পবিত্র বাইতুল্লাহ এবং মসজিদে নববী আধুনিকিকরণের পেছনের অজানা গল্প-১
হারামাইন শরিফাইন অর্থাৎ, মক্কাতুল মুকাররমা এবং মদীনাতুল মুনাওওয়ারায় অবস্থিত পবিত্র দুই মসজিদ বাইতুল্লাহ এবং মসজিদে নববীর আধুনিকিকরণ ও সম্প্রসারণের কাজ বিগত প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ বছর যাবত ধারাবাহিকভাবে হয়ে আসছে। অবশ্য পবিত্র বাইতুল্লাহ বহু পুরাতন এবং পৃথিবীর প্রথম ইবাদতের ঘর হওয়ায় এর সংস্কার কাজ প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনের বহু পূর্ব হতেই চলে এসেছে। বর্তমানে এই দুই মহান স্থাপনার রক্ষনাবেক্ষন, সংস্কার এবং আধুনিকিকরণে সউদী আরবের সরকারের নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কমিটি রয়েছে। মূলতঃ সউদি বাদশাহদের ইচ্ছায় মক্কাতুল মুকাররমা এবং মদীনাতুল মুনাওওয়ারায় অবস্থিত পবিত্র দুই মসজিদের প্রভূত সংস্কার কাজ করা হয়। আমরা জানি, এই দুই পবিত্র মসজিদে ব্যবহৃত পাথরের টাইলসগুলো বিশেষ তাপ শোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন অতি দুর্লভ মার্বেল পাথর। এই বিষয়টি নিয়েই, মসজিদে নববীকে ঘিরে রয়েছে চমকপ্রদ এক অলৌকিক ঘটনা। চলুন, শুনে আসি সেই অলৌকিক ঘটনার বিবরণঃ
হারামাইন শরিফাইনের আধুনিকিকরণ ও সম্প্রসারণের সাম্প্রতিক এ কাজটি করেছেন মিসরের সৌভাগ্যবান এক শতায়ু স্থপতি, যার জন্ম ১৯০৮ ইং সালে এবং যিনি ইন্তিকাল করেন ২০০৮ ইং সালে। তার জীবন যেমন বিস্ময়কর, ঠিক তেমনি দুই মসজিদের, বিশেষ করে মদীনার মসজিদে নববীর আধুনিকিকরণের কাজটিও ছিল অলৌকিকতায় পূর্ণ।
ইসলামের পবিত্রতম স্থান সউদি আরবের মক্কা শহরে অবস্থিত মসজিদুল হারাম। নাবিয়্যিনা হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এবং ইসমাইল আলাইহিস সালাম কর্তৃক নির্মিত বাইতুল্লাহ অভিমুখে মুসলিমরা ছুটে যান প্রাণের টানে হজ্জ ও উমরা করার জন্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লার নৈকট্যলাভের আশায়। হজ্জের সময় এখানে উপস্থিত হওয়া মানুষের জমায়েত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মানব সমাবেশের অন্যতম। অপরদিকে মসজিদে নববী প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মসজিদ যা বর্তমান সউদি আরবের মদিনায় অবস্থিত। গুরুত্বের দিক থেকে মসজিদুল হারামের পর মসজিদে নববীর স্থান। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মদিনায় আসার পরে এই মসজিদ নির্মিত হয়। নির্মাণের পর অনেকবার পুন-নির্মাণ কিংবা সংস্কার করা হয়েছে মুসলমানদের এই পবিত্র দু'টি মসজিদ। আর মক্কার মসজিদুল হারাম কিংবা মদিনার মসজিদে নববীর সংস্কারে একজন মিশরীয় প্রকৌশলী এবং স্থপতি অনেক ভূমিকা রেখেছেন যিনি নিজের প্রচার, প্রসার ও খ্যাতি থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করতেন। এ কারণেই হয়তো অদ্যাবদি তিনি রয়েও গেছেন অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালেই।
সেই মহান ব্যক্তির নাম ড. মুহাম্মদ কামাল ইসমাঈল রহ.। তিনি মিশরের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে উচ্চ বিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত ব্যক্তি। শুধু এটাই নয় তাঁর সম্মন্ধে জানা যায় যে, তিনি রয়েল স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হওয়া এবং সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করা সবচেয়ে কম বয়সী ব্যক্তিও ছিলেন। সবচেয়ে কম বয়সে ইসলামী আর্কিটেকচারে তিনটি ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্তির জন্য ইউরোপেও পড়াশোনা করেছেন তিনি। এছাড়াও তিনি রাজার কাছ থেকে নীলে স্কার্ফ এবং আয়রন পদমর্যাদাপ্রাপ্ত সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। এছাড়াও তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনিই প্রথম প্রকৌশলী যিনি মক্কাতুল মুকাররমাহ ও মদীনাতুল মুনাওওয়ারাহ মসজিদ সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেছিলেন।
বাদশাহ ফাহাদ এবং বিন লাদেন কোম্পানির প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি তার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন এবং স্থাপত্যকর্ম তদারকির জন্য কোনো প্রকার অর্থ গ্রহণ করতে রাজি হননি। তাদের লাখ লাখ রিয়ালের চেক ফিরিয়ে দিয়ে বিন লাদেন কনস্ট্রাকশন্স লি: এর উর্ধ্বতন কমকর্তা বাকের বিন লাদেনকে তিনি বলেছিলেন যে, 'আমি কেন পবিত্র দু'টি মসজিদে আমার কাজের জন্য অর্থ গ্রহণ করব? তাহলে আমি কীভাবে বিচার দিবসে আমার মালিক মহান আল্লাহ তাআ'লাকে মুখ দেখাব?'
ড. মুহাম্মদ কামাল ইসমাঈল রহ. ৪৪ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন। তার স্ত্রী এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে ইন্তেকাল করেন। স্ত্রী বিয়োগের পরে বাকি জীবনে তিনি আর বিয়ে করেননি এবং ২০০৮ ইং সালে ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিজের জীবনের পূর্ণ সময় একমাত্র মহান আল্লাহ তাআ'লার ইবাদতে নিবেদিত করেছিলেন। গণমাধ্যমের যশ, খ্যাতি এবং অর্থের মোহ থেকে দূরে থেকে তিনি তার সময়কে দুই পবিত্র মসজিদের সেবায় ব্যয় করেছিলেন।
মার্বেল পাথরের সেই গল্পে ফিরে যাই চলুন। এই প্রতিভাবান ব্যক্তির ঐকান্তিক ইচ্ছে ছিল- তিনি তাওয়াফকারিদের জন্য মসজিদুল হারাম অর্থাৎ, কাবা শরিফের মেঝেটি এমন একটি মূল্যবান পাথর দিয়ে আচ্ছাদিত করবেন যেটি সহজে গরম হবে না এবং যার কারণে তাওয়াফকারী ও ইবাদতে রত ব্যক্তিবর্গের সুবিধা হয়। এ ব্যাপারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খোঁজ-খবর নিয়ে অবশেষে তিনি জানতে পারলেন যে, এই বিশেষ তাপ শোষণক্ষমতাসম্পন্ন মার্বেল কেবল গ্রীসের একটি ছোট পর্বতেই পাওয়া যায়। এ খবর জানার পরে তিনি কালবিলম্ব না করে সাথে সাথে গ্রীস ভ্রমণের মনস্থ করেন। গ্রীসে পৌঁছে তিনি সেই পাথরের বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে প্রয়োজনীয় আলোচনা শেষে মসজিদুল হারামের জন্য প্রায় উক্ত পাহাড়ের অর্ধেকাংশ পরিমাণে মার্বেল কেনার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। আশ্চর্য্য বিষয় হচ্ছে, তিনি উক্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পরে মক্কায় ফিরে আসতে না আসতেই চুক্তিকৃত সেই সাদা মার্বেল পবিত্র মক্কা মুকাররমায় চলে এসেছিল এবং আলহামদুলিল্লাহ, অতি অল্প সময়ে মক্কার পবিত্র বাইতুল্লাহর মেঝেতে সফলতার সাথে উক্ত মার্বেল স্থাপনের বিশাল কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল।
পবিত্র বাইতুল্লাহ শরিফে বিশেষ তাপ শোষণক্ষমতাসম্পন্ন মার্বেল স্থাপনের সুদীর্ঘ ১৫ বছর পরের ঘটনা। সউদি সরকারের পক্ষ থেকে ড. মুহাম্মদ কামাল ইসমাঈল রহ.কে মদীনার পবিত্র মসজিদে নববীতেও অনুরূপ মার্বেল স্থাপন করতে বলা হয়। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, যখন বাদশাহ তাকে নবীজির মসজিদটিকেও একই মার্বেল দিয়ে আচ্ছাদিত করতে বললেন, তখন আমি খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। কারণ, এই ধরণের মার্বেল পাওয়ার জন্য পৃথিবীতে কেবলমাত্র একটিই জায়গা ছিল এবং এটি ছিল গ্রীস। আর আমি এটাও জানি যে, এরই মধ্যে তার অর্ধেকটা মার্বেল আমিই কিনে নিয়েছি এবং তা-ও বিগত প্রায় ১৫ বছর পূর্বে। সুতরাং, দীর্ঘ এই ১৫ বছর পরে সেখানে গিয়ে বাকি সেই মার্বেল পাওয়া যাবে- এমনটা কিভাবে আশা করতে পারি! যদি উক্ত মার্বেল না পাওয়া যায়, প্রিয় নবীজীর স্মৃতি বিজড়িত মসজিদে নববীর কাজটি কিভাবে সম্পন্ন করবো- ইত্যাকার চিন্তায় আমি অস্থিরতায় ডুবে গেলাম। কেবলই আল্লাহ তাআ'লার উপর ভরসা করে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে এগুতে থাকলাম.....
চলমান।