ফরাসি বিপ্লব : সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার প্রজ্জ্বলিত শিখা
প্রথম পর্ব : Click This Link
ফরাসি বিপ্লব : সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার প্রজ্জ্বলিত শিখা - ২
[গত ১৪ জুলাই ছিল ফরাসি বিপ্লবের ২২২তম বার্ষিকী। ১৭৮৯ সালের এ দিনে বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটে। উৎখাত হয় রাজতন্ত্র। ফরাসি বিপ্লব নিয়ে ধারাবাহিক লেখার দ্বিতীয় পর্ব]
কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষ
ফ্রান্স তখন একটি কৃষিপ্রধান দেশ। ১৭৮৯ সালের হিসাবে দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ গ্রামাঞ্চলে থাকতো। তার মধ্যে ৬৬ ভাগ অর্থাৎ আড়াই কোটি ফরাসির মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৩০ লক্ষই ছিল কৃষক। অথচ চাষযোগ্য জমির অধিকাংশ ছিল গির্জা ও সামন্তপ্রভুদের হাতে, প্রায় ৩০ শতাংশ। যদিও তারা ছিল জনসংখ্যার মাত্র ২ ভাগ। জমির ৩০ শতাংশের মালিক ছিল বণিক বা বুর্জোয়াশ্রেণী। চাষচাষীদের ভাগের জমিগুলো ছিল অনুর্বর। চাষীদের মধ্যেও মূলত তিনটি প্রধান ভাগ ছিল - গৃহস্থ চাষী, ভাগচাষী এবং দিনমজুর। এছাড়া বিপ্লবের সময়টাতে ফ্রান্সে প্রায় দশ লাখের মতো ভূমিদাস ছিল। মাঝেই মাঝেই দেখা দিত অজন্মা, নানা কারণে ফসলের ফলন মার খেত। ফলে গ্রামীণ জনসংখ্যার এক দশমাংশ অংশ কখনো না কখনো ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিতে বাধ্য হত। একজন ইতিহাসবিদ লিখেছিলেন, ফ্রান্সে নয় দশমাংশ লোক অনাহারে মারা যায়, আর এক দশমাংশ মরে অতি ভোজনের ফলে। ইতিহাসিবদদের মতে, মাত্র ১.৫ ভাগ মানুষ গোটা ফরাসি সমাজটাকে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলেছিল।
শিল্পশ্রমিক বলতে যা বোঝায় তার সংখ্যা ছিল নিতান্তই অল্প। এরা ছিল অসংগঠিত। এদের পাশাপাশি শহরে ছিল বিপুল সংখ্যক ছোট দোকানদার, হকার, ফেরিওয়ালা, ছোট ব্যবসায়ী, কারিগর, শিক্ষানবীশ কারিগর, ভবঘুরে, ভ্রাম্যমান অস্থায়ী শ্রমিক, বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ব্যাপক অসংগঠিত শ্রমিক, শিক্ষক, আইনজীবী, ডাক্তার প্রভৃতি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। শ্রমিক-বিরোধী আইন ছিল অত্যন্ত কড়া। মালিকের সই করা পাস বই ছাড়া শ্রমিক নতুন চাকরি পেত না। শ্রমিক-মালিক বিরোধে মালিকের কথাই বিশ্বাস করা হতো।
কত রকম কর বা খাজনা যে দিতে হত সাধারণ মানুষকে -- রাজার আরোপ করা কর, গির্জা কর্তৃক আরোপ করা কর, ভূস্বামী বা জমিদারদের আরোপ করা কর! প্রত্যক্ষ করকে বলা হত তেই (Taille)। আর এক ধরনের কর ছিল যাকে বলা হত টাইদ্ (Tithe) -- জমির ফসল বা পালিত গবাদী পশুর একাংশ এ কর হিসাবে দিতে হত। এমনি এক কর হল ‘লবণ কর’ -- দরকার থাক বা না থাক, পরিবারের সাত বছরের উপর বয়সী প্রতিটি সদস্যের জন্য বছরে সাত পাউন্ড করে লবণ কিনতে বাধ্য ছিল প্রতিটি পরিবার। আর বাড়িতে যতটুকু লবণই থাক তার জন্য কর দিতে হত। এর সাথে ছিল রাস্তার খাজনা, ঘাটের খাজনা, হাটের খাজনা, জমিদারদের উৎসব খাজনা। বিয়ে, মৃত্যু, সামাজি উৎসব অনুষ্ঠান সবকিছুর জন্যই জমিদারকে কর দিতে হত। গম পেষা, আঙুর নিঙড়ে মদ তৈরির মতো কাজগুলো করতে হত জমিদারের যাঁতা বা যন্ত্রে, পাউরুটি তৈরি করতে হত জমিদারের চুল্লিতে -- এসবের জন্যও দিতে হত আলাদা কর। জমিদারের পায়রার খাবার যোগাড় করতে হত চাষীদের। সেনাবাহিনীর চলাচলের জন্য বেগার খাটতে হত সাধারণ মানুষকেই।
ফরাসি কৃষকদের আয়ের চার-পঞ্চমাংশ নিঃশেষ হত রাজার কর, গির্জার ধর্মকর ও জমিদারদের দায় মেটাতে। শিল্পমালিক, বণিকশ্রেণী, ছোট ছোট কারখানা বা গিল্ডের মালিক ও কারিগর সম্প্রদায়ের জন্যও কর ব্যবস্থা ছিল দারম্নন বিপত্তির কারণ। দেশের মধ্যে এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে, এক জমিদারী থেকে আরেক জমিদারীতে মালামাল বহন করতে হলেও কর দিতে হত। জমির চড়া দাম এবং করের বদৌলতে জমিদারী পরিণত হয়েছিল সোনার খনিতে।
আইনও ছিল গরিবের বিপক্ষে। এটা ধরেই নেওয়া হতো যে গরিবেরা চুরি করবেই। তাদের বিচার করার সময় সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে ততটা মাথা ঘামানো হতো না। সামান্য চুরির অভিযোগে কাজের লোকের ফাঁসি পর্যন্ত হয়েছে, পরে হারানো জিনিস ফিরে পাওয়া গেছে বা ইতোমধ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা ব্যক্তির নির্দোষিতা প্রমাণিত হয়েছে, এমন ঘটনা নিতান্ত বিরল ছিল না।
প্যারিসে অভিজাত, যাজক, উচ্চিবিত্ত সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ২০ হাজার। রাজার দরবারে অভিজাত দরবারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ হাজার। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সংখ্যা ছিল ৫ লক্ষ। এদের বাইরে ছিল প্রায় ৫০ হাজারের মতো ভাসমান মানুষ। people শব্দটা তখন অবমাননাসূচক। শ্রমজীবী মানুষকে ডাকা হতো সাঁ-কুলোৎ (sans-culotte), অন্যদিকে অভিজাতদের ডাকা হতো সাঁ-নিয়েৎ নামে। দেশের প্রায় সব বিদ্যালয়ই ছিল চার্চের নিয়ন্ত্রণে। চার্চ নিজস্ব আদালত চালাতো। চার্চের অত্যাচারে স্বাধীন মতামত প্রকাশ করা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু চার্চের মধ্যেও ছিল দুটো শ্রেণী -- উপর তলার যাজক অর্থাৎ বিশপ, অ্যাবট এবং ক্যানন’রা আসত অভিজাত পরিবার থেকে, তারা ছিল বিত্ত-বৈভবের অধিকার। আর নিচের তলার পাদ্রী এবং ভিকাররা আসত সাধারণ মানুষদের মধ্য থেকে। এদের ছিল নুন আনতে পান্তা ফুরানো দশা। তাই এদেরকে বলা হত সর্বহারা যাজক।
প্রাক-বিপ্লব ফ্রান্সের জনগণের দুঃখ-কষ্টের অবধি ছিল না বটে, কিন্তু শুধু দুঃখ-কষ্টই তাদের বিপ্লবের পথে উদ্বুদ্ধ করেনি। আঠারো শতকের এনলাইটেনমেন্ট বা জ্ঞানোন্মেষজনিত চেতনা তাদের ওই পুঞ্জিভূত বেদনায় অগ্নিসংযোগ করেছে, বিপ্লবের পথ দেখিয়েছে।