আগের পর্ব : Click This Link
৬।। এস ইউ ইস আই (সি)-র অবস্থান
এবার আমাদের বিতর্কের দ্বিতীয় পর্ব। যদিও এ অংশটা মূল বিতর্কের প্রক্ষিপ্ত অংশ, কিন্তু যেহেতু আমাদের দল বাসদ, আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম দল ভারতের এস ইউ সি আই (সি) এবং কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রসঙ্গ কারণে-অকারণে টেনে আনা হয়েছে, তাই কিছু আলোচনা হওয়াই ভালো।
আমি ধরেই নিতে পারি যে আনিস রহমান বা অন্য যারাই বুর্জোয়া পার্লামেন্ট প্রশ্নে কোনো একটা পার্টির অবস্থান ও বক্তব্যকে সমালোচনা করছেন, তারা ওই পার্টির বক্তব্য স্পষ্টভাবে জানেন এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের ভিন্নমত বা যুক্তিগুলো তুলে ধরছেন। এখানে যেহেতু আমাদের দল এবং এস ইউ সি আই (সি)-এর প্রসঙ্গ এসেছে, সেহেতু আমাদের ধরে নেয়া উচিত যে তারা এই উভয় দলের বক্তব্য জানেন। চলতি বিতর্কে (এবং এছাড়াও অন্য লেখায়) অনুপ সাদী এবং আরিফুজ্জামান তুহিন এস ইউ সি আই (সি)-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রসঙ্গ টেনেছেন। সুতরাং আমাদের এটাও ধরে নেয়া উচিত যে এরা দুজনেই বুর্জোয়া পার্লামেন্ট-সহ অপরাপর প্রশ্নে কমরেড শিবদাস ঘোষের বক্তব্য জানেন। কারো বক্তব্য না জেনে তার সমালোচনা করার মতো অনৈতিক কর্মে নিশ্চয়ই তারা লিপ্ত হন নি।
১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ প্রকাশিত ‘ভারতে বিপ্লবের স্তর নির্ধারণে সি পি এম, সি পি আই ও নকশালপন্থী-মাওবাদীদের সাথে এস ইউ সি আই (সি)-র পার্থক্য কোথায় এবং কেন’ শিরোনামে প্রকাশিত পুস্তিকায় দলটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাষ ঘোষ যে আলোচনা করেছেন, এখানে আমি তার অংশবিশেষ তুলে ধরছি :
“আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি, শান্তিপূর্ণ পন্থায় ও পার্লামেন্টের মাধ্যমে বিপ্লবের চিন্তা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সম্পূর্ণ বিরোধী এবং সংশোধনবাদী চিন্তা। ব্রিটেনের প্রথম যুগের উদীয়মান গণতন্ত্র দেখে মহান মার্কস ঐ দেশে শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের সম্ভাবনার কথা বললেও তিনি অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে এ কথা বলেননি এবং তাঁর জীবদ্দশাতেই ফ্রান্সে সশস্ত্র শ্রমিক অভ্যুত্থান এবং তার ব্যর্থতা দেখে বলেছিলেন, শ্রমিকশ্রেণীকে সশস্ত্র বিপ্লবের দ্বারা ক্ষমতা দখল করে পুরনো বুর্জোয়া রাষ্ট্র ভেঙে নতুন শ্রমিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে। আর লেনিন সাম্রাজ্যবাদী যুগের বৈশিষ্ট্য দেখিয়ে বলেছিলেন, প্রাক-সাম্রাজ্যবাদী যুগের তুলনায় পুঁজিবাদ এখন সমরবাদ ও আমলাতন্ত্রের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ (“more attached to militarism and bureaucracy”)। ফলে তিনি ‘স্টেট অ্যান্ড রেভোলিউশন’ পুস্তকে বলেছিলেন, “বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে খারিজ করে তার স্থানে সর্বহারার রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া অসম্ভব।” (“The supersession of bourgeois state by the proletarian state is impossible without a violent revolution”) লেনিন ১৯১৭ সালে যখন এ কথা বলেছিলেন, তখনও পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যতটুকু গণতন্ত্রের ধ্বংসাবশেষ ছিল, তারপর বহুকাল ধরেই উন্নত-অনুন্নত কোনও পুঁজিবাদী দেশে সেটুকুও নেই, সব দেশে গণতন্ত্রের নামে নানা রূপে ফ্যাসিবাদ চলছে। ফলে সশস্ত্র বিপ্লব আরও অপরিহার্য হয়েছে।”
পুস্তিকায় আরো বলা হয়েছে :
“কোনও সময়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লব হতে পারে কি না – এই প্রশ্নের উত্তরে স্ট্যালিন শেষজীবনে বলেছিলেন, যখন বর্তমান গুটিকয়েক সমাজতান্ত্রিক দেশকে ঘিরে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির দ্বারা পরিবেষ্টনের পরিবর্তে গুটিকয়েক পুঁজিবাদী দেশকে ঘিরে বহু সমাজতান্ত্রিক দেশ গড়ে উঠবে, তখন হয়ত ঐ গুটিকয়েক পুঁজিবাদী দেশের শাসকরা শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা ছেড়ে দিতে পারে। তাঁর এ কথা এখনও প্রাসঙ্গিক। এ প্রশ্নে কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিপ্লব শান্তিপূর্ণ হলেও তা বুর্জোয়া সুপারস্ট্রাকচাররের অঙ্গ পার্লামেন্টের মাধ্যমে হবে না। শান্তিপূর্ণভাবে বুর্জোয়া সুপারস্ট্রাকচার ও পার্লামেন্টকে খারিজ (ডিজলভ্) করে সোস্যালিস্ট সুপারস্ট্রাকচার গড়ে তুলতে হবে। ফলে ভারতের মতো একটা শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশে, সি পি এম-সি পি আই পার্লামেন্টে মেজরিটি হয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের যে তত্ত্ব হাজির করেছেন, তার ফলে তাঁরা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় জাতীয় বুর্জোয়াদের কোনও না কোনও দলের সাথে বোঝাপড়া করে সংসদীয় রাজনীতির খপ্পরে পড়তে বাধ্য এবং বাস্তবে সেটাই বারবার ঘটতে দেখাও যাচ্ছে। জাতীয় বুর্জোয়াদের ‘প্রগতিশীল’ আখ্যা দিয়ে ‘বুর্জোয়া ল্যান্ড লর্ড স্টেট হেডেড বাই বিগ বুর্জোয়াজি’র বিরুদ্ধে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের যে তত্ত্ব তাঁরা সৃষ্টি করেছেন, গোড়াতে সেটা তত্ত্বগত বিভ্রান্তি থেকে হলেও এখন নেতৃত্ব এটাকে সচেতনভাবেই ভোট রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করছেন দলের কর্মীদের চেতনার নিম্ন মানের সুযোগ নিয়ে। ‘প্রগতিশীল জাতীয় বুর্জোয়াদের সাথে ঐক্যে’র এই তত্ত্বটি দেখিয়ে নেতারা প্রয়োজনমতো কখনও জাতীয় বুর্জোয়াদের অমুক দল বা আঞ্চলিক বুর্জোয়াদের সাথে বা প্রয়োজনমতো এই ধরনের অন্য দলের সাথে ঐক্য গড়ে নির্বাচনী ফয়দা তোলার চেষ্টা চালান শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রাম, গণআন্দোলনের পথ ত্যাগ করে।”
বিষয়টা এমন নয় যে ২০১৩ সালেই এস ইউ সি আই (সি) বিপ্লবের সশস্ত্র ধরন (form) সম্পর্কে নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করেছে। এস ইউ সি-র এ অবস্থান তাদের দলের বিপ্লবের লাইনের সাথেই সম্পর্কিত। এ প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব। এখানে আলোচনায় বার বার শিবদাস ঘোষের প্রসঙ্গ এসেছে। বিশেষত আরিফুজ্জামান তুহিন এবং অনুপ সাদী এনেছেন। আগেই বলেছি, আমাদের ধরে নেয়া উচিত, এরা দুজনেই বর্তমান বিতর্কের প্রশ্নে কমরেড শিবদাস ঘোষের অবদান সম্পর্কে জানেন। এবার আমরা সেদিকে নজর ফেরাতে চাই।
৭।। আধুনিক সংশোধনবাদ, শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের তত্ত্ব ও কমরেড শিবদাস ঘোষ
বর্তমান বিতর্কের প্রশ্নে একটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক আলোচনা এখানে করে নেয়া দরকার। বিপ্লব সশস্ত্র হবে, এ প্রশ্নে মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিন-মাও সেতুঙ এর স্পষ্ট মতামত থাকার পরও বিভ্রান্তি তৈরি হল কেন?
১৯৫৬ সালে কমরেড স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভ-চক্র সোভিয়েত পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসে মহান স্ট্যালিনকে আক্রমণ করার পাশাপাশি শোধনবাদী তত্ত্বের অনুপ্রেবশ ঘটালো। ওইসব শোধনবাদী তত্ত্বের একটি হল শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ। ক্রুশ্চেভ-চক্র সেদিন বলেছিল, বর্তমান পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে অনেকগুলি পুঁজিবাদী দেশে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লব সংগঠিত হতে পারে। তারা বলেছিল, বুর্জোয়া পার্লামেন্টকে ‘জনগণের প্রকৃত ইচ্ছার যন্ত্রে’ রূপান্তরিত করার মারফৎ শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এবং আমরা এও জানি যে, সোভিয়েত লাইনকে অন্ধভাবে অনুসরণকারী পার্টিগুলোর সকলেই এই শোধনবাদী তত্ত্বের খপ্পরে গিয়ে পড়েছিল। আমাদের বাংলাদেশের সিপিবির পূর্বসূরী অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি, ভারতের অবিভক্ত সিপিআই ওইসব পার্টিগুলোর মধ্যে পড়ে।
কমরেড মাও সেতুঙ সেদিন সারা দুনিয়ার বিপ্লবী কমিউনিস্টদের নেতা হিসাবে ক্রুশ্চেভ-চক্রের শোধনবাদী তত্ত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। একই সাথে আমাদের এ সত্যেরও স্বীকৃতি দিতে হবে যে, কমরেড মাও সেতুঙ-কে নেতা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েই মহান শিবদাস ঘোষ সেদিন এক এক করে ক্রুশ্চেভ-চক্রের সংশোধনবাদী চিন্তাগুলোর স্বরূপ দুনিয়ার কমিউনিস্টদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। একই সাথে তিনি চীনের পার্টির ভুলগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোরও সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর ওইসব ঐতিহাসিক শিক্ষা (১) সোভিয়েট ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতি কংগ্রেসের রিপোর্ট প্রসঙ্গে [২০ মে ১৯৫৬-তে প্রদত্ত ভাষণ]; (২) ইমরে নাগী [১২ জুলাই ১৯৫৮-তে গণদাবী-তে প্রকাশিত]; (৩) যুদ্ধ ও শান্তি, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি এবং ‘শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ’ সম্পর্কে [জুলাই ১৯৫৯-এ প্রদত্ত ভাষণ]; (৪) সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির স্ট্যালিনবিরোধী পদক্ষেপ প্রসঙ্গে [১৬-১৮ মার্চ ১৯৬১-তে কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক গৃহীত দলিল]; (৫) সোভিয়েট ইউনিয়নে উদ্ভূত কয়েকটি অর্থনৈতিক সমস্যা প্রসঙ্গে [সেপ্টেম্বর ১৯৬২]; (৬) আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের নেতাদের উদ্দেশে একটি আবেদন [১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৩]; (৭) টনকিন সঙ্কট প্রসঙ্গে [নভেম্বর ১৯৬৩]; (৮) চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব [২৭ অক্টোবর ১৯৬৭ প্রদত্ত ভাষণ, এবং ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯-এ কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় গৃহীত]; (৯) নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি [৭ নভেম্বর ১৯৬৭ প্রদত্ত ভাষণ]; (১০) চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েট মিলিটারি হস্তক্ষেপ, রাশিয়ায় শোধনবাদের বিকাশ ও পুঁজিবাদের বিপদ প্রসঙ্গে [২৬ আগস্ট ১৯৬৮ প্রদত্ত ভাষণ]; (১১) চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নবম কংগ্রেস [৩০ আগস্ট ১৯৬৯ প্রদত্ত ভাষণ]; (১২) চীনের কমিউনিস্ট পার্টির দশম কংগ্রেস [৬ নভেম্বর ১৯৭৩ প্রদত্ত ভাষণ] ইত্যাদি রচনায় (এবং অন্যান্য রচনায়ও) ছড়িয়ে আছে।
এখানে সবগুলো বিষয় উল্লেখ না করে শুধু বিতর্কের সাথে সম্পর্কিত অংশটুকুই তুলে ধরছি।
২০ মে ১৯৫৬-তে প্রদত্ত ‘সোভিয়েট ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতি কংগ্রেসের রিপোর্ট প্রসঙ্গে’ ভাষণে তিনি বলছেন :
“ক্রুশ্চেভ প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশের বুর্জোয়া রাষ্ট্র কাঠামোকে নতুন রাষ্ট্র কাঠামো দ্বারা ‘রিপ্লেস’ (পাল্টানোর) যে প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন সে সম্পর্কে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। কিন্তু কী উপায়ে তা করা সম্ভব – শান্তিপূর্ণ উপায়ে, নাকি সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের মারফৎ – এটাই হচ্ছে মূল প্রশ্ন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে কোনও কোনও দেশে সমাজতন্ত্র আনা সম্ভব – এই অভিমত এক সময়ে কার্ল মার্কস ব্যক্ত করেন। কিন্তু সেদিন বাস্তব অবস্থা পুরোপুরি ভিন্ন ছিল। সেদিন পুঁজিবাদী দেশগুলিতে উদীয়মান গণতান্ত্রিক আবহাওয়া দেখে তিনি অনেক আশা করেছিলেন। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে যায়। তাই কমরেড লেনিন স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন যে, সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান ছাড়া, বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধুলিসাৎ করা ছাড়া সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটতে পারে না। একথা আজও প্রযোজ্য। বাস্তব পরিস্থিতিকে সামনে না রেখে কোনও বিষয়ে আলোচনা করা মার্কসীয় নীতি বিরোধী। লেনিনের সময়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের অবশ্য প্রয়োজনীয়তাকে জনসাধারণের মনে দানা বাঁধাতে পরিস্থিতি সম্পর্কে লেনিনের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা বিরাটভাবে কাজ করেছে। অবশ্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর আশেপাশের পুঁজিবাদী দেশগুলোতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লবের সম্ভাবনার কথা লেনিন বলেছিলেন।
শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ক্রুশ্চেভ বলেছেন যে, “যদি পুঁজিবাদীরা রাস্তা ছেড়ে দেয়, কোন প্রকার বলপ্রয়োগ না করে তাহলে কমিউনিস্টরাও বলপ্রয়োগ করবে না। কিন্তু যেহেতু একথা নিশ্চিত যে, তারা বলপ্রয়োগ করবেই তাই আমাদেরও তৈরি থাকা দরকার।” ‘কমিউনিস্টরা রক্তচোষা’ (blood thirsty) এই মিথ্যাপ্রচারের জবাবে তাঁর এই যুক্তি খুবই উপযুক্ত সন্দেহ নেই। তিনি যদি একথা বলেই থামতেন তাহলে ভাল হ’ত। কিন্তু তিনি আরো বলেছেন যে, বর্তমান পরিবর্ততি আন্তর্জাতিক অবস্থায় অনেকগুলি পুঁজিবাদী এবং পূর্বেকার ঔপনিবেশিক দেশে নাকি শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লব সংগঠিত হতে পারে! আমরা এই চিন্তার সাথে একমত হতে পারিনি। মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে একথা আদপেই গ্রহণ করা যায় না। কোন সন্দেহ নেই যে,ক্রুশ্চেভের এই চিন্ত বিভিন্ন দেশের সাম্যবাদী আন্দোলনে শোধনবাদী-সংস্কারবাদী প্রবণতার জন্ম দিতে সাহায্য করবে।”
১৯৫৮ সালের ১২ জুলাই গণদাবী-তে প্রকাশিত ‘ইমরে নাগী’রচনায় তিনি বলছেন,
“... আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট নেতাদের কাছে ও বিশেষ করে আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ কর্মীদের কাছে আমাদের বক্তব্য এই যে, সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতি কংগ্রেসের পর থেকে সাম্যবাদী আন্দোলনের চিন্তাগত ও সংগঠনগত ক্ষেত্রে শোধনবাদ, সংস্কারবাদ ও গণতন্ত্রীকরণের নামে কার্যত বিকেন্দ্রীকরণের যে ঝোঁক অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে, তাই-ই বর্তমান আদর্শগত বিভ্রান্তির জন্য অনেকাংশে দায়ী। ... তদুপরি, ‘বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন রাস্তা’ – এই স্লোগানের আড়ালে গণতন্ত্রের শ্রেণীচরিত্রের বিন্দুমাত্র উল্লেখ না করে, ‘গণতন্ত্র’ ও ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতি’ সম্বন্ধে সাধারণভাবে কথা বলে রাষ্ট্রযন্ত্র ও গণতন্ত্রের শ্রেণীচরিত্র সম্বন্ধে মার্কসবাদের মূল তত্ত্বগত ব্যাখ্যাকে কার্যত অস্বীকার করা হয়েছে। যার দ্বারা গণতন্ত্র সম্পর্কে শ্রেণীনিরপেক্ষ ভ্রান্ত ধারণা গড়তে ও বুর্জোয়া পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা সম্বন্ধে জনগণের মধ্যে অহেতুক মোহ সৃষ্টি করতেই সাহায্য করা হয়েছে।”
১৯৫৯ সালে ‘যুদ্ধ ও শান্তি, শান্তপূর্ণ সহাবস্থান নীতি এবং ‘শান্তিপূর্ণ উপায়ে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ’ শীর্ষক ভাষণে তিনি বলেছিলেন :
“চিন্তার দেউলিয়াপনা সবচেয়ে নগ্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে বুর্জোয়া পার্লামেন্টকে ‘জনগণের প্রকৃত ইচ্ছার যন্ত্রে’ রূপান্তরিত করার মারফৎ শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার ধারণার মধ্যে। ... ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্রের একটি অঙ্গ পার্লামেন্টকে জনগণের প্রকৃত ইচ্ছার যন্ত্রে রূপান্তরিত করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার’ তত্ত্ব সম্পূর্ণ অবাস্তব এবং এর সাথে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের কোনও সম্পর্ক নেই।”
কমিউনিস্টরা পার্লামেন্টে যায় পার্লামেন্ট সম্পর্ক জনগণের মোহ দূর করার এবং বাইরের শ্রেণীসংগ্রাম ও গণআন্দোলনকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে। মার্কস থেকে শিবদাস ঘোষের এটাই শিক্ষা। কমরেড শিবদাস ঘোষ এ সম্পর্কে আরো কিছু দিক আমাদের সামনে রেখে গেছেন।
১৯৫৭ সালে কেরালায় সিপিআই মেজরিটি পেয়ে সরকার গঠন করে। কিন্তু এই সরকারই ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা’র নামে ধর্মঘটী শ্রমিকদের উপর গুলি চালিয়েছিল। সে সময় কমরেড শিবদাস ঘোষ একজন সৃজনশীল মার্কসবাদী চিন্তানায়ক হিসাবে আমাদের সামনে কিছু অমূল্য শিক্ষা তুলে ধরলেন। তিনি বললেন, ঘটনাচক্রে কোন বিপ্লবী দল এককভাবে কিংবা ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে অন্যান্য বিরোধী দলের সাথে মিলিত যুক্তফ্রন্ট মেজরিটি পেলে কমিউনিস্টরা কি করবে? তারা ক্ষমতা ছেড়ে দেবে? না। মেজরিটি পেল অবশ্যই তারা দায়িত্ব পরিত্যাগ করবে না। সরকার গঠন তারা করবে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য হবে, সরকারে থেকে বুর্জোয়া রাষ্ট্র ও সংবিধানের সীমাবদ্ধতা ও শ্রেণীচরিত্র উদ্ঘাটন করা, বাইরের শ্রেণীসংগ্রাম ও গণআন্দোলনকে তীব্রতর করা এবং তা করার জন্য প্রয়োজনে সংঘাতেও যেতে হবে। এটাই সরকার পরিচালনার মূল লক্ষ্য হবে। তাতে যদি বুর্জোয়াশ্রেণী/শাসকশ্রেণী সরকার ভেঙে দেয়, তাতে ক্ষতি নেই। কারণ তার দ্বারা জনগণের সামনে রাষ্ট্রের শ্রেণীচরিত্রই উদ্ঘাটিত হবে। ১৯৬৭ সালের ১৫ আগস্ট এক ভাষণে কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন :
“আমি বলি, এই যে ‘মিথ’টা (মোহটা) – গভর্নমেন্টে গেলেই সব হয় – গভর্নমেন্টের গদিতে থেকেই তাকে ভেঙে দিতে হবে। গভর্নমেন্টের গদিতে থেকে ‘কনস্টিটিউশন’ (সংবিধান) অনুযায়ী যতটুকু ক্ষমতা, সেই ক্ষমতা জনস্বার্থে বুরোক্রেসিকে পুরোপুরি কন্ট্রোল করার জন্য যুক্তফ্রন্ট সরকারকে সাহসের সাথে প্রয়োগ করতে হবে। সেখানে ব্যুরোক্রেসির চাপে কোনমতেই নতি স্বীকার করা চলবে না। অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে পুলিশকে সরকারের প্রগতিশীল নীতি অনুযায়ী চলতে বাধ্য করতে হবে। ন্যায্য গণআন্দোলনগুলোকে পুলিশি হস্তক্ষেপ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে হবে। এইসব নীতিগুলো অনুসরণের ক্ষেত্রে সরকারের গদিতে আমরা কতদিন আসীন থাকতে পারব, কি পারব না – এসব কোন প্রশ্নের দ্বারাই বিভ্রান্ত হলে চলবে না। মালিকশ্রেণী, পুলিশ, আমলাতন্ত্র ও কেন্দ্রীয় সরকারের যত চাপই থাকুক না কেন, যুক্তফ্রন্ট সরকার যদি এই কাজগুলো করতে পারে তাহলেই সত্যিকারের জনস্বার্থের অনুকূলে কাজ করা হবে। অন্যথায় জনতার আস্থাকে পদদলিত করে শেষপর্যন্ত জনস্বার্থের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।”