somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বুর্জোয়া পার্লামেন্ট সম্পর্কে কমিউনিস্টদের দৃষ্টিভঙ্গী কী হবে?

২১ শে জুন, ২০১৪ দুপুর ১২:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১।।
একটা ভয়াবহ রকমের বৈষম্য, নিপীড়ন ও বঞ্চনামূলক সমাজ ও রাষ্ট্রে আমরা বসবাস করছি। বিবেকবান ও অনুভূতিপ্রবণ মানুষ মাত্রেই এর থেকে নিষ্কৃতি ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করছেন। অন্তর্গত সেই যন্ত্রণা নিয়ে মানুষ পথের সন্ধান করছে, মুক্তির উপায় খুঁজে ফিরছে। নিজেরা ভাবছেন, অন্যকেও ভাবিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন। এভাবেই মানুষ একে অপরের কাছে আসছে, সংগঠিত হচ্ছে। সংগ্রামের ধারায় সংগ্রামী মানুষের মধ্যে নিবিড় ঐক্য ও বন্ধন গড়ে উঠছে। আবার কখনো মতভিন্নতা, মতপার্থক্যও তৈরি হচ্ছে। পুনরায় সেই মতপার্থক্য দূর করার চেষ্টাও মানুষ করছে।
বর্তমান দুনিয়ায় মানবমুক্তির একমাত্র যৌক্তিক ও নৈতিক আদর্শ মার্কসবাদ, বিপ্লব ছাড়া মুক্তি নেই, সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ ছাড়া মুক্তি অসম্ভব – এই সত্য আমরা যুক্তিতে-আবেগে-বিশ্বাসে ধারণ করি। আমরা কমিউনিজমের আদর্শে বিশ্বাস করি। কিন্তু মতপার্থক্য আমাদের মধ্যে হয়। নীতিগত অবস্থান নিয়ে মতভিন্নতা হয়, আদর্শিক উপলব্ধি নিয়ে মতভিন্নতা হয়, কর্মকৌশল নিয়ে মতভিন্নতা হয়। এই মতভিন্নতা নিয়েও আমরা লড়াই করি – একে অপরের ভুল চিন্তার বিরুদ্ধে লড়ি।
নিজেদের মধ্যকার এইসব মতপার্থক্য-মতভিন্নতা দূর করার লড়াই অত্যন্ত জরুরি একটি কাজ – কমিউনিস্টদের এটা একটা নৈতিক দায়িত্বও বটে।
বর্তমান বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ-বিপ্লবের জন্য যে লড়াই চলছে – তা মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। অবশ্য শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্ব পরিসরেও কমিউনিস্ট আন্দোলনের চিত্র নৈরাশ্যজনক বললে ভুল বলা হবে না। এই চিত্র কমসে-কম এ-সত্যটুকু আমাদের সামনে তুলে ধরছে যে, আমাদের অর্থাৎ কমিউনিস্টদের বিরাট ও বিপুল ত্রুটি-ঘাটতি-বিচ্যুতির পরিণতেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের বর্তমান দুর্বল চেহারা। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, আমরা এ নিয়ে ভাবিত নই। এমনকি নিজেদের অতীত সংগ্রামের মূল্যায়ন এবং শিক্ষাগুলো খুঁজে বের করা ও তুলে ধরার ক্ষেত্রেও যেন আমাদের প্রবল অনীহা।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন কমিউনিস্ট আন্দোলনের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক ত্রুটি-বিচ্যুতি-ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে নিরন্তর আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক এবং প্রধানত আত্মসমালোচনা একেবারে গোড়ার কাজ হিসেবেই বিবেচিত হওয়া উচিত। শুধু জাতীয় ক্ষেত্রেই নয় – আন্তর্জাতিক পরিসরেও।

২।।
বুর্জোয়া পার্লামেন্ট এবং নির্বাচন সম্পর্কে কমিউনিস্টদের নীতি কি হবে – এটি বেশ পুরনো একটি বিতর্ক। একেবারে মার্কস-এঙ্গেলসের সময় থেকেই এ বিতর্ক শুরু। কমিউনিস্টরা বুর্জোয়া পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি না, বুর্জোয়া পার্লামেন্টের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব কি না – এগুলিই হল বির্তকের মূল প্রশ্ন। এ বিতর্ক মার্কস-এঙ্গেলস-কে করতে হয়েছে, কমরেড লেনিন-কে করতে হয়েছে, কমরেড স্ট্যালিন-কে করতে হয়েছে। আজকের দিনেও এ বিকর্ত চালু আছে।
মূলত এ প্রসঙ্গটি ধরেই সম্প্রতি ফেসবুকে একটি বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে। (Click This Link) আনিস রায়হান এই বিতর্কে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করেছেন আমাদের দল বাসদ (কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটি) এবং আমাদের বন্ধুপ্রতীম দল ভারতের এস ইউ সি আই (সি)-কে। তার ওই লেখাটি চোখে পড়লেও সেদিকে মনযোগ দিতে পারি নি। ফলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হওয়ার সুযোগও পাই নি। বেটার লেট দ্যান নেভার।
আনিস রায়হান তার লেখায় মূল যে সমালোচনাটি করেছেন তাহলো সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ কোনো কমিউনিস্ট পার্টির কাজ হতে পারে না। ফলে যারাই বুর্জোয়া পার্লামেন্টের নির্বাচনে যায় তারা সুবিধাবাদী এবং বিপ্লবের লাইন পরিত্যাগকারী। তার ওই লেখার সূত্র ধরে আরো কয়েকজন সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছেন, যার মধ্যে আছেন অনুপ সাদী এবং আরিফুজ্জামান তুহিন। আনিসের মতের বিপরীতে ফাহিমা কানিজ লাভা এবং রঞ্জন দে কিছু যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন ।
আনিস রায়হানের লেখার পুরোটাই, এমনকি উনার করা মন্তব্যগুলোসহ তুলে দিতেই আমি আগ্রহী ছিলাম। তাতে করে অন্ততপক্ষে নতুন পাঠকরা আনিসের যুক্তির ধারা ও মনোভাবটা বুঝতে পারতেন। কিন্তু সেটা করতে গেলে লেখাটা অহেতুক বড় হয়ে যাবে। আমি তার লেখার মূল অংশটুকু তুলে ধরছি।
আনিস বলছেন :
“কিন্তু এই বিতর্ক এক কদম আগানোর আগেই প্রসঙ্গ এসে যায়, লেনিন সংসদে গিয়েছিলেন। যে যুক্তি এখানকার এসইউসিআই বা বাসদও দিয়ে থাকে। কথা হচ্ছে, আজকের পরিণত বুর্জোয়ারা আর লেনিনের আমলের অপরিণত বুর্জোয়ারা এক নন। লেনিনকে নির্বাসন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ভারতের চারু মজুমদার আর আমাদের দেশের সিরাজ সিকদারসহ বিভিন্ন দেশে অসংখ্য বিপ্লবীকে কিন্তু জেলেও ভরা হয়নি। স্রেফ কচুকাটা করা হয়েছে। এটা হচ্ছে বুর্জোয়াদের বিকাশ এবং বুর্জোয়া রাষ্ট্র ও বুর্জোয়া ক্ষমতার সঙ্গে কমিউনিস্টদের দ্বন্দ্বের অগ্রগতির ফলাফল। আজকের যুগে এজন্যই আমরা দেখি, সংসদমুখী কোনো দলই আর বিপ্লবকে প্রতিনিধিত্ব করে না। তারা রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিয়ে অভিজাত বিপ্লবীতে পরিণত হয়। বিপ্লব সংসদে না কমরেড, ওটা শ্রেণীর মধ্যে।”
“আজকের যুগে, বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীলতা যেখানে সর্বব্যাপী রাজত্ব করছে সেখানে বিপ্লবের লাইন একটাই - সশস্ত্র সংগ্রাম। এখানে সংসদে যাওয়াটা হচ্ছে পার্টিকে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়াদের মুঠোর মধ্যে দিয়ে আসা, ধ্বংস করা।এটা আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে পাচ্ছি। বিপ্লবের লড়াই কেবল সশস্ত্র সংগ্রামের ধারাতেই আজ দুনিয়াব্যাপী টিকে আছে।”
“বুর্জোয়াদের খোয়াড়টা নিয়ে আমাদের আগ্রহ নেই। বিদ্বেষ আছে। ওখানে আমরা বিপ্লবের ক্ষতি হওয়া ছাড়া আর কিছু দেখি না। আমি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছি, আজকের যুগে সংসদমুখীতা বিপ্লব ত্যাগেরই নামান্তর।”
“লেনিনের কনটেক্সট ও আজকের কনটেক্সটের পার্থক্য উল্লেখ করে আজকের যুগের বুর্জোয়া প্রবণতাও ব্যাখ্যা করেছি। ভোট হলে দেখা যাবে, জনগণ এদেশে শরিয়া আইনের পক্ষে রায় দিতে পারেন। জনগণকে রাষ্ট্র ভুল শিক্ষা দেয়। মিথ্যার মধ্যে ডুবিয়ে রাখে।”
“আমরা মনে করি, নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে জনগণকে রাষ্ট্র ভুল শিক্ষায় শিক্ষিত করে ফেলতে পারে। এ কারণেই সমষ্টি যা চায়, আমরা তারই সমর্থন করি না। আমরা চূড়ান্তভাবে কোনটা জনগণের পক্ষে যায় সেটার পক্ষে দাঁড়াই। সাময়িকভাবে জনগণ আমাদের পাশে না থাকলেও সেক্ষেত্রে ক্রমশ তারা এগিয়ে আসবে। এ কারণেই লেনিনবাদে পার্টিকে এক কদম অগ্রসর বা ভ্যানগার্ড বলা হয়। পার্টি জনগণের পেছনে থাকে না। ... পার্টি মূলত জনগণের স্বার্থের রক্ষক। সুতরাং বুর্জোয়া সংসদ - যেখান থেকে শোষণ, বৈষম্য প্রয়োগ হয়, সেখানে যাওয়া কমিউনিস্টদের কাজ নয়। এক সময় যাওয়া যায়, তা কেবল তখনই যখন শক্তির ভারসাম্যে কমিউনিস্টরা এগিয়ে থাকে। লেনিন তার আমলের বুর্জোয়াদের অপরিণত সাব্যস্ত করেই সেটাকে কাজে লাগাতে গিয়েছিলেন। এখনকার সময়টা তা থেকে আলাদা।”

আনিসের মূল যুক্তি হল, লেনিনের সময়ের কনটেক্সট (পরিস্থিতি বা অবজেকটিভ কন্ডিশন) আর বর্তমান সময়ের কনটেক্সট আলাদা। কি সেই কনটেক্সট? আনিসের ভাষ্যে, সেই কনটেক্সট হল সেদিন বুর্জোয়ারা ছিল অপরিণত, আর আজ বুর্জোয়ারা পরিণত, বুর্জোয়া রাষ্ট্র পরিণত। আজকের বুর্জোয়ারা প্রতিক্রিয়াশীল। এখন বিপ্লবীদের কচুকাটা করা হচ্ছে। আজকের বুর্জোয়া রাষ্ট্র জনগণকে ভুল শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছে। ফলে নির্বাচনে অংশ নেয়া মানে হল বুর্জোয়াদের দ্বারা ভুল শিক্ষায় শিক্ষিত জনগণের চাওয়ার পেছনে ছোটা।
আমি ধরে নিচ্ছি, আনিস যেহেতু লেনিনের প্রসঙ্গ টেনে এনে আলোচনা করেছেন, সুতরাং তিনি পার্লামেন্ট নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়া প্রশ্নে লেনিনের সমস্ত যুক্তিগুলোই জানেন এবং সেগুলিকে তিনি খণ্ডন করেছেন। একই কথা খাটে লেনিন-পূর্ববর্তী মার্কস-এঙ্গেলস এবং লেনিন পরবর্তী মাও সেতুঙ-এর যুক্তিগুলোর বিষয়েও। তিনি কি করতে পেরেছেন, কতটা করতে পেরেছেন সেটাই আমাদের বিচার্য।

৩।।
বুর্জোয়া পার্লামেন্ট সম্পর্কে মার্কস ও এঙ্গেলস
আগেই বলেছি, কমিউনিস্টরা বুর্জোয়া পার্লামেন্ট ও বুর্জোয়া নির্বাচনকে কীভাবে বিচার করবে এ বিতর্ক মার্কস-এঙ্গেলসের সময় থেকেই ছিল।
কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো হলো সর্বহারাশ্রেণীর জন্য মার্কস-এঙ্গেলসের রেখে যাওয়া অমর শিক্ষা ও পথনির্দেশ। মেনিফেস্টো-তে বলা হয়েছে, “শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবে প্রথম ধাপ হল প্রলেতারিয়েতকে শাসকশ্রেণীর পদে উন্নীত করা, গণতন্ত্রের সংগ্রামে জয়যুক্ত হওয়া।” মেনিফেস্টোর অন্যত্র সুস্পষ্ট ঘোষণা : “অতীত ইতিহাসের প্রতিটি আন্দোলন ছিল সংখ্যাল্পের দ্বারা অথবা সংখ্যাল্পের স্বার্থে আন্দোলন। প্রলেতারীয় আন্দোলন হল বিরাট সংখ্যাধিক্যের স্বার্থে বিপুল সংখ্যাধিক্যের আত্মসচেতন স্বাধীন আন্দোলন।”
১৮৫০ সালের মার্চ মাসে ‘Address to the Communist League’ রচনায় মার্কস বলছেন :
“Even when there is no prospect whatsoever of their being elected, the workers must put up their own candidates in order to preserve their independence, to count their forces, and to bring before the public their revolutionary attitude and party standpoint. In this connection they must not allow themselves to be seduced by such arguments of the democrats as, for example, that by so doing they are splitting the democratic party and making it possible for the reactionaries to win. The ultimate intention of all such phrases is to dupe the proletariat. The advance which the proletarian party is bound to make by such independent action is indefinitely more important than the disadvantage that might be incurred by the presence of a few reactionaries in the representative body.” অর্থাৎ মার্কসের মূল যুক্তিটা হল, নির্বাচনে বিজয়ের কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও শ্রমিকরা নির্বাচনে তাদের প্রতিনিধিদের দাঁড় করাবে তাদের নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা, নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের যাচাই এবং জনগণকে তাদের বিপ্লবী উদ্দেশ্য ও দলীয় অবস্থানের পেছনে জড়ো করার উদ্দেশ্যে।
সাধারণ এই পথনির্দেশ থাকার পরও বিশেষ পরিস্থিতিকে বিচার-বিশ্লেষণ করা ও কর্তব্য নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে তৎকালীন বামপন্থীদের নানা ধরনের বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। ১৮৭৫ সালে জার্মানিতে জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি নির্বাচনী সুবিধার দিকে তাকিয়ে লাসালেপন্থীদের সাথে ঐক্য করার জন্য গোথা ইউনিটি কংগ্রেসে গৃহীত কার্যক্রমে মার্কসবাদের মৌলিক তত্ত্বকে বিসর্জন দিয়ে নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আপোষ করে। এই ঘটনা মার্কস-এঙ্গেলকে গভীরভাবে ব্যথা দেয় এবং এর তীব্রতম নিন্দা করে মার্কস ‘ক্রিটিক অব দি গোথা প্রোগ্রাম’ রচনাটি প্রকাশ করেন। শুধু তাই নয়, ১৮৭৯’র শুরুর দিকে জার্মান সোস্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি বা এসপিডি (SDP)-র নেতাদের উদ্দেশ্যে এক সার্কুলার লেটারে মার্কস-এঙ্গেলস পার্লামেন্টারি রোগের আক্রমণ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন ("infected with the parliamentary diseases, believing that, with the popular vote, the Holy Ghost is poured upon those elected.")। এই সার্কুলার চিঠিতে মার্কস ও এঙ্গেলস পরিষ্কার ভাষায় এই হুঁশিয়ারী দেন যে, বিপ্লবী নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আপোষকারী জার্মান পার্টির সাথে তাদের সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা তাঁরা প্রকাশ্যে ঘোষণা করবেন এবং এই সিদ্ধান্তও ঘোষণা করবেন যে অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও অনেক আশা নিয়ে যে প্রথম আন্তর্জাতিক তারা গড়ে তুলে ছিলেন, তাকে শোধনবাদী ও সুবিধাবাদীদের হাতে ছেড়ে দেয়ার চেয়ে ভেঙ্গে দেয়াই শ্রেয়। [ * Marx and Engels, "Circular Letter to August Bebel, Wilhelm Liebknecht, Wilhelm Bracke and others," Collected Works, Vol. 27, Engels: 1890—1895 (New York: International Publishers, 1990) p. 261.]
এসপিডি নেতা এদুয়ার্দ বার্নেস্তাইন (Eduard Bernstein) প্রমুখরা তখন এই তত্ত্ব প্রচার করতে শুরু করেছিলেন যে, আন্দোলনের প্রয়োজন নেই, বিপ্লবের প্রয়োজন নেই, সংস্কারের মাধ্যমেই বর্তমান ব্যবস্থাকে পাল্টে দেয়া যাবে। মার্কস এবং এঙ্গেলস বার্নেস্তাইনের এই তত্ত্বেরও তীব্র সমালোচনা করেন।
কমিউনিস্ট আন্দোলনে এ ধরনের সুবিধাবাদের বিপদের উল্টো দিকে ছিল আরেক ধরনের বিপদ – ব্ল্যাঙ্কিবাদ। মার্কস-এঙ্গেলস এই ব্ল্যাঙ্কিবাদের বিরুদ্ধেও লড়াই করেছেন : “চকিত আক্রমণ, অচেতন জনতার শীর্ষে সচেতন একটা ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু নেতৃত্বে পরিচালিত বিপ্লবের দিন শেষ হয়ে গেছে। সমাজ সংগঠনের পরিপূর্ণ রূপান্তরই যেখানে প্রশ্ন, সেখানে জনসাধারণকে নিজেদেরই তার মধ্যে সামিল করতে হবে, আগেই তাদের উপলব্ধি করে নিতে হবে প্রশ্নটা কী, কায়মনোবাক্যে কীসের জন্য তারা নামছে। গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছে।” (মার্কস রচিত ‘ফ্রান্সে শ্রেণীসংগ্রাম’ বইয়ের ১৮৯৫ সালের ভূমিকায় এঙ্গেলস)
এই ব্লাঙ্কিপন্থীদের প্রসঙ্গ পরেও আলোচিত হবে।

৪।।
লেনিনের যুক্তিগুলো কি ছিল?
কেরেনেস্কি সরকার যখন ক্ষমতা দখল করে সামরিক একনায়কত্ব কায়েম করেছে তখন ২ আগস্ট ১৯১৭-তে প্রকাশিত ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি’ শীর্ষক রচনায় কমরেড লেনিন বলছেন, “রুশ বিপ্লবের শান্তিপূর্ণ বিকাশের সকল আশা চিরতরে মিলিয়ে গেছে। ...” কিন্তু তখনও তিনি বলছেন,
“৪। শ্রমিক পার্টিকে বৈধ কর্মকাণ্ড ছেড়ে না দিয়ে, কিন্তু কখনও মুহূর্তের জন্যেও তাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব না দিয়ে অবৈধ কাজের সাথে বৈধ কাজের সমন্বয় সাধন করতে হবে, ১৯১২-১৯১৪ কালপর্যায়ে যেমনটা করা হয়েছিল।
বৈধ কাজের একটা ঘণ্টাও হাতছাড়া করা চলবে না। কিন্তু কোন নিয়মতান্ত্রিক কিংবা ‘শান্তিপূর্ণ’ মোহ পোষণও নয়। লিফলেট ইত্যাদি প্রকাশের জন্য বেআইনি সংগঠন কিংবা সেল গড়ে তোলা হোক সর্বত্র, এখনই। অবিলম্বে, অটল হয়ে, দৃঢ়ভাবে সংগঠিত করা হোক একেবারে সর্বত্র।
১৯১২-১৯১৪ কালপর্বে আমরা যেমনটা করেছিলাম সেভাবেই কাজ চলুক, তখন দুমা, বিমা সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন ইত্যাদিতে বৈধ ঘাঁটিগুলো না হারিয়েই আমরা তার সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লব আর সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সাহায্যে জারতন্ত্র উচ্ছেদ করার কথা আমরা বলতে পারতাম।”
১৯ সেপ্টেম্বর ১৯১৭ ‘৩ নং রাবোচায়ে পুৎ’-এ প্রকাশিত ‘আপস প্রসঙ্গে’ রচনায় লেনিন বলছেন :
“ব্লাঙ্কিপন্থী কমিউনিস্টদের ঘোষণাপত্রের (১৮৭৩) সমালোচনায় এঙ্গেলস তাদের “কোন আপস নয়!” উক্তিটাকে উপহাস করে ঠিকই করেছিলেন।*৭ (৭ দ্র: ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস – কমিউনের ব্ল্যাঙ্কিবাদী দেশান্তরীদের কর্মসূচি) তিনি ওই উক্তিটাকে ফাঁকা বুলি বলেছিলেন, কেননা অনেক সময় পরিস্থিতির কারণে কোন সংগ্রামী পার্টির উপর আপোস চেপে বসে, সেটা অপরিহার্য হয়ে পড়ে, আর পাওনাটা ‘অংশে অংশে গ্রহণ করতে’ চূড়ান্তভাবে অস্বীকার করাটা একটা উদ্ভট ব্যাপার বৈকি।*৮ (৮ দ্র: ১৮৯৪-এর ২৬ জানুয়ারি ফিলিপ্পো তুরাতির কাছে এঙ্গেলসের লেখা চিঠি) সব ধরনের আপস বর্জন করা সম্ভব নয়, এটা কেবলমাত্র ঘোষণা করাই একটা প্রকৃত বিপ্লবী পার্টির কাজ হতে পারে না, বরং প্রকৃত কাজটা হলো, যেগুলি অপরিহার্য এমন সকল ধরনের আপসের ভেতর দিয়ে চলার সময়েও নিজেদের নীতিগুলির প্রতি, নিজের শ্রেণীর প্রতি, নিজের বিপ্লবী উদ্দেশ্য বা কর্তব্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা, বিপ্লবের পথ প্রস্তুত করা এবং বিপ্লবে বিজয়লাভের জন্যে জনগণকে শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়ার কাজগুলির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারা।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তৃতীয় এবং চতুর্থ ডুমায় অংশগ্রহণ করতে সম্মত হওয়া ছিল একটা আপোস, সেটা ছিল সাময়িকভাবে বিপ্লবী দাবি-দাওয়া ত্যাগ করা। কিন্তু এটা ছিল আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া আপোস, কেননা তখন বিভিন্ন শক্তির মধ্যে আপেক্ষিক সম্পর্ক এমন ছিল যে, ওই কালপর্বে আমাদের পক্ষে গণ-বিপ্লবী সংগ্রাম তখনকার মতো চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছিল, আর সুদীর্ঘকাল ধরে এই সংগ্রামের প্রস্তুতির জন্যে অমন একটা ‘শুয়োরের খোয়াড়’-এর ভেতরে অবস্থান করেই আমাদের কাজ করতে পারাটাই আবশ্যক ছিল। প্রশ্নটাকে এভাবে নেওয়া পার্টি হিসেবে বলশেভিকদের জন্য পুরোপুরিই সঠিক ছিল, ইতিহাস থেকেই সেটা প্রমাণিত হয়েছে।”

লেনিন বুর্জোয়া পার্লামেন্টকে ‘শুয়োরের খোঁয়াড়’ হিসাবে অভিহিত করার পরও বিপ্লবের আগে বুর্জোয়া পার্লামেন্টে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এমনকি বিপ্লবের পরেও ১৯১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত বুর্জোয়া পার্লামেন্ট টিকিয়ে রেখেছিলেন। লেনিন এ-কাজ করেছিলেন কি বলশেভিকদের ‘খোঁয়াড়ের শুয়োর’ বানানোর উদ্দেশ্যে? এমন কথা নিশ্চয়ই আমাদের বন্ধুরা বলবেন না। বুর্জোয়া সংসদকে বিচারের প্রশ্নে লেনিনের সমগ্র বক্তব্য ও যুক্তিগুলো বাদ দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে শুধু এ কথাটুকু অনেকে উল্লেখ করেন। এদের অবস্থা হল তাদের মতো যারা মার্কসের বক্তব্যের খণ্ডিত উল্লেখ করে বলেন যে মার্কস ধর্মকে জনগণের জন্য আফিম বলেছেন। অথচ তারা ভুলে যান যে এ-কথার আগে-পরে মার্কস বলেছিলেন, ধর্ম হচ্ছে হৃদয়হীন পৃথিবীর হৃদয়, নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাস।
বস্তুত ক্ষমতা দখলের পূর্বে বিদ্যমান বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অসারতা, নির্বাচনের অসারতা প্রমাণ করা, পার্লামেন্ট ও বুর্জোয়া গণতন্ত্র সম্পর্কে জনগণের মোহ দূর করা, সর্বহারাশ্রেণীর সংগ্রামকে সংখ্যাগরিষ্ঠের সংগ্রামে পরিণত করার ঐতিহাসিক প্রয়োজন থেকে। এ বিষয়ে লেনিন ১৯২০ সালে তদানীন্তন জার্মানির একদল অতি বাম নেতার সমালোচনা করে লেনিন ‘লেফট উইং কমিউনিজম : অ্যান ইনফ্যান্টাইল ডিসঅর্ডার’ (Left-Wing Communism: an Infantile Disorder) রচনায় বলছেন :
“১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসের রুশ বুর্জোয়া পার্লামেন্ট-কনস্টিটিউয়েট অ্যাসেম্বলির নির্বাচনে আমরা অংশ নিয়েছিলাম। আমাদের কৌশল কি সঠিক ছিল না? যদি না হয়, তাহলে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট ও স্বচ্ছভাবে প্রমাণ করতে ও চিহ্নিত করতে হবে, কারণ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের যথাযথ পথনির্দেশ হাজির করার জন্যই এটা অত্যন্ত দরকারী। ... ১৯১৭’র ঐ সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে রাশিয়ায় পার্লামেন্টকে রাজৈনতিকভাবে অচল বলে বিবেচনা করতে পারার অধিকার আমাদের রাশিয়ার বলশেভিকদের কি পশ্চিমের অন্যান্য যে-কোনো দেশের চেয়ে বেশি ছিল না? অবশ্যই ছিল ... তৎসত্ত্বেও সর্বহারার রাজনৈতিক বিজয়ের পূর্বে ও পরে উভয় সময়েই বলশেভিকরা কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ... এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, এমনকী সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের বিজয়ের কয়েক সপ্তাহ পূর্বে এবং এমনকী ঐ বিজয়লাভের পরেও, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পার্লামেন্টে অংশ নেওয়া বিপ্লবী সর্বহারার কোনও ক্ষতি তো করেই নি, বরং এই বুর্জোয়া পার্লামেন্ট কেন খারিজ হওয়ার যোগ্য, সেকথা পশ্চাদপদ জনগণের সামনে প্রমাণ করার কাজকে তা সহজ করে দেয়, এবং বুর্জোয়া পার্লামেন্টারিজম যে প্রক্রিয়ার দ্বারা ‘রাজনৈতিকভাবে অচল’ হয়ে যায়, সেই প্রক্রিয়াকেও তা ত্বরান্বিত করে। এই সত্য মেনে নিতে অস্বীকার করলে সর্বোত্তম ভুল করা হবে এবং মুখে আন্তর্জাতিকতাবাদকে গ্রহণ করলেও বাস্তব কাজের ক্ষেত্রে তার থেকে পিছিয়ে যাওয়া হবে।”*৪ (৪ “We took part in the elections to the Constituent Assembly, the Russian bourgeois parliament in September-November 1917. Were our tactics correct or not? If not, then this should be clearly stated and proved, for it is necessary in evolving the correct tactics for international communism. ... In September-November 1917, did we, the Russian Bolsheviks, not have more right than any Western Communists to consider that parliamentarianism was politically obsolete in Russia? Of course we did ... Nevertheless, the Bolsheviks did not boycott the Constituent Assembly, but took part in the elections both before and after the proletariat conquered political power. ... it has been proved that, far from causing harm to the revolutionary proletariat, participation in a bourgeois-democratic parliament, even a few weeks before - the victory of a Soviet republic and even after such a victory, actually helps that proletariat to prove to the backward masses why such parliaments deserve to be done away with; it facilitates their successful dissolution, and helps to make bourgeois parliamentarianism "politically obsolete". To ignore this experience, while at the same time claiming affiliation to the Communist International, which must work out its tactics internationally (not as narrow or exclusively national tactics, but as international tactics), means committing a gross error and actually abandoning internationalism in deed, while recognising it in word.
ওই রচনায় কমরেড লেনিন আরো বলছেন :
“জার্মানির কমিউনিস্টদের কাছে পার্লামেন্টারি রাজনীতি অবশ্যই ‘রাজনৈতিকভাবে অচল’ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ... আমরা যেন কখনই একথা মনে না করি যে, আমাদের কাছে যা অচল হয়ে গিয়েছে, তা শ্রেণীর জন্যও অচল হয়ে গিয়েছে ... জনগণের জন্য অচল হয়ে গিয়েছে। ... নিজ শ্রেণীর পশ্চাদপদ অংশকে এবং অনগ্রসর, নিপীড়িত, অজ্ঞ কৃষক জনগণকে জাগানোর ও সচেতন করার উদ্দেশ্যেই সর্বহারার বিপ্লবী দলের অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে পার্লামেন্টারি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা, পার্লামেন্টের ভিতরে সংগ্রামে অংশ নেওয়া। যতদিন না আপনারা বুর্জোয়া পার্লামেন্ট এবং বাকি প্রত্যেক ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠানকে বাতিল করতে সক্ষম হচ্ছেন, ততদিন আপনাদের অবশ্যই ঐসব প্রতিষ্ঠানের ভিতরে থেকে কাজ করতে হবে।” (“For the communists in Germany, parliamentarism is of course ‘politically obsolete’, but ... we must not regard what is obsolete for us as being obsolete for the class, as being obsolete for the masses ... that participation in parliamentary elections and in the struggle in parliament is obligatory for the party of the revolutionary proletariat precisely for the purpose of educating the backward starta of its own class, precisely for the purpose of awakening and enlightening the undeveloped, downtrodden, ignorant peasant masses. As long as you are unable to disperse the bourgeois parliament and every other type of reactionary institution, you must work inside them ...”)
এ কথাগুলোই তিনি আরো বিস্তৃত করে বলছেন, যা কমরেড রঞ্জন দে আনিস রায়হানের সাথে বিতর্কে উদ্ধৃত করেছিলেন :
“Should we Participate in Bourgeois Parliaments? It is with the utmost contempt—and the utmost levity—that the German "Left" Communists reply to this question in the negative. Their arguments? In the passage quoted above we read:
"... All reversion to parliamentary forms of struggle, which have become historically and politically obsolete, must be emphatically rejected" This is said with ridiculous pretentiousness, and is patently wrong. "Reversion" to parliamentarianism, forsooth! Perhaps there is already a Soviet republic in Germany? It does not look like it! How, then, can one speak of "reversion"? Is this not an empty phrase?
Parliamentarianism has become "historically obsolete". That is true in the propaganda sense. However, everybody knows that this is still a far cry from overcoming it in practice. Capitalism could have been declared—and with full justice—to be "historically obsolete" many decades ago, but that does not at all remove the need for a very long and very persistent struggle on the basis of capitalism. Parliamentarianism is "historically obsolete" from the standpoint of world history, i.e., the era of bourgeois parliamentarianism is over, and the era of the proletarian dictatorship has begun. That is incontestable. But world history is counted in decades. Ten or twenty years earlier or later makes no difference when measured with the yardstick of world history; from the standpoint of world history it is a trifle that cannot be considered even approximately. But for that very reason, it is a glaring theoretical error to apply the yardstick of world history to practical politics.”
এখানে লেনিনের যুক্তিগুলো কি? জার্মান অতি-বাম কমিউনিস্টরা বলেন যে পার্লামেন্টারিজমের সব ধরনের রূপ, সংগ্রামের সংসদীয় ফর্ম-ই ‘ঐতিহাসিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে বাতিল হয়ে গেছে’, সুতরাং একে সজোরে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। লেনিন বলছেন, পার্লামেন্টারিজম ঐতিহাসিকভাবে বাতিল হয়ে গেছে, এ কথাটা প্রচারের দিক থেকে সত্য। কিন্তু সকলেই জানেন যে বাস্তব ব্যবহারিক এবং প্রায়োগিক স্তরে এটাকে সত্য হিসাবে প্রতিভাত করা এখনো এক বহু দূরের আকাঙ্ক্ষা মাত্র (দিল্লী দূর-অস্ত)। পুঁজিবাদকেও তো বহু যুগ আগেই সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গতভাবে ‘ঐতিহাসিকভাবে বাতিল’ বলে ঘোষণা করা যায়। কিন্তু তাতে কি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সর্বহারাশ্রেণীর নিরন্তর সংগ্রামের প্রয়োজনীতাকে বিন্দুমাত্র হ্রাস করে? এবং কমরেড লেনিন পুনরায় গুরুত্বারোপ করছেন যে, ব্যবহারিক রাজনীতিতে বিশ্বের ইতিহাসের মাপকাঠি প্রয়োগ করা একটি জ্বলজ্বলে তাত্ত্বিক ত্রুটি।
কোটেশন ব্যবহার না করে কমরেড লেনিনের যুক্তিগুলো তুলে ধরার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি সেই ঝুঁকি নেয়া থেকে বিরত থাকলাম। কারণ এখানে বিতর্কে লিপ্ত অনেকেই যুক্তির পরিবর্তে মার্কস বা মাও সেতুঙ কে কি বলেছিলেন সেটা আওড়াতেই অত্যধিক পছন্দ করেন।
বিপ্লব কেন সশস্ত্র হবে? এই প্রশ্নের উত্তরেও মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিন বার বার এ কথাই বলেছেন যে, কমিউনিস্টরা রক্ত-পিপাসু নয়। কমিউনিস্টরা হিংসায় বিশ্বাস করে না। হিংসা এবং রক্তপাত কমিউনিস্টদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। বুর্জোয়া রাষ্ট্র এবং বুর্জোয়াশ্রেণী সমস্ত দিক থেকে জনবিরোধী, মানবতাবিরোধী, সভ্যতাবিরোধী শক্তি হিসাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও তারা স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি নয়। সংখ্যায় অত্যন্ত অল্প কিছু মানুষের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে তারা বেশিরভাগ মানুষের উপর বল প্রয়োগ করে, হিংসা এবং রক্তপাত চাপিয়ে দেয়। এটা একটা ঐতিহাসিক সত্য, এটা একটা ঐতিহাসিক নিয়ম। শ্রেণীসংগ্রাম বিকাশের নিয়ম। যে কারণে মার্কস বলেছিলেন, “Force is the midwife of every old society pregnant with a new one.” (পুরনো সমাজের গর্ভে জন্ম নেওয়া নতুন সমাজ ভুমিষ্ঠ হওয়ার ক্ষেত্র বলপ্রয়োগ ধাত্রীর ভূমিকা পালন করে)। কিন্তু একটা নতুন সমাজকে জন্ম নিতে হয়, পরিণত হতে হয়, বিপ্লবকে বিকশিত করে তুলতে হয়।
মানব-ইতিহাসে এমন কোনো রাষ্ট্র বা এমন কোনো শাসকশ্রেণী কি এসেছে যারা জনগণকে ভুল শিক্ষায় শিক্ষিত করে নি? জনগণকে নিজেদের আদর্শ ও সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত করে নি? তবে পার্থক্য হল, অতীতের যে কোনো রাষ্ট্র ও শাসকদের তুলনায় বুর্জোয়াশ্রেণী এ কাজটি করে চলেছে প্রভূত দক্ষতা ও চতুরতার সাথে। সুতরাং পুঁজিবাদ-বিরোধী সর্বহারাশ্রেণীর সংগ্রামকেও অনেক দীর্ঘ ও জটিল পথ পাড়ি দিতে হবে। এ সংগ্রামে নিরন্তর আদর্শগত, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জনগণকে বুর্জোয়াশ্রেণীর শাসন, বুর্জোয়া গণতন্ত্র, বুর্জোয়া পার্লামেন্ট, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার, বাক স্বাধীনতা ইত্যাদি প্রতিটি প্রশ্নে জনগণের মধ্যে যে মোহ আছে তা দুর করার কষ্টসাধ্য কাজটি করতে হবে। এ কথাগুলোই কমরেড লেনিনের কথায় প্রকাশ পেয়েছে :
“... পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার অভ্যন্তরে কোন সময়ে গোটা শ্রমিকশ্রেণী অথবা প্রায় তার পুরোটাই শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রগামী অংশের চেতনা ও কর্মদক্ষতার যে স্তর, সে স্তরে উন্নিত হতে পারে – এই রকমভাবে চিন্তা করার অর্থ হচ্ছে বাস্তবে ম্যানিভোলিম বা লেজুড়বৃত্তিরই চর্চা করা। শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রগামী অংশ এবং তাকে ঘিরে যে ব্যাপক জনগণ জড়ো হয় – সে দুয়ের মধ্যে পার্থক্যকে ভুলে যাওয়া, জনগণের ব্যাপকতর অংশকে সচেতনতার সর্বাপেক্ষা উন্নত স্তরে ক্রমাগত উন্নীত করার যে কর্তব্য অগ্রগামী আংশের উপর ন্যাস্ত থাকে, তাকে ভুলে যাওয়ার অর্থ হলো নিজেকে ঠকানো, দলের সামনে যে বিরাট দায়িত্ব রয়েছে তার প্রতি চোখ বুজে থাকা এবং দায়িত্বকে লঘু করে দেখা।” (নির্বাচিত রচনাবলী, প্রথম খণ্ড)
‘কি করিতে হইবে’ বইতেও লেনিন বলছেন : “পার্টি অবশ্যই লক্ষ লক্ষ সাধারণ শ্রমিকের সাথে সম্পর্কিত থাকবে, যথাযথভাবে শ্রেণী-সমর্থন অর্জন করতে সচেষ্ট থাকবে – এ না হলে পার্টি বিকশিত হবে না।”
আশা করি, সশস্ত্র বিপ্লবের অপরিহার্যতা স্বীকার করেও কমিউনিস্টরা পার্লামেন্ট নির্বাচনে যাবে কেন, মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের যুক্তিগুলো কি ছিল – সেটা আমরা তুলে আনতে পেরেছি। একই সাথে আনিস রায়হান দাবি করছেন যে তিনি লেনিনের যুক্তিগুলো উত্থাপন করেছেন – সেটাও আমরা যাচাই করে দেখতে সক্ষম হয়েছি।

৫।।
সশস্ত্র সংগ্রাম প্রসঙ্গে মাও সেতুঙ
এমনকি কমরেড মাও সেতুঙ, যাঁকে একটা দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রামের পথেই চীন বিপ্লবকে সফল করে তুলতে হয়েছিল, তিনিও ৬ নভেম্বর ১৯৩৮-এ রচিত ‘প্রবলেমস অফ ওয়ার এন্ড স্ট্রাটেজি’ (PROBLEMS OF WAR AND STRATEGY) রচনায় তিনি বলছেন :
“একেবারে ফ্যাসিস্ট বা যুদ্ধকালীন না হলে পুঁজিবাদী দেশগুলি নিজ দেশের ভিতরে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের চর্চা করে (সামন্তীয় ব্যবস্থায় নয়)। ... এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই পুঁজিবাদী দেশগুলির সর্বহারার বিপ্লবী দলের কাজ হচ্ছে, শ্রমিকদের শিক্ষিত করা এবং আইনসম্মত লড়াইয়ের দীর্ঘ পর্বের মধ্য দিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করা। এবং এভাবেই পুঁজিবাদের চূড়ান্ত উচ্ছেদ ঘটাবার জন্য প্রস্তুতি গড়ে তোলা। এসব দেশগুলিতে (অর্থাৎ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে) শ্রমিকদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য পার্লামেন্টকে প্ল্যাটফরম হিসাবে কাজে লাগানো, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া নিয়ে ধর্মঘট ইত্যাদি সংগঠিত করা, ট্রেডইউনিয়ন আন্দোলন পরিচালনা করা ইত্যাদি দীর্ঘ আইনি লড়াই-সংগ্রামের পথ অনুসরণ করতে হবে। এখানকার সংগঠনের রূপ হবে আইনি এবং সংগ্রামের রূপ হবে রক্তপাতহীন (অসামরিক)। ... বুর্জোয়ারা যতক্ষণ পর্যন্ত বাস্তবিকই অসহায় হয়ে পড়বে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সর্বহারার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ সর্বহারাদের স্বেচ্ছায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থান এবং যুদ্ধ শুরু করা উচিত নয়।”
(“Internally, capitalist countries practice bourgeois democracy (not feudalism) when they are not fascist or not at war ... Because of these characteristics, it is the task of the party of the proletariat in the capitalist countries to educate the workers and build up strength through a long period of legal struggle, and thus prepare for the final overthrow of capitalism. In these countries, the question is one of a long legal struggle, of utilizing parliament as a platform, of economic and political strikes, of organizing trade unions and educating the workers. There the form of organization is legal and the form of struggle bloodless (non-military). ... But this insurrection and war should not be launched until the bourgeoisie becomes really helpless, until the majority of the proletariat are determined to rise in arms and fight, and until the rural masses are giving willing help to the proletariat.”)
এই রচনাতেই চীনের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তিনি আরো বলছেন :
“যাই হোক, চীনের পরিস্থিতি ভিন্ন। চীন কোনো স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ নয়, এটি আধা-উপনিবেশিক এবং আধা-সামন্তীয়, কারণ দেশের অভ্যন্তরে কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক চর্চা নেই, বরং আছে সামন্তী নিপীড়ন, আর বাইরের দিক থেকে তার কোনো জাতীয় স্বাধীন সত্ত্বা নেই, সে সাম্রাজ্যবাদের নিপীড়নের শিকার। এবং আমাদের দেশে কোনো পার্লামেন্ট নেই যা আমরা ব্যবহার করতে পারি, এখানে শ্রমিকদের ধর্মঘট করার আইনি অধিকার পর্যন্ত নেই।”
(“China is different however. The characteristics of China are that she is not independent and democratic but semi-colonial and semi-feudal, that internally she has no democracy but is under feudal oppression and that in her external relations she has no national independence but is oppressed by imperialism. It follows that we have no parliament to make use of and no legal right to organize the workers to strike.”)
শুধু এটুকুই নয়। কমরেড মাও জনগণকে শিক্ষিত করা, সংগঠিত করা, বিপ্লবী সংগ্রামকে বিকশিত করে তোলার মার্কসবাদী শিক্ষারই পুনরাবৃত্তি করে বলছেন :
“একটা সুনির্দিষ্ট স্তরে উন্নীত/বিকশিত হওয়ার পরই শ্রেণী, জাতি, রাষ্ট্র অথবা রাজনৈতিক গ্রুপসমূহের দ্বন্দ্বের মীমাংসার সর্বোচ্চ রূপ হল যুদ্ধ। এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও শ্রেণীর উদ্ভবের পর থেকেই এ নিয়ম কার্যকর রয়েছে।” (“War is the highest form of struggle for resolving contradictions, when they have developed to a certain stage, between classes, nations, states, or political groups, and it has existed ever since the emergence of private property and of classes.” (Problems of Strategy in China's Revolutionary War)
এবং অন্যত্র তিনি বলছেন, বিপ্লবী যুদ্ধ হল জনগণের যুদ্ধ, কেবল জনগণকে সংগঠিত করা এবং তাদের উপর আস্থা রাখার মধ্য দিয়েই এ যুদ্ধ পরিচালনা করা যায়।” (“The revolutionary war is a war of the masses; it can be waged only by mobilizing the masses and relying on them.”) (Be Concerned with the Well-Being of the Masses, Pay Attention to Methods of Work) চীনের পার্টির ঐতিহাসিক সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব সম্পর্কিত প্রস্তাবে ১৯৬৬ সালের ৮ আগস্ট এক প্রস্তাবে মাও সেতুঙ বলেছিলেন : “একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করার জন্য সর্বপ্রথম মতাদর্শগত ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য জনমত তৈরি করা দরকার। একথা যেমন বিপ্লবী শ্রেণীর ক্ষেত্রে সত্য, তেমনই প্রতিবিপ্লবী শ্রেণীর ক্ষেত্রেও সত্য।” (“To overthrow a political power it is always necessary first of all to create public opinion to do work in ideological sphere. This is true for the revolutionary class as well as for the counter-revolutionary class.”)
মার্কস থেকে মাও সেতুঙ পর্যন্ত কমিউনিস্ট আন্দোলনের মহান শিক্ষকদের বক্তব্য এবং যুক্তিগুলো যাচাই করে দেখলে এটা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে আমাদের অনেক তথাকথিত ‘মাওবাদী’ দাবিদার বন্ধু, যারা সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া কথাই বলতে চান না, তারা মার্কসবাদের শিক্ষা থেকে, এমনকি মাও সেতুঙ-এর শিক্ষা থেকে কত দূরে অবস্থান করছেন।
(... চলবে ...)
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×