন্যতম দাবিদার। সস্তা প্রাণের আবাসভূমি এই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঘটনাটি যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছিল এবং কিছুদিনের মধ্যে গতানুগতিক ধারায় মিলিয়েও গিয়েছিল দানবিকতার পৈশাচিক নিষ্পেষণে। আসুন, ইতিহাসের কবর থেকে আবার তুলে আনি আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই অশুভ রাতের লোমহর্ষক কাহিনীকে।
ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভুপাল। বিন্ধ্য ভূধরের পাদদেশে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থিত ভারতের এই ১৬তম জনাকীর্ণ নগরীকে বলা হয় লেকের শহর (City of Lakes)। এক সুবিস্তৃত মালভূমির উপর দাঁড়িয়ে আছে সহস্র বছরের পুরাতন এই নগরী। লোককাহিনী মতে, ধারানগর হতে আগত পারমার রাজবংশীয় নৃপতি ভুজা এই নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। ভুজার নামানুসারে এটি প্রথমে পরিচিত ছিল ভুজপাল হিসেবে। পরে একসময়ে কালের বিবর্তনে তা হয়ে যায় ভুপাল। এটি অবশ্য লোককাহিনীর মত। কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এর স্বপক্ষে পাওয়া যায়নি, তবে ভুপাল থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে রাজা ভুজা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি মন্দির আছে যা ভুজেশ্বর মন্দির নামে পরিচিত। এছাড়া আরেকটি মত এমন যে, এই প্রাচীন নগরীর নামাঙ্করণ হয়েছে এক স্থানীয় রাজার নামে যার নাম ছিল ভুপাল। এ তো গেলো প্রাচীনের ইতিহাস। অর্বাচীন তথা আধুনিক ভুপালের প্রতিষ্ঠাতা কিন্তু একজন মুসলিম। নাম তার দাস্ত মোহাম্মদ খান। তিনি ছিলেন মুঘল সেনাবাহিনীর আফগান যোদ্ধা। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তিনি রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল মলওয়া অঞ্চলে ভাড়াতে সৈনিক (মার্সেনারী) হিসেবে কাজ করতেন। এরকমই এক সময়ে ১৭০৯ সালে তিনি বেরাসিয়া এস্টেটটি লীজ নেন এবং এর সাথে আরো কতগুলো এলাকা যুক্ত করে প্রতিষ্ঠা করেন আজকের এই তিলোত্তমা ভুপাল নগরীকে। ভুপালের ইতিহাসের পাতা এখানেই শেষ নয়। কিন্তু তার বিশদ বর্ণনা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক। বরং ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শীর ন্যায় ঘুরে আসি ত্রিশ বছর আগের ঘুমে আচ্ছন্ন এক জনবহুল নগরীতে যেখানে রাতের আঁধারে ‘হত্যা’ করা হয়েছিল সহস্র নিরীহ অধিবাসীকে।
৩ ডিসেম্বর (কোথাও কোথাও ২ ডিসেম্বরের কথা উল্লেখ আছে, কারণ মূল ঘটনার সূত্রপাত এই তারিখেই) মধ্যরাতের কিছু আগে ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডের কীটনাশক প্ল্যান্ট থেকে লিক হয়ে যায় ৪০ টনেরও বেশী (এনসিবিআই ও গ্রিনপিসের তথ্যমতে) বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস যা রচনা করে ভারতের ইতিহাসে এ যাবতকালের সবচেয়ে মারাত্মক ও হৃদয়বিদারক শিল্প দুর্ঘটনা। সরকারের ‘ধামাধরা’ রিপোর্টে পাঁচ হাজার মানুষের মৃত্যুর কথা বলা হয়। কিন্ত বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন গ্রিনপিসের মতে, প্রায় বিশ হাজারের কাছাকাছি মানুষ মারা যায় এই দুর্ঘটনায়। প্রায় তিন হাজার মানুষ মারা যায় সেই রাতের আদিভাগেই যাদের আর আগামীকালের নতুন সূর্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ভোরের আলো যখন রাতের কৃষ্ণকালকে ছাপিয়ে আগত, ততক্ষণে আট হাজার নিরীহ প্রাণ গত। নয় লক্ষ অধিবাসীর ভুপালে আক্রান্ত হয় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ যার প্রায় দুই লক্ষই ছোট্ট ছোট্ট শিশু। যারা মরে গেছে তারা এক অর্থে বেঁচে গেছে আর যারা এই বিভীষিকাকে সঙ্গী করে বেঁচে আছে তারা সতত মৃত্যু কামনায় রত থাকে সৃষ্টিকর্তার সমীপে। আজও ভুপালের পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায় হতভাগ্য অন্ধ মানুষ, দেখা দেয় নিদারুণ শ্বাসকষ্ট, মায়ের জঠর থেকেই ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেয় অনেক শিশু, ক্যান্সারের মরণ যন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে অসহায়েরা। জ্বর, র্যাশ, মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, ক্ষুধামন্দা, পেটের প্রদাহ এইসব যেন আলো, বাতাস আর পানির মতোই ভুপালবাসীদের নিত্যসঙ্গী। ইতিহাসের সেই অমানিশা আজও সেখানকার বাসিন্দাদের অবদাত জীবনের পথে অন্তরায়।
কি ঘটেছিল সেই রাতে?
বিভিন্ন ওয়েবসাইটে দেওয়া গ্রহণযোগ্য তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে যা জানা যায় তা হল এই ঘটনার সূত্রপাত ঘটে ২ ডিসেম্বরের একেবারে শেষভাগে; রাত এগারোটার মতো বাজে তখন। ভুপালের এক মিলিয়ন অধিবাসী সেদিনের সাপ্তাহিক ছুটির দিনটি কাটিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। একে তো শীতের রাত তার উপর পরদিন থেকে নতুন কর্মসপ্তাহ শুরু হবে। তাই কেউ প্রস্তুত হচ্ছে ভালোভাবে ঘুমাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে, কেউবা প্রস্তুত করছে আগামীকালের যন্ত্র-সামগ্রীগুলোকে। ঠিক তখনই একটা লিক ধরা পড়ে ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডের একটি কীটনাশক প্ল্যান্টে (ট্যাঙ্ক ই৬১০) যেখানে রাখা ছিল কীটনাশক কার্বারাইলের মুল উপাদান মিথাইল আইসোসায়ানেট। লিক হয়ে যাওয়ার কারণে পানি ঢুকে পড়ে সেই কীটনাশক প্ল্যান্টে। আর এটাই চূড়ান্ত বিপর্যয় ডেকে আনে। মিথাইল আইসোসায়ানেট পানির সাথে বিক্রিয়া করে প্রচুর তাপ (প্রতি গ্রামে ৩২৫ ক্যালরির মতো!) উৎপন্ন করে। যদি কার্যকরীভাবে এই পানিকে দূর করা না যায় তখন বিক্রিয়ার হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় এবং মিথাইল আইসোসায়ানেট ফুটতে শুরু করে। পরিণামে তৈরি হয় বিশাল পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড। এরপরে কি হবে সেটা কি আর ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ রাখে? কিন্তু প্রশ্ন হল প্ল্যান্টে পানিই বা ঢুকল কিভাবে? একটি সুত্র এইরকম বলে যে, এই প্ল্যান্টটি পরিষ্কার করার সময় সেখানে দুর্ঘটনাবশত পানি ঢুকে যায়। ফলে যা হওয়ার তা একটু আগেই বলেছি। আর এখন যেটা বলবো তা হল- পানি ঢোকার কারণে বিক্রিয়ায় সৃষ্ট তাপে হতোদ্যম হয়ে পড়ে কারখানার লোকেরা। তারা তাপ কমাতে প্ল্যান্টের গায়ে আরো পানি ছুঁড়ে মারে। কিন্তু ফল হয় উল্টো। পরিস্থিতি চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
সকাল সোয়া বারোটা। ডিসেম্বরের নতুন আরেকটি দিন। ঘড়ির নীরস টিক টিক কাটা বলে এটা সকাল কিন্তু প্রকৃতির অভিধানে এটি নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের নিস্তব্ধ প্রহর। এমনই সময়ে দক্ষিণপূর্ব দিক থেকে জনপদের দিকে ধেয়ে আসতে থাকে প্রাণসংহারী বিষাক্ত গ্যাস। লিক হয়ে ছড়িয়ে পড়ার সময় বিপদ ঘণ্টা বাজানো হয়েছিলো; কিন্তু মানুষ যাতে আতংকিত না হয়ে ওঠে সেজন্য কিছুক্ষণ পরেই তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে ঘুমে আচ্ছন্ন ভুপালবাসীরা বিনা সতর্কতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। একযোগে তারা জেগে ওঠে কারো কাশির শব্দে, ঠিকমতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পারার অজানা কষ্টে। ঘরময় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। ছোট ছোট বাবুরা সমানে কাশছে, অসহ্য যন্ত্রণায় মনে হচ্ছে যেন চোখ আর গলা পুড়ে যাচ্ছে, কে যেন তাদের গলা চেপে ধরে রেখেছে। কেউবা পেট চেপে ধরে বসে পড়ছে। চারিদিকে এক হুলস্থূল কাণ্ড। আতঙ্কিত মানুষজন ঘর ছেড়ে বাইরে বের হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। কেউ কেউ পারছে, আর কেউবা চৌকাঠ অবধি যেতে না যেতেই লুটিয়ে পড়ছে মেঝেতে। ঘুম থেকে অসময়ে জেগে চলে যাচ্ছে তারা চিরঘুমের দেশে। অন্যদিকে যারা একটু কঠিন প্রাণ তারা কড়িকাঠ মাড়িয়ে বাইরে আসে। কিন্তু সেখানের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। সারা শহর ধোঁয়ার আচ্ছন্ন। নিঃশ্বাস নেওয়ার এতটুকু অক্সিজেন নেই বাতাসে। বরং তার বদলে যা আছে সেটা টেনে নেওয়ার সাথে সাথে তা পুড়িয়ে দিচ্ছে শ্বাসনালিকা, ফুসফুসে জমতে শুরু করেছে পানি। ধারণা করা হয় এখানে কেবল মিথাইল আইসোসায়ানেটই ছিল না, ছিল ফসজিন, হাইড্রোজেন সায়ানাইড, কার্বন মনোক্সাইড, মনোমিথাইল অ্যামিনের মতো ভারবাহী বিষাক্ত পদার্থও। ভারী হওয়ার কারণে এগুলো মাটির খুব কাছাকাছি ছিল। ফলে যাদের উচ্চতা তুলনামূলক কম তারা বেশী আক্রান্ত হয়েছিল। এ কারণেই ছোট ছোট নিষ্পাপ শিশুরা মৃত্যুর কোলে আগে আগে, অতি দ্রুত ঢোলে পড়ছিল। প্রতিবারের নিঃশ্বাস চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়িয়ে যাচ্ছিল যন্ত্রণার মাত্রা। দম ফুরিয়ে অবসন্ন মানুষ নেতিয়ে পড়ার সাথে সাথেই তারই আতঙ্কগ্রস্ত প্রতিবেশীর পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছিল। একটু অক্সিজেনের খোঁজে হন্যে হয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে সবাই। কিন্তু না। কোথাও নেই সেই অবচেতন মনের মূল্যহীন অক্সিজেন। সহ্যক্ষমতা শেষ হয়ে গেলেই কঠিন অ্যাসফাল্টের উপর মুখ থুবড়ে পড়ছে একজন একজন করে একটু আগেই লাশ হয়ে যাওয়া অন্যজনের উপর। এ যেন জীবন্ত ডমিনোস ইফেক্ট যেখানে পাশাপাশি রাখা ব্লকগুলো একের পর এক পড়ে যায় তার পূর্ববর্তী ব্লকের ধাক্কায়। রাত আরো গভীর হয়। ভুপালের বাড়ি, দোরগোড়া, রাস্তা, বিছানা, হাসপাতাল লাশের স্তূপে পরিণত হয়। প্রাণচঞ্চল জীবননগরী পরিণত হয় প্রাণহীন মৃত্যুনগরীতে। বিন্ধ্য মালভূমির ভুপাল হয়ে ওঠে এক মৃত্যু উপত্যকা, তার বন্ধুরতা তৈরি হয় আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশের স্তূপে।
কে এই মিথাইল আইসোসায়ানেট?
রসায়ন বলে, এটি এক ধরণের জৈবযৌগ। বর্ণহীন, তীব্র গন্ধযুক্ত টিয়ারিং এজেন্ট, দাহ্য তরল। পানির সাথে গলায় গলায় দোস্তি তার। আর এর গলনাঙ্ক কক্ষ তাপমাত্রার চেয়ে কিছুটা বেশী। এটি প্রস্তুত করা হয় মনোমিথাইল অ্যামিন আর বিষাক্ত ফসজিন গ্যাসের সমন্বয়ে। মূলত এই মিথাইল আইসোসায়ানেট বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হয় কীটনাশক কার্বারাইল প্রস্তুতিতে। এছাড়াও রাবার ও আঠা শিল্পে এর প্রয়োগ ব্যাপকভিত্তিক। মিথাইল আইসোসায়ানেট কতটা বিষাক্ত থাবা নিয়ে সেই রাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জানতে চান? আমেরিকার অকুপেশনাল সেফটি এন্ড হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের দেওয়া আদর্শমতে, একটি আট কর্মঘণ্টার কারখানায় মিথাইল আইসোসায়ানেটের সেইফ ভ্যালু ০.০২ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন)। ০.৪ পিপিএমের এক্সপোজারই যেখানে কফ, বুকে ব্যথা, অ্যাসমা, স্কিন ড্যামেজসহ চোখ, নাক আর গলা জ্বালাপোড়ার কারণ হতে পারে সেখানে ভুপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির মিথাইল আইসোসায়ানেটের পিপিএম কত হয়েছিল একটু আন্দাজ করতে পারেন? ২৭ পিপিএম!!!!! যা সেফটি ষ্ট্যাণ্ডার্ডের (০.০২ পিপিএম) চেয়ে প্রায় ১,৪০০ গুণ বেশী ছিল। ভুপালের আট কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই মাত্রার শক্তি নিয়ে সেই রাতে ও তার পরবর্তীতে তাণ্ডবলীলা চালায় মিথাইল আইসোসায়ানেট।
বিভীষিকার অমানিশা শেষ হয় একসময়। প্রতিদিনের রাঙা সূর্য্যিমামা নতুন ভোর নিয়ে আসে ভুপালের আকাশে। কিন্তু সেই উষ্ণ আলোর পরশ পাওয়ার সৌভাগ্যও হয় না কোনোরকমে বেঁচে থাকা দুর্ভাগা মানুষদের কপালে। বিশাল এলাকা আচ্ছন্ন হয়ে থাকে মিথাইল আইসোসায়ানেটের বিষাক্ত ধোঁয়ায়। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে আছে মানুষের নিথর লাশ; গণমৃত্যুর এই মিছিলে আছে গৃহপালিত পশুপাখিও। ততক্ষণে শুধু ভারত না, সারা বিশ্বময় চাউর হয়ে যায় মেট্রোপলিটন সিটি ভুপালের মৃত্যু উপত্যকায় রূপান্তরিত হবার বেদনাবিধুর ঘটনা। সবাই সরব হয় এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও যথোচিত শাস্তির দাবীতে। গ্রেফতারও করা হয় নাটের গুরুদের। তারপর? শাস্তি হয় তাদের? নাকি...
ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড, সংক্ষেপে ইউসিআইএল। একটি কেমিক্যাল কোম্পানি। ১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটির ভারতজুড়ে পাঁচ জেলায় ছিল মোট ১৪টি প্ল্যান্ট যেখানে কাজ করতো নয় হাজারের মতো মানুষ। ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড একটি যৌথ কোম্পানি ছিল যার ৫১% শেয়ার ছিল ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশনের এবং বাকি ৪৯% ছিল বিভিন্ন ভারতীয় বিনিয়োগকারীর যাদের মধ্যে খোদ ভারত সরকারও ছিল। ইউসিআইএল মূলত তৈরি করতো বিভিন্ন কীটনাশক, কার্বন প্রোডাক্ট, প্লাস্টিক, ওয়েল্ডিং ইকুপমেন্ট, ইত্যাদি। ১৯৭০ সালে তারা মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভুপালে প্রতিষ্ঠা করে একটি কীটনাশক প্ল্যান্ট। মূলত সত্তরের দশক থেকে তৎকালীন ভারত সরকারের বৈদেশিক বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকে পড়ার ফলাফলই এই কীটনাশক প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠা। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশনকে বলা হয়েছিল ব্যাপকভিত্তিক হারে এশিয়া জুড়ে বহুল ব্যবহৃত কীটনাশক সেভিন (কার্বারাইলের একটি বাণিজ্যিক নাম) উৎপাদনের জন্য। চুক্তি বাস্তবায়নে খোদ তৎকালীন ভারত সরকার স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সেখানে পূঁজি খাটাতে জোরারোপ করে। এমনকি ভারত সরকার ইউসিআইএলকে ২২% ভর্তুকি পর্যন্ত প্রদান করে এই নিমিত্তে। অথচ যে জায়গায় এই কীটনাশক প্ল্যান্ট বসানো হয়েছিল সেটা ছিল হালকা ধরণের শিল্পকারখানা আর সাধারণ বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য নির্দিষ্ট; কোনোভাবেই কীটনাশক প্ল্যান্টের মতো বিপজ্জনক শিল্পের জন্য নয়। কিন্তু তারপরও সেটা হয়। প্রাথমিকভাবে ইউসিআইএলকে কেবল কীটনাশক উৎপাদনের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। আর তার জন্য যে কাঁচামাল দরকার তা ইউসিআইএল তাদের প্যারেন্ট কোম্পানি থেকে নিয়ে আসতো। কিন্তু কীটনাশকের চক্রবৃদ্ধিহারে চাহিদা কোম্পানিটিকে পশ্চাদগামী সমন্বয়ে প্রভাবিত করে, অর্থাৎ তারা তখন কাঁচামালও এই প্ল্যান্টেই তৈরি করা শুরু করলো। কিন্তু এটা তো আর চাট্টিখানি কথা না। ফলে যা হওয়ার তাই হল। এক জটিল, বিপজ্জনক প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটলো ভুপালের মাটিতে। কিন্তু...
ঝামেলা বাঁধল গিয়ে আশির দশকের শুরুর দিকে ভারতজুড়ে চলা দুর্ভিক্ষ নিয়ে। একদিকে দুর্ভিক্ষ, অন্যদিকে ফসল না হওয়া আর মাথার উপর ক্রমাগত বাড়তে থাকা ঋণের বোঝা দিনকে দিন কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহারে অনুৎসাহিত করে তোলে। ফলে ব্যবসায়ে ভাটা পড়ে কীটনাশক উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর। ১৯৮৪ সালে ইউসিআইএলের সেভিন উৎপাদন প্রায় সিকিভাগে নেমে আসে। ফলে উপর থেকে নির্দেশ আসে ইউসিআইএলের ভুপাল প্ল্যান্ট বন্ধ করে বিক্রি করে দেওয়ার। কিন্তু কেউই কিনতে চায় না মন্দভাগে থাকা কীটনাশক কারখানাটি। ফলে বাধ্য হয়ে ইউসিআইএল কর্তৃপক্ষ ফ্যাসিলিটি অন্য কোন উন্নয়নশীল দেশে ট্র্যান্সফার করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সময়ে কারখানাটির সেফটি ইকুপমেন্ট আর পরিচালনা পর্যায় তাদের স্ট্যান্ডার্ড মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হতে থাকে এবং এটা ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয় বলে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধারণা। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার সেফটি ষ্ট্যাণ্ডার্ডের অধোগতির বিষয়টা জানার পরও এই ব্যাপারে চুপটি মেরে বসে থাকে। ঘটনার দিন রাতে লিকেজ দিয়ে পানি প্রবেশ করার কারণে স্টোরেজ ট্যাঙ্কে অর্থাৎ প্ল্যান্টে উচ্চচাপের উদ্ভব ঘটে। অথচ এই প্ল্যান্টটিতে ছয় স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। কারখানার শ্রমিকেরা বিষয়টা উচ্চ পর্যায়ে জানানোর পরও কারো মাথাব্যথা হয়নি। উল্টো সেটা না সারিয়ে ঐ অবস্থাতেই সেটা রেখে ঘটনার তিন সপ্তাহ আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়। মূলত লিকেজটি হয় সেফটি ভাল্ভে যা দিয়ে ঢুকে পড়ে এক টনের মতো পানি। আর সেই পানি গিয়ে ভয়াবহ বিক্রিয়া শুরু করে দেয় প্ল্যান্টে থাকা প্রায় চল্লিশ টনের মতো মিথাইল আইসোসায়ানেটের সাথে। ফলে উচ্চচাপ ও উচ্চ তাপের যুগপৎ ক্রিয়ায় সেটা ছড়িয়ে পড়ে ভুপালের কুহেলিকাময় রাতের আকাশে। যারা মারা গিয়েছিল তাদের বেশিরভাগই ছিল দরিদ্র বস্তিবাসী ও নিম্ন আয়ের মানুষ। কারণ প্ল্যান্টটি ছিল একটি ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি এলাকার কাছাকাছি।
এই ঘটনার জন্য যাকে সবচেয়ে বেশী দায়ী করা হয় তার নাম ওয়ারেন অ্যান্ডারসন। ইউসিআইএলের তৎকালীন চেয়ারম্যান। ডিসেম্বরের ৭ তারিখ তাকে গ্রেফতার করা হলেও ঘণ্টা ছয়েকের মধ্যেই ২, ১০০ ডলারের বিনিময়ে সে জামিন পেয়ে সরকারী বিমানে করে যুক্তরাষ্ট্রে ‘পালিয়ে’ যায়। দুঃখজনকভাবে মার্কিন সরকার তাদের এই কুলাঙ্গার নাগরিকের পক্ষ নেয়। তাকে মার্কিন কংগ্রেস ঐ মাসেরই ১৪ তারিখে ডেকে পাঠায় এবং “এমন কাজটি কোথাও যেন করিও না আর” এই আহ্লাদি শর্তে ছেড়ে দেয়। যার জন্য আজো বেঁচে আছে ৯২ বছর বয়সী ভুপালের সেই গণহত্যাকারী। অন্যদিকে ভারত সরকারও বিড়ালের মতো মিনমিনে কণ্ঠে হুংকার দেওয়ার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে এখনো। অবশ্য ১৯৮৭ সালের ১ ডিসেম্বর ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন মূল আসামী অ্যান্ডারসনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করে। বিশ হাজারের মতো নিরীহ প্রাণের হত্যাকারী, লক্ষ লক্ষ জীবন্মৃত মানুষের ভোগান্তির হোতা এই ওয়ারেন অ্যান্ডারসনকে তার অন্যান্য (ভারতীয়) সাগরেদসমেত ভারতের আদালত গত ২০১০ সালের জুনে শাস্তির আদেশ দেয়। শাস্তিতা কি ছিল জানেন? অবহেলা ও অন্যান্য ব্লা ব্লা কারণে প্রত্যেককে নগদে দুই বছরের জেল এবং ১ লাখ রুপী করে জরিমানা!!! ব্যস, তাদের দায়িত্ব ঐ পর্যন্তই। না ভারত সরকার, না অন্য কেউ, আসলে কেউই আজও পারেনি ভুপালের অধিবাসীদের সেই বিভীষিকা ভুলিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসতে।
মধ্যপ্রদেশের এক মধ্যরাতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা আমাদের দেশেও ঘটতে পারে কিন্তু। বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর নাম করে আমরাও কি বিদেশী কোম্পানি আর রাষ্ট্রের হাতে দেশের সর্বনাশ করার অনুমতিপত্র দিয়ে দিচ্ছি কিনা সেটা আরেকবার ভেবে দেখা দরকার নয় কি?
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৫:০৩