গতকাল রাজধানী ঢাকা কার্যত অচল ছিল। সাধারণ মানুষ, চাকুরিজীবী, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পায়ে হেঁটে গন্তব্যে গিয়েছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানহটে আটকে থেকে ভোগান্তীর শিকার হয়েছেন। কিন্তু প্রায় সবাই এই কষ্টটুকু মেনে নিয়েছেন, কারণ তারা জানেন এই কষ্টের পেছনে আছে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর দাবি আদায়ের আন্দোলন।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের ওপর শেখ হাসিনার মহাজোট সরকারের আরোপ করা ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে ছাত্ররা রাজপথে নেমেছে। তারা এই ভ্যাট প্রত্যাহার চায়। এই ছাত্রদের মধ্যবিত্ত বাবা-মায়েরা অনেক কষ্ট করেই তাদের লেখাপড়ার খরচ যোগান দেন। আমি কয়েকজন শিক্ষার্থীকে চিনি যারা টিকে থাকার জন্য টিউশনি করেন।
এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা বলা দরকার।
"ছাত্র রাজনীতি খুব খারাপ বিষয়। রাজনীতিই খারাপ বিষয়।" একথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনেকেই বলতেন। বেসরকারি কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিজ্ঞাপনে এক সময় লেখা দেখেছি 'ছাত্ররাজনীতি ও ধুমপান মুক্ত'। কিন্তু এখন দেখছি আর কেউ মুক্ত থাকতে চাইছে না। অথবা পারছে না। মাস্টার সাহেবরা আন্দোলন করছেন, কেউ করছেন ভিসি বদলানোর দাবিতে, কেউ করছেন নতুন বেতন কাঠামোর দাবিতে। কেউ ''মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তচিন্তা'র ত্যানা উড়াচ্ছেন .. কেউ এককাঠি সরেস : "মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয়মূল্যবোধ" -- অর্থাৎ ত্যানাটাকে আরেকটু বড় করেছেন। কেউ খুব শান্তিবাদী, গান্ধিও হার মানবেন, এমন কায়দায় আন্দোলন করছেন। সবাই অবশ্য অতটা শান্তিবাদী থাকতে চাইছেন না, সেজন্য 'দুষ্টু ছেলের দল'কে লেলিয়ে দিয়ে 'নাট-বল্টু' টাইট দিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু যাই হোক, আন্দোলন ছাড়ছেন না কেউ। ... এসব অব্শ্য রাজনীতি নয়।
আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা অনেকদিন ধরেই রাস্তায় মিছিল-সমাবেশ করে চলেছেন। এবার পুলিশের লাঠি-গুলির স্বাদও একটু নিলেন। ... এসব অবশ্য রাজনীতি নয়।
কিন্তু আমরা যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই, আমাদের যাদের ভিসি বদল কিংবা ভ্যাট প্রত্যাহার কোনোটার সাথেই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নিজেদের স্বার্থ নেই, আমরা যারা গলায় রক্ত তুলে বলছি : 'দেশ স্বাধীন হল ৪৪ বছর পার হয়েছে, এখনো দেশে স্বাক্ষরতার হার ৬০ ভাগ পার হল না কেন?' 'সরকার শিক্ষার জন্য বরাদ্দ বাড়ায় না কেন?' আমরা যারা শিক্ষার বেসরকারিকরণ-বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করার দাবি জানিয়েছি দিনের পর দিন, এখনো জানাচ্ছি, আমরা যারা দাবি জানাচ্ছি : 'সবার শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে, শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সামাজিক মর্যাদা ও বেতন কাঠামো নিশ্চিত করতে হবে, সর্বজনীন বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতি প্রনয়ণ করতে হবে' ... আমরা রাজনীতি করি। হ্যাঁ, এটা রাজনীতি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী বন্ধু এবং তাদের বাবা-মায়েরা একটু ভেবে দেখবেন।
আজ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলছে, 'ভ্যাট দেবনা, গুলি কর'। তারা স্লোগান দিচ্ছে, 'নো ভ্যাট অন এডুকেশন'। এদের সাধুবাদ ও অভিনন্দন। কিন্তু আমরাই কি সরকারকে, রাষ্ট্রকে এই সুযোগ করে দেই নি? আমরা তো সরকারি দায়িত্বে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের দাবিতে রাজপথে নামিনি। প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে কি ভয়াবহ ভোগান্তী আর হয়রানির শিকার হয়। কি বিপুল অর্থ তাদের ব্যয় হয় ভর্তিযুদ্ধের পেছনে। আমরা তো আন্দোলনে নামছি না। এই তীব্র ভর্তিসংকটকে কাজে লাগিয়েই তো একের পর এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো গজিয়েছে। আমরা তো এসব প্রতিরোধ করিনি।
যদি দেশে শিক্ষার বেসরকারিকরণ-বাণিজ্যিকীকরণ চলতে থাকে, যদি শিক্ষাকে পণ্য হিসাবে আমাদের মেনে নেয়ার এই প্রবণতা চলতে থাকে তাহলে আজ ১০% ভ্যাট কমানো বা বাতিল করা হয়ত সম্ভব হবে। কিন্তু কাল? কাল তো নতুন কৌশলে এই ভ্যাট-ফি চাপাবে। তখন কি করবেন?
দেশে এখন চলছে একটাই নীতি 'ফেল কড়ি মাখো তেল'। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যান, টাকা না থাকলে চিকিৎসা নেই। আপনি মরে গেলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আপনার চিকিৎসা করবে না। শিক্ষাক্ষেত্রেও এই নীতি, 'টাকা যার, শিক্ষা তার'। আপনার টাকা নেই, আপনার ছেলেমেয়ের জন্য শিক্ষাও নেই। গরিব হলে ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শোখানোর দরকার নেই। ঢাকা শহরের কোনো ভদ্রলোক তার ছেলেমেয়েক সরকারি প্রাইমারী স্কুলে পাঠায় না। আরো যারা গরিব, তাদের জন্য আছে কোরবানীর চামড়ার এতিম খানা।
এ অবস্থার অবসান দরকার। আমাদের সবার মিলিতভাবে নামা দরকার। সবাই মিলে বলা দরকার : 'টাকা যার, শিক্ষা তার -- এই নীতি মানি না'। এ কথা তো সবারই জানা যে নগরে আগুন লাগলে দেবালয় রক্ষা পায় না।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৪২