যুদ্ধাপরাধী বনূ কুরাইজার বিচার নিয়ে অনৈতিক আপত্তি এবং আমাদের কিছু কথা
যুদ্ধাপরাধী বনু কুরাইজার বিচার প্রসঙ্গটি কিছু লোকের কাছে হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চরিত্র এবং ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার মোক্ষম একটি অস্ত্র বটে!
তাদের প্রশ্ন, অভিযোগ এবং আপত্তি- বনু কুরাইজার সাতশ কিংবা নয়শ পুরুষকে জবাই করা হয়েছে নবী কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশে। এটা কি মহান একজন নবীর কাজ হতে পারে?
বস্তুতঃ বিষয়টিকে যেভাবে তারা উপস্থাপন করে থাকেন, তাদের এ উপস্থাপন পদ্ধতিটিই সঠিক নয়। তাদের উপস্থাপন পদ্ধতি দেখেই বুঝা যায় যে, তারা বিষয়টিকে ভিন্ন উদ্দেশ্যে খুবই অন্যায়মূলক ও গর্হিতভাবে তুলে ধরে থাকেন। তারা তাদের প্রশ্নটি তুলেই থাকেন আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে। যুদ্ধাপরাধী এবং বিশ্বাসঘাতক ও চুক্তির শর্ত ভঙ্গকারী একটি সম্প্রদায়ের বিচারকে 'হত্যাকান্ড' বলে আখ্যায়িত করা নিঃসন্দেহে স্বাভাবিক এবং সুস্থ মস্তিষ্কের বিষয় বলা যায় না।
এবার আসুন, উক্ত শ্রেণির অভিযোগকারীগণের মুখস্ত কথার বিপরীতে ইতিহাসের আলোকে বনু কুরাইজার অভিযানের বিষয়টি একটু বুঝার চেষ্টা করি-
বনু কুরাইজার পরিচয় এবং তাদের সাথে মুসলিমদের সন্ধি চুক্তিঃ
বনু কুরাইজা মদীনায় অবস্থানকারী এমন একটি গোত্র যাদের সাথে রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শান্তি চুক্তি ছিল। সেই চুক্তির শর্তানুযায়ী বনু কুরাইজা এবং মুসলিমগণ পরষ্পর কেউ কারো প্রতি আক্রমণ করবে না। চুক্তির শর্তে এ-ও ছিল যে, বর্হিশত্রু আক্রমণ করলে পরস্পর একে অপরকে বিপদের মুহূর্তে সহযোগিতা করবে। -দেখুন, সীরাতে ইবনে হিশাম- খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৫০৩-৫০৪
বনু কুরাইজা সন্ধির চুক্তি ভঙ্গ করে মুসলিমদের প্রতিপক্ষের সাথে হাত মেলায়ঃ
কিন্তু খন্দক যুদ্ধের সময় যখন কুরাইশরা দশ হাজার বাহিনী নিয়ে মদীনা ঘেরাও করে তখন মুসলিম শিবিরে সেনা সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আক্রমনকারী অবরোধকারী কুরাইশ সেনাদের প্রতিরোধ ও প্রতিহত করা ছাড়া মুসলিমদের সামনে বিকল্প কোনো পথ অবশিষ্ট ছিল না।
অসম এক সমরে অবতীর্ণ দুই পক্ষ। এ সময় মিত্রশক্তির সহযোগিতাপ্রাপ্তি মুসলিমদের জন্য ছিল একান্তই কাঙ্খিত। হামলাকারীদের হাত থেকে মদিনাবাসীর জান মাল রক্ষার প্রয়োজনেই এই সহযোগিতা মুসলিমদের কাম্য ছিল। কিন্তু আফসোসের বিষয় হল, মুসলিমদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ মিত্র বনু কুরাইজা সহযোগিতা করবে তো দূরে থাক, বরং সেই নিতান্ত সঙ্গীন সময়ে মুসলিমদের শত্রু মদিনার উপরে হামলে পড়া কুরাইশদের সাথে হাত মেলায়।
বনু কুরাইজার সাথে যে সন্ধি চুক্তি ছিল, তা তারা ভঙ্গ করে মক্কার মুশরিকদের সাথে মিলে যায়। সেই সাথে রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালাগাল করে।
যখন বনী নজীরের সর্দার হুআই বিন আখতাব বনু কুরাইজার সর্দার কাব বিন আসাদ কুরাজীকে তার দলে টানতে আসে, তখন প্রথমতঃ সে দৃঢ়তার সাথেই বলেছিলঃ
وَيْحكَ يَا حُيَيُّ: إنَّكَ امْرُؤٌ مَشْئُومٌ، وَإِنِّي قَدْ عَاهَدْتُ مُحَمَّدًا، فَلَسْتُ بِنَاقِضٍ مَا بَيْنِي وَبَيْنَهُ، وَلَمْ أَرَ مِنْهُ إلَّا وَفَاءً وَصِدْقًا
আফসোস! তোমার জন্য হে হুয়াই! নিশ্চয় তুমি এক নিকৃষ্ট ব্যক্তি। নিশ্চয় আমি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাথে চুক্তিবদ্ধ। সুতরাং, আমার ও তার মাঝে যে চুক্তি রয়েছে তা আমি ভঙ্গ করতে পারবো না। আর আমি তাকে একজন ওয়াদা রক্ষাকারী এবং সত্যনিষ্ট ব্যক্তি হিসেবেই পেয়েছি। -দেখুন, সীরাতে ইবনে হিশাম- খন্ড ২, গাযওয়ায়ে খন্দক অধ্যায়, পৃষ্ঠা ২২০
কিন্তু নিতান্ত দুঃখজনক ব্যাপার হল, বনু কুরাইজার সর্দার কাব বিন আসাদ কুরাজী তার এ সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি। লাভ এবং লোভের বশবর্তী হয়ে শেষমেষ হুয়াইয়ের ফাঁদে পড়ে যায় সে এবং চুক্তি ভঙ্গ করে শত্রুপক্ষের সাথে মিলে যায় তার গোত্রের লোকজনসহ। এমনকি, এক পর্যায়ে নবীজীর প্রতিনিধি যখন তার সাথে সাক্ষাত করে মুসলিমদের সাথে তাদের চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় তখন সে তাচ্ছিল্যের সাথে বলেঃ
مَنْ رَسُولُ اللَّهِ؟ لَا عَهْدَ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مُحَمَّدٍ وَلَا عَقْدَ
আল্লাহর নবী কে? মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং আমাদের মাঝে কোন চুক্তি নেই। কোন সন্ধি নেই। -দেখুন, সীরাতে ইবনে হিশাম- খন্ড ২, পৃষ্ঠা ২২২
এইভাবে শান্তি ও সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে বনু কুরাইজার নেতা কাব বিন আসাদ মুসলমানদের চরম বিপদের মুহুর্তে মুসলমানদের শত্রুপক্ষের সাথে হাত মিলিয়ে মুসলমানদের জন্য চরম দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একদিকে বহিশত্রু মক্কার মুশরিকদের বিরাট বাহিনীর ঘেরাওয়ের কবলে গোটা মদিনা। অপরদিকে ঘরের শত্রু চুক্তি ভঙ্গকারী গাদ্দার বনু কুরাইজা।
বনী কুরাইজার অবরোধঃ
এ গাদ্দারীর কারণেই খন্দক যুদ্ধ শেষে বনী কুরাইজাকে শায়েস্তা করতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাহিনী নিয়ে বনু কুরাইজা অভিমুখে যাত্রা করেন। বনু কুরাইজার অধিবাসীরা তাদের দুর্গ বন্ধ করে বসে থাকে। ২৫ দিন পর্যন্ত তাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। অবশেষে তাদের বন্দি করা হয়। বনু কুরাইজার দীর্ঘকালীন এ অভিযানে একজন মহিলা ছাড়া কোন মহিলাকে হত্যা করা হয়নি। তার নাম ছিল বুনানা এবং হাকাম কুরাজির স্ত্রী ছিল। উক্ত মহিলা ছাদের উপর থেকে যাঁতার একটি অংশ সাহাবী খাল্লাদ বিন সুআইদ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর উপরে ফেলে দেন এবং এতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। -দেখুন, উয়ুনুল আছার- খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৮৭, সীরাতুল মুস্তাফা ২য় খন্ড, আল্লামাহ ইদরীস কান্ধলভী, পৃষ্ঠা ২৮৩
বনু কুরাইজার বিচার ও শাস্তিপ্রদানকৃত অপরাধীদের সংখ্যাঃ
অনেক মায়াকান্নার ধ্বজাধারীদের চুক্তি ভঙ্গকারী চরম গাদ্দারির পরেও যুদ্ধাপরাধী এই বনু কুরাইজাকে শাস্তি প্রদানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাউমাউ করে পরিবেশ ঘোলাটে করতে চান। তারা প্রকৃত সংখ্যাকে আড়াল করে ফুলিয়ে ফাপিয়ে এবং বাড়িয়ে হাজার বা কিছু কম বেশি লোককে হত্যার কথা বলে মানুষের দয়ার দৃষ্টি আকর্ষন করতে চান। আসলে বনু কুরাইজার যেসব অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল তাদের এই সংখ্যাটা হাজার খানেক বা তার কাছাকাছি ছিল না; বরং, তিরমিজী, নাসায়ী ও ইবনে হিব্বানের বর্ণনা অনুপাতে তাদের সংখ্যা চারশত জনের মত ছিল। -দেখুন, তিরমিজী, নাসায়ী ও ইবনে হিব্বানের এই বিষয়ক বর্ণনা, সীরাতুল মুস্তাফা ২য় খন্ড, আল্লামাহ ইদরীস কান্ধলভী, পৃষ্ঠা ২৮৩
হযরত সা'দ রা. এর সিদ্ধান্ত অনুসারে বনূ কুরাইজার একদলকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হয় এবং আরেক দলকে বন্দী করা হয় কিন্তু সেই দিন ঠিক কতজন ইয়াহুদীকে হত্যা করা হয়, সেই ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক তাদের সংখ্যা ছয় শত হতে নয় শত পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন যা ইউরোপীয় লেখকগণকে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর চরিত্রে কালিমা লেপনে রসদ যুগিয়েছে। নিম্নোক্ত বিশ্লেষনের মাধ্যমে নিহতদের প্রকৃত ও নির্ভরযোগ্য সংখ্যা পাওয়া যাবে-
কুরাইজা গোত্রে অভিযানকালে তাদের পুরুষ লোকদিগকের সংখ্যা কত ছিল তা ইমাম তিরমিযী, নাসাঈ প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে বিশ্বস্ত সূত্রে হযরত যাবির রা. কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, 'তাদের (পুরুষদের) সংখ্যা ছিল চার শত'। অতঃপর তাদেরকে হত্যার ফায়সালা দেয়ার পরে সাদ রা. ইনতিকাল করেন। এই চার শত পুরুষের মধ্যে যারা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন বা যুদ্ধে লিপ্ত হতে সমর্থ ছিলেন কেবল তাদেরকে সা'দ রা. হত্যার আদেশ দেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত সা'দ রা. এর এতদসংক্রান্ত উক্তিই উহার প্রকৃষ্ট প্রমান বহন করে। তিনি বলেছিলেন যে, 'আমি যুদ্ধে নিযুক্ত বা যুদ্ধ করতে সক্ষম পুরুষদিগকে হত্যার আদেশ করছি'। সা'দ রা. এর এই উক্তিতে প্রাপ্ত এবং অপ্রাপ্তবয়ষ্ক সকল পুরুষ যোদ্ধাকে হত্যা করবার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল, যা স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু নবী কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মধ্যে কেবল প্রাপ্তবয়ষ্কদেরকে হত্যার নির্দেশ প্রদান করেন। -দেখুন, যাদুল মাআদ, ৩য় খন্ড পৃষ্ঠা ১৩২, আবূ দাউদ, হাদীস নং ৪৪০৪, তিরমিজি, পৃষ্ঠা ১৫৪৮, নাসাঈ ৬ষ্ঠ খন্ড, ইবনে মাজা, পৃষ্ঠা ৪৫৪১
অপ্রাপ্তবয়ষ্কদেরকে বন্দী করে রাখা হয়। -সূত্র, প্রাগুক্ত
অতঃপর তাদেরকে নবী কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুক্ত করে দেন। এদের মধ্যে আতিয়া আল কুরাজির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ও তার কয়েকজন সঙ্গী প্রাণে রক্ষা পেয়ে মুসলমান হন। -সূত্র, আর রাহীকুল মাখতূম, পৃষ্ঠা ২৯১
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে আসাকির কুরাইজার ঘটনা প্রসঙ্গে একখানা হাদীস বর্ণনা করেছেন। নিম্নে তা উল্লেক করা হল। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের তিন শত পুরুষ হত্যা করেন এবং অবশিষ্ট লোকদিগকে বললেন যে, তোমরা সিরিয়া প্রদেশে চলে যাও। অবশ্য আমি তোমাদের গতিবিধির সন্ধান রাখবো। অতঃপর তিনি তাদেরকে সিরিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন। -সূত্র, মোহাম্মাদ আকরম খাঁ, মোস্তফা চরিত, পৃষ্ঠা ৪৭১-৪৭২, কানযুল উম্মাল, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২৮২
আসলে বনূ কুরাইজার নিহত যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যাকে বাড়িয়ে যারা এসব ডাহা মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করে থাকেন তাদেরকে প্রায়ই নিজেদেরকে মুক্ত চিন্তার মানুষ হিসেবে দাবী করতে দেখা যায়। আসলে এটাই এখন চিন্তার বিষয় যে, মুক্ত চিন্তার সত্যিকারের মানেটা কি? মুক্ত চিন্তা মানে কি, একতরফা চিন্তা? একতরফা বিচার ফায়সালা? নিজের মনগড়া চিন্তাভাবনাকেই কি মুক্ত চিন্তা বলতে হবে?
তাদেরকে বিনীতভাবে একটা প্রশ্ন করি-
যখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আমাদের দেশের উপরে আক্রমণ করেছিল তখন আমাদের দেশের নাগরিকদের মধ্যে রাজাকার, আল বদরসহ যেসব লোক পাকিস্তানীদের পক্ষে কাজ করে আমাদের দেশের মানুষদের হত্যায় সহযোগিতা করেছিল সেসব গাদ্দার রাজাকারদের ক্ষেত্রে মুক্তচিন্তার অধিকারী এসব ভাইদের মতামত কী? তারা কি বলবেন যে, সেসব রাজাকারদের ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল? কিংবা, বঙ্গভবন অথবা রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায় অভ্যর্থনার মাধ্যমে তাদেরকে ফুলের মালা পড়িয়ে পুরষ্কৃত করা সঠিক ছিল? না কি, তাদের কঠোর বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের পক্ষে তারা তাদের মত প্রদান করবেন?
বস্তুতঃ আমরা তো দেখেছি, মুক্ত চিন্তার অধিকারী দাবিদারগণই গাদ্দার যুদ্ধাপরাধী এসব রাজাকারদের হত্যা করার জন্য সবচে’ বেশি সোচ্চার। হওয়া উচিতও তো ছিল সেটাই। তাহলে বনু কুরাইজার যুদ্ধাপরাধী গাদ্দারদের ক্ষেত্রে তাদের এই দ্বি-চারিতা কেন? তাদের একই মুখে বিশ্বাসঘাতক চুক্তি ভঙ্গকারী বনু কুরাইজার জন্য এ কেমন হাস্যকর দরদ? এ কেমন মায়াকান্না? এটা কি দ্বিমুখী নীতি নয়? এটাকে দ্বি-চারিতা ছাড়া আর কিইবা বলা যায়?
অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হওয়ার পূর্বে প্রতিটি কথা যাচাই করে নেয়া বুদ্ধিমানের কাজঃ
কিছু লোককে তো দেখা যায়, অন্যের বলা কথাই তারা তোতাপাখির মত আউড়ে বেড়াতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাদের প্রতি অনুরোধ, বাছবিচার না করে অন্যের বলা কথার সত্যতা যাচাই না করে শুধু শুধু না আউড়ে, নিজের বিবেক বুদ্ধি দিয়ে ঘটনাগুলো দয়া করে একটু আধটু যাচাই করুন। নিজের বিবেকের কাছে অন্ততঃ নিজেকে সৎ বলে প্রমান করুন। তাহলে দেখবেনঃ বনু কুরাইজার ঘটনার উপরে কোন সুস্থ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তির প্রশ্ন থাকতে পারে না।
বনূ কুরাইজার বিচার হয়েছিল তাওরাতের বিধান অনুসারেঃ
যুদ্ধাপরাধী বনূ কুরাইজার বিচারের ক্ষেত্রে তাদের প্রতি ফায়সালা রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে দেননি বরং এই দায়িত্বটি দেয়া হয়েছিল তাদেরই গোত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তি হযরত সা'দ ইবনে মু'আয রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর উপরে। বস্তুতঃ বনূ কুরাইজার ব্যাপারে হযরত সা'দ ইবনে মু'আয রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর ফায়সালা তাওরাতের বিধান অনুযায়ী হয়েছিল, যার প্রতি তাদের ঈমান ছিল। তাওরাতের সফর ইস্তিসনা, বিংশতম অধ্যায়ের দশম আয়াতে আছেঃ
''যখন তুমি যুদ্ধের জন্য কোন শহরের নিকটবর্তী হও, প্রথমে তাদেরকে সন্ধির প্রস্তাব দাও; তারা যদি সন্ধির প্রস্তাবে সম্মত হয় এবং তোমাদের জন্য ফটক খুলে দেয়, তা হলে ঐ জনপদে যত নাগরিক পাওয়া যাবে, সবাই তোমাদেরকে খাজনা দেবে এবং তোমাদের সেবা করবে। আর যদি তারা তোমাদের সাথে সন্ধি না করে বরং যুদ্ধ করে, তবে তাদেরকে তোমরা অবরোধ কর, আর যখন আল্লাহ তা'আলা তা তোমাদের করতলে দেন, তবে সেখানকার সমস্ত পুরুষকে মৃত্যুদন্ড প্রদান কর কিন্তু স্ত্রীলোকদেরকে, বালকদেরকে এবং জীবজন্তুসহ যা কিছু ঐ শহরে আছে, সব কিছু তোমাদের জন্য নিয়ে যাও। তোমাদের প্রভূই সেগুলো ভোগের জন্য তোমাদের দিয়েছেন, (সুতরাং) ভোগ কর।'' -দেখুন, সীরাতুল মুস্তাফা ২য় খন্ড, আল্লামাহ ইদরীস কান্ধলভী, পৃষ্ঠা ২৮৩
একটি ভুল ধারণার অপনোদনঃ
ইসলাম বিরোধী শিবির বরাবরই বনূ কুরাইজাকে শাস্তি সম্মন্ধে নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচারের জোর আপত্তি তুলে থাকেন। তারা শুধু ঘটনার খোলস তথা বাহিরের দিকটাই দেখে থাকেন। উহার অভ্যন্তরে তলিয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করেন না। শাস্তির রূপটিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, উহার কারণ পর্যালোচনা করেন না। যদি তারা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন হতে রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে বনূ কুরাইজার আচরণ গভীরভাবে পর্যালোচনা করতেন তাহলে কোনোভাবেই নিষ্ঠুরতার অপবাদ উত্থাপন করতেন না। নিচে প্রকৃত ব্যাপারটির সার সংক্ষেপ তুলে ধরা হচ্ছে, যার দ্বারা বুঝা যাবে, কেন তাদের বিরুদ্ধে সা'দ রা. উপরোক্ত রায় প্রদান করেছিলেন-
এক. মদীনায় পৌঁছে রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনূ কুরাইজার সঙ্গে সদয় আচরণ করেন এবং মৈত্রী চুক্তি স্থাপন করেন।
দুই. তিনি তাদের সঙ্গে যে চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন তাতে তাদেরকে পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং জানমাল রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছিল।
তিন. বনূ কুরাইজা বনূ নাযির অপেক্ষা কম মর্যাদাসম্পন্ন হিসেবে বিবেচিত ছিল। বনূ নাযিরের কারও দ্বারা বনূ কুরাইজার কেউ নিহত হলে তার রক্তপণ ছিল অর্ধেক। অপরদিকে বনূ কুরাইজার দ্বারা বনূ নাযিরের কেউ নিহত হলে কুরাইজার ইয়াহূদিদেরকে পূর্ণ রক্তপণ পরিশোধ করতে হতো। মানবতার মুক্তির দিশারী রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনূ কুরাইজাকে এই সামাজিক বৈষম্যের শৃঙ্খল হতে মুক্ত করেন। তিনি তাদের মর্যাদা বনূ নাযিরের সমান করে দেন। -সূত্র, আবূ দাউদ, ২য় খন্ড পৃষ্ঠা, ২৭৭
চার. রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনূ নাযিরকে মদিনা হতে বহিষ্কার করার পর বনূ কুরাইজার সাথে চুক্তি নবায়ন করেন। পুনঃচুক্তির মাধ্যমে তিনি তাদেরকে স্বীয় বাসস্থানে অবস্থানের সুযোগ দেন।
পাঁচ. তাদের সঙ্গে এত ভালো আচরণ করার পরও মুসলমানগণ যখন তাদের জীবনের সর্বাপেক্ষা কঠিন মুহূর্ত অতিক্রম করছিলেন, ইসলাম বিরোধী বহিঃশত্রুর সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমন হতে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার লক্ষ্যে একাধারে কয়েক দিন ক্ষুধার্ত অবস্থায় দীর্ঘ পরিখা খননের মাধ্যমে রণপ্রস্তুতিতে যখন একেবারে ক্লান্ত ও অবসন্নপ্রায়, ঠিক এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতি ও নাযুক অবস্থায় তারা মদিনার ভিতরে থেকেই রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করে এবং মুসলমানদেরকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য ইয়াহূদী-কুরাইশ সামরিক শক্তির পক্ষাবলম্বন করে।
ছয়. মুসলিম নারী ও শিশুগণকে হেফাজতের জন্য তাঁবুতে প্রেরণ করা হলে তারা তাদের উপরে আক্রমন করতে উদ্যত হয়। -দেখুন, সীরাতুন নবী, ১ম খন্ড পৃষ্ঠা ২৫৪
সাত. জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়াও এই অকৃতজ্ঞ গোষ্ঠী মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য পনের শত তরবারি, দুই হাজার বর্শা-বল্লম, তিন শত বর্ম ও পনের শত ঢাল সংগ্রহ করে রেখেছিল যা তাদের দুর্গ বিজিত হওয়ার পরে মুসলিম বাহিনীর হস্তগত হয়। -দেখুন, তাবাকাত ইবনে সা'দ, পৃষ্ঠা ৭৫
আট. খন্দক যুদ্ধের মূল উস্কানীদাতা হুয়াই ইবনে আখতাব, যাকে বিদ্রোহের অপরাধে মদিনা হতে বহিষ্কার করা হয়েছিল এবং যে গোটা আরবকে উস্কানী দিয়ে আহযাব (খন্দক) যুদ্ধের আয়োজন করিয়েছিল, বনূ কুরাইজা এমন রাষ্ট্রদ্রোহী শত্রু নিজেদের সঙ্গে রেখে গাদ্দারী ও হঠকারিতার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে।
এমতাবস্থায় তাদের সঙ্গে উপরোক্ত আচরণ ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। তারা নিজেদের কুকর্মের ফলে সর্বাপেক্ষা জঘন্য যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে গণ্য হয়েছিল, যাদের প্রাপ্য কেবল মৃত্যুদন্ডই। -সূত্র, আর রাহিকুল মাখতূম, পৃষ্ঠা ২৯০
আরবে চুক্তির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। মৈত্রী চুক্তিকে প্রকৃত ভ্রাতৃত্বের সমতুল্য মনে করা হতো। মৈত্রী বন্ধনের ফলে রক্তের সম্পর্কের ন্যায় অনেক সময় গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হতো। বনূ কুরাইজার মিত্র আওসের অবস্থা ছিল ঠিক অনুরূপ। তারা মনে-প্রাণে চাচ্ছিল, বনূ কুরাইজা যেন কোনরূপ শাস্তির সম্মুখীন না হয়। তাদের সঙ্গে যেন ক্ষমাসুন্দর আচরণ করা হয়। তাদের ব্যাপারে আওস গোত্রপতি সাদ ইবনে মুয়াজ রা. এর পেরেশানীও কম ছিল না। চুক্তির ব্যাপারে তিনিই ছিলেন প্রকৃত যিম্মাদার। তাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্টতা ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন তাদের বড় হিতাকাঙ্খী। কিন্তু এই হতভাগ্য জাতির অপরাধ এতই মারাত্মক ছিল যে, এত কিছুর পরেও তাঁর (সা'দ রা.) পক্ষে উপরোক্ত সিদ্ধান্ত দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। -সূত্র, সীরাতুন নবী, পৃষ্ঠা ২৫৫
অপরাধ অনুপাতে সা'দ রা. এর ফায়সালা ছিল পুরোপুরি ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। এই ঘটনার উপর আলোকপাত করতে গিয়ে R.V.C Bodley তার The Messenger The Life of Muhammad নামক বিখ্যাত গ্রন্থে লিখেছেনঃ
''মুহাম্মাদ আরবে একা ছিলেন। এই ভূখন্ড আকার-আয়তনের দিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক-তৃতীয়াংশ এবং এর লোকসংখ্যা ছিল পঞ্চাশ লাখ। তাদের নিকট এমন কোন সৈন্যবাহিনী ছিল না যারা জনসাধারণকে আদেশ পালনে ও আনুগত্য প্রদর্শনে বাধ্য করতে পারে, কেবল একটা ক্ষুদ্র সেনাদল ছাড়া, যার সংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার। এই বাহিনীও আবার পরিপূর্ণরূপে অস্ত্রসজ্জিত ছিল না। এমতাবস্থায় যদি মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনরূপ শৈথিল্য কিংবা গাফলতিকে প্রশ্রয় দিতেন এবং বনূ কুরাইজাকে তাদের বিশ্বাসভঙ্গের কোনরূপ শাস্তিদান ব্যতিরেকে ছেড়ে দিতেন তাহলে আরব উপদ্বীপে ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হতো। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ইয়াহূদীদের হত্যার ব্যাপার খুবই কঠিন ছিল। কিন্তু ইয়াহূদীদের ধর্মীয় ইতিহাসে উহা কোন নতুন ব্যাপার ছিল না। আবার মুসলমানদের দিক হতে ঐ কাজের পেছনে পূর্ণ বৈধতা ও অনুমোদন বর্তমান ছিল''। -সূত্র, The Messenger The Life of Muhammad, London 1946, P. 202-3, নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা ২৭৭
স্যার স্ট্যানলি লেনপুল বলেন, ''মনে রাখতে হবে যে, তাদের অপরাধ ছিল দেশের সঙ্গে গাদ্দারী এবং তাও আবার অবরোধের মত সঙ্কটময় অবস্থায়'' Selection from the Quran, P,IXV। -সূত্র, সীরাত বিশ্বকোষ ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১০৩-৫ ইফাবা অনূদিত
পরিশেষে আমাদের প্রার্থনা শুধুই হেদায়েতের পথপ্রাপ্তিঃ
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেদায়াত দান করুন। খুলে দিন আমাদের বিবেকের বন্ধ দুয়ার। অটল, অবিচল এবং অনড় রাখুন হেদায়াতের চিরচেনা সহজ, সরল ও সত্য পথের উপরে। আমীন।
এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন-
০১। সীরাতুল মুস্তাফা ২য় খন্ড, আল্লামাহ ইদরীস কান্ধলভী, পৃষ্ঠা ২৮৩
০২। সীরাতে ইবনে হিশাম ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৩৮, ইফাবা অনূদিত, ২য় খন্ড পৃষ্ঠা ২৩৭, ২৩৮ ও ২৪৫
০৩। উয়ুনুল আছার- খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৮৭,
০৪। আর রাহীকুল মাখতূম, পৃষ্ঠা ৩১৮-৩২৪
০৫। তানকিহুল ফুহুম, পৃষ্ঠা ১২
০৬। সহীহ বুখারী, ২য় খন্ড পৃষ্ঠা ৫৯১
০৭। সহীহ বুখারী, ১ম খন্ড পৃষ্ঠা ৫৩৬
০৮। সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড পৃষ্ঠা ২৯৪
০৯। জামে তিরমিজি, ২য় খন্ড পৃষ্ঠা ২২৫
১০। ইসলামের ইতিহাস ১ম খন্ড, মাওলানা আকবর শাহ খান নজিবাবাদী প্রণীত, ইফাবা অনূদিত, পৃষ্ঠা ১৭৩-১৭৮
১১। সীরাত বিশ্বকোষ ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৮৫-১০৯ ইফাবা অনূদিত
১২। বনূ কুরাইজা যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ জানার জন্য দেখুন, ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড পৃষ্ঠা ২৩৩-২৭৩, সহীহ বুখারী, ২য় খন্ড পৃষ্ঠা ৫৯০-৫৯১, যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড পৃষ্ঠা ৭২-৭৪, মুখতাছারুছ ছিয়ার, শাইখ আবদুল্লাহ প্রণীত, পৃষ্ঠা ২৮৭-২৯০
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০২১ বিকাল ৪:৩৪