ইমাম আবু হানিফা রহ. এর জীবন ও কর্ম এবং হাদিস ও ফাতাওয়ায় তার অবদান
নোমান ইবনে সাবিত ইবনে যুতা ইবনে মারযুবান (জীবনকাল : ৮০ হি.-১৫০ হি.= ৬৯৯-৭৬৭ খ্রীষ্টাব্দ) (: نعمان بن ثابت بن زوطا بن مرزبان), উপনাম ইমাম আবু হানিফা নামেই অধিক পরিচিত, ছিলেন ফিকহশাস্ত্রের একজন প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ এবং হিজরী প্রথম শতাব্দীর একজন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ব্যক্তিত্ব। ইসলামী ফিকহের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও পরিচিত চারটি সুন্নি মাযহাবের একটি “হানাফি মাযহাব”-এর প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।
মুসলিম উম্মাহর ঐতিহাসিক অহংবোধের প্রতীক এক উজ্জ্বল চরিত্রের মানুষঃ
জ্ঞান সরোবরের গভীর অতলান্ত পদ্ম, ইলম, আমল এবং অধ্যাবসায়ের আকাশের অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র ইমাম আবু হানীফা রহ. আমাদের গর্ব ও গৌরবের প্রতীক। আখলাকে নববীর মিছালি ও বাস্তব নমুনা। জ্ঞানের আকাশে ভূবন আলোকিত করা পূর্ণিমার স্নিগ্ধ চাঁদ। কূলহীন জ্ঞানসমুদ্র। তাঁর অসাধারণ জ্ঞান, অপরিমেয় প্রজ্ঞা এবং বিপুল বিশাল প্রতিভার ছবি আঁকা আমাদের মত ক্ষুদ্রগনের পক্ষে সত্যি দূরূহ। তাঁর বিদ্যাপর্বতের পরিমাপ করা, তাঁর অবাক করা আখলাক ও মহামানবোচিত চরিত্রকে সঠিকভাবে চিত্রন করা আমাদের জন্য সত্যি কঠিন। তাই তো শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী হাদীস শাস্ত্রের প্রাণপুরুষ ইমাম ইবনুল আছীর আল জাযারী রহ. (ওফাত : ৬০৬ হি.) মন্তব্য করেছেন—
ولو ذهبنا إلى شرح مناقبه وفضائله لأطلْنا الخَطْب، ولم نصلْ إلى الغرض منها، فإنه كان عالما عاملا زاهدا عابدا ورعا تقيا، إماما في علوم الشريعة مرضيا.
‘যদি আমরা তাঁর বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর বিশদ বিশ্লেষণ করি, তাহলে বক্তব্য অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে; আর আমরা এ মহিমা কীর্তনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারব না। কেননা তিনি ছিলেন আলেম, আলেম বিল্লাহ ওয়া বি- আমরিল্লাহ, ব্যক্তি জীবনে ধর্মীয় অনুশাসনের যত্নবান অনুসারী, যাহেদ, দুনিয়া নির্মোহতায় চূড়ান্ত, (অতি উচ্চ মার্গের) ইবাদতগুজার, খোদাভীরু ও মুত্তাকী এবং ইলমে শরীয়াতের গ্রহণযোগ্য ইমাম।’ -দ্রষ্টব্য. জামেউল উসুল, ইমাম আবু হানীফা
ইমাম আযমের মাকাম ও মর্যাদা ফুটিয়ে তোলার জন্য কি উদার সুন্দর কথা! এই সংক্ষিপ্ত জীবনী ও রচনার নানা অংশে তাঁর বৈচিত্রময় শুভ্র-সুন্দর জীবনের বিভিন্ন দিক ও তাঁর জ্ঞানবিদ্যার যৎসামান্য পরিচয় তুলে ধরতে সামান্য চেষ্টাচরিত্র করা হয়েছে মাত্র। ইতিহাস কেবল অতীত নয়, এক কথায় আমাদের ভবিষ্যতও। আমাদের মনীষীদের গৌরবময় ইতিহাসের চর্চা যতই বেগবান হবে ততই মুসলিম উম্মাহর আত্মার রূপরেখা নির্মাণের কাজটি সহজ হবে। আল্লাহ্ তাআলা এ ক্ষুদ্র প্রয়াসকে কবুল করুন। আমীন।
কাশফুয যুনূন প্রণেতা হাজী খলীফা (ওফাত : ১০৬৭ হি.) বলেন—
قال أصحاب المناقب : ينبغي لكل مقلد إمام أن يعرف حال إمامه الذي قلده، ولا يحصل ذلك إلا بمعرفة مناقبه وشمائله وفضائله وسيرته في أحواله وصحة أقواله، ثم إنه لابد من معرفة اسمه وكنيته ونسبه وعصره وبلده، ثم معرفة أصحابه وتلامذته.
মানাকিব প্রণেতাগণ, ইমামদের জীবনীকারগণ বলেন, ‘প্রত্যেক মুকাল্লিদের জন্য তার অনুসৃত ইমামের বৃত্তান্ত জানা থাকা দরকার; আর তা জানা সম্ভব হবে না তাঁর চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী শামায়েল (স্বভাব চরিত্র, আচার-ব্যবহার, অভ্যাস) প্রভৃতি লিপিবদ্ধ এবং বিভিন্ন অবস্থায় তাঁর আচরণ ও উচ্চারণ তথা ব্যক্তিগত জীবন ও তাঁর বক্তব্যের যথার্থতা সম্পর্কে অবগত হওয়া ছাড়া। তদুপরি তাঁর নাম, কুনিয়াত (ডাকনাম), নসব, যুগ ও দেশ এবং তাঁর অনুগামী ও শাগরিদবৃন্দ সম্পর্কেও জানা থাকতে হবে।’ [কাশফুজ যুনূন-২/৬৭২]
এককথায়, অনুসৃত ইমামের জীবনের প্রত্যেকটি দিক মুকাল্লিদের সামনে উজ্জ্বল ও প্রোজ্জ্বল থাকবে। অতি স্পষ্টরূপে দেদীপ্যমান থাকবে। তা দৃষ্টির অন্তরালে প্রচ্ছন্ন থাকা মোটেও কাম্য নয়। কেননা চোখওয়ালা ভক্ত ও বীর-ভক্তই কাম্য।
জন্ম ও পরিচয়ঃ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের ৬৯ বছর পরে ৮০ হিজরীতে (প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী) আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের আমলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বায়আতে রিযওয়ানে অংশগ্রহণকারী বিখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আওফা রা. (ওফাত : ৮৭ হি.) তখন কুফাতেই অবস্থান করছিলেন। -আসসিয়আহ এর মুকাদ্দিমায় ইমাম আযমের জীবনী অংশ দ্র:
ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর নাম নুমান। কুনিয়াত আবু হানীফা। আর ইমামে আযম হল তাঁর লকব। আমরা পর্যায়ক্রমে তাঁর নাম ও কুনিয়াতের অর্থ ও তাৎপর্য নিয়ে কিছু কথা আরজ করব। তবে ইমামে আযম লকবের তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এ গ্রন্থের শেষ পর্যায়ের দিকে।
জন্ম, নাম ও বংশধরঃ
উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের রাজত্বকালে ইমাম আবু হানিফা ইরাকের কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ছয় বছর বয়সে আবদুল মালিক মৃত্যুবরণ করেন। ষোল বছর বয়সে তিনি পিতার সাথে হজ্জে গিয়েছিলেন তার পিতা সাবিত বিন যুতা কাবুল, আফগানিস্তানের একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তার পিতার বয়স যখন ৪০ বছর তখন আবু হানিফা জন্মগ্রহণ করেন। বংশধরের দিক থেকে তাকে অ-আরবীয় বলে ধরা হয়ে থাকে কারণ তার দাদার নামের শেষে যুতা। প্রখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবিদ খতীবে বাগদাদী আবু হানিফার নাতি ইসমাইল বিন হামাদের বক্তব্য থেকে আবু হানিফার বংশ ব্যাখা দেন। অন্য আরেক ইতিহাসবিদ হামাদ আবু হানিফাকে পারসিক বংশ্বদ্ভূত বলে দাবি করেন। আবু হানিফার বংশ নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও নির্ভরযোগ্য মত হলো তিনি কাবুলের পারসিক বংশদ্ভূত।
বংশ তালিকা ও পূর্বপুরুষদের বিবরণঃ
হানাফী মাযহাবের ইমাম, ইমাম আবু হানীফা রহ. ঈমানের রঙে রঙিন পরিবেশে চোখ খোলেন। ইলম ও আমলের কোলে বেড়ে ওঠেন। তাঁর পিতার নাম ছাবিত। তবে দাদার নাম নিয়ে বিভিন্ন মতামত পরিলক্ষিত হয়, যা নিম্নে উল্লেখ করা হল।
এক.
ঈসমাইল বিন হাম্মাদের বর্ণনায় দাদার নাম নুমান; আর পরদাদার নাম মারযুবান বলে উল্লেখ রয়েছে। [তারীখে বাগদাদ ১৫/৪৪৮]
দুই.
ঈসমাইল-এর ভাই উমর-এর বর্ণনা মতে দাদার নাম যূতা; আর পরদাদার নাম মাহ। উভয় বর্ণনার মাঝে এভাবে সমন্বয় করা যায় যে, হতে পারে তাঁর দাদা ও পরদাদা উভয়েরই দু’টি করে নাম ছিল। কিংবা একটি হল মূল নাম আরেকটি হল লকব। কিংবা হতে পারে (দাদা) যূতা এর আরবী অর্থ (বা ইসলামী নাম) নুমান। আর (পরদাদা) মাহ অর্থ মারযুবান—সরদার। [উকুদুল জুমান, পৃ. ৫৪]
কীর্তিমান গবেষক আল্লামা শিবলী নুমানী মনে করেন, মাহ বা মারযুবান হল যূতা‘র পিতার লকব। আর মাহ বা মারযুবান সমার্থবোধক শব্দ। উভয়ের অর্থ সরদার। -সীরাতুন নুমান, পৃ. ২২
উপরি-উক্ত বিশ্লেষণের সারকথা হল, যূতা ও নুমান মূলত একই ব্যক্তি। একই ব্যক্তির দুই নাম। অনুরূপভাবে পরদাদা মাহ বা মারযুবান মূলত একই ব্যক্তি। যার নাম মাহ তারই লকব মারযুবান।
তিন.
সীরাতুকোন কোন বর্ণনায় তাঁর দাদার নাম মারযুবান বলেও উল্লেখ রয়েছে। -ওয়াহবী সুলাইমান গাবুজী, আবূ হানীফা আননুমান, পৃ-৪২
(উল্লেখ্য যে, ফারসী উচ্চারণে মীম বর্ণটি যের যোগে শব্দটি এরূপ مِہ। যার অর্থ সরদার (‘noble of the town’)। একটু চেহারা বদল করে আরবীতে লেখা হয় এভাবে- ماه ॥
অগ্রগণ্য মত : এসব বর্ণনার মধ্যে আল্লামা যাহেদ আলকাউসারী রহ. ঈসমাইল বিন হাম্মাদের বর্ণনাকে প্রাধান্য দিয়ে বলেন, ‘যূতা ছাবিতের সরাসরি পিতা নন। বরং যূতা ও ছাবিতের মাঝের ব্যক্তি হলেন নুমান বিন মারযুবান। আর যূতার পিতা হলেন মাহ, যেমনটি মাসঊদ বিন শাইবা তাঁর মুকাদ্দিমাতু কিতাবুত তালীমের মাঝে (পৃ. ৩) উদ্ধৃত করেছেন। এটিই ঈসমাইল বিন হাম্মাদ থেকে বর্ণিত বিশুদ্ধ বর্ণনার মুওয়াফিক।’ -ইমাম যাহাবী রহ., মানাকিবুল ইমাম আবী হানীফা এর টীকা, পৃষ্ঠা-১৩
হযরত আলী রা.-এর সঙ্গে তাঁর পিতা ও দাদার যোগসূত্রতা ও ঘনিষ্ঠতাঃ
নুমান বিন সাবেত বিন মারযুবান—তিনি স্বাধীন পারসিক রক্তের অধিকারী ছিলেন। তাঁর দাদা উমর রা.-এর খেলাফতকালে ইসলাম গ্রহণ করেন। নিজ আবাস ভূমি (বর্তমান আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল) থেকে হিজরত করে ইসলামের দারুল খিলাফাত কুফাতে নিবাস পাতেন। অগ্রগণ্য মতানুযায়ী আবু হানীফা রহ. খলীফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের শাসনামলে ৮০ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। -ওয়াহবী সুলাইমান গাবুজী, আবূ হানীফা আননুমান, পৃষ্ঠা ৪১, মুকাদ্দিমাতু কিতাবিত তা’লীম-৩
ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর পিতা ছাবিতকে তাঁর পিতা মারযুবান নিয়ে গিয়েছিলেন আলী রা.-এর কাছে। (তাঁরা থাকতেন কুফাতে। আলী রা.ও তাঁর খেলাফতের সময় কুফায় ছিলেন। তিনি ছাবিতকে আলী রা.-এর কাছে নিয়ে বললেন—এ আমার ছেলে।) ফলে আলী রা. ছাবিত এবং তাঁর বংশধরের জন্য বরকতের দুআ করেন। -তারীখে বাগদাদ-১৩/৩২৬
হযরত আলী রা.-এর দুআর ফসলঃ
আবু আব্দুল্লাহ্ বিন আহমদ বিন কিদাম বলেন,
وقد استجاب الله دعاءه، حيث جعل خلفاء الأرض، وملوك الآفاق، وأكثر أهل الإسلام تبعا له في الدين، وعالة عليه في الفقه.
‘আল্লাহ্ তাআলা হযরত আলী রা.-এর এ দুআকে কবুল করেছেন। যেহেতু দ্বীনের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা তাঁকে বিভিন্ন দেশ ও রাষ্ট্রের কর্ণধারদের এবং পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমানের মুক্তাদা ও অনুসৃত বানিয়েছেন। এবং ফিকহ তথা ইসলামের সামগ্রিক বিধানাবলীর ক্ষেত্রেও তাদেরকে তাঁর পরিবারভুক্ত বানিয়েছেন।’ -মুহাদ্দিস ও ফকীহ মাসঈদ বিন শাইবা সিন্ধী, মুকাদ্দামাতু কিতাবিত তালীম-১১৭
সারকথা, হযরত আলী রা.-এর ওই দুআর সবচেয়ে বেশি ভাগ পেয়েছেন ইমাম আবু হানীফা রহ.। তার প্রমাণ হল, আল্লাহ তাআলা ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর অনুসারীদেরকে অসংখ্য বরকতে সিক্ত করেছন।
হযরত আলী রা.-কে হাদিয়া প্রদানঃ
সাবিতের পিতা নুমান বিন মারযুবান হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি আলী ইবনে আবী তালেব রা.-কে তৎকালীন সামাজিক মর্যাদার স্মারক হিসেবে ‘নওরোয’—ইসলামপূর্ব বর্ষবরণ উৎসবের দিন ফালুদা উপহার দিয়েছিলেন। তখন আলী রা. (বর্ষবরণ উপলক্ষ্যের এ সংস্কৃতির উপর আপত্তি জানিয়ে) বলেছিলেন, আমাদের উৎসব তো প্রতিদিন। -তারীখে বাগদাদ-১৫/৪৪৮
কোন বর্ণনায় মেহেরজান (নবান্ন উৎসব) এর কথাও রয়েছে।
হায়দারী ঝাণ্ডা বহনের গৌরবময় মর্যাদার অধিকারীঃ
বাগদাদ ও ওয়াসিত এর মধ্যে অবস্থিত একটি বৃহৎ অঞ্চলের নাম ‘নাহরাওয়ান।’ ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী ‘দুমাতুল জান্দাল’ নামক স্থানে হযরত আলী রা. ও হযরত মুআবিয়া রা.-এর মধ্যকার সালিশী বৈঠক অনুষ্ঠানের পর খারেজীরা একটা স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। তারা হযরত আলী রা.-এর বাইআত ভঙ্গ করে আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহাব আর-রাসেবীর হাতে বাইআত গ্রহণ করে। এবং কুফা, বসরা, আম্বার, সাদায়েন প্রভৃতি এলাকায় এই দলের যত লোক ছিল তারা সবাই নাহরাওয়ানে একত্রিত হয়ে ব্যাপক হত্যা ও লুণ্ঠনকার্যে লিপ্ত হয়।
হযরত আলী রা.-কে তারা কাফের সাব্যস্ত করে (নাউযুবিল্লাহ্) তওবার আহবান করে। হযরত আলী রা. এদের সাথে আলোচনা, বিতর্ক ও হিদায়েত দানের সকল প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু যখন তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল তখন তিনি বাধ্য হয়ে সেনাদলকে প্রস্তুতির হুকুম দিলেন। ৯/২/৩৮ হিজরীতে শালিসীব্যবস্থা অস্বীকারকারী এ খারেজীদের সাথে ‘নাহরাওয়ান’ নামক স্থানে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। শ্রেষ্ঠতর একদল সাহাবী এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।
হযরত আলী রা. বামভাগে হুজ্র বিন আদী ও ডানভাগে শাবাছ বিন রিবয়ীকে নিযুক্ত করলেন এবং পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী পরিচালনায় যথাক্রমে হযরত আবু কাতাদাহ আনসারী রা. ও হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা.-কে নিযুক্ত করলেন। -আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া-১০/৫৮৭, যিরিকলী, আল আলাম-৪/২৯৫, আত তামহীদ-২৩/৩২২, ড. মুহাম্দ আলী আস সাল্লাবী লিখিত ‘আসমাল মাতালিব ফী সীরাতি আমীরিল মুমিনীন আলী বিন আবী তালিব রাঃ, পৃষ্ঠা-৭৩০-৭৩৪
ইমাম আবু হানীফার পিতামহ মারযুবান-এর জীবনে এ গৌরবময় যুদ্ধে অংশ গ্রহণ ছিল সৌভাগ্যের স্বর্ণসোপান। এ যুদ্ধে তিনি হযরত আলী রা.-এর হেলালী ঝাণ্ডাবহনকারী ছিলেন। খতীব বাগদাদীর সমসাময়িক ঐতিহাসিক ফকীহ ও আল্লামা আবুল কাসেম আলী বিন মুহাম্মাদ আসসিমনানী (ওফাত : ৪৯৯ হি.) তাঁর রওজাতুল কুযাত ওয়া তরীকুন্নাজাত গ্রন্থে বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করেছেন—
وأبو حنيفة في رواية ابن كاس (ولد) سنة سبعين وفي رواية حماد سنة ثمانين وتوفى سنة خمسين ومائة وهو صاحب المذهب اسمه النعمان بن ثابت بن المرزبان والمرزبان صاحب راية علي بن أبي طالب يوم النهروان.
মোটকথা, আবু হানীফা ও তাঁর পিতা ইসলামের উপরই জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর দাদাও ছিলেন মুসলমান। পারিবারিক ঐতিহ্য বা আবহাওয়া ও পরিবেশ বলে যে একটা কথা আছে তা ইমামে আযমেরও ছিল। [রওজাতুল কুযাত ওয়া তরীকুন্নাজাত-৪/১৪৯৭, মুআসসাতুর রিসালাহ, বৈরূত, লেবানন, তানীবুল খতীব, পৃষ্ঠা-১৬০, আত তালীকুল কাবীর আলা মুকাদ্দিমাতি কিতাবিত তালীম-৮]
পাঠকদেরকে একটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ‘নাহরাওয়ান’ যুদ্ধ এটি যেমন-তেমন কোন যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধে খারেজীদের শক্তি বিধ্বস্ত হয়েছিল বটে; কিন্তু তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল দেশের বিভিন্ন অংশে বর্তমান ছিল। ফলে এ যুদ্ধের রেশ ধরেই খারেজীদের হাতে হযরত আলী রা.-এর মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনা ঘটে। -বিস্তারিত জানতে দেখুন, ড. মুহাম্মাদ আলী আস-সল্লাবী লিখিত ‘আসমাল মাতালিব ফী সীরাতি আমীরিল মুমিনীন আলী ইবনে আবী তালিব রা.’, পৃ. ১০২৭, ১০২৮
‘মাওলা’ শব্দের বিশ্লেষণ ও মর্মকথাঃ
ইমাম আবু হানীফা রহ. ছিলেন বনী তায়মুল্লাহ বিন সালাবা বিন বকর বিন ওয়ায়েল গোত্রের জনৈক ব্যক্তির মাওলা। -মানাকিবুল ইমাম আবী হানীফা ওয়া সাবিাইহি আবী ইউসুফ ও মুহাম্মদ ইবনুল হাসান, পৃষ্ঠা-১৪
তাই মাওলা সম্পর্কে মৌলিক কিছু কথা পাঠকের খেদমতে পেশ করা শোভনীয় বলে মনে হচ্ছে। মাওলা শব্দটির সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ যুক্ত আছে। মানাযির আহসান গীলানী রহ. (১৩৭৫ হি.)-এর বিশ্লেষণে সেই ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ উঠে এসেছে সুন্দরভাবে। নিম্নে তা পেশ করা হল। তিনি বলেন-
‘মাওলা বা الموالى শব্দটি সেসব অনারব লোকদের বেলায় ব্যবহৃত হয় যে নিজে বা তার পিতা, পিতামহ দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়ে আযাদি লাভ করেছে। অনুরূপভাবে আরব বংশদ্ভূত নয় এবং আরব দেশের বাইরে অবস্থিত কোন দেশ বা এলাকার অধিবাসী তারা ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও ন্যায় বিচারের কথা শুনে ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছে।
ইসলাম গ্রহণের পর তারা যখন যে কোন আরব কবীলার বাসস্থানসমূহ, যেমন- কুফা, বসরা ইত্যাদি শহরে নিবাস পাততে চাইলো তখন আরবদের কোন একটি গোত্রের সাথে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের চুক্তি করে সেখানেই থেকে যেত। এ শ্রেণীর লোকও মাওলার অন্তর্ভুক্ত। আর যে গোত্রের সাথে তাদের এরূপ সম্পর্ক তৈরী হত তাদেরকে সেই গোত্রের ‘মাওয়ালী’ বা বন্ধুত্বের চুক্তিতে আবদ্ধ লোক বলে সম্বোধন করা হত।
অনুরূপভাবে কোন অনারব ব্যক্তি আরব ব্যক্তির হাতে ইসলাম গ্রহণ করলে ওই নব দীক্ষিত অনারবকেও আরব লোকটির গোত্রের দিকে সম্পৃক্ত করে ঐ গোত্রের ‘মাওয়ালী’ বলে পরিচয় দেয়া হত। ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর পৌত্র ঈসমাইল ইবনে হাম্মাদ-এর দাবিও তাঁর ব্যাপারে এমনই ছিল।
তবে ইসলাম গ্রহণের কারণে যারা موالى নামে পরিচিত লাভ করতেন, তাদেরকে موالى الإسلام বা ইসলাম গ্রহণসূত্রে মাওলা বলা হত। পরস্পর সহযোগিতার চুক্তিতে আসার কারণে যাদেরকে موالى বলা হত তাদেরকে موالى الحلف বা চুক্তিসূত্রে মাওলা বলা হত। আর প্রকৃত কৃতদাস থাকায় যারা موالى পরিচয় পেত তাদেরকে موالى العتاقة বা দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভের সূত্রে দাস/মুক্তিপ্রাপ্ত মাওলা বলা হত। موالى শব্দের ব্যবহার সবার ক্ষেত্রে পাওয়া যেত।’ -মানাযির আহসান গিলানী রহ., তাদবীনে হাদীস-১৪১-১৪২
মাওলা শব্দের অর্থের মাঝে ব্যাপকতার কারণে ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর ব্যাপারে কেউ কেউ এ বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন যে, তাঁর ক্ষেত্রে যে মাওলা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এর অর্থ গোলাম।
কিন্তু খোদ ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর সুস্পষ্ট বক্তব্য এর বিপরীত। ইমাম ত্বহাবী রহ. তাঁর শরহু মুশকিলিল আছার কিতাবে আকদে মুওয়ালাতের উপর আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম আযম থেকে সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন যে, আবু আব্দুর রহমান আলমুকরী বলেন, আমি ইমাম আবু হানীফার নিকট আসলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন—
ممن الرجل ؟ فقلت: رجل من الله عز وجل عليه بالإسلام , فقال لي: لا تقل هكذا ولكن والِ بعضَ هذه الأحياءَ , ثم انتَمِ , فإني أنا كنت كذلك”.
তোমার পরিচয় কী? নিবেদন করলাম, এমন এক ব্যক্তি যার উপর আল্লাহ্ তাআলা ইসলামের কারণে অনুগ্রহ করেছেন। (অর্থাৎ সবেমাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছি।) ইমাম আযম বললেন, তুমি এমনটি বলো না।
বরং কোন কবীলা বা গোত্রের সাথে মুওয়ালাত বা পারস্পরিক সৌহার্দ্যভিত্তিক চুক্তি কর, তাহলে এ গোত্রের দিকেই তুমি ইনতেসাব বা সম্পৃক্ত হবে। কেননা আমার নিজের ব্যাপারটিও অনুরূপ। -শরহু মুশকিলুল আছার-৪/৫৪, দায়েরাতুল মাআরেফ, হায়দ্রাবাদ, দাকান,
শাইখ শুআইব আলআরনাউত এ বর্ণনার রাবীদেরকে সিকাহ বলেছেন। -শরহু মুশকিলুল আছার, মুআসসাতুর রিসালা-৭/২৮৪
ইমাম আযমের এই ওয়ালাউল মুওয়ালাত বা পারস্পরিক সৌহার্দ্যভিত্তিক ওয়ালা কোন গোত্রের সঙ্গে ছিল তা শরহু মুশকিলুল আছার‘র উক্ত বর্ণনায় উল্লেখ না থাকলেও ইবনে আবী আবিল আওয়ামকৃত ফাযায়িলু আবী হানীফাতে উক্ত গোত্রের নাম—বনু তায়মুল্লাহ বিন ছা’লাবা বিন বকর বিন ওয়ায়েল—বলে উল্লেখ রয়েছে। -ফাযায়েলে আবী হানীফা, পৃষ্ঠা-৪০, নং ৪, আখবারুল কুযাত, মুহাম্মদ বিন খালফ বিন হাইয্যান ওয়াকীকৃত-২/১৯৭
মোদ্দাকথা, তায়মুল্লাহ বিন ছা’লাবা গোত্রের সাথে ইমাম আবু হানীফার ওয়ালা ছিল ওয়ালাউল মুওয়ালাত—পারস্পরিক সৌহার্দ্যভিত্তিক বা বন্ধুত্বের সূত্রে সম্পর্কিত ওয়ালা। ইমাম আযমের পূর্বপুরুষদের কেউ বনী তায়মুল্লার কারো কাছে ইসলাম গ্রহণসূত্রে মাওলা ছিলেন না। -ইমাম যাহাবী, মানাকিবুল ইমাম আবী হানীফা, কাওসারী রহঃ এর টীকা, পৃষ্ঠা-১৫, তানীবুল খতীব-১৬০
আবার এ গোত্রের কেউ ইমাম আবু হানীফার পূর্ব পুরুষদের কাউকে দাসত্ব থেকে মুক্তিপ্রদানের সূত্রেও তিনি মাওলা ছিলেন না। তিনি স্বাধীন পারসিক রক্তের অধিকারী ছিলেন। দাসত্বের ছাপ তাঁর বংশে কখনো পড়েনি। -[ইকদুল জুমান ফী তারীখি আহলিয যামান, বরাতে শায়েখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহঃ কৃত, আইন্তেকারের টিকা-১৮৯-১৯১
শিক্ষাঃ
প্রথমত তিনি কুফা শহরেই ইলমে কালাম শিক্ষা করেন। ২০ বছর বয়সে তিনি ইলমে দ্বীন শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করেন। ইলমে আদব ও ইলমে কালাম শেখার পর তিনি ইলমে ফিকহ অর্জনের জন্য সমকালীন ফকিহ ইমাম হাম্মাদ (রহ.)-এর শিক্ষাগারে অংশগ্রহণ করেন। ইমাম হাম্মাদ (রহ.) ছিলেন তার বিশেষ ওস্তাদ। তিনি ছাড়াও তার গুরুজনের সংখ্যা ছিল প্রায় চার হাজার।
প্রাথমিক জীবন বা ব্যবসায়িক জীবনঃ
ইমাম আবু হানিফার রহ. প্রাথমিক জীবন কেমন ছিল এ বিষয়ে ঐতিহাসিকগণ বেশীকিছু উদ্ধৃত করেননি। তিনি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ কাপড় ব্যবসায়ী। ইমাম আবু হানিফার পৈত্রিক পেশা ছিল কাপড়ের ব্যবসা। ইরান থেকে শুরু করে ইরাক, সিরিয়া ও হেজায পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলব্যপী বিপুল পরিমণ মুল্যবান রেশমী কাপড়ের আমদানী ও রফতানী হতো। পৈত্রিক এই ব্যবসার সুবাদেই তিনি প্রচুর বিত্তের মালিক ছিলেন। তৎকালীন বিশিষ্ট ওলামাগণের মধ্যে সম্ভবত তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি রাস্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা বা বিত্তবানদের হাদীয়া-তোহফা প্রাপ্তির পরোয়া না করে নিজ উপার্জনের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ, এলেমের সেবা এবং তার নিকট সমবেত গরীব শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করার ব্যবস্হা করতেন। ১৬ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। পিতা ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী । তার মৃত্যুর পর এই ব্যাবসার দায়িত্ব নিতে হয় যুবক ইমাম আবু হানিফাকে। -আল ফিকহুল আকবার, ভূমিকা, ইমাম আবু হানিফার জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন
তার অসামান্য দক্ষতা ও নিষ্ঠায় ব্যাবসা প্রসারিত করার পাশাপাশি কাপড় তৈরির এক কারখানা স্থাপন করেন। যা কিছু দিনের মধ্যেই অনন্য হয়ে ওঠে। ব্যবসায় তার সততার পরিচয় পেয়ে দিগ্বিদিক থেকে লোকেরা তার দোকানে ভিড় জমাতেন। এভাবে তিনি জন মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত লাভ করলেন। ইমাম শাবী রহ. তাকে ইলমের ব্যাপারে উৎসাহিত করার আগ পর্যন্ত তিনি এ ব্যবসাকেই নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে নিয়েছিলেন। -উসুলুদ্দিন ইনদা আবি হানিফা, পৃষ্ঠা- ৬৬
ব্যবসা জীবন থেকে শিক্ষা জীবনে পদার্পণঃ
কিশোর বয়স থেকেই ইমাম সাহেব পিতার ব্যবসার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ব্যবসায়ীক কাজেই তাকে বিভিন্ন বাজার ও বাণিজ্য কেন্দ্রে যাতায়াত করতে হতো। ঘটনাচক্রে একদিন ইমাম শাবীর রহ. সাথে তার সাক্ষাত হয়ে যায়। প্রথম দর্শনেই ইমাম শাবী আবু হনীফার নিষ্পাপ চেহারার মধ্যে প্রতিভার স্ফুরণ লক্ষ করেছিলেন।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে বৎস! তুমি কি কর? এ পথে তোমাকে সব সময় যাতায়াত করতে দেখি? ইমাম সাহেব জবাব দিলেন, আমি ব্যবসা করি। ব্যবসার দায়িত্ব পালনার্থেই ব্যবাসায়ীদের দোকানে দোকানে আমাকে যাওয়া-আসা করতে হয়। ইমাম শাবী রহ. পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এটা তো তোমার লেখাপড়ার বয়স। কোন আলেমের শিক্ষায়তনেও কি তোমার যাতায়াত আছে? আবু হানিফা সরলভাবেই জবাব দিলেন, সেরূপ সুযোগ আমার খুব কমই হয়। কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই ইমাম শাবী আবু হানিফাকে জ্ঞানার্জনে মনোযোগী হওয়ার প্রতি আগ্রহী করে তুললেন। ইমাম আবু হানিফা বলেন, ইমাম শাবীর রহ সেই আন্তরিকতাপূর্ণ উপদেশবাণী গুলো আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করল এবং এরপর থেকেই আমি বিপনীকেন্দ্রগুলোতে আসা-যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রেও যাতায়াত শুরু করলাম। এ সময় আবু হানিফার রহ. বয়স ছিল উনিশ বা বিশ বছর। -আল ফিকহুল আকবার, ভূমিকা, ইমাম আবু হানিফার জীবন ও কর্ম,ইসলামিক ফাউণ্ডেশন
হাদিসশাস্ত্রের শিক্ষা গ্রহণঃ
ফিকাহ অধ্যায়নের এরপর তিনি হাদিস শিক্ষার জন্য তদানিন্তন হাদিস বেত্তাদের খিদমতে হাজির হন এবং শিক্ষা লাভ করেন। তখনও কোন প্রনিধান যোগ্য হাদিস গ্রন্থ সংকলিত হয়নি। কোন একজন মুহাদ্দিস সকল হাদিসের হাফিজ ছিলেন না। প্রথমে তিনি কুফায় অবস্থানরত মুহাদ্দিসদের থেকে হাদিস শেখেন। এরপর তিন বসরা যান। সেখানে হজরত কাতাদাহ রহ.-এর খিদমতে হাজির হন এবং হাদিসের দরস হাসিল করেন। তারপর ইমাম আবু হানিফা রহ. হজরত শুবা রহ.-এর দরসে যোগ দেন। তাকে হাদিস শাস্ত্রে ‘আমিরুল মুমিনিন’ বলা হয়। কুফা ও বসরার পর ইমাম আবু হানিফা হারামাইন শরিফাইন এর দিকে দৃষ্টিপাত করেন । প্রথমে তিনি মক্কা গেলেন এবং সেখানে তিনি হাদিসবিদ হজরত আতা ইবনে আবু রিবাহ রহ. -এর দরবারে যান এবং দরসে শামিল হয়ে শিক্ষা অর্জন করেন। ১১৫ হিজরিতে আতা রহ. ইন্তেকাল করলে তিনি মক্কায় চলে আসেন এবং হজরত ইকরামা রহ. -এর কাছ থেকেও হাদিসের সনদ লাভ করেন। -আল ফিকহুল আকবার, ভূমিকা, ইমাম আবু হানিফার জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন
সাহাবিদের দর্শলাভঃ
উম্মতের সর্বসম্মতিক্রমে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) একজন তাবেই ছিলেন। আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী (রহ.) বলেন, ‘ইমাম আবু হানিফা (রহ.) নিম্নে উল্লেখিত সাহাবিদের সাক্ষাৎ লাভ করেন:
হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) (ওফাত: ৯৩ হিজরি),
আবদুল্লাহ ইবনে আবী আওফা (রা.) (ওফাত: ৮৭ হিজরি),
সহল ইবনে সা’আদ (রা.) (ওফাত: ৮৮ হিজরি),
আবু তোফায়েল (রা.) (ওফাত: ১১০ হিজরি),
আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়দি (রা.) (ওফাত: ৯৯ হিজরি),
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) (ওফাত: ৯৪ হিজরি) এবং
ওয়াসেলা ইবনুল আসকা (রা.) (ওফাত: ৮৫ হিজরি)।
ফিকহ শাস্ত্রের আবিষ্কারক
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ফিকহ শাস্ত্রের আবিষ্কারক ছিলেন।[৮] ফিকহ ও ইসলামী আইন সংকলন ও সম্পাদনার জন্য তিনি ৪০ জন ফকিহ নিয়ে এক আইনজ্ঞ কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন। ওই যুগে যেসব মাসয়ালা-মাসায়িল সংকলন হয়েছিল, তার সংখ্যা ১২ লাখ ৭০ হাজারের ঊর্ধ্বে। ফিকহ শাস্ত্রে তার অবদানের ব্যাপারে ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, ‘ফিকহ শাস্ত্রের সব মানুষ ছিলেন আবু হানিফার (রহ.) পরিবারভুক্ত।‘ -আছারুল ফিকহিল ইসলামী
ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, ‘আবু হানিফা (রহ.) এমন এক ব্যক্তি, তিনি যদি ইচ্ছা করতেন, এই স্তম্ভটিকে সোনা প্রমাণিত করবেন, তবে নিঃসন্দেহে তিনি তা করতে সক্ষম।‘ -জামিউ বয়ানিল ইলম
তাই ইমাম আবু হানিফার (রহ.) নামযুক্ত মাসয়ালাগুলো ও মাযহাব দ্রুত সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।
হাদিস শাস্ত্রে অবদানঃ
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) হাদিস শাস্ত্রে অতুলনীয় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি চার হাজার শাইখ থেকে হাদিস সংগ্রহ করেছেন। -আস সুন্নাহ, উকূদুল জামান
ইমাম বোখারির অন্যতম ওস্তাদ মক্কী বিন ইব্রাহীম (রহ.), যাঁর সনদে ইমাম বুখারি (রহ.) বেশির ভাগ ‘সুলাসিয়াত’ হাদিস বর্ণনা করেছেন। এই মক্কী বিন ইব্রাহীম ইমাম হানিফা (রহ.)-এর ছাত্র। তিনি ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সম্পর্কে বলেন, ‘আবু হানিফা তার সময়কালের শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন।‘ -মানাকেবে ইমাম আজম রহ.
আবিদ ইবনি সালিহ বলেন, ‘ইমাম আবু হানিফা (রহ.) হাদিসের নাসিখ ও মানসুখ নির্ণয়ের ব্যাপারে খুব সতর্ক ছিলেন। ‘ ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তার শহরে যেসব হাদিস পৌঁছেছে তার মধ্যে রাসুল (সা.)-এর তিরোধানের সময়কার সর্বশেষ আমল কী ছিল সেসব তার মুখস্থ ছিল।
ইয়াহিয়া ইবনে নাসর বলেন, ‘একদিন আমি ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ঘরে প্রবেশ করি। সেখানে তার কিতাব ভরপুর ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এগুলো কী? তিনি বললেন, এগুলো সব হাদিসের কিতাব, যার মধ্যে আমি সামান্য কিছু বর্ণনা করেছি, সেগুলো ফলপ্রদ। -আস সুন্নাহ, উকদু জাওয়াহিরিল মুনীকাহ
কাজীর পদ প্রত্যাখানঃ
আব্বাসীয় বংশের আল-মনসুর আবু হানিফাকে রাজ্যের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব দেন কিন্তু স্বাধীনভাবে থাকার জন্য তিনি প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। তার পরীবর্তে তার ছাত্র আবু ইউসুফকে প্রধান বিচারপতির দ্বায়িত দেওয়া হয়। প্রস্তাব প্রত্যাখানের ব্যাপারে আবু ইউসুফ আল মনসুরকে ব্যাখা দেন তিনি নিজেকে এই পদের জন্য উপযুক্ত মনে করছেন না। আল-মনসুরের এই পদ প্রস্তাব দেওয়ার পেছেনে তার নিজস্ব কারণ ছিল, আবু হানিফা প্রস্তাব প্রত্যাখান করার পর মনসুর তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিযুক্ত করেন। এই অভিযোগের ব্যাখ্যায় আবু হানিফা বলেন, “আমি যদি মিথ্যাবাদী হই তাহলে প্রস্তাব প্রত্যাখান করার ব্যাপারে আমার মতামত সঠিক, কারণ কিভাবে আপনি প্রধান বিচারপতির পদে একজন মিথ্যাবাদিকে বসাবেন।” এই ব্যাখার উত্তরে আল-মনসুর আবু হানিফাকে গ্রেফতার করেন ও তাকে নির্যাতন করে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। এমনকি বিচারকরা সিদ্ধান্ত নিতেন কে তার সাথে দেখা করতে পারবে।
ইনতিকালঃ
সালে আবু হানিফা কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর কারণ পরিষ্কার নয়। কেউ কেউ বলেন আবু হানিফা আল মনসুরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের চেষ্টা করেন এ জন্য তাকে জেলখানার ভেতর মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এটা বলা হয়ে থাকে যে, আবু হানিফার জানাযায় অনেক লোক সমাগম হয়েছিল। ইতিহাসবিদ খাতিবের পক্ষে বলা হয় তার জন্য লোকজন মৃত্যুর ২০ দিন পর্যন্ত প্রার্থনা করেছিল। পরবর্তীতে, অনেক বছর পর বাগদাদের পাশে আধামিয়াতে আবু হানিফ মসজিদ নামে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয় আবু হানিফার নামে।
১৫০৮ সালে সাফাভি সম্রাজ্যের শাহ ইসমাইল আবু হানিফা ও আব্দুল কাদের জিলানীর মাজার এবং অন্যান্য সুন্নি নিদর্শন ধ্বংস করে দেন। ১৫৩৩ সালে উসমানীয়রা পুনরায় ইরাক দখল করে ও মাজারসহ অন্যান্য সুন্নি নিদর্শন পুনর্নির্মাণ করে।
ইমাম আবু হানিফা-র মর্যাদা সম্পর্কে মনীষীদের অভিমতঃ
ইমাম শাফি-র মতে: যে ব্যক্তি ফেকাহর জ্ঞান অর্জন করতে চায়, সে যেন ইমাম আবু হানিফা এবং তার ছাত্রদের সান্নিধ্য লাভ করে। কারণ ফেকাহর ব্যাপারে সকলেই আবু হানিফা-র মুখাপেক্ষী। ইমাম আবু ইউসুফ ইউসুফ বলেন, ইমাম আবু হানিফা কেবলমাত্র কারাগারে বসেই ১২ লক্ষ ৯০ হাজারের অধিক মাসয়ালা লিপিবদ্ধ করেছেন’ ।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) রচিত গ্রন্থাবলীঃ
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) -এর বহু গ্রন্থ অনারব মুসলিম দেশে পাওয়া যায়। তার নিজের লেখা কোন কিতাব নেই। কোন সূত্র ছাড়াই তার রচিত গ্রন্থের অধিকাংশই পৃথিবীর বিভিন্ন মিউজিয়ামে ও গ্রন্থাগারে পাণ্ডুলিপি আকারে সংরক্ষিত রয়েছে। কয়েকটি মুদ্রিত হয়েছে। কয়েকটির একাধিক শরাহ রচিত হয়েছে । এখানে তার পরিচিত ২০টি প্রসিদ্ধ গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হলো-
১. আল-ফিকাহুল আকবর।
২. আল-ফিকাহুল আবসাত।
৩. কিতাব আল আলিম অয়াল মুতাআল্লিম।
৪. আল-অসিয়া।
৫. আর-রিসালা।
৬. মুসনাদে আবি হানিফা ।
৭. অসিয়া ইলা ইবনিহি হাম্মাদ।
৮. অসিয়া ইলা তিল মিজিহি ইউসুফ ইবনে খালিদ।
৯. অসিয়া ইলা তিল মিজিহি আল কাজী আবি ইউসুফ।
১০. রিসালা ইলা উসমান আল বাত্তি।
১১. আল কাসিদা আল কাফিয়া (আননুমানিয়া)।
১২. মুজাদালা লি আহাদিদ দাহ রিন।
১৩. মারিফাতুল মাজাহিব।
১৪. আল জাওয়াবিত আস সালাসা।
১৫. রিসালা ফিল ফারাইয।
১৬. দুআউ আবি হানিফা।
১৭. মুখাতাবাতু আবি হানিফা মাআ জাফর ইবনে মুহাম্মদ।
১৮. বাআজ ফতোয়া আবি হানিফা।
১৯. কিতাবের মাক সুদ ফিস সারফ।
২০. কিতাবু মাখারিজ ফিল হিয়াল।
শেষের প্রার্থনাঃ
উম্মাহর একনিষ্ঠ রাহবার, জ্ঞানের দিকপাল, মুখলিস আবেদ, দ্বীনের খিদমতে নিরলস সাধক, আলোকিত এ জ্ঞানতাপসকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা উত্তম প্রতিদান প্রদান করে ধন্য করুন। জান্নাতে তাকে উঁচু মাকাম দান করুন। তাঁর প্রদর্শিত পথে চলবার তাওফিক দান করে আমাদেরকেও সৌভাগ্যমন্ডিত করুন।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০২১ সকাল ১০:২৮