বৃষ্টি: দয়াময়ের রহমতের অমীয় বারিধারা, বৃষ্টির সময়ে পালনীয় কিছু সুন্নাত
প্রাককথন
বৃষ্টি। ফোটা ফোটা রহম যেন। রহমতের বারিধারা। নেমে আসে। উপর থেকে। আসমান হতে। বারি বর্ষন করেন। প্রতিপালক প্রভূ মহান। আমরা পরম বিস্ময়ে দেখি সেই বৃষ্টি। বৃষ্টি আর কেউ বর্ষন করাতে পারেন না। কারও ক্ষমতা নেই বৃষ্টি দেয়ার। কিংবা না দেয়ার। এই ক্ষমতা কেবলই আল্লাহ তাআলার। মহান প্রতিপালকের। আসলে তিনি ইচ্ছে করলেই বৃষ্টির আলতো ছোঁয়ায় ভিজিয়ে দেন তার ধরণিকে। যেন পুনরায় প্রাণ ফিরিয়ে দিয়ে মৃত থেকে জীবন্ত করেন বৃক্ষ, ফল ফসলের নানাবিধ উদ্ভিদ, প্রাণিকুলের অনেক সদস্য এবং মরা মাটিকে। বায়ুকেও তিনি এই বৃষ্টির মাধ্যমেই করে দেন নির্মল। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা বর্ষিত হয় আল্লাহ তাআলার রহমতের ধারা হয়ে। বৃষ্টি হলে প্রভুকে বেশি বেশি স্মরণের শিক্ষা দিয়েছেন বিশ্বনবী সল্লাল্লাহু আলাইিহি ওয়া সাল্লাম।
বিশ্বনবী সল্লাল্লাহু আলাইিহি ওয়া সাল্লাম এর গোটা পবিত্র জীবনই আমাদের জন্য, গোটা মানব জাতির জন্য শিক্ষণীয়। তাঁর পবিত্র সীরাত থেকে আমরা জানতে পারি, তিনি বৃষ্টিকে খুব ভালোভাবেই উপভোগ করতেন।
বৃষ্টি: শুধুই কি কিছু পানির সমষ্টি?
হ্যাঁ, বৃষ্টি, বৃষ্টির কথাই বলছি, বৃষ্টিকে আমরা তো নিছক পানিই মনে করে থাকি। আসলেও কি তাই? বৃষ্টি তো শুধুই আকাশ থেকে বর্ষিত পানি নয়, বরং দয়াময় মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লার অনুপম অপরিসীম রহমতেরই অসাধারণ বহিপ্রকাশ এটি। তাঁর অন্তহীন দয়ার অমীয় বারিধারা বৃষ্টি। বৃষ্টি দেখলে, বৃষ্টির দিকে গভীরভাবে অন্তরের চোখ খুলে তাকালে অনুভূতির দুয়ার খুলে যায়, নরম অনুভবে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আমাদের মনের মুকুরে মৃত প্রায় চেতনা, এ যেন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি নয়, এ তো তাঁর সীমাহীন ফজল, করম, রহম, আর করুনা ও অনুগ্রহ বৃষ্টি হয়ে ঝরঝর ঝড়ে পড়া।
আল্লাহ তাআলা বান্দার প্রতি বেশি খুশি হলে ৩টি জিনিস দান করেন। সেগুলো হলো- কন্যা সন্তান; মেহমান এবং বৃষ্টি। বর্ষা মৌসুমে অধিক বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি বেশি হলেই অনেকে নানান কথা বলে থাকেন। কিন্তু বৃষ্টির সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কিছু করণীয় প্রমাণিত। এই করণীয়গুলো থেকে বৃষ্টির উপকারি ও ক্ষতিকর বিষয়গুলো উঠে এসেছে। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় এ করণীয়গুলো সুস্পষ্ট। বৃষ্টির সাথে সম্পৃক্ত অনন্য কিছু সুন্নাত নিয়ে আলোকপাত করি চলুন-
বৃষ্টির সময় কল্যাণের দোয়া করা
যখন বৃষ্টি হয় তখন বৃষ্টি থেকে উপকার পেতে দোয়া করা জরুরি। বৃষ্টি শুরু হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কল্যাণ ও উপকার পেতে ৩ শব্দের ছোট্ট একাটি দোয়া বেশি বেশি পড়তেন। তাহলো-
اللَّهُمَّ صَيِّبًا نَافِعًا
উচ্চারণ :‘ আল্লাহুম্মা সাইয়্যেবান নাফিআ।' (বুখারি, নাসাঈ)
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনি মুষলধারায় যে বৃষ্টি দিচ্ছেন, তা যেন আমাদের জন্য উপকারি হয়।'
এ দোয়া পড়লে আল্লাহ তাআলা বৃষ্টির ক্ষতিকর দিকগুলো দূর করে দেবেন এবং কল্যাণকর ও উপকারি বৃষ্টি দান করবেন।
বৃষ্টিতে অল্প সময় ভেজা
আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমের বৃষ্টির অনেক উপকারিতার কথা তুলে ধরেছেন। বৃষ্টি মানুষের জন্য রহমতস্বরূপ। আল্লাহর রহমত ও বরকত পেতে কিছু সময় বৃষ্টি ভেজার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। হাদিসে এসেছে-
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে থাকাকালীন সময়ে একবার বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পরনের কাপড়ের কিছু অংশ তুলে ধরলেন যাতে করে তাঁর শরীরে কিছুটা বৃষ্টির পানি পড়ে। এরকম করার কারণ জানতে চাইলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
‘এটা (বৃষ্টি) এইমাত্র আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে।’ (মুসলিম)
বৃষ্টি শুরু হলে দোয়া করা
দোয়া কবুল হওয়ার বিশেষ সময়গুলোর মধ্যে বৃষ্টির সময়ও একটি। সুতরাং বৃষ্টি শুরু হলে নিজেদের জানা দোয়াগুলো পেশ করতে আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে রোনাজারি করা বা দোয়া করা জরুরি।
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘দুই সময়ের দোয়া কখনও ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। এক- আজানের পরে করা দোয়া। আর দুই- বৃষ্টির সময় করা দোয়া।’ (আল-হাকিম)
বৃষ্টির জন্য দোয়া ও ক্ষতি থেকে আশ্রয় চাওয়া
ঝড়-বৃষ্টির ভারি বর্ষণের ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়ে দোয়া করাও সুন্নাত। দীর্ঘ এক হাদিসে এসেছে-
হজরত আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি জুমআর দিন দারুল কাজা (বিচার করার স্থান)-এর দিকের দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করল। এ সময় আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে খুতবাহ দিচ্ছিলেন। লোকটি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বলল-
‘হে আল্লাহর রাসুল! ধন-সম্পদ নষ্ট হয়ে গেল এবং রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেল। আপনি আল্লার কাছে দোয়া করুন যেন তিনি আমাদের বৃষ্টি দান করেন।
তখন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই হাত তুলে (৩ বার) দোয়া করলেন-
اللَّهُمَّ اسْقِنَا، اللَّهُمَّ اسْقِنَا، اللَّهُمَّ اسْقِنَا
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মাসক্বিনা, আল্লাহুম্মাসক্বিনা, আল্লাহুম্মাসক্বিনা।’
‘হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করুন। হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করুন। হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করুন।
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মেঘ নেই, মেঘের সামান্য টুকরোও নেই। অথচ সালআ পর্বত ও আমাদের মধ্যে কোনো ঘরবাড়িও ছিল না।
তিনি বললেন, হঠাৎ সালআর ওই পাশ থেকে ঢালের মত মেঘ উঠে এল এবং মধ্য আকাশে এসে ছড়িয়ে পড়লো। অতঃপর প্রচুর বর্ষণ হতে লাগল। আল্লাহর কসম! আমরা ৬ দিন সূর্য দেখতে পাইনি।
পরের জুমআয় ক্ষতি থেকে বাঁচার দোয়া
এরপরের জুমআয় সে দরজা দিয়ে এক ব্যক্তি প্রবেশ করল। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন দাঁড়িয়ে খুতবাহ দিচ্ছিলেন। লোকটি তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল- ‘হে আল্লাগর রাসুল! ধন-সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেল এবং রাস্তাঘাট বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কাজেই আপনি বৃষ্টি বন্ধের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন।
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন দুই হাত তুলে (এভাবে) দোয়া করলেন-
اللَّهُمَّ حَوَالَيْنَا وَلاَ عَلَيْنَا، اللَّهُمَّ عَلَى الآكَامِ وَالْجِبَالِ وَالآجَامِ وَالظِّرَابِ وَالأَوْدِيَةِ وَمَنَابِتِ الشَّجَرِ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা হাওয়ালাইনা ওয়া লা আলাইনা; আল্লাহুম্মা আলাল আকামি ওয়াল ঝিবালি ওয়াল আঝামি ওয়াজ জিরাবি ওয়াল আওদিয়াতি ওয়া মানাবিতিশ শাঝারি।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমাদের আশে পাশে, আমাদের উপর নয়। হে আল্লাহ! টিলা, মালভূমি, উপত্যকায় এবং বনভূমিতে বর্ষণ করুন।’
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তখন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল এবং আমরা বেরিয়ে রোদে চলতে লাগলাম।’ (রাবী) শরিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমি আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করলাম- এ লোকটি কি আগের সেই লোক? তিনি বললেন, আমি জানি না।’ -বুখারি
বজ্র-বৃষ্টিতে দোয়া
বজ্রপাত মহান আল্লাহ তাআলার মহাশক্তির এক ছোট নিদর্শন। এতেই মানুষ বিচলিত হয়ে পড়ে। যার ওপর বজ্রপাত হয় তার মৃত্যু অনেকটাই নিশ্চিত। বজ্রবৃষ্টি থেকে বাঁচতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও দোয়া করতে বলেছেন বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর বাবা থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বজ্রের শব্দ শুনতেন বা বিদ্যুৎ চমক দেখতেন তখন সঙ্গে সঙ্গে বলতেন-
اَللَّهُمَّ لَا تَقْتُلْنَا بِغَضَبِكَ وَ لَا تُهْلِكْنَا بِعَذَابِكَ وَ عَافِنَا قَبْلَ ذَلِكَ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা লা তাক্বতুলনা বিগাদাবিকা ওয়া লা তুহলিকনা বিআজাবিকা, ওয়া আ’ফিনা ক্ববলা জালিকা।’ (তিরমিজি)
অর্থ : ‘হে আমাদের প্রভু! তোমার ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আমাদের মেরে ফেল না আর তোমার আজাব দিয়ে আমাদের ধ্বংস করো না। বরং এর আগেই আমাদের ক্ষমা ও নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে নাও।’
বজ্রপাত থেকে হেফাজত থাকার তাসবিহ
বজ্রের আক্রমণে মৃত্যু থেকে বাঁচতে ছোট্ট একটি তাসবিহ পড়ার কথা এসেছে হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ মুসান্নেফে আবি শায়বায়। তাতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি এ তাসবিহ পড়বে-
سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ
উচ্চারণ : ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি।’
সে বজ্রপাতের আঘাত থেকে মুক্ত থাকবে। -মুসান্নেফে আবি শায়বা
উপকারি বৃষ্টির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
বৃষ্টিপাত বন্ধ হলে আল্লাহর কাছে এ বৃষ্টি সবার জন্য উপকারি হতে কিংবা বৃষ্টি বন্ধ হলে আল্লাহর কাছে এ দোয়া করা সুন্নাত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, ‘যে ব্যক্তি (বৃষ্টির পর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের) এই দোয়া পাঠ করে, সে আমাকে বিশ্বাস করে আর তারকায় (তারার শক্তিতে) অবিশ্বাস করে। তাহলো-
مُطِرْنا بِفَضْلِ اللهِ وَرَحْمَتِهِ
উচ্চারণ : ‘মুত্বিরনা বিফাদলিল্লাহি ওয়া রাহমাতিহি’
অর্থ : ‘আমরা আল্লাহর দয়া ও করুণার বৃষ্টি লাভ করেছি।’ (বুখারি ও মুসলিম)
বৃষ্টির সময় দোয়া করা
কেননা বৃষ্টির সময় দোয়া কবুল হয়। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইিহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বৃষ্টির সময়ের দোয়া কবুল হয়ে থাকে। -আবু দাউদ, হাদিস : ২৫৪০
বৃষ্টির পানি স্পর্শ করা
প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আনাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বলেন, ‘আমরা মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইিহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে থাকাকালে একবার বৃষ্টি নামল। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইিহি ওয়া সাল্লাম তখন তার কাপড় প্রসারিত করলেন যাতে পানি তাকে স্পর্শ করতে পারে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কেন এমন করলেন? তিনি বললেন, কারণ বৃষ্টি তার মহান রবের কাছ থেকে এই মাত্রই এসেছে।’ -মুসলিম, হাদিস : ১৯৬৮
আল্লাহর রহমত কামনা করা
বৃষ্টি একদিকে যেমন রহমতের, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আজাবেরও হতে পারে অনুষঙ্গ বা উপকরণ। এ কারণে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইিহি ওয়া সাল্লাম বৃষ্টি দেখলেই মহান আল্লাহর দরবারে উপকারী বৃষ্টির জন্য দোয়া করতেন। হজরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইিহি ওয়া সাল্লাম যখন বৃষ্টি হতো তখন বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা সয়্যিবান নাফিআহ’, অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি এ বৃষ্টিকে প্রবহমান এবং উপকারী করে দিন। -নাসায়ি, হাদিস : ১৫২৩
ঝোড়ো হাওয়া বইলে আল্লাহকে ভয় করা
রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইিহি ওয়া সাল্লাম কখনো দমকা হাওয়া ও মেঘের ঘনঘটা দেখলে তাঁর চেহারায় আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠত এবং তিনি আগে-পেছনে উদ্বিগ্ন হয়ে চলাফেরা করতেন। এরপর যখন বৃষ্টি হতো খুশি হয়ে যেতেন, আর তাঁর থেকে এ অস্থিরতা দূর হয়ে যেত। হজরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি এ বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমার আশঙ্কা হয় যে, আমার উম্মতের ওপর কোনো ‘আজাব’ এসে পতিত হয় নাকি। তিনি বৃষ্টি দেখলে বলতেন, ‘রহমাতান’ এটা (আল্লাহর) রহমত। -মুসলিম, হাদিস : ১৯৬৯
তাই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে আমরাও ‘রহমাতান’ বলে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইিহি ওয়া সাল্লাম -এর এই সুন্নতটি আদায় করতে পারি। অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সল্লাল্লাহু আলাইিহি ওয়া সাল্লাম আকাশের প্রান্তে মেঘ উঠতে দেখলে যাবতীয় (নফল) ইবাদত ছেড়ে দিতেন, এমনকি তিনি নামাজে থাকলেও। অতঃপর তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট এর অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাইছি।’ যদি বর্ষা হতো তাহলে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! বরকতপূর্ণ ও সুমিষ্ট পানি দান করুন।’ -আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৯৯
অতিবৃষ্টি থেকে বাঁচতে দোয়া
অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে আল্লাহর কাছে অতিবৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দোয়া করতে হবে। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইিহি ওয়া সাল্লাম একবার অতিবৃষ্টিতে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন, ‘আল্লাহুম্মা হাওয়ালাইনা ওয়ালা আলাইনা’ অর্থ—হে আল্লাহ! আপনি বৃষ্টি আমাদের আশপাশে বর্ষণ করুন, আমাদের ওপরে নয়। -নাসায়ি, হাদিস : ১৫২৭
উল্লেখ্য, এখানে এটি উদ্দেশ্য নয় যে আমাদের পাশের এলাকা বৃষ্টিতে ডুবিয়ে দেয়ার প্রার্থনা করা, বরং প্রকৃত উদ্দেশ্য, জনবসতিহীন কোথাও বৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার দোআ করা।
পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে বর্ণিত হয়েছে বৃষ্টির উপকারিতা
বৃষ্টি আল্লাহর অফুরন্ত রহমতের নিদর্শন। এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ দুনিয়ায় কল্যাণ ও রিজিকের ব্যবস্থা করেন। পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে বৃষ্টির উপকারিতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। বৃষ্টি এলে মানুষের মন প্রফুল্ল হয়ে যায়।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেন,
وَاللَّهُ أَنزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِّقَوْمٍ يَسْمَعُونَ
‘আর আল্লাহ আকাশ থেকে পানি অবতীর্ণ করেছেন এবং পৃথিবীকে এর মৃত্যুর পর এর মাধ্যমে জীবিত করে তুলেছেন। নিশ্চয় এতে সেইসব লোকের জন্য রয়েছে এক বড় নিদর্শন যারা কথা শুনে’। -সুরা নাহল: আয়াত ৬৫
রৌদ্রজ্জ্বল তাপদাহে তপ্ত ধরণী যখন অতিষ্ট ঠিক তখনই আল্লাহ পাকের বারিধারায় হয়ে উঠে সুজলা-সুফলা। যেমনটি পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَتَرَى الْأَرْضَ هَامِدَةً فَإِذَا أَنزَلْنَا عَلَيْهَا الْمَاءَ اهْتَزَّتْ وَرَبَتْ وَأَنبَتَتْ مِن كُلِّ زَوْجٍ بَهِيجٍ
‘তুমি পৃথিবীকে নিষ্প্রাণ দেখতে পাও। এরপর আমি যখন এর ওপর পানি বর্ষণ করি তখন তা সক্রিয় হয়ে ওঠে ও ফেঁপে ফুলে ওঠে এবং প্রত্যেক প্রকার উদ্ভিদের সবুজ শ্যামল শোভামণ্ডিত জোড়া উৎপন্ন করে’। -সুরা হজ, আয়াত: ৫
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন-
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ أَنزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَتُصْبِحُ الْأَرْضُ مُخْضَرَّةً ۗ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ
‘তুমি কি দেখনি, নিশ্চয় আল্লাহ আকাশ থেকে পানি অবতীর্ণ করেন যার ফলে পৃথিবী সবুজশ্যামল হয়ে ওঠে? নিশ্চয় আল্লাহ অতি সূক্ষদর্শী ও সর্বজ্ঞ’। -সুরা হজ: আয়াত ৬৩
অপর দিকে যারা পাপাচারে লিপ্ত এবং সীমালঙ্ঘন করে তাদেরকে আল্লাহপাক পানি বর্ষণের মাধ্যমে শাস্তিও দিয়ে থাকেন। যেভাবে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন-
وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهِم مَّطَرًا ۖ فَانظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُجْرِمِينَ
‘আমি তাদের ওপর পাথরের প্রচণ্ড বৃষ্টি বর্ষণ করলাম। অতএব চেয়ে দেখ, অপরাধীদের কী পরিণাম হয়ে থাকে’। -সুরা আরাফ, আয়াত: ৮৪
পাপাচারিদের ওপর পাথর কুচি ও শীলাখণ্ডের বৃষ্টি বর্ষণ বিভিন্ন সময় হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهِم مَّطَرًا ۖ فَسَاءَ مَطَرُ الْمُنذَرِينَ
‘আর আমি তাদের ওপর এক বৃষ্টি বর্ষণ করলাম। আর যাদের সতর্ক করা হয় তাদের ওপর বর্ষিত বৃষ্টি অতি ক্ষতিকর হয়ে থাকে’। -সুরা শোআরা, আয়াত: ১৭৩
তাই আমাদের কর্মের দুর্বলতার জন্য যেন আল্লাহ পাকের বৃষ্টির পানি ক্ষতির কারণ না হয় সে জন্য সর্বদা তার দরবারে দোয়ারত থাকতে হবে।
বৃষ্টি শেষে যে দোয়া পড়তে হয়
উচ্চারণ: ‘মুতিরনা বিফাদলিল্লাহি ওয়া রহমাতিহ। ’
অর্থ: ‘আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে। ’
উপকার: বৃষ্টি শেষে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইিহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামদের এই বিশেষ দোয়াটি পড়ার তাগিদ দিয়েছেন। কারণ মক্কার কাফিররা ভাবত বিভিন্ন তারকার প্রভাবে পৃথিবীতে বৃষ্টি হয়। -বুখারি, হাদিস: ১০৩৮
শেষের প্রার্থনা
সুতরাং বিশ্বাসীদের উচিত, বৃষ্টির সময় ও বৃষ্টি পরবর্তী সময়ে হাদিসে নির্দেশিত উপরোক্ত সুন্নাতগুলো যথাযথভাবে পালন করা। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বৃষ্টির সময় ও বৃষ্টি পরবর্তী সময়ে করণীয়গুলো যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর আমল করার সৌভাগ্য নসিব করুন। আমিন।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০২২ সকাল ৯:৫৭