পর্ব-১ : Click This Link
পর্ব-২ : Click This Link
৮।। গণআন্দোলন, নির্বাচন এবং এস ইউ সি আই (সি)
কমরেড শিবদাস ঘোষের এই শিক্ষাকে পাথেয় করেই এস ইউ সি আই (সি) ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকারের শরিক হয়েছিল। ইন্দিরা সরকারের প্রবল জনবিরোধী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা কংগ্রেস, সিপিআই, সিপিএম, ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপি ইত্যাদি দলগুলো মিলে যে যুক্তফ্রন্ট গড়ে উঠেছিল এস ইউ সি আই (সি) তার শরিক ছিল। গণআন্দোলনের ধারাতেই যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয় এবং সরকার গঠন করে। এস ইউ সি আই (সি) নেতা কমরেড সুবোধ ব্যানার্জী দলের পরিকল্পনাক্রমে শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা অনুসারে সুবোধ ব্যানার্জী শ্রমমন্ত্রী হিসাবে শ্রমিকদের ‘ঘেরাও’কে আইনসঙ্গত অধিকার বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গে ঘেরাও আন্দোলন তীব্র রূপ লাভ করে। খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারতের মালিকগোষ্ঠী এতে আতঙ্কিত বোধ করতে শুরু করে। মালিকগোষ্ঠীর চাপে সুবোধ ব্যানার্জীকে পরের দফা যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভায় শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। এবং সর্বোপরি আন্দোলন পরিচালনা, সরকার পরিচালনা, যুক্তফ্রন্টের অভ্যন্তরে মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনার প্রশ্নে মতভিন্নতা প্রশ্নে এস ইউ সি আই (সি)-কে যুক্তফ্রন্ট ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করে। এস ইউ সি আই (সি) সেদিন নীতি বিসর্জন দিয়ে যেনতেনো প্রকারে যুক্তফ্রন্টে থেকে ক্ষমতার গদিতে থাকার চেষ্টা করেনি। ক্ষমতার মোহে এস ইউ সি আই (সি) আন্দোলনের পথ, রাজপথে লড়াইয়ের পথ বিসর্জন দেয়নি।
প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারে এস ইউ সি আই (সি) এবং কমরেড সুবোধ ব্যানার্জীর ভূমিকা নিয়ে দুটি লিংক দেয়া হল, আগ্রহী যে কেউ পড়ে দেখতে পারেন। Click This Link Click This Link এছাড়া ‘The Puzzle of India's Governance: Culture, Context and Comparative Theory’ By Subrata K. Mitra বইটির ১০০ পৃষ্ঠায় কিছু তথ্য আছে। (এ বইটিও নেটে পাওয়া যায়)।
এস ইউ সি আই (সি) সারা ভারতে কোথায় কোন কোন আন্দোলন করেছে সব আমার জানা নেই। তাদের পত্রিকা ‘গণদাবী’ এবং ছাত্র সংগঠনের মুখপত্র ‘ছাত্র সংহতি’ থেকে যে দু’একটা খবর জানি সেটাই উল্লেখ করি।
(ক) পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের জনস্বার্থবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে একটানা ১৮ বছর সম্পূর্ণ এককভাবে আন্দোলন চালিয়ে প্রাইমারি স্তরে ইংরেজি শিক্ষা চালু করতে সরকারকে বাধ্য করেছে। এ আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গের নামকরা শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা যুক্ত ছিলেন। যথা ভাষাবিদ সুকুমার সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলেশ দে, প্রমথনাথ বিশী, ড. সুশীলকুমার মুখার্জী প্রমুখ। এই শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘সেভ এডুকেশন কমিটি’।
(খ) যে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন সিপিএম-নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের ক্ষমতার ভিত ধসিয়ে দিয়েছে, সেই আন্দোলনের একেবারে শুরু থেকে এস ইউ সি আই (সি) ছিল। এ আন্দোলন সম্পর্কে ভারতে নিষিদ্ধ ঘোষিত সিপিআই(মাওবাদী)র পলিটব্যুরোর সদস্য কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেনজির মূল্যায়ন হল : “কোনো রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে এমন দীর্ঘ ও ধারাবাহিক আন্দোলন (সিঙ্গুর ও নন্দিগ্রাম) স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে আর কখনো হয়নি। জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতাই এর প্রধান কারণ বলে আমরা মনে করি।” [দেখুন : ভারতের মাওবাদী তিন নেতার সাক্ষাৎকার; উৎস পাবলিশার্স, ঢাকা] এই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে ‘ভূমি অধিগ্রহণ প্রতিরোধ কমিটি’ নামে একেবারে গ্রাম-স্তরে যে কমিটি হয়েছিল তাতে শরিক ছিল তিনটি শক্তি : (১) এস ইউ সি আই (সি), (২) তৃণমূল কংগ্রেস, এবং (৩) জমিয়াতে ওলামায়ে হিন্দ। পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সমর্থনে বুদ্ধিজীবী-শিল্প-সাহিত্যকদের যে কমিটি গঠিত হয়েছিল তাতেও এস ইউ সি আই (সি)-র ভূমিকা ছিল।
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের সময় ফেসবুকে একটা ভিডিও দেখেছিলাম। তৃণমূলের এক নেতা বক্তৃতা করছেন এস ইউ সি র বিরুদ্ধে : ‘এস ইউ সি শুধু আন্দোলনের কথা বলে, ওদের জন্য আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বিশেষ ব্লক করে দেয়া হয়েছে, ওদের পাছার কাপড় খুলে দেখুন, পুলিশের লঠির বাড়িতে সবার পাছায় দাগ পড়ে গেছে।’ কি চমৎকার বদনাম!
এ পর্যন্ত কংগ্রেস-সিপিএম গুন্ডাদের হাতে শুধু পশ্চিমবঙ্গেই এস ইউ সি আই (সি)-র ১৬০ জনের মতো নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। একজন নির্বাচিত বিধায়ক-সহ বিভিন্ন মিথ্যা মামলায়, রাজনৈতিক মামলায় বন্দি আছেন কয়েক শত। সদাশয় অপুন সাদী মহাশয়েয় ভাষায় বললে, এসব নেতা-কর্মি সম্ভবত পা/হাঁটু কাঁপতে কাঁপতে ‘হার্ট এ্যাটাক’ হয়ে মারা গেছেন (যেমন আমাদের দেশে র্যাথবের হাতে অনেক সময় মারা যায়)। কিংবা এস ইউ সি আই (সি) নেতা-কর্মীরা স্বেচ্ছায় স্ব-উদ্যোগে কারাগারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। কি জানি, বাইরে থাকলে আবার কখন সশস্ত্র বিপ্লব করতে হয়! ফলে সশস্ত্র বিপ্লব আর গণআন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্বটা তাঁরা অনুপ সাদী মহাশয় এবং তার বন্ধুদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন।
এস ই্উ সি আই (সি) একটা সংগ্রামী পার্টি হিসাবেই আমাদের সামনে প্রতিভাত। এরকম একটি সংগ্রামী পার্টির সাথে আমাদের বন্ধুপ্রতীম সম্পর্কের কারণে আমরা গর্বিত। বিপরীতে আমাদের এদেশের মাটিতে ধারাবাহিক, লাগাতার গণআন্দোলন গড়ে তোলার কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষত নব্বুই এর স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে বাম দলগুলোর জোট ৫ দলের শরিক হিসাবে আমাদের দল সাহসী ভূমিকা পালন করলেও নব্বুই পরবর্তীকালে যখন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক শাসক আপেক্ষিক স্থায় রূপ নিয়েছে, তখন জনজীবনের সমস্যা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে গণআন্দোলন গড়ে তোলার রাস্তায় দল এগোতে পারে নি। কখনো কখনো কিছু চেষ্টা হয়েছে কিন্তু দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে তথাকথিত ‘দৃশ্যমান’ হওয়ার প্রবণতা দলকে বিপ্লবী লাইনে এগোতে বাধাগ্রস্ত করেছে। আমাদের দলের অভ্যন্তরে মতবাদিক বিতর্ক এবং দলের বিভক্তির এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে এসেছে। কিন্তু তার মানে এই নয় আমাদের দল বাসদ, ছাত্র ফ্রন্ট গান্ধিবাদী রাজনীতির চর্চা করছি।
কিন্তু অনুপ সাদী মহাশয়ের কথা শুনলে মনে হবে, কেউ মারবে শুনলে আমরা ভয়েই আর রাস্তায় বের হই না। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, (বা আরো দু’চারটি জায়গায়) পুলিশ প্রশাসন-ছাত্রলীগের গুন্ডাপান্ডার হাতে পিটুনি/মার যা খাবার সব অনুপ সাদী মহাশয় আর তার সশস্ত্র বিপ্লবপন্থী বন্ধুরাই খাচ্ছেন, খেয়ে চলেছেন। ওসবের মধ্যে আমরা ছিলাম না। পত্রপত্রিকায় আমাদের দু-চার জন নেতাকর্মীর নাম-ছবি যা এসেছে, সেসব বুর্জোয়াদের কারসাজি।
নির্বাচন প্রশ্নে আরো একটা বিষয় বলবার আছে। নির্বাচনকে আমরা গণআন্দোলনের অংশ হিসাবেই দেখে থাকি। নির্বাচনে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য জনগণের মধ্যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অসারতা প্রমাণ করা, জনগণের রাজনৈতিক চেতনার মানোন্নয়ন ঘটানো। এবং এটা শুধু কথায় নয়, নির্বাচনী প্রক্রিয়াতেও আমরা এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকি। সমগ্র দল পরিচালনা এবং নির্বাচন পরিচালনার ব্যয়ভার জনগণের কাছ থেকেই করা হয়। এবং সেটা প্রকাশ্যেই, গণচাঁদা সংগ্রহের মাধ্যমে। এস ইউ সি আই (সি)-ও একই পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে।
৯।। ক্ষুদিরাম-প্রীতিলতা-সূর্যসেন-ভগৎ সিং প্রসঙ্গ
অনুপ সাদী মহাশয় একটা অত্যন্ত সত্য কথা বলেছেন। বাসদ-এস ইউ সি আই (সি) ক্ষুদিরাম-প্রীতিলতা-সূর্যসেন-ভগৎ সিং-এর নাম জপ করে। কথাটা সত্য। এ জপটা আরো ভালো করে করতে পারলে আমরা আরো খুশি হতাম। কারণ আমরা মনে করি, কোনো একটা দেশে জনগণের অতীত দিনের সংগ্রামী ঐতিহ্যের সাথে, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করা বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য অপরিহার্য অংশ। কমরেড লেনিনের শিক্ষা এটা। ভারতে এটাকেই বিশেষায়িত করেছিলেন কমরেড শিবদাস ঘোষ। তিনি দেখিয়েছেন, অতীতের এ সংগ্রামী ধারার সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতে না পারলে জাতিগতভাবে আমরা ছিন্নমূল হয়ে পড়ব। তাঁর ওই শিক্ষার ভিত্তিতেই ভারতে এস ইউ সি আই (সি) এবং বাংলাদেশে আমাদের দল ভারতবর্ষের নবজাগরণ আন্দোলন এবং বুর্জোয়া মানবতাবাদের আপসহীন ধারার প্রতিনিধি মনীষী, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের আপসহীন বিপ্লবীদের স্মরণ করা এবং তাদের জীবন-সংগ্রাম দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার কাজটি করে চলেছি।
বিপরীতক্রমে, আমার জানা মতে, নকশাল বলে পরিচিত মাওবাদীরা বিদ্যাসাগর-সহ ভারতের নবজাগরণের মনীষীদের ‘বুর্জায়া’ আখ্যা দিয়ে তাঁদের মূর্তি ভাঙা, মূর্তি-ছবিতে কালিলেপনের ন্যাক্কারজনক কাজটি করেছিল। তাদের সেই আন্দোলনের নাম ছিল ‘মূর্তিভাঙ্গা আন্দোলন’ (ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের একটি লেখা ‘মূর্তিভাঙ্গা আন্দোলন’ শিরোনামে বদরুদ্দিন উমর সম্পাদিত ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল)। এস ইউ সি আই (সি) দিনের পর দিন, বছরের পর বছর প্রবীন বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়ে এঁদের স্মরণ করার কাজটি করে গেছে। শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের তাঁবেদার সংবাদমাধ্যমগুলো যখন স্বাধীনতা সংগ্রামের আপসহীন ধারার প্রতিনিধিদের একেবারে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ভাষায় ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসাবে আখ্যায়িত করে চলেছে, তখন এস ইউ সি আই (সি) তার প্রতিবাদ করেছে। ভারতের পাঠ্যপুস্তকে ক্ষুদিরাম-ভগৎ সিং-দের সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দেয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেছে। প্রসঙ্গত মনে করিয়ে দেই, ক্ষুদিরাম শতবর্ষে আমাদের কারো কারো প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ক্ষুদিরামকে ‘নেতাদের দ্বারা বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট বালক’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিল। সেদিন এস ইউ সি আই (সি) এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিল।
কবি নজরুল এবং বেগম রোকেয়াকে ভারতের সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠী, সংবাদমাধ্যম নীরবে দিনের পর দিন উপেক্ষা করে গেছে। এস ইউ সি আই (সি) বিদ্যাসাগর, শরৎচন্দ্র, নজরুল, রোকেয়া প্রমুখ মনীষী এবং ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, ভগৎ সিং, প্রীতিলতা প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্মশতবর্ষ, মৃত্যুশতবর্ষ প্রভৃতি উদযাপন করেছে। কলকাতায় স্থাপিত শহীদ ক্ষুদিরামের ভাস্কর্যটির ভাস্কর এস ইউ সি আই (সি) কেন্দ্রীয় কমিটির প্রয়াত সদস্য কমরেড তাপস দত্ত। বাংলাদেশের মাটিতেও আমরা আমাদের দলের সাধ্যমতো এ কাজটি করে চলেছি। এদেশে যখন কেউ সূর্যসেন-প্রীতিলতার নাম উচ্চারণ করত না, তখন আমাদের দল তার সীমিত সামর্থ্য নিয়ে তাঁদের স্মরণ করার কাজটি করে গেছে। আমাদের দলের উদ্যোগেই চট্টগ্রামে প্রীতিলতার একটা ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে।
৯।। এবং আরো কিছু প্রসঙ্গ
বিতর্ক করার জন্য যুক্তি করার পদ্ধতি নিয়েও আমাদের একটু ভেবে দেখা উচিত। যার লেখার সূত্র ধরে আমরা এই লেখাটি হাজির করছি সেই আনিস রহমানের যুক্তির ধারাটি একবার খেয়াল করুন। এস ইউ সি আই (সি) তাদের মুখপত্র গণদাবী-তে লিখেছে, এস ইউ সি আই (সি)-র সাংসদ ডা. তরুণ মন্ডলের উদ্যোগে স্বাধীন ভারতের মাটিতে এই প্রথম সংসদের মধ্যে শহীদ ক্ষুদিরামের শহীদ দিবস পালিত হল। আনিস রহমান বলছেন, এর মধ্য দিয়ে বুর্জোয়া পার্লামেন্টের মহিমাকীর্তন করা হলো, ক্ষুদিরামকে অপমান করা হলো।
এ ধরনের যুক্তিধারাকে কি বলবেন? কাল যদি বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকরা আন্দোলনের মাধ্যমে ৯ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবি মানতে বাধ্য করতে পারে, আর আমরা যদি বলি, ‘শ্রমিক আন্দোলনের মুখে সরকার-মালিকপক্ষ বাধ্য হলো দাবি মানতে’ – তাতে করে কি বুর্জোয়া সরকারের কিংবা মালিকগোষ্ঠীর মহিমাকীর্তন করা হবে? কিংবা বাংলাদেশের সংসদে যদি সুন্দরবনের পাশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায়, আর আমরা দাবি করি, বামপন্থীদের প্রতিবাদের মুখে সংসদে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎপ্রকল্প বাতিল হল’ – তাতে কি শাসকগোষ্ঠীর মহিমাকীর্তন করা হবে? প্রসঙ্গত আরো বলা দরকার যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় হিটলারের ফ্যাসিস্ট জার্মানি পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেদিন কি ব্রিটেন-ফ্রান্স বা কোনো পুঁজিবাদী দেশের পার্লামেন্টে বা শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সোভিয়েতের ভূমিকার, স্ট্যালিনের ভূমিকার প্রশংসা করে কথা বলা হয়নি? মহান মাও সেতুং-এর নাম কি মার্কিন পার্লামেন্টে উচ্চারিত হয় নি? তাতে কি এঁদের অসম্মান হয়েছিল? আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ক্ষুদিরাম-প্রীতিলতা-সূর্যসেন-ভগৎ সিং প্রমুখ বিপ্লবীদের নিয়ে এস ইউ সি আই (সি)-র একটা ধারাবাহিক কাজ আছে, চর্চা আছে। বিষয়টা এমন নয় যে এসব নিয়ে এস ইউ সি আই (সি) আগে কখনো কিছু বলেনি, কিছুই করেনি, হঠাৎ করে পার্লামেন্টে বুর্জোয়াদের সাথে দহরম-মহরম করে কিছু একটা করে নিজেদের নাম ফাটাতে লেগে গেছে।
এমন ধারা যুক্তির আরেক অত্যুজ্জ্বল নমুনা স্থাপন করেছেন বন্ধু আরিফুজ্জামান তুহিন। সমকামীতা প্রশ্নে এস ইউ সি আই (সি)-র একটি বিবৃতিকে পোস্ট করে বললেন, এস ইউ সি আই (সি) সমকামিতার বিপক্ষে? সমকামিতাকে তারা বিকৃতি মনে করে? সমকামিতাকে তারা ব্যাভিচার মনে করে? এরা আবার কি কমিউনিস্ট? এরা তো জনগণের শত্রু! এর পর তিনি আরো এক ধাপ এগিয়ে বললেন, মার্কস-এঙ্গেলস এদের শেখাতে পারে নি, শিবদাস ঘোষ আর এদের কি শেখাবেন? ইত্যাদি ইত্যাদি।
আরিফুজ্জামান তুহিনের ওই পোস্টে আমরা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলেছিলাম যে এ ধরনের মন্তব্য ছুঁড়ে দেবেন না। যুক্তি থাকলে সেগুলো বলুন। কোনো একটা পার্টিকে জনগণের শত্রু হিসাবে, জনবিরোধী হিসাবে আখ্যায়িত করার এই কি পদ্ধতি? এই কি যুক্তি? এমন গুরুতর একটা অভিযোগ করার আগে কি অন্তত এ তথ্য ও যুক্তিগুলো হাজির করা দরকার নয় যে এই পার্টিটা জনগণের কোন গণআন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? কোন গণআন্দোলনকে পেছন থেকে ছুরি মেরেছে? কোন গণআন্দোলন ছেড়ে পেছন থেকে পালিয়ে গেছে? তিনি বলেছিলেন, অচিরেই আমাদের নিয়ে লিখবেন। আমরা চেয়েছি, তিনি লিখুন। হয়তো নানা ব্যস্ততায় সেটি করে উঠতে পারেন নি। কিন্তু আনিস রায়হানের লেখার সূত্র ধরে তিনি পুনর্বার এসে হাজির হলেন।
একটু ভাবুন বিষয়টা! সারা দুনিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঠিকতা-বেঠিকতা বিচারের ‘কি-পয়েন্ট’ হয়ে দাঁড়িয়েছে সমকামীতা! আর সমকামিতা প্রশ্নে যেহেতু এস ইই সি আই (সি)-র মতের সাথে আপনার মত মেলেনি তাই এস ইউ সি আই (সি) হয়ে গেল জনবিরোধী শক্তি? জনগণের শত্রু? সমকামিতাই তাহলে এখন সারা পৃথিবীর মানুষের সামনে প্রধান সমস্যা? এ প্রশ্নে কে কি অবস্থান নিলেন তার দ্বারাই নির্ধারিত হবে জনগণের শত্রু-মিত্র? বালখিল্যতার একটা সীমা থাকা উচিত নয়?
এতো গেল একটা দিক। তার আরেকটি মন্তব্য খেয়াল করুন : ‘মার্কস-এঙ্গেলস এদের শেখাতে পারেন নি, শিবদাস ঘোষ আর এদের কি শেখাবেন!’ হতেও পারে। খোদ মার্কস-এঙ্গেলসই যদি আমাদের না শেখাতে পারেন, তাহলে শিবদাস ঘোষ আর কি শেখাবেন! কিন্তু মাননীয় আরিফুজ্জামান তুহিন কি বলবেন, মার্কস-এঙ্গেলস এর কোন শিক্ষাটা নিতে আমাদের ভুল হয়েছে? সে বিষয়ে তিনি কিন্তু কিছুই উল্লেখ করলেন না, মন্তব্য করেই খালাস। আর সেই সাথে উনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসটাও বেমালুম হজম করে ফেললেন। মার্কস-এঙ্গেলস এর অমূল্য শিক্ষা দুনিয়ার সব কমিউনিস্টদের সামনে থাকার পরও লেনিন-স্ট্যালিন-মাও সেতুঙ-কে বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হয়েছে আমাদের শেখানোর জন্য। শুধু তাই নয়, লেনিনের শিক্ষা থাকার পরও সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি সংশোধনবাদী বিচ্যুতির শিকার হয়েছে। মাও সেতুঙ এর শিক্ষা সামনে থাকার পরও চীনের পার্টি শোধনবাদী লাইনে চলে গিয়েছে। এসব ইতিহাস তিনিও জানেন। কিন্তু সম্ভবত আমাদের উপর বিশেষ কোনো আক্রোশ থেকে কথার ঝোঁকে এমন বালখিল্য মন্তব্য করে বসেছেন। শিবদাস ঘোষ আমাদের কি শিখিয়েছেন তার দু’একটা উদাহরণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। আশা করি, তুহিন সেগুলো ভেবে দেখবেন।
অনুপ সাদী মহোদয়ের যুক্তি-ধারা ও মন্তব্য নিয়ে কিছু কথা আগেই বলা হয়েছে।
১০।। তত্ত্ববিহীন একদল তাত্ত্বিক
কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিতর্ক একটি অত্যন্ত জরুরি কাজ। সমালোচনা আমাদের চালাতেই হবে। কিন্তু সমস্ত কাজেরই কিছু নীতি-পদ্ধতি প্রয়োজন হয় – বিতর্ক, সমালোচনার জন্যও কিছু নীতি-পদ্ধতি প্রয়োজন। তা না হলে এগুলো নিছক কতগুলো কথা চালাচালি, একে অপরের খুঁত খুঁজে বের করায় পর্যবসিত হবে। সমালোচনার পরিবর্তে ছিদ্রান্বেষণ চলবে। বিতর্ক পরিণত হবে বালখিল্যতায়। আমাদের অবস্থা হবে সুকুমার রায়ের হ-য-ব-র-ল’র সেই বুড়োর মতো :
“তার পরে হুঁকোটাকে দূরবীনের মতো করে চোখের সামনে ধরে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার পর পকেট থেকে কয়েকখানা রঙিন কাঁচ বের করে তাই দিয়ে আমায় বার বার দেখতে লাগল। তার পর কোত্থেকে একটা পুরনো দরজির ফিতে এনে সে আমার মাপ নিতে শুরু করল, আর হাঁকতে লাগল, “খাড়াই ছাব্বিশ ইঞ্চি, হাতা ছাব্বিশ ইঞ্চি, আস্তিন ছাব্বিশ ইঞ্চি, ছাতি ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলা ছাব্বিশ ইঞ্চি।”
আমি ভয়ানক আপত্তি করে বললাম, “এ হতেই পারে না। বুকের মাপও ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলাও ছাব্বিশ ইঞ্চি? আমি কি শুওর?”
বুড়ো বলল, “বিশ্বাস না হয়, দেখ।”
দেখলাম ফিতের লেখা-টেখা সব উঠে গিয়েছে, খালি ২৬ লেখাটা একটু পড়া যাচ্ছে, তাই বুড়ো যা কিছু মাপে সবই ছাব্বিশ ইঞ্চি হয়ে যায়।”
যা মাপব সবই ছাব্বিশ ইঞ্চি হয়ে গেলে ভারি মুশকিলে পড়তে হবে। এটা বোধ হয় আমরা কেউ-ই চাইছি না।
আমরা সমস্ত কমিউনিস্টরাই স্বীকার করছি যে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ আমাদের আদর্শ। কিন্তু মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধির ভিন্নতা থেকেই তো আমাদের চিন্তার ভিন্নতা, ক্রিয়ার ভিন্নতা। ফলে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে দাঁড়িয়ে একে অপরের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার জন্য একটা সাধারণ মানদণ্ড আমাদের লাগবেই। কি হবে সেই মানদণ্ড?
১৯০২ সালের মার্চ মাসে ‘কি করিতে হইবে?’ গ্রন্থে অর্থনীতিবাদী ধ্যান-ধারণাকে পরাস্ত করে মার্কসবাদী পার্টির তত্ত্বগত বনিয়াদ রচনা করেন কমরেড লেনিন। তিনি লেখেন, “বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লবী গণআন্দোলন সম্ভব নয়। ... সবচেয়ে অগ্রগামী আদর্শের (তত্ত্বের) দ্বারা পরিচালিত পার্টিই কেবল পারে সর্বহারা শ্রেণীর অগ্রণী বাহিনীর ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করতে।” লেনিনের এই শিক্ষাকেই চমৎকার ভাষায় প্রকাশ করেছেন কমরেড শিবদাস ঘোষ – বিপ্লবী দল ছাড়া বিপ্লব হয় না, আর বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লবী দল হয় না। ফলে যে-কোনো সমালোচনার ভরকেন্দ্র হওয়া উচিত কোনো দল বা কোন ব্যক্তি কোন তত্ত্বের ভিত্তিতে ক্রিয়া করছেন, আলোচনা করছেন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন।
তাহলে কোনো দলের বিপ্লবী তত্ত্ব বলতে কি বোঝায়? বিপ্লবী তত্ত্ব বলতে প্রধানত বোঝায় কোনো দেশের রাষ্ট্রচরিত্র বিশ্লেষণ, বিপ্লবের স্তর, বিপ্লবের রণনীতি-রণকৌশল ও শত্রু-মিত্র নির্ধারণ। আমাদের দল বাসদ মনে করে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, এখানকার বুর্জোয়াশ্রেণী রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন। ফলে এখানকার বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক। এবং এই বিপ্লব হবে সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানমূলক। এস ইউ সি আই (সি) ভারতকে একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র মনে করে, শুধু তাই নয়, ভারতকে একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ মনে করে। ফলে সেখানকার বিপ্লবের স্তরও সমাজতান্ত্রিক। এবং অতি অবশ্যই বিপ্লবের ধরন সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানমূলক।
আমাদের যেসব বন্ধুরা নানা বিষয় নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হচ্ছেন, রাষ্ট্রচরিত্র, বিপ্লবের স্তর ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা বা বক্তব্য এখনো নজরে পড়ে নি। তারা বিতর্কের কোথাও সেসব উল্লেখও করেন নি। সশস্ত্র বিপ্লব তো বিপ্লবের ধরন (form), কিন্তু বিপ্লবের চরিত্র (charecter/content) কি? বিপ্লবের মূল প্রশ্নটা অর্থাৎ বিপ্লবের চরিত্র কি হবে সে প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে ফরম নিয়ে বিতর্ক অর্থহীন নয় কি? অথচ এরা তাই করে চলেছেন। এদের বিপ্লবী তত্ত্বটা কি সেটা তারা কোথাও বলেন না। এরা যেন এমন একদল তাত্ত্বিক যাদের কোনো তত্ত্বই নেই।
এ আলোচনা শেষ করি লড়াকু মানবতাবাদী দার্শনিক বাট্রার্ন্ড রাসেলের একটি কথা দিয়ে। An Inquiry into Meaning and Truth-এ তিনি লিখেছিলেন :
“একবার কয়েকটি খবরের কাগজ পড়ে জানা গেল আমি মারা গিয়েছি। তারপর ভালো করে সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় হলে সেসব যাচাই করে দেখলাম – আমি মারা যাইনি।
অতএব মালুম হল যাচাই (verification) জিনিসটা হচ্ছে মিথ্যা-সিদ্ধান্ত বা বক্তব্যের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই।”
সত্য উদ্ঘাটন এবং সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই মিথ্যাকে চিহ্নিত ও প্রকাশিত করতে হয়। আমাদের বিতর্কের উদ্দেশ্যও তাই। কমিউনিস্টদের নিরন্তর এ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:১৬