মাহে রমজান এত ফজিলতপূর্ণ হওয়ার কিছু কারণ
পবিত্র মাহে রমজান। হিজরি বর্ষের নবম মাস। এ মাস ঈমানদারদের জন্য অনেক বড় নিয়ামত। এটি দয়াময় আল্লাহ তাআ'লার দয়া এবং করুণা লাভের সুবর্ণ সুযোগ, তাঁর নৈকট্য লাভের উত্তম সময়, পরকালীন পাথেয় অর্জনের উৎষ্ট মৌসুম। রমজানকে আখ্যায়িত করা হয়েছে 'ইবাদতের মৌসুম' নামে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা এই মাসের প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি নেক আমলে দান করেছেন অশেষ খায়ের-বরকত ও অফুরন্ত কল্যাণ। অন্য মাসের একটি সাধারণ আমল এ মাসের একটি ফরজ ইবাদত তুল্য। মহিমান্বিত এ মাসটি এত ফজিলতপূর্ণ হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। কয়েকটি মৌলিক কারণ এখানে তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ-
দিবসের সিয়াম ও রজনীর কিয়াম
পবিত্র মাহে রমজানের আগমন ঘটে প্রধানত দিনভর রোজা ও এবং রাতের একটি অংশে তারাবীহ নামাজের খোশখবরি নিয়ে। রোজা রাখা ফরজ আর তারাবীহ আদায় করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। এই দু'টিই রমজান মাসের বিশেষ আমল। প্রত্যেক মুসলমানের এ দুই বিষয়ে যত্নবান হওয়া কর্তব্য। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বনকারী হতে পারো।’ -সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৩
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘...সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস (রমজান) পাবে, সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তবে অন্য সময় সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে।’ -সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৫
আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বলেন, যখন রমজান মাসের আগমন ঘটল, তখন নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘তোমাদের কাছে বরকতময় মাস রমজান এসেছে। আল্লাহ তাআলা তোমাদের ওপর এ মাসের রোজা ফরজ করেছেন ...।’ -মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৭১৪৮
মানুষের প্রতিটি আমলের সাওয়াব বৃদ্ধি করে দেওয়া হয় এ মাসে। একটি নেকী ১০ গুণ থেকে (ক্ষেত্র বিশেষে) ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন: কিন্তু রোজার ব্যাপারটি ভিন্ন। কারণ রোজা আমার জন্য। সুতরাং তার প্রতিদান আমি নিজেই প্রদান করব। -বুখারি, হাদিস : ১৮৯৪
জান্নাতে রাইয়ান নামক একটি বিশেষ দরজা রয়েছে, যা দিয়ে একমাত্র রোজাদাররাই প্রবেশ করবে। অন্য কেউ সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। আর যে ব্যক্তি সে রাইয়ান গেট দিয়ে প্রবেশ করবে সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না। -মুসলিম, হাদিস: ১১৫২
আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বলেন, রমজান মাস লাভকারী ব্যক্তি, যিনি উত্তমরূপে সিয়াম ও কিয়াম পালন করে, তার প্রথম পুরস্কার—রমজান শেষে গুনাহ থেকে ওই দিনের মতো পবিত্র হয় যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৮৯৬৬
ইসলামী শরিয়ত সমর্থিত ওজর ছাড়া ইচ্ছাকৃত রোজা ভঙ্গকারী মৌলিক ফরজ লংঘনকারী ও ইসলামের ভিত্তি বিনষ্টকারীরূপে গণ্য। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ওজর বা অসুস্থতা ছাড়া রমজানের একটি রোজা পরিত্যাগ করবে সে যদি ওই রোজার পরিবর্তে আজীবন রোজা রাখে তবু ওই এক রোজার ক্ষতিপূরণ হবে না। ’ -তিরমিজি, হাদিস : ৭২৩
কোরআন নাজিল
রমজান মাস কোরআন নাজিলের মাস। এ মাসেই পূর্ণ কোরআন লাওহে মাহফুজ থেকে একসঙ্গে প্রথম আসমানে ‘বাইতুল ইজ্জতে’ অবতীর্ণ হয়। এবং রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর ওপর ওহি অবতরণের সূচনাও হয় এ মাসেই। ইরশাদ হয়েছে, ‘রমজান মাস, যাতে কোরআন নাজিল হয়েছে, যা মানুষের জন্য হেদায়েত ও সুপথ প্রাপ্তির সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এবং হক-বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী। ’ -সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৫
শুধু কোরআন নয়, ইবরাহিম আলাইহিস সালাম -এর সহিফা, তাওরাত, জাবুর, ইঞ্জিলসহ সকল আসমানি কিতাব এ মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে।
কোরআন তিলাওয়াত
এটি যেমন কোরআন নাজিলের মাস তেমনি কোরআন তিলাওয়াতেরও মাস। কোরআন শেখা ও শেখানোর মাস। কোরআন শুদ্ধ করার মাস। কোরআন মুখস্থ করা ও ইয়াদ করার মাস। কোরআন শোনা ও শোনানোর মাস।
রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘রোজা ও কোরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও যৌন সম্ভোগ থেকে পূর্ণ বিরত রেখেছি। তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। আর কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। কাজেই তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। অতঃপর তাদের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’ -মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ৬৬২৬
সালাফে সালেহিনের জীবনী আলোচনা করলে দেখা যায়, তারা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা রমজানে বহুবার কোরআন খতম করতেন।
আমলের সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধি
এ মাস ঈমানদারের নেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধির মাস। আখিরাতের সওদা করার শ্রেষ্ঠ সময়। ব্যবসায়ীদের যেমন বিশেষ বিশেষ মৌসুম থাকে—যখন খুব জমজমাট ব্যবসা হয়। বছরের অন্য সময়ের তুলনায় আয়-উপার্জন বেশি হয়, তেমনি আখিরাতের ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসার শ্রেষ্ঠ মৌসুম রমজান মাস। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘রমজান মাসের যে কোনো নফল ইবাদত অন্য মাসের ফরজ ইবাদতের সমান এবং যেকোনো ফরজ ইবাদত অন্য মাসের ৭০টি ফরজ ইবাদতের সমান।’
কল্যাণের ঘোষণা
এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন রমজান মাসের প্রথম রাতের আগমন ঘটে, তখন দুষ্ট জিন ও শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, তার একটি দরজাও খোলা হয় না এবং জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, তার একটি দরজাও বন্ধ করা হয় না। আর একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকে— হে কল্যাণের প্রত্যাশী! অগ্রসর হও। হে অকল্যাণের প্রার্থী! থেমে যাও। আল্লাহ তাআলা এ মাসের প্রতি রাতে অসংখ্য জাহান্নামিকে মুক্তি দান করেন। -তিরমিজি, হাদিস : ৬৮২
দোয়া কবুল ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি
এ মাসে অসংখ্য মানুষের দোয়া কবুল করা হয়। আবেদন মঞ্জুর করা হয়। জাহান্নামির নাম জাহান্নামের তালিকা থেকে মুছে ফেলা হয়, দোখজ থেকে মুক্তির ঘোষণা দেওয়া হয়। তাই এ মাসে বেশি বেশি নেক আমল করতে হবে। তাওবা-ইস্তিগফার করতে হবে। জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাইতে হবে। যাবতীয় দরখাস্ত দয়াময় আল্লাহর দরবারে পেশ করতে হবে। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ তাআলা রমজান মাসের প্রত্যেক দিন ও রাতে অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন এবং প্রত্যেক মুমিন বান্দার একটি করে দোয়া কবুল করেন।’ -মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৭৪৫০
তিন ব্যক্তির দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না : রোজাদারের দোয়া, ইফতার পর্যন্ত। ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া। মজলুমের দোয়া। -সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৩৪২৮
ক্ষমা লাভ করা
এটি পাপ মোচন ও গুনাহ থেকে ক্ষমা লাভের মাস। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুমা থেকে আরেক জুমা এবং এক রমজান থেকে আরেক রমজান মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহগুলো মুছে দেয় যদি সে কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে। ’ -মুসলিম, হাদিস : ২৩৩
সারা বছরের জন্য ইবাদতের শক্তি ও পাথেয় সংগ্রহ
মাসগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাস রমজান। বারো মাসের সর্দার রমজান মাস। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর কসম! মুসলমানদের জন্য রমজানের চেয়ে উত্তম কোনো মাস আসেনি এবং মুনাফিকদের জন্য রমজান মাসের চেয়ে অধিক ক্ষতির মাসও আর আসেনি। কেননা মুমিনরা এ মাসে (সারা বছরের জন্য) ইবাদতের শক্তি ও পাথেয় সংগ্রহ করে। আর মুনাফিকরা তাতে মানুষের উদাসীনতা ও দোষত্রুটি অন্বেষণ করে। এ মাস মুমিনের জন্য গনিমত আর মুনাফিকের জন্য ক্ষতির কারণ।’ -মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৮৩৬৮
দানশীলতা
নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনিতেই প্রচুর দান করতেন। এ মাসে দানের পরিমাণ আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দিতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বলেন, রাসুলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানুষের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। তার দানশীলতা অধিকতর বৃদ্ধি পেত রমজান মাসে, যখন জিবরাঈল আলাইহিস সালাম তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম রমজানের প্রতি রাতে আগমন করতেন এবং তারা পরস্পর কোরআন শোনাতেন। আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন কল্যাণবাহী বায়ুর চেয়েও অধিক দানশীল। -মুসলিম, হাদিস : ২৩০৮
রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে তার (রোজাদারের) অনুরূপ প্রতিদান লাভ করবে। তবে রোজাদারের প্রতিদান থেকে বিন্দুমাত্রও হ্রাস করা হবে না।’ -তিরমিজি, হাদিস : ৮০৭
লাইলাতুল কদর
এ মাসে রয়েছে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মাস, লাইলাতুল কদর। এ রাতে ইবাদত করলে হাজার রাতে ইবাদত করার চেয়ে বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘লাইলাতুল কদর এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে ফেরেশতাগণ ও রুহ (জিবরাঈল আলাইহিস সালাম) তাদের পালনকর্তার আদেশক্রমে প্রত্যেক কল্যাণময় বস্তু নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। যে রাত পুরোটাই শান্তি, যা ফজর হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ -সুরা : কদর, আয়াত ৩-৫
রমজান মাসের কল্যান লাভে চাই অধিক পরিমানে দোআ করা
১৪৪৩ হিজরির ০৫ রমজান আজ; রহমতের পঞ্চম দিন। এ দশকে আল্লাহ তাআলা রোজাদার মুমিন বান্দা বান্দির প্রতি রহমত অবতীর্ণ করেন। তাঁর অবারিত রহমতের শীতল ছোঁয়া স্পর্শ দিয়ে যায় গোটা সৃষ্টিজগতজুড়ে। এই মাসজুড়ে রহমত বরকত মাগফেরাতের পাশাপাশি দান করেন জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত।
মাগফেরাতের মাধ্যমে মুমিন মুসলমান চায় তার মনের একান্ত আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো পরিপূর্ণ করতে। আর সে জন্যই রমজানের কল্যাণ লাভে তুলে ধরা হলো একটি দোয়া-
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ওয়াফফির ফিহি হাজা মিন বারাকাতিহি; ওয়া সাহ্হিল সাবিলি ইলা খায়রাতিহি; ওয়া লা তাহরিমনি ক্বুবুলা হাসানাতিহি; ইয়া হাদিয়ান ইলাল হাক্কিল মুবিন।
অর্থ : হে আল্লাহ! আমাকে এ মাসের বরকতের অধিকারী করুন। এর কল্যাণ অজর্নের পথ আমার জন্য সহজ করে দিন। দয়া করে এ মাসের কল্যাণ লাভ থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না, হে সুস্পষ্ট সত্যের দিকে পথ-নির্দেশকারী।
পরিশেষে...
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজানের অবারিত রহমত, বরকত এবং মাগফিরাতলাভের তাওফিক দান করুন। মানব সম্প্রদায়ের সকলকে 'সিরাতুল মুস্তাকিম' তথা শান্তির সঠিক পথে উপনীত হয়ে সেই পথেই চলার তাওফিক দান করুন। সমগ্র সৃষ্টি জগতের প্রতি তাঁর করুণার বৃষ্টি বর্ষন করুন। প্রাণবান সকল সত্ত্বাকে কল্যানে রাখুন, সুখে শান্তিতে রাখুন। আমিন।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০২২ দুপুর ১২:৩৭