সত্যিকারের মগের মুল্লুকের গল্প, না পড়িলে পুরাই মিসসস!!!!!!!!!!!!!! (রিপোস্ট)
অনেক অনেক দিন আগেকার কথা। এক গুরু বাহির হইয়াছিলেন দেশ ভ্রমনে। চিকনা পাতলা রোগা টাইপের এক চ্যালাও সফরসঙ্গী হইল তাহার।
গুরু-চ্যালা দুইজনে চলিতে শুরু করিলেন। চলিতে চলিতে বহুদূর গিয়া পৌঁছাইলেন তাহারা। এক দেশের উপর দিয়া যাওয়ার সময় দেখিলেন সেখানকার সকল জিনিষপত্রের দাম একইরকম। দুধ যেমন এক টাকায় ষোল সের পাওয়া যায়, ঘি-ও টাকায় ষোল সেরই মেলে। তৈলও ক্রয় করা যায় এক টাকা দিয়া ষোল সের! দেখিয়া শুনিয়া গুরু চ্যালা উভয়েই বেশ পুলকিত হইলেন! বহু দেশ দর্শন করিলেও এমন আজব দেশ আর কোথাও দেখা হয় নাই তাহাদের! সত্যিই, বড় আজব, বড় মজার একটি দেশ বটে!
আজব দেশের ততোধিক আজব সব হাল হকিকত দর্শনে গুরু চ্যালাকে ডাকিয়া কহিলেন, ''মগের মুল্লুকের নাম শুনিয়াছ। এক্ষনে সচক্ষে দেখিয়া লও! ইহাই হইলো সেই আসল মগের মুল্লুক, যেই দেশে ইনসাফ, ন্যায়াচার ও সত্য বলিতে কিছুই নাই, দেখিতেছ না, সকল জিনিষপত্রের দাম একই সমান! ইহার অর্থ হইলো, এইখানে ছোটতে বড়োতে কোন ভেদাভেদ নাই। সুতরাং, এইখানে বসবাস করা কিংবা বিলম্ব করা বিপজ্জনক হইতে পারে! চলো, এই দেশ হইতে শিগগির পালাইয়া যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হইবে!''
চ্যালা অতিব উৎসুক হইয়া বলিল, ''না, গুরু, ইহা কি বলিতেছ! এই দেশ হইতে চলিয়া যাইব! তাহা কি করিয়া হয়! এই দেশে ঘি আর দুধ যেইরকম সস্তায় পাওয়া যায়! তুমি দেখিতেছ না? এমন সস্তা দুধ এবং ঘি আর কোথাও পাওয়া যাইবে কি? যাইবে না। যাইবে না, গুরু! তুমি বুঝিতেছ না! গুরু, তুমি এই দেশ ছাড়িয়া যাওয়ার মত অমন কথা বলিও না দয়া করিয়া! এই দেশেই থাকিয়া যাই, গুরু। দুধ ঘি খুব করিয়া খাওয়া যাইবে। গুরু, আমার দুধ ঘি খাইতে অত্যাধিক শখ! ইহাতে কখনো আমার কোনো বিরক্তি আসে না! অরুচিও হইয়া ওঠে না! পানির মত করিয়া ব্যাপক পরিমানে দুধ পান করিতে পারিলে আমি শান্তি পাই!''
গুরুর কপালে চিন্তার রেখায় ভাঁজ! কিংকর্তব্যবিমূঢ়; বুঝিতে পারিতেছেন না, কি করিবেন তিনি! নিতান্ত অনিচ্ছায় চ্যালার মন রক্ষা করার জন্য বলিলেন, ''ঠিক আছে। এত করিয়াই যখন অনুরোধ করিতেছ, থাকো এই দেশে, আর কিছু দিন খাইয়া দেখ, কেমন সুস্বাদু এই দেশের দুধ ঘি! তবে মনে রাখিও, দুধ ঘি খাওয়ার লোভে লোভে এই দেশে বসবাস করা জীবনের জন্য কাল হইয়া দাঁড়াইতে পারে! কপালে দুর্গতি আসিতে পারে!''
গুরুর এসব কথা চ্যালা তেমন একটা গায়ে মাখিল না। দুধ আর ঘি খাওয়ার লোভে সে পাগলপ্রায়। তাহার ধারণা, প্রতি দিন সে সেরকে সের দুধ খাইবে, ঘি খাইবে বরতন ভরিয়া। আহ! কি মজা হইবে তাহাতে!
তাহার মনোবাসনা মত সে মজা মারিয়া কিছু দিন দুধ ঘি খুব করিয়া খাইলো। খাইতে খাইতে তাহার অবস্থা বেগতিক হইয়া উঠিল। শরিরে চিকনাই ফিরিয়া আসিয়াছে। চেহারা সুরতে দশাসই অবস্থা। দরজা দিয়া চলাচল করাই এক প্রকার কঠিন হইয়া দাঁড়াইয়াছে! ফলি মাছের মত কাত হইয়া তাহাকে দরজা দিয়া কামরায় প্রবেশ করিতে হয়! এখন আরেক নতুন সমস্যার উদ্ভব ঘটিয়াছে, চ্যালাকে দেখিয়া অনেকেই গুরু ভাবিয়া তাহাকেই প্রণাম করিতে ছুটিয়া আসে! গুরুর জন্য ইহা কি যে এক বিব্রতকর অবস্থা! মহাখাদক চ্যালার পাল্লায় পড়িয়া তিনিও এক্ষনে ত্যক্ত-বিরক্ত!
দিন যায়। মাস বহিয়া যায়। এইভাবে চলিতেছিল ভালোই! কিন্তু হঠাৎ এক দিন....
এক দিন রাজ দরবারের পাশ দিয়া যাওয়ার সময় গুরু এবং চ্যালা দেখিল, সেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষের ভীড়। চ্যালা কহিল, ''গুরু, তুমি দাঁড়াও! আমি যাইয়া একটু দেখিয়া আসি, রাজবাড়ি আজ কি কারনে এত লোকে লোকারন্য।''
গুরু ভীড়ের কাছে গেলেন না। একটু দূরে দাঁড়াইয়া রহিলেন। চ্যালা ভিতরে উঁকি দিয়া দেখিল, সেখানে একটি মোকদ্দমা পেশ করা হইয়াছে। মকদ্দমাটি ছিল এইরূপ:
দুই চোর চুরি করিতে যাইয়া এক বাড়িতে সিঁধ কাটিল। একজন বাহিরে দাঁড়াইয়া রহিল আরেকজন সিঁধের ভিতরে ঢুকিল। হঠাৎ সিঁধের উপরের দেওয়াল ধ্বসিয়া পড়িল। ফলে সিঁধের ভিতরে থাকা চোরটি মরিয়া গেল। পরে বাঁচিয়া ফিরিয়া আসা চোরটি এই বলিয়া বাদী হইয়া রাজদরবারে মোকদ্দমা করিয়াছে যে, ''চুরি করিতে যাইয়া ইটের দেওয়াল ভাঙ্গিয়া পড়িয়া আমার বন্ধু মরিয়া গিয়াছে, সুতরাং বাড়িওয়ালার ফাঁসী চাই।''
রাজা মশাই বাড়িওয়ালাকে ডাকাইয়া আনিলেন এবং তাহাকে বলিলেন, ''যে বাড়ির ইটের দেওয়াল ভাঙ্গিয়া পড়িয়া মানুষ মরিয়া যায়, এইরকম বাড়ি বানানোর পেছনে তোমার নিশ্চয়ই অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। তোমার ফাঁসীর হুকুম প্রদান করা হইলো। তবে, আত্মপক্ষ সমর্থনে তোমার কোন কথা থাকিলে বলিতে পার।''
বাড়িওয়ালা বলিল, ''হুজুর, আমাকে ক্ষমা করুন! আমি নিরীহ প্রকৃতির লোক। বাড়ি নির্মানের সময় মানুষ মারার কোনো অভিপ্রায় আদৌ আমার ছিল না। আমি একেবারে নির্দোষ। আর তা ছাড়া, এই দেওয়াল নির্মানের কাজ কস্মিনকালেও আমি করি নাই। ইহা করিয়াছে রাজমিস্ত্রী। সে-ই মানুষ হত্যার এই মহাচক্রান্তের হোতা। মহারাজ, দয়া করিয়া তাহাকে শাস্তি প্রদান করুন! আসল অপরাধী সেই ব্যক্তিই!''
রাজা জল্লাদকে বলিলেন, ''ইহাকে ছাড়িয়া দাও। ডাকিয়া আনো ব্যাটা রাজমিস্ত্রীকে।''
রাজার হুকুম বলিয়া কথা! ছাড়িয়া দেওয়া হইল বাড়িওয়ালা লোকটিকে। পাইক পেয়াদা পাঠাইয়া ধরিয়া আনা হইল রাজমিস্ত্রীকে।
রাজার সামনে আনা হইলে রাজা তাহাকে বলিলেন, ''যে বাড়ির ইটের দেওয়াল ভাঙ্গিয়া পড়িয়া মানুষ মরিয়া যায়, এইরকম ওয়াল বানানোর উদ্দেশ্য কী? তোমার তো ফাঁসীর হুকুম। আত্মপক্ষ সমর্থনে তোমার কোন কথা থাকিলে বলিতে পার।''
রাজমিস্ত্রী বলিল, ''হুজুর, আমি একেবারেই নির্দোষ। এই কাজ ভুলেও আমি করি নাই। আমার সহকারী যোগানদার বালি সিমেন্ট মিলাইয়া তাহাতে পানি ঢালিয়া 'গারা' তৈরি করিত। সে পাতলা 'গারা' আনিয়াছিল যাহার দরুন গাঁথুনি মজবুত হয় নাই। ব্যাটা বেআক্কল যোগানদারই মানুষ হত্যার এই মহাচক্রান্তে জড়িত। আমি সম্পূর্ন নির্দোষ, মহারাজ! দয়া করিয়া আমাকে মুক্তি দিন!''
রাজা জল্লাদকে বলিলেন, ''ইহাকে খালাস দাও। রাজমিস্ত্রীর সহকারী যোগানদারকে আনিয়া ফাঁসীতে ঝুলাও।'
রাজার হুকুমমত রাজমিস্ত্রীকে ছাড়িয়া দেওয়া হইল। পাইক বরকন্দাজগন মিলিয়া ধরিয়া আনিলেন যোগানদারকে।
রাজার সামনে আনা হইলে রাজা বলিলেন, ''এইরকম ওয়াল বানানোর জন্য 'গারা' পাতলা করার উদ্দেশ্য কী ছিল তোমার? 'গারা' পাতলা করিয়া মানুষ হত্যা করিতেই বা তোমার কোন অভিপ্রায়, বাপু হে? তোমার তো ফাঁসীর হুকুম। কোন কথা থাকিলে বলিতে পার।''
যোগানদার বলিল, ''হুজুর, আমি একেবারেই নির্দোষ। এই কাজ ভুলেও আমি স্বেচ্ছায় করি নাই। সেই সময় একটা হাতী ক্ষেপিয়া গিয়াছিল। হাতীটি আমার দিকে ছুটিয়া আসিতেছিল। আমি ভয়ে থতমত খাইয়া গিয়াছিলাম। হাত পায়ে রীতিমত কাঁপন ধরিয়া গিয়াছিল আমার। তাই পানি বেশি পড়িয়া 'গারা' পাতলা হইয়া গিয়াছিল। সুতরাং, সম্পুর্ন দোষ সেই হাতী আর হাতীর মাহুতের। আমি নির্দোষ, হুজুর! দয়া করিয়া আমাকে ক্ষমা করিয়া দিন!''
রাজা জল্লাদকে বলিলেন, ''ইহার খালাস। ফাঁসী দিয়া দাও হাতীর মাহুত ব্যাটাকে।'
রাজার হুকুমমত রাজমিস্ত্রীর যোগানদারকে ছাড়িয়া দেওয়া হইল। সৈন্য সামন্তরা গিয়া হমলাইয়া পড়িলেন হাতীর মাহুতের উপর। ধরিয়া আনা হইল হাতীর পুচকে মাহুতকে।
রাজা তাহাকে বলিলেন, ''মিয়া, খবর রাখো? হাতী লইয়া পাড়া ঘুরিয়া বেড়াও, হাতীর পিঠে উঠিয়া ফুর্তি কর, আর হাতী লাফ দেয়, গারা পাতলা হয়, ওয়াল ধ্বসিয়া পড়িয়া মানুষ মারা যায়। এইসবের খবর আছে তোমার? মানুষ হত্যা করিতে তো দেখা যায় তুমিই আসল ষড়যন্ত্রকারী! তোমার ফাঁসীর হুকুম। কোন কথা থাকিলে বলিতে পার।''
হাতীর মাহুত বলিল, ''হুজুর, আমার কোন দোষ নাই। এই কাজ ঘূনাক্ষরেও আমি করিতাম না। ঘটনাটা তাহলে মহারাজার সম্মুখে খুলিয়াই বলিতে হয়, আমি যখন হাতী নিয়া সেই রাস্তা অতিক্রম করিতেছিলাম, সেই সময় কাঁকন আর নোলক পড়া এক মহিলাও জল ভর্তি কলসি কাঁখে করিয়া হাতীর পেছন পেছন আসিতেছিল। তার চুড়ি আর কাঁকন পিতলের কলসিতে লাগিয়া ঝুনঝুন করিয়া এমন এক আওয়াজ সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছিল যে, তাহাতে আমার হাতী ক্ষেপিয়া গিয়া শুরু করিয়া দিয়াছিল ব্যাপক লম্ফ ঝম্ফ। কি আর বলিব মহারাজ! হাতীকে আমি শত চেষ্টা করিয়াও তখন বশে আনিতে পারি নাই। কোনোভাবেই থামাইতে পারি নাই। আমার কোনো দোষ নাই। আমি নির্দোষ মহারাজ! আমাকে মাফ করে দিন হুজূর!''
রাজা জল্লাদকে বলিলেন, ''ইহাকে ছাড়িয়া দাও। ধরিয়া আনিয়া ফাঁসী দাও নির্বোধ সেই মেয়ে লোকটিকে।'
সুতরাং রাজার হুকুমমত ফাঁসির মঞ্চে আনা হইল ভরা কলসি কাঁখে করিয়া হাতীর পেছন পেছন চলা সেই মেয়ে লোকটিকে। মেয়ে লোকটি তাহার শেষ ইচ্ছা পূরন করিবার উদ্দেশ্যে বলিল, ''আমাকে মহারাজার সহিত কথা বলিতে দাও।''
মহারাজার সম্মুখে আনা হইলে মেয়ে লোকটি রাজাকে বলিল, ''মহারাজ, দোষ আমার নহে। আসল দোষ স্বর্নকারের। সে-ই আমাকে চুড়ি, নোলক ইত্যাদি গহনা তৈরি করিয়া দিয়াছে। তাহা ছাড়াও এই চুড়ি ব্যতিত আমার অন্য যতসব স্বর্ন গয়না সবই সেই লোকই বানাইয়া দিয়াছে। সে তৈরি করিয়া না দিলে এইসব আমি বানাইতেও পারিতাম না, আর কোনো দিন পরিধানও করিতাম না। এই রকম ঝুনঝুন শব্দের কারনে হাতীও লাফাইতো না, গারাও পাতলা হইয়া ওয়াল খারাপ হইতো না, আর সেই ওয়াল ধ্বসিয়া পড়িয়া মানুষও মারা পড়িত না। মহারাজ, দেখিলেন তো, আসল দোষটা কিন্তু স্বর্ণকার ব্যাটারই। তাই দয়া করিয়া আমাকে বেকসুর খালাস দিন।''
সব শুনিয়া রাজা বলিলেন, ''কথা তো সঠিক! মহিলা সত্যবাদী। এই, ইহাকে বেকসুর খালাস দাও। ধরিয়া আনো স্বর্নকার ব্যাটাকে।''
লোক লষ্করের বিরাট রাজকীয় বাহিনী চিরুনী অভিযান চালাইয়া স্বর্নকারের হদিস করিল। তাহাকে আটক করিয়া রাজার সম্মুখে উপস্থিত করিলে রাজা গুরু গম্ভীর স্বরে বলিলেন, ''কি হে মিয়া স্বর্নকার! স্বর্নের ব্যবসায় তো ভালোই আয় রোজগার করিয়া চলিয়াছ! তাহা তোমার লোক মারার ফন্দি কেন, বাপু হে? চুড়ি তৈরি করিয়া, সেই চুড়ি মহিলার হাতে পড়াইয়া, তাহা দিয়া ঝুন ঝুন আওয়াজ তৈরি করাও, তাহাতে হাতী লাফ দেয়, গারা পাতলা হয়, ওয়াল ধ্বসিয়া পড়িয়া মানুষ মারা যায়, খবর রাখো মিয়া? তোমার তো ফাঁসীর হুকুম। কিছু বলার থাকিলে বলিতে পারো।''
স্বর্নকার দুই হাত কচলাইয়া কাচুমাচু করিতে লাগিল। কোনো জবাব দিতে পারিল না। এক্ষনে তাহার বাপ দাদাদের কথা মনে পড়িয়া গেল। তাহারা আজ কেহ বাঁচিয়া নাই। তাহারাই তাহাকে এই কাজ শিখাইয়াছিল। তাহারা বাঁচিয়া থাকিলে তাহাদের জিজ্ঞাসা করিয়া মনের ক্ষোভ কিছুটা হইলেও দূর করা যাইতো যে, কেন তাহারা তাহাকে এই অলক্ষুনে পেশায় আনিয়াছিল, যে পেশা ধারন করার অপরাধে আজ তাহাকে জীবন দিতে হইতেছে!
স্বর্নকার চিন্তা করিতেছে, আজ বাপ দাদাদের কাউকে এই কাঠগড়ায় হাজির করাও যাইবে না, জিজ্ঞাসাও করা যাইবে না- কেন তাহারা তাহাকে এই কাজ শিখাইয়াছিল! তাই সে চুপ করিয়াই রহিল। সুতরাং, বেচারার ফাঁসীর হুকুম হইয়া গেল।
ফাঁসীর মঞ্চে নেওয়া হইল স্বর্নকারকে। জল্লাদ আসিল। ফাঁসী দিতে যাইয়া জল্লাদ দেখিল, তাহার গলার চাইতে দঁড়ির ফাঁস বড়। গলায় কোনমতেই রসি আটকায় না। যতবারই গলায় রসি পড়ানো হয়, ততবারই চিকন গলা হইতে তাহা বাহির হইয়া যায়।
অবশেষে উপয়ান্তর না পাইয়া রাজাকে জানানো হইল বিষয়টি।
রাজা সহাস্যে বলিয়া উঠিলেন, ''ঠিক আছে, ইহাতে এত পেরেশান হওয়ার কি আছে! স্বর্নকারকে ছাড়িয়া দাও। যার গলা মোটা তাহাকে ফাঁসী দিয়া দিলেই তো সব ঝামেলা চুকিয়া যায়। তোমাদের সাধারন জ্ঞানেরও দেখিতেছি, বড়ই অভাব!''
রাজ দরবারে যত মানুষ ছিল তাহাদের মধ্যে সেই চ্যালাটিই সবার চাইতে মোটা। তাহাকেই ফাঁসীর মঞ্চে আনয়ন করা হইল।
চ্যালা দুধ ঘি সস্তার দেশে এই প্রথম বড় কোনো বিপদে পড়িয়া গেল। চক্ষে সরিষা ফুল দেখিতে লাগিল সে। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার প্রাক্কালে গুরুকে ধরিয়া সে কাঁদিয়া কাটিয়া বলিল, ''গুরু, এইবারের মত বাঁচাইয়া দাও। তোমার কথার অবাধ্য আর কোনো দিন হইব না। আর দুধ ঘি খাওয়ার লোভ করিব না।''
অতিশয় দু:খে কাতর হইয়া গুরু বলিলেন, ''ব্যাটা, আমি তোকে আগেই বলিয়াছিলাম, এই দেশে থাকিলে খুব বিপদ হইতে পারে! এখন দুধ-ঘি খাওয়ার মজা অনুভব কর।''
চ্যালা বলিল, ''আমি তৌবা করিলাম। গুরু, এইবার আমাকে বাঁচাইয়া নাও। জীবনে আর কোন দিন তোমার কথার বিরুদ্ধে যাইবো না। যাহা বলিবা তাহাই শুনিব।''
গুরু গম্ভীর স্বরে জল্লাদকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিলেন, ''উহাকে ছাড়িয়া দাও। ফাঁসী আমার হইবে। আমাকে ফাঁসী দিয়া দাও।''
ইহা দেখিয়া চ্যালা ভাবিল, আমাকে বাঁচানোর জন্য গুরু ফাঁসীতে চড়িবেন? ইহা কিছুতেই সম্ভব হইতে পারে না। আমি বাঁচিয়া থাকিব আর গুরুর ফাঁসী হইবে? তাহা আমি জ্যান্ত থাকিতে হইতে দিব না।
সে জল্লাদকে বলিল, ''কক্ষনও নহে! ফাঁসী আমাকে দিয়া দাও!''
গুরু বলিলেন, ''না। ফাঁসী আমাকে দিতে হইবে।''
ইহা নিয়া দুইজনে তুমুল ঝগড়া! একরকম ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি অবস্থা! এ বলে, আমাকে দাও তো, ও বলে, আমাকে ফাঁসী দাও।
জল্লাদ বেচারা পড়িল মহাফাঁপড়ে! বিপদে পড়িয়া দিশাহারা অবস্থা তাহার! বুঝিতে পারিতেছে না, এখন কাহাকে ফাঁসী দিবে সে!
উপয়ান্তর না পাইয়া গুরু চ্যালার একজন অন্যজনকে রাখিয়া ফাঁসীতে ঝুলিয়া মরিবার বাসনায় ঠেলাঠেলির বিষয়টি সে রাজার কানে তুলিল।
রাজা গুরুকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ''কি হইয়াছে তোমার? তুমি কেন অযথা ফাঁসীতে ঝুলিতে চাহিতেছ?''
গুরু কহিলেন, ''হুজুর, আমি হইলাম শাস্ত্রের পন্ডিত, ঠাকুর মহাশয়, শাস্ত্রের পন্ডিত! শাস্ত্র গণনা করিয়া আমি জানিতে পারিয়াছি, এক্ষনে এমন একটি লগ্ন, এই লগ্নে যে ফাঁসীতে ঝুলিয়া প্রান সংহার করার সৌভাগ্য লাভ করিবে, সে সাক্ষাত বৈকুন্ঠ স্বর্গে চলিয়া যাইবে! এই জন্যে আমি চাহিতেছি, ফাঁসীটা আমাকেই দেওয়া হউক।''
রাজা খুশিতে গদগদ হইয়া আহলাদি গলায় বলিলেন, ''তাই না কি! তাই যদি হয়, তাহা হইলে বৈকুন্ঠ স্বর্গে তো আমাকেই যাইতে হইবে সকলের আগে! ফাঁসী আমাকেই দিয়া দাও।''
রাজার আগে বৈকুন্ঠ স্বর্গে যাওয়ার সাহস আর কেহ করিল না। অগত্যা সকল ঝগড়া মিটিয়া গেল। ফাঁসী রাজাকেই দেওয়া হইল।
মহামতি রাজার ফাঁসী হইয়া গেল। দেশ ঠান্ডা হইল।
গুরু চ্যালাকে বলিলেন, ''আর এক মুহূর্ত এই দেশে নহে। চল, এখান হইতে কাটিয়া পড়ি। এই জনপদ মোটেই নিরাপদ নহে।''
এই গল্পটিকে যদিও কেউ কেউ একটি খামখেয়ালী গল্প বলিয়া মনে করিতে পারে, কিন্তু বিশৃঙ্খলা এবং অন্যায় অত্যাচারের একটি সুন্দর চিত্র আঁকা হইয়াছে ইহাতে।
গল্প হইতে শিক্ষনীয় বিষয়:
মানুষ আজকাল আল্লাহ পাককে প্রায় যেন সেই রকমই ভাবিয়া বসিয়াছে। তাই প্রায়শই আল্লাহ পাক সম্মন্ধে এমনসব উক্তি করিতে শোনা যায়, যাহাতে প্রতীয়মান হয়, তিনি সামঞ্জস্য ও উদ্দেশ্যহীন এবং অবিবেচনাবশত: বিনা প্রয়োজনে কোনো কিছু করিয়া থাকেন। যেমন, ছোট ছোট বাচ্চা রাখিয়া যুবক বয়সের কোনো লোকের মৃত্যু সংবাদ শুনিয়া, অতি দরদ দেখাইতে যাইয়া অনেকে আফসোস করিয়া বলিয়া বসেন, ''আল্লাহ এই কাজটি কি ঠিক করিলেন? অথবা, ইহাদের (বাচ্চাদের) উপর তিনি জুলূম করিলেন।'' নাউজুবিল্লাহ।
এমনি করিয়া, কেউ মরিয়া গেলে অনেক শিক্ষিত লোককেও দু:খ করিয়া বলিতে শোনা যায়, ''আহ! বেচারা বড় ভালো মানুষ ছিলেন! অসময়ে চলিয়া গেলেন।''
-এইসব কথা প্রকারান্তরে আল্লাহ পাকের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল বলিয়া ইহা বড়ই অন্যায় এবং ঈমান হরনকারী কথা হিসাবে প্রতীয়মান হয়। কারন, কোনো লোকের অকালে চলিয়া যাওয়ার অর্থ হইল, আল্লাহ পাক তাহাকে তাহার সময় আসিবার পূর্বক্ষনেই মৃত্যু দান করিয়া তাহার প্রতি ইনসাফ করিলেন না! নাউজুবিল্লাহ।
প্রকৃত প্রস্তাবে কথা হইল, আল্লাহ পাক সর্বাবস্থায় ন্যায় বিচারক। তিনি কখনও কাহার সাথেই ন্যায়পরিপন্থী আচরন করেন না। করিতে পারেন না।
আল্লাহ পাক চিরন্তন ন্যায়বিচারকারী। মনুষ্য প্রজাতিকেও তিনি ন্যায়ের উপরে প্রতিষ্ঠিত হইতে যথোপযুক্ত যোগ্যতা দান করিয়া তাহাদের নসিব বুলন্দ করিয়া ধন্য করুন।
গল্প কৃতজ্ঞতা: মূল গল্পটি হাকীমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহির লেখা মুসলমানের হাসি বই হইতে সংগৃহীত এবং ইষৎ সংশোধিত ও পরিমার্জিত।
সকলের কল্যান হোক।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০২১ সকাল ৯:৩৮