ইসলামে যৌতুকের স্থান নেই...
ইসলাম কল্যাণময় জীবন ব্যবস্থার সূব্যবস্থা ও বিধি-বিধান প্রদান করেছে। মানব সমাজকে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করে ইসলাম। সুখ শা্ন্তিতে ভরপুর আনন্দময় জীবনের পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়ে মানুষের জন্য যা যা কল্যানকর তার সবকিছুই রয়েছে ইসলামে। মানবতার অবমাননা হয় এমন কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই ইসলামে। বিয়ে শাদির ক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়ত কিছু বিষয় নির্ধারণ করে দিয়েছে যা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য কল্যানকর। এর মধ্যে নারীর জন্য স্বামীর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত মোহর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাশাপাশি বিবাহিত জীবনে আত্মীয়দের মধ্যে পরস্পর উপহার, উপঢৌকন এবং বিনিময়ের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। উপহারের আলোচনার সাথে সাথে চলে আসে যৌতুকের মত অনাকাঙ্খিত বিষয়টিও। অনেকে উপহার এবং যৌতুককে এক এবং একাকার করে ফেলেন। বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় সচেতনতার লক্ষ্যে উপহার এবং যৌতুকের পার্থক্য নিঃসন্দেহে আলোচনাযোগ্য। বলা বাহুল্য, মনুষ্যত্বের জন্য অবমাননাকর ঘৃণ্য যৌতুক প্রথার স্থান নেই ইসলামে। নারী জাতির প্রতি চরম অবমাননা, নিগ্রহ এবং অন্যায় ও জুলূমের হাতিয়ার যৌতুকের অনুমোদন দেয় না ইসলামী শরিয়ত। জঘন্য এবং ঘৃণ্য এ প্রথা ইসলামী বিধি-বিধান ও আদর্শ এবং নির্দেশনার সাথে সর্বোতই সাংঘর্ষিক। ইসলামের নীতি আদর্শের পরিপন্থী এবং সম্পূর্ণ অগ্রহনযোগ্য।
ইসলাম নারীকে মর্যাদার আসন দিয়েছে। বিয়ের সময় স্ত্রীর কাছ থেকে যৌতুক গ্রহণ করা তো নয়ই বরং স্ত্রীকে মোহর প্রদানের জন্য বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে ইসলাম। কুরআনে হাকিমের সূরা নিসার ৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করা হয়েছে
وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً ۚ فَإِن طِبْنَ لَكُمْ عَن شَيْءٍ مِّنْهُ نَفْسًا فَكُلُوهُ هَنِيئًا مَّرِيئًا
“আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশী মনে। তারা যদি খুশী হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর।” -সূরা নিসা: আয়াত ৪
ইসলাম শুধু যৌতুক প্রথার বিরোধীই নয় বিয়েশাদির ক্ষেত্রে সব ধরনের অপচয়েরও বিপক্ষে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সেই বিয়েই সর্বাধিক বরকতময়, যে বিয়েতে ব্যয় খুব সামান্যই হয়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে বিয়ে করেছেন সাধারণভাবে, নিজের প্রিয় কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.) কে বিয়ে দিয়েছেন একইভাবে। বিয়েতে অপব্যয় পাত্র-পাত্রীর পরিবারের জন্য কষ্টকর পরিণতি ডেকে আনে। সামাজিক সম্মান রক্ষার অজুহাতে অনেকে বিয়েতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় করে দেউলিয়া হয়ে পড়ে, যা ইসলাম কোনোভাবেই অনুমোদন করে না।
যৌতুককে শোষণ এবং নারী নিগ্রহের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় আমাদের সমাজে। যৌতুক আদায়ের জন্য স্ত্রীর ওপর দৈহিক নির্যাতন চালানোর ঘটনা অহরহ ঘটে থাকে, এমনকি এই বর্বরতায় হত্যার ঘটনা পর্যন্ত ঘটতে দেখা যায়। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরনের অমানবিক আচরণ স্পষ্টভাবে হারাম বা নিষিদ্ধ।
মহর নিয়ে কিছু কথাঃ
আরবি মহর শব্দটির বাংলা উচ্চারণ মাহর, মুহর, মোহর। এর আভিধানিক অর্থ হলো দান-অনুদান। বস্তুতঃ মহর বলতে আরও কিছু জিনিষ বুঝানো হয়ে থাকে, যেমন- প্রাচীন যুগের স্বর্ণের তৈরি মুদ্রাবিশেষ বা স্বর্ণমুদ্রাকেও মহর বলা হতো। নামের সিল বা ছাপও মহর নামে পরিচিত। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়- বিয়ের সময় বরের পক্ষ থেকে কনেকে যে অর্থ বা সম্পদ দেওয়া হয়, তাকে মহর বলে। বিবাহ সম্পাদনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘আকদ’। বিয়ের প্রস্তাব প্রদান, প্রস্তাব গ্রহণ, সাক্ষী ও মহর এগুলো ‘আক্দ’ সম্পন্ন হওয়ার মৌল বা আবশ্যিক উপকরণ হিসেবে স্বীকৃত। সর্বশেষ বিয়েকার্য সমাধা করার লিখিত রূপকে বলা হয়ে থাকে ‘কাবিন’, যা বিয়ে শাদিতে গুরুত্ব বহন করে এবং বিয়ের দালিলিক প্রমান বহন করে।
‘মহরে মিছাল’ কি?
বিয়ের ক্ষেত্রে মহর নির্ধারণ করা নেয়া উচিত, কারণ মহর বিয়ের অন্যতম ফরজ। তবে, কোনো কারণে বিয়েতে কখনো যদি মহর অনির্ধারিত বা ঊহ্য থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে ‘মহরে মিছাল’ বা ‘সমমান মহর’ বর্তাবে। সমপর্যায়ের, সমবয়সের, সমমর্যাদাপূর্ণ, সমমান, সমরূপ ও সমগুণসম্পন্ন অন্য কোনো মেয়ের প্রচলিত সাধারণ মহরের সমপরিমান মহর নির্ধারণ করাকে ‘মহরে মিছাল’ বা ‘সমমান মহর’ বলা হয়।
মহর পরিশোধ করার নিয়মঃ
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহর বিয়ের অন্যতম পালনীয় শর্ত। স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে মহর পরিশোধ করে দেয়া অত্যাবশ্যক। আর মহর বিয়ের সময় বর কর্তৃক কনেকে প্রদত্ত সম্মানী; যার মাধ্যমে সে স্বামীর অধিকার লাভ করে। মহর নগদে প্রদান করা উচিত। উভয় পক্ষের সম্মতিতে আংশিক বা সম্পূর্ণ বাকিও থাকতে পারে। তবে তা অবশ্যই পরিশোধযোগ্য। পরিশোধ না করা হলে স্বামীকে এর দায়ভার বহন করতে হবে। স্ত্রীর কাছে তাকে দেনাদার হিসেবে থাকতে হবে।
মহরের পরিমাণ নির্ধারণঃ
বরের সামর্থ্য এবং কনের যোগ্যতা বিবেচনায় উভয় পক্ষের সম্মতিতে মহরের পরিমাণ নির্ধারিত হবে। এর সর্বনিম্ন কোনো পরিমাণ নির্ধারিত নেই। কোরআন করিমে বলা হয়েছে:
وَآتَيْتُمْ إِحْدَاهُنَّ قِنطَارًا فَلَا تَأْخُذُوا مِنْهُ شَيْئًا
‘আর যদি তোমরা তাদের কোনো একজনকে অগাধ সম্পদ বা অঢেল অর্থও দিয়ে থাকো, তবু তা হতে কিছুই প্রতিগ্রহণ করো না।’ -সুরা: ৪ নিসা, আয়াত: ২০
তবে মহরের পরিমাণ এত কম হওয়া উচিত নয়, যাতে মেয়ের সম্মান ও অধিকার ক্ষুন্ন হয় এবং এত বেশি হওয়াও বাঞ্ছিত নয়, যা ছেলের ওপর জুলুম হয়। মহর নির্ধারণের সময়ই তা পরিশোধের বিষয়টি মাথায় রেখে ধার্য্য করতে হবে। অন্যদের প্রদর্শনের জন্য বা যশ খ্যাতি ইত্যাদি লাভের উদ্দেশ্যে কখনোই মহর নির্ধারণ করা উচিত নয়।
মহরের অর্থের মালিকানাঃ
জেনে রাখা প্রয়োজন যে, মহরের অর্থ একান্তই স্ত্রীর। এই অর্থ তিনি যেভাবে খুশি ব্যয় করতে পারবেন। সঞ্চয় হিসেবে জমা করেও রাখতে পারবেন। ইচ্ছে করলে তিনি মহরের অর্থ কোনো কাজে বিনিয়োগও করতে পারবেন। মোটকথা, স্ত্রীই মহরের অর্থের পূর্ণ অধিকারী, তিনি যাকে ইচ্ছে উক্ত অর্থ দান-অনুদান বা উপহার ও হাদিয়া হিসেবে প্রদান করতে পারবেন। এতে স্বামী কিংবা অন্য কারও কিছু বলার থাকবে না। সহজ কথায় মহরের অর্থ যেহেতু স্ত্রীর, সেহেতু তিনিই তা ব্যয় করার বিষয়ে পূর্ণ ক্ষমতাবান।
দেনমোহর এবং আমাদের সমাজ বাস্তবতাঃ
আল্লাহ তাআলা বলেন: وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً ۚ فَإِن طِبْنَ لَكُمْ عَن شَيْءٍ مِّنْهُ نَفْسًا فَكُلُوهُ هَنِيئًا مَّرِيئًا “আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশী মনে। তারা যদি খুশী হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর।” -সূরা নিসা: ৪
কুরআনুল কারিমের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকার সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যবশত: স্বীকার না করে উপায় নেই যে, কুরআনের এ নির্দেশ বর্তমানে আমাদের সমাজে সরকারী বিয়ে রেজিস্ট্রির খাতায় কেবল লিখে রাখার বিষয়ের মধ্যে দিনকে দিন সীমিত হয়ে যাচ্ছে। অনেক মানুষ তাদের স্ত্রীদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবধারিত ও অনিবার্য প্রাপ্য মোহর থেকে শুধু বঞ্চিতই করছে না বরং উল্টো স্ত্রীর পরিবার থেকে চাপ প্রয়োগ করে, কৌশল খাটিয়ে এবং বিভিন্ন প্রকার উপায় অবলম্বন পূর্বক বিপুল পরিমাণ অর্থ-কড়ি এবং আসবাব-পত্র যৌতুক হিসেবে হাতিয়ে নিচ্ছে। এটি নি:সন্দেহে কনের পরিবারের উপর একটি মারাত্মক জুলুম। যে পিতা তার শরীরের রক্ত ঘাম দিয়ে একটি মেয়েকে প্রতিপালন করলেন সেই মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে তার মাথার উপর যখন যৌতুকের মত এই মহা অভিশাপ চেপে বসে তখন তার মানসিক কী অবস্থা কী হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ যৌতুকের কারণে কত অসহায় নারীকে স্বামীর নির্মম নির্যাতনে নিষ্পেষিত হচ্ছে, অপমানিত হতে হচ্ছে, কত নারী তার স্বামী বা স্বামীর আত্মীয়-স্বজনদের অত্যাচারে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে সেসব খবর মিডিয়ায় কয়টাই বা প্রকাশ পায়? সুতরাং, বিধর্মীদের থেকে অনুপ্রবেশকারী এই অপসংস্কৃতি, সামাজিক ব্যাধি ও হারাম প্রথার অবসান হওয়া জরুরি।
যৌতুক কাকে বলে?
যৌতুকের আবার সংজ্ঞা কি? যৌতুক তো যৌতুকই। যৌতুক মানে, অপরের সম্পদের প্রতি অন্যায়ভাবে লালায়িত হওয়া। যৌতুক মানে, অন্যের সম্পদ গ্রাস করা। যৌতুক মানে, অসহায় একটি নারী যিনি স্ত্রী হয়ে স্বামীর বাড়িতে এসেছেন, তাকে জিম্মি করে তার বাবা মায়ের কাছ থেকে অর্থ সম্পদ লুট করে নেয়া। বস্তুতঃ কনের পক্ষ থেকে বরকে বিয়ের সময় বা তার আগে-পরে শর্ত করে বা দাবি করে অথবা প্রথা হিসেবে কোনো দ্রব্যসামগ্রী বা অর্থ-সম্পদ ও টাকাপয়সা নেওয়া বা দেওয়াকে যৌতুক বলে। শরিয়তের বিধানে যৌতুক সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ এবং কবিরা গুনাহ বা মহাপাপ।
বাংলা অভিধানমতে, যৌতুক হলো ‘বিবাহের পর বর বা কনেকে যে মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী উপহার দেওয়া হয়। যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রদত্ত উপহার।’ -বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান
বাংলা পিডিয়ায় বলা হয়েছে: “বিবাহের চুক্তি অনুসারে কন্যাপক্ষ বরপক্ষকে বা বরপক্ষ কন্যাপক্ষকে যে সম্পত্তি বা অর্থ দেয় তাকে যৌতুক বা পণ বলে।” -বাংলাপিডিয়া ৮/৪৫৫
যৌতুক ও মহর একই জিনিষ নয়ঃ
এই অর্থে যৌতুক ও মহরের মধ্যে বিভ্রাট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। ইসলামে মহর হলো ফরজ ইবাদাত আর যৌতুক হলো বিলকুল হারাম ও সম্পূর্ণ নাজায়েজ। তাই যৌতুক ও মহর এই উভয়ের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করা জরুরি।
যৌতুক ও মহরের মাঝে পার্থক্যঃ
‘ছেলেপক্ষ যে অর্থ দেয় তা হলো মহর, মেয়েপক্ষ যা দেয় তা হলো যৌতুক।’ মেয়ের বাড়িতে শর্ত করে আপ্যায়ন গ্রহণ করাও হারাম যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত। যৌতুক চাওয়া ভিক্ষাবৃত্তি অপেক্ষা নিন্দনীয়, ঘৃণ্য ও জঘন্য অপরাধ। আমাদের দেশের আইনেও যৌতুক শাস্তিযোগ্য ও দণ্ডনীয় অপরাধ। যৌতুকের শর্তে বিয়ে সম্পাদিত হলে, বিয়ে কার্যকর হয়ে যাবে ঠিকই; কিন্তু যৌতুকের শর্ত অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে। ইসলামি শরিয়তের বিধানমতে অবৈধ শর্ত পালনীয় নয়, বরং বাধ্যতামূলকভাবেই তা বর্জনীয়।
যৌতুক প্রথা কেন হারাম?
ইসলামে কেন যৌতুক প্রথা হারাম ও গর্হিত বিষয় তা নিন্মে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল:
এক. যৌতুক ভিন্ন সংস্কৃতির অংশঃ
যৌতুক প্রথাটি অন্য কোনো কোনো ধর্মাবলম্বীদের রীতি-নীতির অন্তর্ভূক্ত। আর ইসলামের দৃষ্টিতে অমুসলিমদের ধর্মীয় রীতি-নীতি ও কৃষ্টি-কালচার অনুসরণ করা হারাম। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ “যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত হিসেবে গণ্য হবে।” -সুনানে আবু দাউদ, অধ্যায়: পোশাক-পরিচ্ছেদ হা/৪০৩১-হাসান সহিহ
অন্য ধর্মাবলম্বীদের এই অপসংস্কৃতিটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারত উপমহাদেশের মুসলিমদের মাঝে ব্যাপকভাবে অনুপ্রবেশ করেছে।
যেভাবে যৌতুক প্রথার উৎপত্তিঃ
এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত বইয়ের নিচের উদ্ধৃতিগুলো অনুধাবনযোগ্য। প্রথমতঃ “হিন্দু সমাজে নারীরা পুরুষদের মতো একইভাবে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতো না। তাই অনেক আগে থেকেই হিন্দু সমাজে নারীদেরকে বিয়ের সময়ে যৌতুক দেবার প্রচলন ছিল। কালক্রমে তা বিয়ের পণ হিসাবে আবির্ভূত হয় যা একসময় কনে পক্ষের জন্য এক কষ্টকর রীতি হয়ে দাঁড়ায়।” -উৎস: কাজী এবাদুল হক (জানুয়ারি ২০০৩ “যৌতুক”)
দ্বিতীয়তঃ “দীর্ঘদিন যাবত হিন্দু সমাজ ও মুসলিম সমাজ একত্রে বসবাসের কারণে সাম্প্রতিককালে আরো বিভিন্ন কুপ্রথার মতো এই যৌতুক কুপ্রথাটিও মুসলিম সমাজে সংক্রমিত হয়।” -ইসলামের বৈধ ও নৈতিক প্রেক্ষাপট। লেখক: তমিজুল হক (ব্যরিস্টার এট ল.) পৃষ্ঠা নং ৫২৮
দুই. যৌতুক অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভক্ষণের নামান্তরঃ
ইসলামের দৃষ্টিতে এটি ‘অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভক্ষণ’ এর নামান্তর। এটি আল্লাহ তাআলা বলেন: وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُم بَيْنَكُم بِالْبَاطِلِ “তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করো না।” (সূরা বাকারা: ১৮৮)
তিন. প্রচলিত আইনে যৌতুক দণ্ডনীয় অপরাধঃ
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে যৌতুক লেনদেন একটি দণ্ডনীয় অপরাধ আর ইসলামের বিধান হল, মানব কল্যাণে প্রণীত সরকারী আইন মান্য করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য অপরিহার্য। কোনভাবেই তা লঙ্ঘন করা বৈধ নয়-যতক্ষণ না তা আল্লাহর নির্দেশ পরিপন্থী হয়। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের যৌতুক নিরোধক আইন অনুসারে যৌতুক গ্রহণের অপরাধ প্রমাণিত হলে এক থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল বা ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
যৌতুকের শাস্তিঃ
১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইন অনুযায়ী, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যদি কোনো পক্ষ অপর পক্ষকে বিয়ের আগে-পরে বা বিয়ে চলাকালে যেকোনো সময় যেকোনো সম্পদ বা মূল্যবান জামানত হস্তান্তর করে বা করতে সম্মত হয়, সেটাই যৌতুক বলে বিবেচ্য হবে। যৌতুক গ্রহণ ও যৌতুক প্রদান অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
যৌতুক নেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যা প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর এবং সর্বনিম্ন এক বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
চার. যৌতুক প্রথা বিবাহের ক্ষেত্রে শরিয়তের বিধান পরিপন্থীঃ
যৌতুক প্রথা বিবাহের ক্ষেত্রে শরিয়তের বিধান পরিপন্থী। কেননা ইসলামের বিধান হল, বিয়ের ক্ষেত্রে স্বামী তার স্ত্রীকে দেনমোহর প্রদান করবে। স্ত্রীর পক্ষ থেকে অগ্রিম চুক্তি করে কোনো কিছু নেয়ার বিধান দেয়া হয় নি। কিন্তু এখানে নামকে ওয়াস্তে দেনমোহর রেজিস্ট্রেশন খাতায় লেখা হলেও বাস্তবে স্ত্রীর নিকট যৌতুক গ্রহণ করা হয়। সুতরাং তা সম্পূর্ণ হারাম, জুলুম ও অনৈতিক কাজ। বর বা তার পরিবারের জন্য এ সম্পদ ভক্ষণ করা সম্পূর্ণ হারাম। পূর্ব যুগের মুসলিমগণ এই যৌতুক প্রথার সাথে পরিচিত ছিল না। কিন্তু বিশেষ করে পাক-ভারত উপমহাদেশে অমুসলিমদের সাহচর্য্যে থাকার ফলে ধীরে ধীরে এই নিকৃষ্ট প্রথা দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ ও অসচেতন মুসলিমদের মাঝে সংক্রামিত হয়েছে। (আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমীন)
উপহার বলতে আমরা কি বুঝবো?
নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থ দানকে উপহার বলা হয়। এই উপহার যে কেউ যে কাউকে যেকোনো সময়ে যেকোনো অবস্থায় যেকোনো অবস্থানে যেকোনো অবস্থান থেকে দিতে পারেন। সুতরাং, বিয়ের সময় বা তার পরে স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে যেকোনো কিছু উপহার দিতে পারেন।
স্বামীর দেওয়া উপহার সাধারণত মহরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে না। কখনো যদি মূল্যবান গয়না ও অলংকার মহরের মধ্যে শামিল করা হয়, তখন বলা হয়ে থাকে ‘জেওর ও মহর’ এত টাকা এবং জেওর বা অলংকার বাবদ ওয়াসিল বা পরিশোধ এত টাকা। কনের পরিবারের পক্ষ থেকে শর্ত ও দাবি ছাড়া বরকে কোনো উপহার দিতে বাধা নেই। তবে প্রথা বা অঘোষিত শর্তরূপে দিতে বাধ্য হলে তা পরিহারযোগ্য। বিবাহ উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব বর ও কনেকে উপহার দিতে পারেন। তবে এটি যেন প্রথারূপে না হয়। উল্লেখ্য যে মহর প্রদেয়, উপহার অফেরতযোগ্য।
বিয়ের সময় প্রদত্ত উপহারসামগ্রী বা অর্থের মালিক বর বা কনে। যে উপহার যাঁকে দেওয়া হয়েছে, তিনিই সেই উপহারের মালিক। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি, যেমন শ্বশুর-শাশুড়ি বা অন্য কেউ মালিকের পূর্ব অনুমতি ছাড়া এসব উপহার কাউকে দিতে পারবেন না এবং যথেচ্ছ ব্যবহারও করতে পারবেন না। স্ত্রী বা কনে প্রাপ্ত উপহার নিজে ব্যবহার করা ছাড়াও যাকে খুশি কারও অনুমতি ছাড়া দিতে পারবেন। এতে স্বামী বা বরপক্ষের কারও কোনো এখতিয়ার থাকবে না; যদিও সেই উপহারসামগ্রী স্বয়ং স্বামী বা বরপক্ষই দিয়ে থাকে।
উপহার কি যৌতুক?
বিয়েতে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত মূল্যমানের উপহার যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে না। তবে এখানে শর্ত হচ্ছে যে এই উপহার অবশ্যই বিয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয় এমন কেউ প্রদান করতে হবে এবং বিয়ের পণ (যৌতুক) হিসেবে প্রদান করতে পারবেন না, উপহার হিসেবে দিতে হবে।
অর্থাৎ বিয়ের শর্ত হিসেবে ৫০০ টাকার সমমূল্যের কোনো কিছুও দেওয়া যাবে না। দিলে তা আইন অনুসারে যৌতুক হবে এবং অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ অনুযায়ী, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে বা বিবাহের পণ হিসেবে প্রদত্ত বা প্রদানে সম্মত অর্থ, যেকোনো সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ হলো যৌতুক।
আমাদের বর্তমান অবস্থা এবং করণীয়ঃ
আমাদের দেশের মুসলমানদের মধ্যে যৌতুক প্রথা বেশ জোরেশোরে প্রচলিত। এ দেশীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত যৌতুক প্রথা মুসলিম সমাজকে এতটাই আক্রান্ত করেছে যে, আমাদের দেশে যৌতুক ছাড়া বিয়ে এখন খুব কমই হয়। অথচ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলে কিংবা পরবর্তীতে ইসলামী সমাজে কখনো যৌতুক চালু ছিল, এমন প্রমাণ নেই। যৌতুকের মত গুরুতর অপসংস্কৃতি কুরআন হাদিসের নীতি, আদর্শ এবং নির্দেশনার পরিপন্থী বিধায় তা বর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য্য।
পবিত্র কুরআনুল কারিমে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে উদরস্থ করার ব্যাপারে কঠোর ধমকি প্রদান করে এর উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। বস্তুতঃ বিবাহযোগ্য মেয়ের অভিভাবকগণ তাদের মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে যৌতুক দিতে বাধ্য হয়ে থাকেন। যারা যৌতুক গ্রহণ করেন নিঃসন্দেহে তারা অন্যায়ভাবেই এ অর্থ সম্পদ নিয়ে থাকেন। মনে রাখতে হবে, এটি অবৈধ এবং সুনিশ্চিতভাবে গুনাহের কাজ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা আমাদের যৌতুকের গর্হিত ও নিন্দিত পথ থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন। যৌতুক এবং শোষনমুক্ত পরিবার এবং সমাজ বিনির্মানে, প্রতিটি ঘরে ঘরে সুখ শান্তি এবং শৃঙ্খলা আনয়নে আমাদের সকলের সার্বিক সচেতনতার কোনোই বিকল্প নেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০২১ দুপুর ১২:৩২