আমি একজন ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্রের গৃহশিক্ষক। ভিতর থেকে শুনলাম মা তার ছেলেকে বলছে, অমুকের ছেলে এই করেছে সেই করেছে; তুমি কি করেছ? ঠিকমত পড়াশুনা করছ না কেন? ছোট্র বাচ্ছা ছেলে; দুনিয়ার কিছু বুঝে না উঠার আগেই তার উপর প্রত্যাশার চাপ সাওয়ার হয়েছে। বিদ্যালয়ে তাকে অমুক তমুকের চেয়ে ভাল ফলাফল করতেই হবে, না হলে বাবা-মায়ের মানসম্মানেও আঘাত লাগতে পারে। সর্বোপরি তাকে একজন ভাল ছাত্র হয়ে তাকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট ইত্যাদি হতেই হবে। প্রত্যাশার চাপ খারাপ কিছু না। তবে কচিকাঁচাদের এই বয়সে পুস্তককেন্দ্রিক জ্ঞানের চেয়ে সরেজমিন আমোদী শিক্ষাদান বেশি দরকার এবং তা কার্যকরী। যেমন - ছাত্রকে জিজ্ঞাস করলাম, তুমি কি কখনো কৃষকের ধানের চারা রোপন করতে দেখেছ? কখনো গাছ রোপণ করেছ? দোয়েল পাখি দেখেছ কখনো? উত্তরে শুধু না আর না। শহরের শিশু হওয়াতে তার হয়ত এই সম্পর্কে জ্ঞান নেই। কিন্তু একজন না পড়ূয়া গ্রাম্য শিশুকে বললে এই প্রশগুলোর অকপটে উত্তর পাওয়া যাবে। কিন্তু গ্রামের শিশুরা পারিপার্শ্বিক জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তাদের মেধা বিকাশের সুযোগ কমই পায় বা তাদের প্রতিভার পরিচর্যা করা হয় না সেভাবে । আবার শহরের শিশুরা কমবেশি পরিচর্যা পেলেও তারা পুস্তক আর বাস্তবকে মিলাতে পারেনা। আর পুস্তক আর বাস্তবের সংযোগ না ঘটলে সে বিদ্যা অল্পতেই ক্ষয়ে যায়। গ্রামের একটি শিশুর শৈশব কাটে দুরন্তপণাময়, বাল্যজীবন হয় মধুর এবং স্মৃতিময়। সে পরিবেশ থেকে শিখে কিন্তু তার প্রাতিষ্ঠানিক সংশ্লিষ্টতা কম থাকে বা অনেক সময় সে বিদ্যালয়ে গমন করে না অথবা পরিস্থিতির কারনে তার সুযোগ থাকে না। ফলে তার সম্ভাবনা হারিয়ে যায়।
অন্যদিকে, মা-বাবা সচেতন হওয়ায়, সুযোগ-সুবিধা থাকায় শহরের শিশুরা (বস্তিবাসী এবং ছিন্নমূল শিশু ব্যাতিত) স্কুলে গমন করতে পারছে। কিন্তু তাদের উপর পড়ে প্রবল চাপ; এ চাপ অতি অধ্যয়ন এবং তাড়িত প্রত্যাশার । ফলে তাদের পড়াশুনা হয় নিরস এবং নিরানন্দ। অনিচ্ছা সত্বেও বাবা-মায়ের বকুনির ভয়ে তাঁরা গিলছে শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণা। সোনালী বাল্যজীবনের কৈশোরিক আনন্দ সে পায়না। কৈশোর রোমন্থনের স্মৃতির মিনারও তৈরি হয়না। মধুর শৈশবকে হারিয়ে তাদের তৈরি করতে হয় শ্রমরতের এক বিশাল স্মৃতি। কিন্তু তা কার্যকরী কমই হয়। কারন এ ধরনের তীব্র চাপ শিশুর সামাজিক, মানসিক, শারীরিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, ঘুমেত ঘাটতি, খাদ্যে অনীহা, অত্যধিক দুশ্চিন্তা, বন্ধুবান্ধব থেকে বিচ্ছিন্নকরণ, কোন কাজে শখের আগ্রহ হারানো ইত্যাদি সমস্যাগুলো বাড়তি চাপের কারনে দেখা দিতে পারে। এছাড়ায়ও দৃষ্টিশক্তিহীনতা, মাথাব্যাথা, খিটখিটে মেজাজ, সৃজনশীলতার অভাভ ,বদহজম, চোখের নিচে কালোদাগের মত ইত্যাদি শারীরিক ও মানসিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। ফলে সব কিছুই বর সাপে হয়ে যেতে পারে। স্বাভাবিক মেধার বিকাশ এবং আত্ববিশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
তো ছাত্রকে ডাক্তার, ইঙ্গিনিয়ার কিংবা পাইলট হতে হবেই, তার বাবা মায়ের স্বপ্ন। এ জন্য তাকে সারাদিন ব্যাস্ততার মধ্যে রাখা হয়। চলতে থাকে স্কুল, কোচিং সেন্টার, আরবী শিক্ষক, গৃহ শিক্ষকের, সংগীত শিক্ষকের আনাগোনা। ক্লান্ত দেহে আর অস্থির মনে তাকে সয়ে যেতে হয়।
ছাত্র একদিন জিজ্ঞেস করল, স্যার পরীক্ষা কে আবিষ্কার করছে? আমি তাকে পাইলে শেষ করে দিতাম। আসলে শিক্ষা ব্যাবস্থা অতিমাত্রায় পরীক্ষা নির্ভর হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মুখস্থ বিদ্যার দিকে প্রেষণা যোগায়। কারণ শিক্ষার্থীদের মূল টার্গেট হয়ে উঠে পরীক্ষায় পাস করা অথবা পরীক্ষায় আরো ভালো করা। এ ভ্রম শিক্ষা ব্যাবস্থায় পরীক্ষার খাতায় সব মুল্যায়ণ করতে হয়। একচুয়ালি অতিরিক্ত পরীক্ষা কিলস মেরিট অফ চাইল্ড।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৩৯