আমার এ লেখাটি উৎসর্গ করছি কর্নেল তাহের-কে (আজ ২১ জুলাই তাঁর ফাঁসি দিবস), এবং আহমদ ছফা-কে (আগামী ২৮ জুলাই তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী)।
প্রয়াত আহমদ ছফা ১৯৭৩ সালে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে, প্রকাশিত তাঁর 'বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' বইটি শুরু করেছিলেন একটি মোক্ষম বাক্য দিয়ে -- "বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না।" তাঁর ওই কথাটি আজ আবার স্মরণ করছি। সেই সঙ্গে বাক্যটির আজকের তাৎপর্যটিও বোঝার এবং হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করছি।
টিপাইবাঁধ এক 'হট' ইস্যু। সকলেই কথা বলছেন। ডানপন্থি, বামপন্থি, মৌলবাদী, জাতীয়তাবাদী -- সবাই। আবার ব্লগে দেখছি, টিপাইবাঁধের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে পরস্পর কাদা ছোড়াছুড়ি এমন জায়গায় যাচ্ছে যে পড়াই কঠিন।
যে কোনো বিষয়ের পক্ষে থাকি আর বিপক্ষে থাকি, যুক্তির মাধ্যমেই তো আমরা পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণ করব। টিপাইবাঁধের বিরোধীতা আমরা অনেকেই করছি। কিন্তু কেন? সেটা কি শুধু ভারত টিপাইবাঁধ নির্মাণ করছে বলে? পাকিস্তান বা নেপাল এ ধরনের কিছু করলে কি আমরা তার পক্ষে থাকতাম? কিংবা ভারত যদি আমাদের সাথে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত ছিটমহল সমস্যা নিয়ে আলোচনা করত এবং বাংলাদেশের পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিত, কিংবা নেপালের সাথে আমাদের ট্রানজিট সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নিত -- তাহলে কি আমরা সেগুলোর বিরোধীতা করতাম? ফলে পাশাপাশি দুটি দেশের মধ্যে চলা যে কোনো বিতর্কের দুটি দিক আছে। এক, এখানে কার কি স্বার্থ হাসিল হবে এবং কার কি সমস্যা হবে। আর দুই, পররাষ্ট্রনীতিগত দিক। দেশ দুটির সম্পর্ক কেমন, কোন দেশটির চরিত্র কেমন, বিগত দিনের ইতিহাস কি বলে -- এসব দিক।
ভারত এবং বাংলাদেশ প্রতিবেশী। শুধু প্রতিবেশী হলেও কথা ছিল, দু দেশের মধ্যে আরো অনেক বিষয়ে বন্ধন এবং সম্পর্ক রয়েছে। একদা বাংলাদেশের মানুষ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাসহ আরো কয়েকটি অঞ্চলের মানুষ পরস্পরের সাথে যুক্ত ছিল। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশর মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে -- এ এক আত্মীক বন্ধন। আবার ভারত মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সহযোগিতা করেছে যা আমাদের সব সময়ই মনে রাখা উচিত। ইত্যাদি নানা বিষয় আছে যা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিচারে আমাদের চেতনায় কাজ করে।
আবার এর বিপরীতে আরো একটি দিক আছে -- সেটি সাম্প্রদায়িক মনোভাব। ভারত হিন্দুর দেশ। আমরা মুসলমান। হিন্দু মুসলমানের যে বিরোধ ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হয়েছিল তার জের আজো শেষ হয়নি। দেশভাগ, দাঙ্গা ইত্যাদি ঘটনার সাথে যুক্ত হয়েছে ভারতের মাটিতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গুজরাটের দাঙ্গা। যুক্ত হয়েছে ফারাক্কাবাঁধসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভারতের 'দাদাগিরি'-সুলভ মনোভাব।
আমরা যারা মার্কসবাদে বিশ্বাস করি, আমরা এ সবগুলো বিষয়ই বিবেচনায় রাখবো। কিন্তু একটা দেশের (অর্থাৎ রাষ্ট্রের) চরিত্র বিচারে কি এগুলো মুখ্য বিষয়? আবার একটা দেশের বা রাষ্ট্রের চরিত্র বিচার করা ছাড়া তার সাথে কোনো বিষয় কিভাবে ফয়সালা করা হবে? শত্রুতা বলি আর বন্ধুতা বলি, সেটার ভিত্তিই বা কি হবে? অন্তত মার্কসবাদীদের এ প্রশ্নটার ফয়সালা সবার আগে করে নিতে হবে। কিন্তু মজার কথা হল, আমাদের মার্কসবাদী বলে খ্যাত বুদ্ধিজীবী বা বামপন্থি বিভিন্ন সংগঠন এ বিচারের ধারে কাছে না গিয়েই গৎবাঁধা কতগুলো কথা বলে চলেছেন। আর তাদের ভাব-ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে যেহেতু টিপাইবাঁধ একটা হট ইস্যু ফলে এ নিয়ে কথা না বললে বোধ হয় পিছিয়ে পড়তে হবে বা জনগণের চোখের আড়ালে চলে যেতে হবে।
উদহারণ হিসাবে বলি, গত ৭ জুলাই গত "সমাজ রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্র" এক সংলাপের আয়োজন করে। সেখানে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট বামপন্থি বুদ্ধিজীবী ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, পরিচালনা করেন আহমেদ কামাল, ইনিও বামপন্থি এবং বুদ্ধিজীবী। আর সেখানে সূচনা বক্তব্য রাখেন গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। ড. চৌধুরী তাঁর আলোচনার শুরু করলেন এই বলে যে, "ভারত আমাদের মিত্র"। আমি শুরুতেই হোঁচট খেলাম। যদি ভারত আমাদের মিত্রই হয়, তাহলে তো তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই টিপাইবাঁধ শুধু নয়, যে কোনো বিষয়েরই ফয়সালা হয়ে যাওয়ার কথা। এ নিয়ে এত হৈচৈ করার কি আছে? আর ড. চৌধুরীদের সংলাপ করারই বা কি আছে? কথাগুলো সেদিন সংলাপে দাঁড়িয়েই বলার খুব লোভ হচ্ছিল, কিন্তু একে আমি বয়সে তরুণ তার ওপর রবাহূত। ফলে সেখানে আর কথা বাড়াইনি।
কিন্তু সম্প্রতি ব্লগে আমাদের এক বন্ধু 'মেঘনাদ' সেদিনের সংলাপে জোনায়েদ সাকী কর্তৃক পঠিত লিখিত বক্তব্যটি তুলে ধরেছেন। এটা দেখার পর প্রশ্নটা আবার নতুন করে জাগল।
Click This Link
এছাড়া 'প্রপদ' (প্রগতির পরিব্রাজক দল) নামের এক বন্ধু বেশ কয়েকটি লেখা দিয়েছেন টিপাইবাঁধ এবং আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা দিয়েছেন।
(১) টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ: সম্প্রসারণবাদী ভারতীয় ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসুন!
Click This Link
(২) ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পঃ বাহ্যিক লাভ-ক্ষতির হিসাব নয়, প্রত্যেকের ভূমিকা এবং স্বার্থকে যথাযথ বিশ্লেষণ করে শত্রু চিহ্নিত করে করণীয় নির্ধারণ করতে বাংলাদেশ সহ দক্ষিন এশিয়ার জনগণকে শিখতে হবে। (ধারাবাহিক)
Click This Link
প্রপদের লেখায় আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ভারত রাষ্ট্রের চরিত্র সম্পর্কে তাদের বিশ্লেষণ কি? শত্রুচিহ্নিত করার পথ ও পদ্ধতি কি? উনারা সে বিশ্লষণে যান নি। তবে যেহেতু ভারত সম্পর্কে 'সম্প্রসারণবাদী' বিশেষণ ব্যবহার করেছেন ফলে ধরে নিতে পারি ভারত একটি সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্র। কিন্তু এই 'সম্প্রসারণবাদ' কথাটির ব্যাখ্যা কি?
ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কথায় পুনরায় ফিরে যাই। তিনি লেনিনের খুব অনুরক্ত, তাঁর একটি বই আছে 'লেনিন কেন জরুরি'। পৃথিবীর যে কোনো মার্কসবাদীর কাছেই লেনিন জরুরি। শুধু জরুরি বললে কম বলা হবে, অত্যন্ত জরুরি। কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-এর প্রয়াণের পর দুনিয়ার সামনে মার্কসবাদের যথর্থতা দার্শনিক এবং প্রায়োগিকভাবে তুলে ধরার কাজটি তিনি করেছিলেন। কার্ল মার্কস তাঁর জীবদ্দশায় পুঁজিবাদের অবক্ষয় দেখে গিয়েছিলেন, কিন্তু পুঁজিবাদ যে সম্পূর্ণ এক নতুন দশায় উপনীত হয়েছে, যার নাম সাম্রাজ্যবাদ, সে দিকটি দেখে যেতে পারেন নি। ফলে দুনিয়ার সংগ্রামী মানুষের সামনে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং করণীয় নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে 'সাম্রাজ্যবাদ'কে চিহ্নিত করা এবং তার ভিত্তিতে কর্তব্য নির্ধারণ করার কাজটি করেছিলেন কমরেড লেনিন। বলতে সংকোচ বোধ হচ্ছে, কিন্তু না বলেও পারছিনা যে ড. চৌধুরী 'লেনিন কেন জরুরি' লিখেছেন, কিন্তু লেনিনের কাছ থেকে জরুরি শিক্ষাটুকু নিতে পারেন নি। তার কারণ আজ যে প্রশ্নটি নিয়ে আমাদের বিতর্কের সূত্রপাত, সেই টিপাইবাঁধ এবং মূলত ভারত রাষ্ট্রের চরিত্র বিচারের প্রশ্নটি তিনি এবং তাঁর মতো আরো অনেকেই গোলমাল করে ফেলেছেন। এ কথা মনে হওয়ার আরো কারণ হল, শুনতে পেলাম (শুনতে পেলামই বলতে হল, কারণ আমার হাতে লিখিত কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই) ড. চৌধুরীর প্রিয়ভাজন একজন তরুণ বামপন্থি নেতা, যাঁকে ড. চৌধুরী 'বাংলাদেশের লেনিন' আখ্যা দিয়েছেন, তিনি গত ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েয় অনুষ্ঠিত এক পাঠচক্রে ভারতকে বড় পুঁজিবাদী দেশ বললেও ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই বলে যে ভারতকে যত বড় দেখায় ভারত বা ভারতীয় পুঁজি আসলে তত বড় নয়। আসলে মার্কিন পুঁজি পেছন থেকে মদত দেয় বলেই ভারতকে এত বড় লাগে!
যাই হোক, আমি আমার এ লেখায় ভারত রাষ্ট্রের চরিত্র বিচার করার চেষ্টা করব। কিন্তু বিনয়ের সাথে বলে রাখি, এটি আমার নিজস্ব বা মৌলিক কোনো লেখা নয়। আমি কলকাতা থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক অন্যচোখে, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের মুখপত্র ভ্যানগার্ডের বিভিন্ন সংখ্যা, ১৯৯৬ সালে বাসদ প্রকাশিত "ট্রানজিট-হাইওয়ে বিতর্ক; পানি চুক্তি ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক" পুস্তিকা, আহমদ ছফা রচনাবলীর বিভিন্ন খণ্ড-সহ আরো দু'একটি বই-পুস্তিকা-পত্রপত্রিকার সহযোগিতা নিয়েছি। আজ-কালকের মধ্যেই পরের কিস্তি দিতে পারব বলে আশা করি।
পরের পর্ব
Click This Link