নামাজে একাগ্রতা ও মনযোগ ধরে রাখার কিছু উপায়, পর্ব-০১
নামাজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতগুলোর অন্যতম। নামাজের গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য কুরআনুল কারিমে এর বারংবার উল্লেখের বিষয়টি অনুধাবনই যথেষ্ট। আল্লাহ তাআ'লা ইরশাদ করেন-
وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ۚ وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنفُسِكُم مِّنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِندَ اللَّهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত দাও। তোমরা নিজের জন্যে পূর্বে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যা কিছু কর, নিশ্চয় আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন। -সূরাহ আল বাকারাহ, আয়াত ১১০
অন্য আয়াতে মুমিন মুসলিমদের দায়িত্ব ও গুণাবলী বর্ণনা করে তিনি ইরশাদ করেন-
الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ
তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি সামর্থ্য তথা রাষ্ট্রক্ষমতা দান করলে তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত দিবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রত্যেক কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারভূক্ত।’ -সুরা হাজ : আয়াত ৪১
কুরআনুল কারিমে নামাজের নির্দেশনা ৮০ -এর অধিকবার এসেছে। অন্য কোনও ইবাদতের আলোচনা এবং নির্দেশনা এতবার প্রদান করা হয়নি। নামাজ মহান প্রতিপালক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লার সান্নিধ্যলাভের শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম। হাদিসে নামাজকে 'মুমিনের মিরাজ' বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অন্য হাদিসে এসেছে যে, 'বান্দা যখন সিজদায় অবনত হয় তখন সে তার প্রতিপালকের সবচেয়ে নিকটে পৌঁছে যায়।' নামাজে দাঁড়ালে অনেক সময় এলোমেলো চিন্তাভাবনা মনে উঁকিঝুকি দেয়। ব্যবসা বানিজ্য, চাকরি বাকরি, অফিস আদালত, হিসাব কিতাব, লেনদেনসহ নানান বিষয় এসে ভীড় করে মনের ভেতর। নানান ভাবনারা এসে এমনভাবে মনকে নাড়িয়ে দেয় যে, মাঝেমধ্যে নামাজের রাকাআত সংখ্যা পর্যন্ত ভুলে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এক হাদিসে রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ অবস্থাকে ‘শয়তানের ছিনতাই’ বলেছেন। বস্তুতঃ অনেকেই নামাজে মনোসংযোগ রাখতে না পারার কারণে বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তিতে ভোগেন। এই সমস্যা দূর করার পদ্ধতি জানার আগ্রহ পোষন করেন অন্তরে। অনেকেই বুঝতে পারেন না, কিভাবে নামাজে মনোসংযোগ ধরে রাখবেন। বক্ষমান নিবন্ধে এই সমস্যাটির সমাধানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার প্রয়াস পাব, যার মাধ্যমে প্রত্যেক নামাজী ব্যক্তিই উপকৃত হবেন ইনশাআল্লাহ।
প্রাককথনঃ
প্রিয় পাঠক, ইসলামের ইবাদত প্রধানত দু’প্রকার: করণীয় ও বর্জনীয়। সালাত করণীয় শ্রেষ্ঠ ইবাদত। আর খুশু হচ্ছে তার প্রাণ ও সৌন্দর্য। কাজেই শরীআত তা রক্ষার জন্যে কড়া নির্দেশ দিয়েছে, তবে যেহেতু আল্লাহর শত্রু শয়তান আদম সন্তানকে পথভ্রষ্ট ও ফিতনায় নিমজ্জিত করার শপথ করে এসেছে এবং জেদ করেই বলেছে,
﴿ثُمَّ لَأٓتِيَنَّهُم مِّنۢ بَيۡنِ أَيۡدِيهِمۡ وَمِنۡ خَلۡفِهِمۡ وَعَنۡ أَيۡمَٰنِهِمۡ وَعَن شَمَآئِلِهِمۡۖ وَلَا تَجِدُ أَكۡثَرَهُمۡ شَٰكِرِينَ ١٧﴾ [الاعراف: ١٧]
“তারপর অবশ্যই আমি তাদের নিকট আসব, তাদের সামনে থেকে ও তাদের পেছন থেকে এবং তাদের ডান থেকে ও তাদের বাম থেকে। আর আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না।” -সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৭
সেহেতু তার ষড়যন্ত্রের প্রথম ধাপ হচ্ছে বিভিন্ন উপায়ে তাদেরকে সালাত থেকে বিমুখ করা এবং তাতে বিভিন্ন ওয়াসওয়াসা দেওয়া, যেন তার স্বাদ থেকে তারা বঞ্চিত হয় এবং তাদের সাওয়াবও নষ্ট হয়।
আরেকটি বাস্তবতা হচ্ছে, কিয়ামতের পূর্বে পৃথিবী থেকে সবার আগে তুলে নেওয়া হবে সালাতের খুশু ও একাগ্রতা আর আমরা কিয়ামতের পূর্বের যুগেই বাস করছি। তাই আমাদের মধ্যে হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহুর আশঙ্কা দুঃখজনকভাবে সত্যে পরিণত হয়েছে! তিনি বলেছেন,
«أول ما تفقدون من دينكم الخشوع، وآخر ما تفقدون من دينكم الصلاة، ورُبّ مصلٍّ لا خير فيه، ويوشك أن تدخل المسجد فلا ترى فيهم خاشعًا».
“তোমরা তোমাদের দীন থেকে প্রথম হারাবে সালাতের একাগ্রতা (খুশু), আর সবশেষে হারাবে সালাত। এমনও মুসল্লি থাকবে যার ভেতর কোনো কল্যাণ থাকবে না। তুমি অতি শীঘ্রই মসজিদে প্রবেশ করবে, কিন্তু তাদের একজনকেও একাগ্রচিত্ত পাবে না।” -ইবনুল কাইয়্যেম প্রণীত ‘মাদারিজুস সালিকিন’: ১/৫২১
অধিকন্তু সালাতে নানা কল্পনার উদ্রেক হওয়া, তাতে একাগ্রতা না থাকা প্রভৃতি অভিযোগ মুসল্লি নিজের ভেতর অনুভব করে এবং তার পাশের বহু লোক থেকেও শ্রবণ করে, তাই সেটা দূর করার লক্ষ্যে ‘সালাতে একাগ্রতা অর্জনের কিছু উপায়’ উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি, যেন আমার ও আমার মুসলিম ভাই-বোনের জন্যে কল্যাণকর হয়। আল্লাহর নিকট দো‘আ করি তিনি সবাইকে এর দ্বারা উপকৃত করুন।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা মুমিনুনের শুরুতে সফল মুমিনদের গুণাবলি উল্লেখ করেছেন, প্রথমেই বলেছেন সালাতে খুশু ও একাগ্রতার কথা, যেমন:
﴿قَدۡ أَفۡلَحَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ١ ٱلَّذِينَ هُمۡ فِي صَلَاتِهِمۡ خَٰشِعُونَ ٢﴾ [المؤمنون: ١، ٢]
“মুমিনগণ সফল, যারা তাদের সালাতে একাগ্র (খুশুওয়ালা)।” -সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত: ১-২
ইবন কাসীর রহ. আয়াতটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, “আল্লাহ ভীরু ও একাগ্রতাসম্পন্ন মুমিনরা সফল। আর একাগ্রতা (খুশু) বলা হয় আল্লাহর প্রতি গভীর মনোযোগ ও তার ভয় থেকে সৃষ্ট ধীরতা, স্থিরতা, ধৈর্য, গম্ভীরতা ও বিনয়াবনতাকে।” -ইবন কাসীর প্রণীত ‘তাফসির’: ৬/৪১৪, ‘দারুশ-শা‘আব’ প্রকাশিত
অন্য কেউ বলেন: “বিনয়াবনত ও অন্তরের অবনত ভাব নিয়ে আল্লাহর সমীপে দাঁড়ানোকে একাগ্রতা (খুশু) বলা হয়।” -ইবনুল কাইয়্যেম প্রণীত ‘মাদারিজুস সালিকিন’: ১/৫২০
তাবেয়ি মুজাহিদ রহ. আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ﴿وَقُومُواْ لِلَّهِ قَٰنِتِينَ﴾ [البقرة: ٢٣٨] [তোমরা আল্লাহর জন্যে কুনুতের অবস্থায় (বিনীতভাবে) দাঁড়াও।] এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, “সালাতে সুন্দরভাবে রুকু করা, তাতে খুশু ও একাগ্রতা রক্ষা করা, চোখের দৃষ্টি অবনত রাখা এবং আল্লাহর ভয়ে বিনয়ী শরীর নিয়ে দাঁড়ানোকে কুনুতের অবস্থা বলা হয়।” -মুহাম্মাদ ইবন নাসর আল-মারওয়াযি সংকলিত ‘তাজিমু কাদরিস সালাত’: ১/১৮৮
ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “খুশুর স্থান অন্তর, তবে তার আলামত স্পষ্ট হয় গোটা শরীরে। কারণ, শরীর অন্তরের অনুসারী, তাই গাফিলতি ও ওয়াসওয়াসার জন্যে যখন অন্তরের আমল খুশু ও একাগ্রতা নষ্ট হয় তখন বাহিরের আমল বিনয়-নম্রতাও নষ্ট হয়। কেননা, অন্তর বাদশাহ আর অঙ্গসমূহ আজ্ঞাবহ সৈনিকের মতো। বাদশাহর নির্দেশে সৈনিকেরা চলে ও সামনে অগ্রসর হয়। যদি খুশু না থাকার দরুন অন্তরনামী বাদশাহর পতন ঘটে, তাহলে তার প্রজাদের ধ্বংস অনিবার্য। হ্যাঁ, কেউ যদি অন্তরে খুশু ধারণ না করে স্রেফ দেখানোর জন্যে বাহিরে খুশুর আলামত প্রকাশ করে, তবে সেটা অবশ্যই নিন্দনীয়, বস্তুত খুশুর আলামত প্রকাশ না করাই ইখলাস।
হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, ‘কপট খুশু থেকে বিরত থাক। জিজ্ঞেস করা হলো, কপট খুশু কী? তিনি বললেন, বহিরঙ্গে খুশু দেখানো যদিও অন্তরঙ্গ খুশুবিহীন।’
ফুদায়েল ইবন আয়াদ্ব রহ. বলেন, ‘আগেকার যুগে অন্তরঙ্গে যে পরিমাণ খুশু আছে বহিরঙ্গে তার চেয়ে বেশি প্রকাশ করাকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো।’
জনৈক আলেম কোনো এক ব্যক্তির শরীর ও কাঁধে খুশুর আলামত দেখে বললেন: হে ছেলে, খুশু এখানে নয়—কাঁধের দিকে ইশারা করে। আর বুকের দিকে ইশারা করে বললেন, খুশু এখানে।” -ইবনুল কাইয়্যেম প্রণীত ‘মাদারিজুস সালিকিন’: ১/৫২১
ইবনুল কাইয়্যেম রহ. ঈমানের খুশু ও নিফাকের খুশুর মাঝে পার্থক্য নির্ণয়ে বলেন, “ঈমানের খুশু হচ্ছে আল্লাহর সম্মান, বড়ত্ব, গম্ভীরতা, ভয় ও লজ্জা থেকে সৃষ্ট বান্দার অন্তরের একাগ্রতা। এরূপ একাগ্রতার ফলে বান্দার অন্তর আল্লাহর ভয় ও মহত্ত্বে চুপসে যায় এবং নিজের দেহে তার নিআমত দেখে ও নিজের কৃত অপরাধ স্মরণ করে আরো কৃতজ্ঞ ও লজ্জিত হয়। আর এই বিনয় মিশ্রিতই ভাবকে সঙ্গ দেয় দেহের বাহ্যিক অঙ্গসমূহ। অপরপক্ষে নিফাকের খুশু লোক দেখানো ও কপটতা হেতু যদিও বহিরঙ্গে দেখা যায় কিন্তু অন্তরঙ্গ থাকে নিষ্ক্রিয় ও উদাসীন। জনৈক সাহাবী বলতেন: ‘আল্লাহর নিকট নিফাকের খুশু থেকে পানাহ চাই; তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, নিফাকের খুশু কী? তিনি বললেন, শরীরে একাগ্রতা প্রকাশ করা যদিও অন্তর একাগ্রতাহীন।’
প্রকৃত অর্থে খুশু ও একাগ্রতা তার সালাতেই অর্জন হয়, যার প্রবৃত্তির আগুন নিভে গেছে, বুক থেকে তার ধোঁয়া বেরোনো বন্ধ হয়েছে, ফলে তার ভেতরটা উজ্জ্বল, হৃদয়টা সম্প্রসারিত এবং দেহটা হয় আল্লাহর বড়ত্বের দ্যোতিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ। ইতোপূর্বে যে প্রবৃত্তি তাকে ঘিরেছিল, সে এখন হাত-পা বাঁধা, নিশ্চল, আল্লাহর ভয় ও গম্ভীরতায় নিস্তব্ধ, ফলে তার অন্তরটা আল্লাহতে নিবিষ্ট এবং তার তাওফিকে তাকেই স্মরণ করছে অনবরত। দিগ্বিদিক থেকে গড়িয়ে আসা মেঘের পানি ধারণ করে উপত্যকা যেরূপ সিক্ত হয়, তার মতো সেও অঙ্গে-অঙ্গে আল্লাহর বড়ত্ব চুষে পরিতৃপ্ত। তারপর আল্লাহর মহত্ত্বে আবেগাপ্লুত হয়ে বিনয়ী ও ভঙ্গুর হৃদয় নিয়ে সাজদায় লুটিয়ে পড়ে, যতক্ষণ না তার সাক্ষাত পায় মাথা তুলে সোজা হয় না। এটাই ঈমানের খুশু ও একাগ্রতা। পক্ষান্তরে দাম্ভিকের অন্তর দম্ভে স্ফীত, অবাধ্য, অন্যায় কামী ও উচ্ছৃঙ্খল, ঠিক যেন পাথুরে পর্বত, তাতে পানি জমে না এবং তার থেকে ফসলও উৎপাদিত হয় না। তার সালাতে দাঁড়িয়ে মরার ভান করা ও শরীরের কপট স্থিরতা দ্বারা লোক দেখানো খুশু সৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু তার ভেতরে নফস পুরো যুবক, চাহিদা ও প্রবৃত্তিতে নিমজ্জিত। সে বাহ্যিকভাবে খুশুর ভান করে, কিন্তু তার দু’পাশ থেকে ঝোপের সাপ ও জঙ্গলের বাঘ তাকে শিকার করতে ওঁত পেতে থাকে।” -ইবনুল কাইয়্যেম প্রণীত ‘আর-রুহ’: পৃ.৩১৪, ‘দারুল ফিকর’, জর্ডান
ইবন কাসীর রহ. বলেন, “কেবল তার সালাতে খুশু ও একাগ্রতা অর্জন হয়, যে নিজের অন্তরকে তার জন্যে অবসর করে, সবকিছু ত্যাগ করে তাকে নিয়ে মগ্ন হয় এবং সবকিছুর উপর তাকে প্রাধান্য দেয়। আর একাগ্রতা সম্পন্ন সালাতই আত্মার প্রশান্তি ও চোখের শীতলতা হয়। যেমন, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে ইমাম আহমদ ও নাসাঈর বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«وجعلت قرة عيني في الصلاة».
‘আমার চোখের প্রশান্তি করা হয়েছে সালাতে।” -ইবন কাসীর প্রণীত ‘তাফসির’: ৫/৪৫৬, হাদীসটির জন্যে আরো দেখুন: ‘সহীহ আল-জামি’: হাদীস নং ৩১২৪
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারিমের যেখানে স্বীয় মনোনীত বান্দাদের গুণ বর্ণনা করেছেন সেখানে খুশুর সাথে সালাত আদায়কারী নারী-পুরুষকেও উল্লেখ করেছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন,
﴿أَعَدَّ ٱللَّهُ لَهُم مَّغۡفِرَةٗ وَأَجۡرًا عَظِيمٗا ٣٥﴾ [الاحزاب: ٣٥]
“আল্লাহ তাদের জন্যে ক্ষমা ও মহান প্রতিদান নির্ধারণ করেছেন।” -সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৫
খুশু সালাতকে বান্দার ওপর হালকা করে দেয়। এটা খুশুর আরেকটি ফায়দা, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَٱسۡتَعِينُواْ بِٱلصَّبۡرِ وَٱلصَّلَوٰةِۚ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى ٱلۡخَٰشِعِينَ ٤٥﴾ [البقرة: ٤٥]
“তোমরা ধৈর্য ও সালাতের দ্বারা সাহায্য চাও, নিশ্চয় তা খুশুর ধারক ছাড়া অন্যদের ওপর কঠিন।” -সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৪৫
ইবন কাসীর রহ. আয়াতটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, “অর্থাৎ সালাত বড় কষ্টের কাজ, তবে খুশুওয়ালাদের জন্যে তাতে কোনো কষ্ট নেই।” -ইবন কাসীর প্রণীত ‘তাফসির’: ১/১২৫
খুশুর গুরুত্ব অনেক। খুশু খুব কষ্টে অর্জন হয়, আবার প্রস্থান করেও দ্রুত। বর্তমান যুগে খুশুর খুব অভাব, বিশেষভাবে যেহেতু এটা শেষ যুগ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أول شيء يرفع من هذه الأمة الخشوع، حتى لا ترى فيها خاشعا».
“এ উম্মত থেকে প্রথম উঠিয়ে নেওয়া হবে খুশু, ফলে তুমি তাদের ভেতর কাউকে খুশুওয়ালা দেখবে না।” -মুহাদ্দিস হায়সামি সংকলিত ‘আল-মাজমা’: ২/১৩৬; তিনি বলেন, “ইমাম তাবরানি ‘আল-কাবির’ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তার সনদটি হাসান।” আরো দেখুন, ‘সহীহ আত-তারগিব ও আত-তারহিব’, হাদীস নং ৫৪৩, আলবানি হাদীসটি সহীহ বলেছেন
নামাজে মনোসংযোগ ধরে রাখার ব্যাপারে ইমাম আবু হামিদ আল-গাজ্জালি (রহ.) তার বিখ্যাত ‘এহইয়াউ উলুমিদ্দিন’ গ্রন্থে এমন ছয়টি বিষয়ের কথা বর্ণনা করেন, যেগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিলে নামাজে মনোযোগ ধরে রাখা সহজ হয়। যে বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে নামাজ আদায় করলে জীবন্ত হয়ে ওঠে নামাজ এখানে এমন কিছু বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে-
এক. নামাজে ‘হুজুরে দিল’ বা একাগ্র চিত্ত থাকাঃ
নামাজে ‘হুজুরে দিল’ বা একাগ্র চিত্ত থাকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটিকে বরং বলা যায়, নামাজের প্রাণ। নামাজ এমনভাবে পড়তে হবে যেন আল্লাহ আমাকে দেখছেন। রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
« أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ ، فَإِنَّهُ يَرَاكَ » . (متفق عليه).
“তুমি আল্লাহ তা‘আলার ‘ইবাদত করবে এমনভাবে, মনে হয় যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ; আর যদি তুমি তাঁকে দেখতে না পাও, তবে মনে রাখবে তিনি তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন।” -সহিহ বুখারি : ৫০, সহিহ মুসলিম : ৮
অর্থাৎ, নামাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই কল্পনা ধরে রাখার অনুশীলন করুন যে ‘আল্লাহ তাআ'লা আমাকে দেখছেন’। এই ভাবনা নিয়ে নামাজে দাঁড়ান যে, আমি মহান মালিক বিশ্ব জগতের একচ্ছত্র অধিকর্তা আল্লাহ তাআ'লার সামনে দন্ডায়মান হচ্ছি। এভাবে বিনয় ও নম্রতার অনুশীলনের মাধ্যমে শুরু থেকে শেষ পর্যন্তু নামাজ সমাপ্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখুন। রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
عَنْ حُمْرَانَ، رَأَيْتُ عُثْمَانَ ـ رضى الله عنه ـ تَوَضَّأَ، فَأَفْرَغَ عَلَى يَدَيْهِ ثَلاَثًا، ثُمَّ تَمَضْمَضَ وَاسْتَنْثَرَ، ثُمَّ غَسَلَ وَجْهَهُ ثَلاَثًا، ثُمَّ غَسَلَ يَدَهُ الْيُمْنَى إِلَى الْمَرْفِقِ ثَلاَثًا، ثُمَّ غَسَلَ يَدَهُ الْيُسْرَى إِلَى الْمَرْفِقِ ثَلاَثًا، ثُمَّ مَسَحَ بِرَأْسِهِ، ثُمَّ غَسَلَ رِجْلَهُ الْيُمْنَى ثَلاَثًا، ثُمَّ الْيُسْرَى ثَلاَثًا، ثُمَّ قَالَ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم تَوَضَّأَ نَحْوَ وُضُوئِي هَذَا، ثُمَّ قَالَ " مَنْ تَوَضَّأَ وُضُوئِي هَذَا، ثُمَّ يُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ، لاَ يُحَدِّثُ نَفْسَهُ فِيهِمَا بِشَىْءٍ، إِلاَّ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
হুমরান (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ‘উসমান রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুকে উযূ করতে দেখেছি। তিনি তিন বার হাতের উপর পানি ঢাললেন। এরপর তিনি কুলি করলেন, নাকে পানি দিলেন। তারপর তিন বার চেহারা (মুখমন্ডল) ধুইলেন। এরপর ডান হাত কনুই পর্যন্ত তিন বার ধুইলেন এবং বাম হাত কনুই পর্যন্ত তিন বার ধুইলেন। এরপর তিনি মাথা মাসেহ করলেন। তারপর ডান পা তিন বার ধুইলেন তারপর বাম পা তিন বার ধুইলেন। এরপর বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উযূ করতে দেখেছি আমার এ উযূর মতই। এরপর তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার এ উযূর মত উযূ করে দু’রাক’আত সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করবে এবং মনে মনে কোন কিছুর চিন্তা-ভাবনায় লিপ্ত হবে না, তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। -সহিহ বুখারি : ১৯৩৪,
অন্য হাদিসে এসেছে-
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ الْجُهَنِيِّ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ ثُمَّ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ يُقْبِلُ عَلَيْهِمَا بِقَلْبِهِ وَوَجْهِهِ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ
মূসা ইবনু আবদুর রহমান মাসরূকী (রহঃ) ... উকবা ইবনু আমির জুহানী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যাক্তি উত্তমরূপে উযূ (ওজু/অজু/অযু) করে তারপর দু’রাকাত সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করে নিষ্ঠার সাথে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়। -হাদিসের মানঃ সহীহ, সহীহ আবূ দাউদ হাঃ ৮৪১, মুসলিম (ইসলামিক সেন্টার) হাঃ ৪৬০, নাসাঈ : ১৫১
দুই. বিশুদ্ধ উচ্চারণে সহিহ তিলাওয়াত নামাজে মনযোগ বৃদ্ধির কারণঃ
নামাজে যা কিছু তিলাওয়াত করা হয় তা বিশুদ্ধ উচ্চারণে সহিহ করে পড়ার চেষ্টা করুন। এটি অন্তরের উপস্থিতিকে আরও দৃঢ় করে। অন্ততঃ সুরা ফাতিহা ও তাসবিহগুলোর অর্থ বুঝে পড়ার চেষ্টা করুন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا
‘স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কুরআন তিলাওয়াত করুন।’ -সুরা মুজ্জাম্মিল : ৪
রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিটি সুরা তারতিলসহকারে তিলাওয়াত করতেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ حَفْصَةَ، أَنَّهَا قَالَتْ مَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم صَلَّى فِي سُبْحَتِهِ قَاعِدًا حَتَّى كَانَ قَبْلَ وَفَاتِهِ بِعَامٍ فَكَانَ يُصَلِّي فِي سُبْحَتِهِ قَاعِدًا وَكَانَ يَقْرَأُ بِالسُّورَةِ فَيُرَتِّلُهَا حَتَّى تَكُونَ أَطْوَلَ مِنْ أَطْوَلَ مِنْهَا .
হাফসাহ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কখনো বসে নফল সালাত আদায় করতে দেখিনি। পরবর্তী সময়ে তার ওয়াফাতের এক বছর পূর্বে তাকে বসে নফল সালাত আদায় করতে দেখেছি। তিনি অতি উত্তমরূপে স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে সুরাহ পড়তেন। এ কারণে তার সালাত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে যেত। -সহিহ মুসলিম : হাদিস একাডেমী ৭৩৩, ইসলামী ফাউন্ডেশন ১৫৮২, ইসলামিক সেন্টার ১৫৮৯, সুনানে তিরমিজি : ৩৭৩
একেকটি আয়াত পৃথক পৃথক তিলাওয়াত করা। এভাবে তিলাওয়াত করলে বুঝতে ও চিন্তা করতে সহজ হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই তিলাওয়াত করতেন, যেমন তাঁর তিলাওয়াত সম্পর্কে উম্মে সালামাহ—রাদিয়াল্লাহু আনহা—বলেন, “তিনি بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ বলতেন, (অপর বর্ণনায় এসেছে, তারপর ওয়াকফ করতেন,) তারপর বলতেন, ﴿ ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٢﴾ ﴿ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ ٣﴾ (অপর বর্ণনায় এসেছে, তারপর ওয়াকফ করতেন,) তারপর বলতেন, ﴿مَٰلِكِ يَوۡمِ ٱلدِّينِ ٤﴾ এভাবে তিনি একেকটি আয়াত পৃথক পৃথক তিলাওয়াত করতেন।” -আবু দাউদ, হাদীস নং ৪০০১; আলবানি প্রণীত ‘আল-ইরওয়া’: ২/৬০, তিনি এর বিভিন্ন সনদ উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন হাদীসটি সহি
তিন. নামাজে কুরআন তিলাওয়াত করুন সুমধুর সুরে হৃদ্যতা নিয়েঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করতেন, «مفسرة حرفاً حرفًا» “একটি একটি হরফ সুস্পষ্টভাবে।” -ইমাম আহমদ সংকলিত ‘মুসনাদু’: ৬/২৯৪; আলবানি হাদীসটির সনদ সহীহ বলেছেন। ‘সিফাতুস সালাত’: পৃ.১০৫
ইমাম মুসলিম তার তিলাওয়াত সম্পর্কে বর্ণনা করেন,
«وكان صلى الله عليه وسلم يقرأ بالسورة فيرتلها حتى تكون أطول من أطول منها».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সূরা পড়তেন তারতিলসহ পড়তেন, এমন কি সেটি (বিনা তারতিলে পঠিত) তার চেয়ে দীর্ঘ সূরা থেকেও দীর্ঘ হয়ে যেত।” -সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৩৩
দ্রুত গতিতে তিলাওয়াত করা অপেক্ষা তারতিলসহ আয়াতে আয়াতে ওয়াকফ করে তিলাওয়াত করা চিন্তা ও খুশুর জন্যে বেশি সহায়ক। খুশুর আরেকটি সহায়ক হচ্ছে সুন্দর স্বরে তিলাওয়াত করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«زينوا القرآن بأصواتكم فإن الصوت الحسن يزيد القرآن حسنًا».
“তোমরা তোমাদের আওয়াজ দ্বারা কুরআনুল কারিমকে সৌন্দর্যমণ্ডিত কর। কেননা, সুন্দর আওয়াজ কুরআনুল কারীমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।” -ইমাম হাকিম সংকলিত ‘আল-মুসতাদরাক’: ১/৫৭৫; ‘সহীহ আল-জামি’, হাদীস নং ৩৫৮১
উল্লেখ্য যে, সুন্দর আওয়াজের অর্থ (কারীদের ন্যায়) টেনে-টেনে ও পাপীদের সঙ্গীতের ন্যায় সুর করে পড়া নয়; বরং চিন্তার আওয়াজে সুন্দর করে পড়াই উদ্দেশ্য, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إن من أحسن الناس صوتًا بالقرآن الذي إذا سمعتموه يقرأ حسبتموه يخشى الله».
“কুরআনুল কারিমে তার আওয়াজই সবচেয়ে সুন্দর, যাকে তিলাওয়াত করতে শুনলে তোমরা মনে কর আল্লাহকে ভয় করছে।” -ইবন মাজাহ: ১/১৩৩৯; ‘সহীহ আল-জামি’, হাদীস নং ২২০২
চার. নামাজে মহান আল্লাহর প্রতি ‘তাজিম’ বা ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করুনঃ
নামাজে আল্লাহ তাআ'লার প্রতি ‘তাজিম’ বা ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করুন। কেননা, আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের নির্দেশ দিয়েছেন,
حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلَاةِ الْوُسْطَىٰ وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ
‘সমস্ত নামাযের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাযের ব্যাপারে। আর আল্লাহর সামনে একান্ত আদবের সাথে বিনীতভাবে দন্ডায়মান হও।’ -সুরা আল বাকারা : ২৩৮
কাজেই নামাজে ধীরস্থিরতা অবলম্বন করুন। এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-
وَعَنْ أَبِي قَتَادَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَسْوَأُ النَّاسِ سَرِقَةً الَّذِي يَسْرِقُ مِنْ صَلَاتِهِ» . قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ وَكَيْفَ يَسْرِقُ مِنْ صَلَاتِهِ؟ قَالَ: لَا يتم ركوعها وَلَا سجودها . رَوَاهُ أَحْمد
‘আবু কাতাদা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, নিকৃষ্টতম চোর হলো সেই ব্যক্তি, যে নামাজে চুরি করে। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! নামাজে কীভাবে চুরি করে? তিনি বলেন, ‘যে রুকু-সিজদা পূর্ণভাবে আদায় করে না।’ -হাদিসের মানঃ সহীহ, মুসনাদ আহমাদ ২২১৩৬, মিশকাত ৮৮৫, সহীহ আত্ তারগীব ৫২৪
পাঁচ. নামাজে দাঁড়িয়ে খুশু' তথা মহান আল্লাহর ভয় অন্তরে জাগরুক রাখুনঃ
মহান আল্লাহ তায়ালা সালাত সম্পর্কেই বলেছেন,
﴿وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى ٱلۡخَٰشِعِينَ ٤٥ ﴾ [البقرة: ٤٥، ٤٦]
“নিশ্চয় সালাত অনেক কঠিন তবে একাগ্রচিত্তদের (খুশুর ধারকদের) ওপর নয়।” -সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৪৫
الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُم مُّلَاقُو رَبِّهِمْ وَأَنَّهُمْ إِلَيْهِ رَاجِعُونَ
যারা একথা খেয়াল করে যে, তাদেরকে সম্মুখীন হতে হবে স্বীয় পরওয়ারদেগারের এবং তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে। -সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৪৬
নামাজে দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহকে ভয় করুন। ভাবুন, এই নামাজই হয়তো আমার জীবনের শেষ নামাজ। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-
وَعَنْ أَبِي أَيُّوبَ الْأَنْصَارِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: جَاءَ رَحل إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: عِظْنِي وَأَوْجِزْ. فَقَالَ: «إِذَا قُمْتَ فِي صَلَاتِكَ فَصَلِّ صَلَاةَ مُوَدِّعٍ وَلَا تَكَلَّمْ بِكَلَامٍ تَعْذِرُ مِنْهُ غَدًا وَأَجْمِعِ الْإِيَاسَ مِمَّا فِي أَيْدِي النَّاس»
আবূ আইয়ুব আল আনসারী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর নিকট এসে বলল, আমাকে সংক্ষেপে কিছু উপদেশ দিন। তখন রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : যখন তুমি সলাতে দাঁড়াবে, তখন সে সলাতকে নিজের জীবনের শেষ সলাত মনে করে আদায় করবে। আর এমন কোন কথা বলো না, যার দরুন আগামীকাল (কিয়ামতের দিন) ত্রুটি স্বীকার করতে হবে এবং মানুষের হাতে যা আছে। তা হতে তোমার নৈরাশ্যকে সুদৃঢ় করে নাও। -হাদিসের মানঃ হাসান, মিশকাত : ৫২২৬, ইবনু মাজাহ ৪১৭১, সিলসিলাতুস সহীহাহ্ ৪০০, সহীহুল জামি' ৭৪২, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ্ ৩৫৫৯১, আল মু'জামুল কাবীর লিত্ব তবারানী ৩৮৯০
ছয়. নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কল্যাণ আশা করুনঃ
নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কল্যাণ আশা করুন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ ۚ
‘তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।’ -সুরা : আল বাকারা : ৪৫
এই বিশ্বাস রাখুন যে, আল্লাহ আমার প্রতিটি প্রার্থনায় সাড়া দিচ্ছেন। রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কেউ নামাজে দাঁড়ালে সে মূলত তার প্রভুর সঙ্গে কথোপকথন করে। তাই সে যেন দেখে, কীভাবে সে কথোপকথন করছে।’ -মুসতাদরাক হাকেম, সহিহুল জামে হাদিস : ১৫৩৮
সাত. মহান দাতা আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হতে নিজের মাঝে ‘হায়া’ বা লজ্জা পোষন করুনঃ
মহান আল্লাহর দেয়া অফুরন্ত নেআমত ভোগ করা সত্বও তাঁর কত নাফরমানিতে ডুবে থাকার পরেও তিনি আমাকে শাস্তি দেন না। আমার প্রতি তাঁর নেআমতের ধারাকে রুদ্ধ করেন না। এসব কথা ভেবে, নামাজে নিজের গুনাহর কথা চিন্তা করে, আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার কথা অনুভূতিতে রেখে নিজের মাঝে ‘হায়া’ বা লজ্জাবোধ জাগ্রত করুন। নামাজে দণ্ডায়মান অবস্থায় একজন অপরাধীর মতো মস্তক অবনত রেখে এবং দৃষ্টিকে সিজদার স্থানের দিকে নিবদ্ধ রাখুন। রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (দাঁড়ানো অবস্থায়) সিজদার জায়গায় দৃষ্টি রাখতেন। -তাফসিরে তবারি : ৯/১৯৭
উপরের বিষয়গুলো অনুসরণ করলে নামাজে মনযোগ তৈরি হবে ইনশাআল্লাহ। এক হাদিসে রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
حَدَّثَنَا عَبْدُ بْنُ حُمَيْدٍ، وَحَجَّاجُ بْنُ الشَّاعِرِ، كِلاَهُمَا عَنْ أَبِي الْوَلِيدِ، قَالَ عَبْدٌ حَدَّثَنِي أَبُو الْوَلِيدِ، حَدَّثَنَا إِسْحَاقُ بْنُ سَعِيدِ بْنِ عَمْرِو بْنِ سَعِيدِ بْنِ الْعَاصِ، حَدَّثَنِي أَبِي، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ كُنْتُ عِنْدَ عُثْمَانَ فَدَعَا بِطَهُورٍ فَقَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ " مَا مِنِ امْرِئٍ مُسْلِمٍ تَحْضُرُهُ صَلاَةٌ مَكْتُوبَةٌ فَيُحْسِنُ وُضُوءَهَا وَخُشُوعَهَا وَرُكُوعَهَا إِلاَّ كَانَتْ كَفَّارَةً لِمَا قَبْلَهَا مِنَ الذُّنُوبِ مَا لَمْ يُؤْتِ كَبِيرَةً وَذَلِكَ الدَّهْرَ كُلَّهُ "
আবদ ইবনু হুমাইদ ও হাজ্জাজ ইবনু আশ শাইর (রহঃ) .... 'আমর ইবনু সাঈদ ইবনুল 'আস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি উসমান রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। এমন সময়ে তিনি পানি আনার নির্দেশ দিলেন। এরপর তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, কোন মুসলিমের যখন কোন ফরয সালাতের ওয়াক্ত হয় আর সে উত্তমরূপে সালাতের ওযু করে, সালাতের নিয়ম ও রুকূকে উত্তমরূপে আদায় করে তাহলে যতক্ষণ না সে কোন কাবীরাহ গুনাহে লিপ্ত হবে তার এ সালাত তার পিছনের সকল গুনাহের জন্যে কাফফারাহ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আর এ অবস্থা সর্বযুগেই বিদ্যমান। -সহিহ মুসলিম, হাদিস একাডেমি নাম্বারঃ ৪৩১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২২৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৩৪, ইসলামিক সেন্টারঃ ৪৫০
আট. সকল বিচারকের বিচারকের সামনে দাঁড়াতে বিনয় নম্রতা এবং শিষ্টাচারের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করুনঃ
নামাজে দাঁড়াতে মনে মনে ভাবুন যে, আপনি এমন এক মহান সত্ত্বার সামনে দাঁড়াচ্ছেন যিনি সকল বিচারকের বিচারক। কুরআনুল হাকিমে ইরশাদ হয়েছে-
أَلَيْسَ اللَّهُ بِأَحْكَمِ الْحَاكِمِينَ
আল্লাহ কি বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্টতম বিচারক নন? -সূরাহ ত্বীন, আয়াত ৮
মহান আল্লাহ তাআ'লা এমনই এক এবং একক প্রতিপালক যার উপরে আর কেউ নেই। যার সমকক্ষ কেউ নেই। যার সাথে তুলনীয় কেউ নেই। যার কুদরতি হাতের মুঠোয় গোটা সৃষ্টি জগত। যার ইশারায় আমার বেঁচে থাকা। যার সামনে ব্যতিত আর কারও সামনে মাথা নত করা যায় না। পৃথিবীর নিয়মে আমরা দেখি, বিচারকের সামনে বিনয় এবং নম্রতার সাথে দাঁড়াতে হয়। তো, সকল বিচারকের যিনি বিচারক, তার সামনে কিভাবে দাঁড়ানো উচিত?
সুতরাং, এমন মহান সত্ত্বার সামনে দাঁড়াতে বিনয়, নম্রতা এবং শিষ্টাচারের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করুন। নিজেকে অপরাধী ভাবুন। তাঁর অফুরন্ত দয়া, ইহসান আর করুনার প্রতি কৃতজ্ঞতাকে জাগ্রত করুন। তাঁর প্রতি বিগলিত চিত্তে তাকে স্মরণ করুন নামাজে। দেখবেন, চোখ ফেটে আপনার অজান্তেই প্রবাহিত হতে থাকবে অশ্রুর অবারিত ধারা। নামাজ হয়ে উঠবে জীবন্ত। যে নামাজকে হাদিসে 'মিরাজুল্লিল মুমিনীন' অভিহিত করা হয়েছে, হয়ে উঠবে সত্যিকারের সেই নামাজ। আল্লাহ তাআ'লা আমাদেরকে এমন নামাজ আদায়ের তাওফিক প্রদান করুন।
নয়. নামাজকে নিজের জন্য সৌভাগ্যের সোপান মনে করুনঃ
নামাজে অতিবাহিত প্রতিটি মুহূর্তকে মহান রবের সাথে মুলাকাতের মাধ্যম মনে করুন। নামাজের প্রতিটি কিয়াম, প্রতিটি রুকূ, প্রতিটি সিজদাহ, প্রতিটি বৈঠক, প্রতিটি তাসবিহ, প্রতিটি তাহমিদকে জীবনের সবচেয়ে দামী সম্পদ ভাবুন। হাদিসে বলা হয়েছে, একটি সিজদাহ দুনিয়া এবং দুনিয়ার মধ্যস্থ বস্তুর চেয়ে উত্তম। এমন দামী নামাজে আপনার মনযোগ যেন কোনভাবেই অন্য দিকে না যেতে পারে সেই চেষ্টা করুন। মনকে নিবদ্ধ রাখুন। নজরকে স্থির রাখুন। শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোকে দৃঢ় রাখুন। অনর্থক নড়াচড়া থেকে মুক্ত থাকুন। অপ্রয়োজনীয় প্রতিটি কাজ, এমনকি গলা খাকারি দেয়া থেকেও সতর্কতার সাথে বিরত থাকুন। তবেই আপনার নামাজ হয়ে উঠবে সত্যিকারের নামাজ।
দশ. নামাজে একাগ্রতার প্রেরণাদায়ক একটি ঘটনাঃ
ইমাম ইবন হিব্বান বর্ণনা করেন, “তবেয়ি আতা রহ. বলেন, আমি ও ‘উবাইদ ইবন ওমায়ের আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তাআ'লা আনহা এর নিকট গেলাম। ‘উবাইদ তাকে বললেন, আপনার চোখে দেখা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি আশ্চর্য ঘটনা আমাদের শুনান। তিনি কেঁদে ফেললেন ও বললেন, তিনি কোনো এক রাতে উঠে বলেন: «يا عائشة ذريني أتعبّد لربي». ‘হে আয়েশা, আমাকে ছাড়, আমি আমার রবের ইবাদত করব।’ আয়েশা বলেন, আমি বললাম, আল্লাহর কসম, আমি আপনার নৈকট্য পছন্দ করি এবং যা আপনার পছন্দের কারণ তাও আমি পছন্দ করি। আয়েশা বলেন, তিনি উঠলেন, ওযু করলেন ও সালাতে দাঁড়ালেন। তারপর কাঁদতে লাগলেন, ফলে তার বুক ভিজে গেল। আরো কাঁদলেন, এতো কাঁদলেন মাটিও ভিজে গেল। ইতোমধ্যে তাঁকে সালাতের সংবাদ দিতে বেলাল এলো। বেলাল যখন দেখল তিনি কাঁদছেন, তখন বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কাঁদছেন, অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সব গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন? তিনি বললেন,
«أفلا أكون عبدا شكورا؟ لقد نزلت عليّ الليلة آيات ويل لمن قرأها ولم يتفكّر ما فيها»: ﴿إِنَّ فِي خَلۡقِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ ... الآية ١٩٠﴾ [ال عمران: ١٩٠]».
‘আমি কি শোকর গোজার বান্দা হব না? আজ রাতে আমার ওপর কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, ধ্বংস তার জন্যে যে তা পড়ল, কিন্তু তাতে চিন্তা করল না। আয়াতগুলো হচ্ছে:
﴿إِنَّ فِي خَلۡقِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ ... الآية ١٩٠﴾ [ال عمران: ١٩٠]
“নিশ্চয় আসমান ও জমিনের সৃষ্টিতে...।’ -সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ১৯০” -সহীহ ইবন হিব্বান। আলবানি সংকলিত ‘আস-সহীহাহ’, হাদীস নং ৬৮, তিনি বলেছেন, “এই সনদটি জাইয়্যেদ
ঘটনাটি থেকে যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাতে চিন্তা ও খুশুর বিষয়টি স্পষ্ট হয়, তেমন স্পষ্ট হয় তার আবশ্যকতা।
সুরা ফাতিহা শেষে ‘আমীন’ বলাও আয়াতের সঙ্গে সঙ্গ দেওয়ার একটি অংশ। আর ‘আমীন’ বলার সাওয়াব তো আছেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إذا أمَّنَ الإمام فأمِّنُوا فإنه مَن وافق تأمِينُهُ تأمين الملائكة غُفر له ما تقدم من ذنبه».
“যখন ইমাম ‘আমীন’ বলে, তোমরাও তখন আমীন বল। কারণ, যার ‘আমীন’ মালায়েকার ‘আমীনে’র সাথে মিলবে তার পূর্বের সব পাপ মাফ করা হবে।” -সহীহ বুখারি, হাদীস নং ৭৪৭
অনুরূপভাবে যখন ইমাম বলে: سمع الله لمن حمده (আল্লাহ ঐ ব্যক্তির কথা শুনেন যে তার প্রশংসা করে) তখন মুক্তাদির ربنا ولك الحمد (হে আমাদের রব, তোমার জন্যেই সকল প্রশংসা) বলে ইমামকে সঙ্গ দেওয়া খুশুর আলামত। আর সাওয়াব তো আছেই।
রিফাআ ইবন রাফি আয-যারকি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “একদা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে সালাত পড়ছিলাম, যখন তিনি سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ বলে রুকু থেকে মাথা তুললেন, তখন পেছন থেকে কেউ বলল, «رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا كَثِيرًا طَيِّبًا مُبَارَكًا فِيهِ» (হে আমাদের রব, তোমার জন্যেই প্রশংসা, অনেক প্রশংসা, পবিত্র ও বরকতময় প্রশংসা) তিনি সালাত শেষ করে বললেন, «من المتكلم» ‘কথক কে?’ লোকটি বলল, ‘আমি’। তিনি বললেন,«رأيت بضعة وثلاثين ملكًا يبتدرونها أيهم يكتبها أولُ». ‘আমি ত্রিশেরও অধিক ফেরেশতা দেখেছি, সবার আগে কে তার সাওয়াব লিখবে প্রতিযোগিতায় তার দিকে ছুটে আসছে।” -সহীহ বুখারি বর্ণিত, দেখুন ‘ফাতহুল বারি’: ২/২৮৪
এগারো. সালাতে এ কথা মনে করা যে, আল্লাহ তা‘আলা আমার কথার উত্তর দিচ্ছেনঃ
সালাতের সময় মনে করা যে, আল্লাহ তা‘আলা আমার কথার উত্তর দিচ্ছেন, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«قال الله عز وجل قسمت الصلاة بيني وبين عبدي نصفين ولعبدي ما سأل، فإذا قال: الحمد لله رب العالمين، قال الله: حمدني عبدي، فإذا قال: الرحمن الرحيم، قال الله: أثنى عليّ عبدي، فإذا قال: مالك يوم الدين، قال الله: مجّدني عبدي، فإذا قال: إياك نعبد وإياك نستعين، قال: هذا بيني وبين عبدي ولعبدي ما سأل، فإذا قال: إهدنا الصراط المستقيم، صراط الذين أنعمت عليهم غير المغضوب عليهم ولا الضالين، قال الله: هذا لعبدي ولعبدي ما سأل».
“আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি সালাতকে আমার ও আমার বান্দার মধ্যে দু’ভাগে ভাগ করেছি। আর আমার বান্দার জন্যে তাই রয়েছে—যা সে চাইবে। যখন বান্দা বলে, ﴿ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٢﴾ (সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্যে, যিনি গোটা জগতের রব) তখন আল্লাহ বলেন, عبدي حمدني (আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে।) যখন বান্দা বলে, ﴿ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ ٣﴾ (পরম দয়ালু অতীব মেহেরবান।) তখন আল্লাহ বলেন, أثنى علي عبدي (আমার বান্দা আমার গুণাবলি বর্ণনা করেছে।) যখন বান্দা বলে, ﴿مَٰلِكِ يَوۡمِ ٱلدِّينِ ٤﴾ (প্রতিদান দিবসের মালিক।) তখন আল্লাহ বলেন,مجدني عبدي (আমার বান্দা আমাকে মর্যাদা দিয়েছে।) যখন বান্দা বলে, ﴿إِيَّاكَ نَعۡبُدُ وَإِيَّاكَ نَسۡتَعِينُ ٥﴾ (আমরা কেবল আপনারই ইবাদত করি এবং কেবল আপনার কাছেই সাহায্য চাই।) তখন আল্লাহ বলেন, هذا بيني وبين عبدي ولعبدي ما سأل، (এটি আমার ও আমার বান্দার জন্যে, আর আমার বান্দার জন্যে তাই রয়েছে—যা সে চাইবে।) যখন বান্দা বলে, ﴿ٱهۡدِنَا ٱلصِّرَٰطَ ٱلۡمُسۡتَقِيمَ ٦ صِرَٰطَ ٱلَّذِينَ أَنۡعَمۡتَ عَلَيۡهِمۡ غَيۡرِ ٱلۡمَغۡضُوبِ عَلَيۡهِمۡ وَلَا ٱلضَّآلِّينَ ٧ ﴾ (আমাদের সরল পথের হিদায়েত দিন, তাদের পথ—যাদের ওপর আপনি নিয়ামত দিয়েছেন এবং যাদের ওপর আপনার ক্রোধ পতিত হয় নি এবং যারা পথভ্রষ্টও নয়।) তখন আল্লাহ বলেন, هذا لعبدي ولعبدي ما سأل. (এটা আমার বান্দার জন্যে, আর আমার বান্দার জন্যে তাই রয়েছে—যা সে চাইবে।)” -সহীহ মুসলিম, কিতাবুস সালাত
প্রকৃত মুসল্লির নিকট হাদীসটির মূল্য অনেক, যদি প্রত্যেক মুসল্লি হাদীসটি মনে-প্রাণে গ্রহণ করে, প্রত্যেকের সালাতেই পূর্ণ খুশু হাসিল হবে এবং প্রত্যেকে তাদের সালাতে ফাতিহা পড়ার স্বাদ অনুভব করবে। কেন করবে না, অথচ মুসল্লি নিজেই রবকে সম্বোধন করছে এবং তার চিন্তায় আছে তিনি তার উত্তর দিচ্ছেন।
অতএব মুসল্লি মাত্রের সূরা ফাতিহার মাধ্যমে মহান রবের সাথে সম্বোধন ও কথোপকথন করার মূল্য দেওয়া উচিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إن أحدكم إذا قام يصلي فإنما يناجي ربه فلينظر كيف يناجيه».
“তোমাদের কেউ যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন সে তার রবের সাথে কথোপকথন করে, অতএব সে তার রবের সাথে কীভাবে কথা বলবে চিন্তা করুক।” -ইমাম হাকিম সংকলিত ‘আল-মুসতাদরাক’: ১/২৩৬; ‘সহীহ আল-জামি’, হাদীস নং ১৫৩৮
পরিশেষেঃ
নামাজে খুশুর বিষয়টা খুব স্পর্শকাতর। আল্লাহ তাআ'লা প্রদত্ত তাওফিক ছাড়া কারো পক্ষেই পুঙ্খানুপুঙ্খ খুশু অর্জন করা সম্ভবপর নয়। আবার খুশু থেকে বঞ্চিত হওয়াও বড় দুর্ভাগ্য। এ জন্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন,
«اللهم إني أعوذ بك من قلب لا يخشع».
“হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে এমন অন্তর থেকে পানাহ চাই, যে ভীত হয় না (খুশু অর্জন করে না)।” -তিরমিযী, ৫/৪৮৫, হাদীস নং ৩৪৮২, সহীহ তিরমিযী, ২৭৬৯
সবশেষে মহান আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা করি, তিনি আমাদের খুশুওয়ালা বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমাদের উপর রহমতের দৃষ্টি দান করুন। অতঃপর যারা গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি পাঠপূর্বক সহিহ এবং সর্বাঙ্গীন সুন্দর খুশুওয়ালা পরিপূর্ণ নামাজে নিজে মনযোগী হবেন এবং অন্যদের মনযোগী করার জন্য এর প্রচারে অংশ নিবেন তাদের সবাইকে তিনি উপকৃত করুন ও উত্তম বিনিময় দান করুন। আমীন। আল-হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন।
নিবন্ধটি প্রণয়নে সহায়তা নেয়া হয়েছে যেসব সূত্র থেকেঃ
০১. সউদি আরবের প্রখ্যাত আলেম এবং দায়ী মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ দা. বা. এর অনবদ্য গ্রন্থ 'সালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩টি উপায়'
০২. ইবনুল কাইয়্যেম প্রণীত ‘মাদারিজুস সালিকিন’: ১/৫২১
০৩. মুহাম্মাদ ইবন নাসর আল-মারওয়াযি সংকলিত ‘তাজিমু কাদরিস সালাত’: ১/১৮৮
০৪. ইবন কাসীর প্রণীত ‘তাফসির ইবনে কাসীর
০৫. ইবনুল কাইয়্যেম প্রণীত ‘আর-রুহ’
০৬. ‘সহীহ আল-জামি’
০৭. মুহাদ্দিস হায়সামি সংকলিত ‘আল-মাজমা’
০৮. ‘আল-কাবির’ লিইমাম তাবরানি
০৯. ‘সহীহ আত-তারগিব ও আত-তারহিব’
১০. ‘এহইয়াউ উলুমিদ্দিন’ ইমাম আবু হামিদ আল-গাজ্জালি (রহ.)
১১. সহিহ বুখারি
১২. সহিহ মুসলিম
১৩. সহীহ আবূ দাউদ
১৪. সুনানে নাসাঈ
১৫. সুনানে তিরমিজি
১৬. আলবানি প্রণীত ‘আল-ইরওয়া’
১৭. ইমাম আহমদ সংকলিত ‘মুসনাদ’
১৮. ইমাম হাকিম সংকলিত ‘আল-মুসতাদরাক
১৯. ইবন মাজাহ
২০. মিশকাতুল মাসাবীহ
২১. সিলসিলাতুস সহীহাহ্
২২. মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ্
২৩. আল মু'জামুল কাবীর লিত্ব তবারানী
২৪. মুসতাদরাক হাকেম
২৫. তাফসিরে তবারি
২৬. সহীহ ইবন হিব্বান
২৭. ‘ফাতহুল বারি’ শরহে সহীহ বুখারি
২৮. ইমাম নববি কর্তৃক সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থ
২৯. সহীহ ইবন খুযাইমাহ
৩০. ইবন রজব প্রণীত ‘আল-খুশু ফিস সালাত’
৩১. মুহাম্মাদ ইবন নাসর আল-মারওয়াযি সংকলিত ‘তাযিমু কাদরিস সালাত’
৩২. আব্দুল আযিয মুহাম্মাদ প্রণীত ‘সিলাহুল ইয়াকযান লি তারদিশ শায়তান’
৩৩. ইবন তাইমিয়ার ফাতওয়া সংকলন ‘মাজমুউল ফাতাওয়া’
৩৪. মার‘ঈ আল-কারমি প্রণীত ‘আল-কাওয়াকিবুদ দুররিয়্যাহ ফি মানাকিবিল মুজতাহিদ ইবন তাইমিয়াহ’
৩৫. আলবানি সংকলিত ‘সিলসিলাহ দাঈফাহ’
৩৬. ইমাম বায়হাকি সংকলিত ‘আস-সুনানুল কুবরা’
৩৭. ইমাম মুনাভি প্রণীত ‘জামি সাগিরে’র ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘ফয়যুল কাদির’
৩৮. ইমাম বায়হাকি সংকলিত ‘আস-সুনানুল কুবরা’
৩৯. ইবনুল কাইয়্যেম প্রণীত ‘আল-ওয়াবিলুস সায়্যিব’
৪০. হাফিয ইরাকি প্রণীত তাখরিজ ইহইয়াউল উলুম
৪১. মুহাম্মাদ শামসুল হক আল-আযিম আবাদি প্রণীত ‘আউনুল মাবুদ’
৪২. মোল্লা আলি আল-কারি প্রণীত ‘মিরকাতুল মাফাতিহ’
চলমান-
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ দুপুর ১২:০৫