ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।
পৃথিবী এবং অন্তহীন রহস্যে ঘেরা মহাশুণ্য, পর্ব-১
পৃথিবী এবং অন্তহীন রহস্যে ঘেরা মহাশুণ্য, পর্ব-২
পৃথিবী প্রানীদের বাসোপযোগী একটি গ্রহ। হয়তো একমাত্র গ্রহ। হয়তো বা নয়। হয়তো পৃথিবী ছাড়া আরও কোনো গ্রহে মানুষের মত বুদ্ধিমান প্রাণি থেকে থাকতে পারে। হয়তো বলা ছাড়া এর বেশি কিছু বলার কোনো সুযোগ আপাততঃ এ পর্যন্ত নেই। কারণ, জানামতে মানুষের মত এমন বুদ্ধিমান কোনো প্রাণি পৃথিবী ছাড়া আর কোনো গ্রহে রয়েছে এমন কোনো তথ্য এ যাবত প্রাপ্ত গবেষনা বা আবিষ্কারে প্রমান হয়নি। ধর্মীয় গ্রন্থেও এমন কোনো ইঙ্গিত চোখে পড়েনি। বিশেষতঃ কুরআনুল কারিমে এমন কোনো কথা পাওয়া যায় না, যা দ্বারা এ ধরণের ইঙ্গিত অনুধাবন করা যায়।
সূর্য পৃথিবী থেকে ১৩ লক্ষ গুন বড়ঃ
মহান রাব্বুল আলামিন পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করেছেন। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান প্রাণি মানুষসহ অন্যান্য হাজার হাজার মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন। বিশ্বজাহানের অস্তিত্বের তুলনায় আমাদের এই পৃথিবীকে আসলে অতিক্ষুদ্র বললেও কম বলা হবে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বলা যায়? তা-ও বোধ করি বেমানান লাগবে। আসলে মহাবিশ্ব এত বড়, এতই বড় যে, এর সামনে, এর বিশাল, বিপুল এবং অভাবনীয় আয়তনের তুলনায় আমাদের পৃথিবীর অস্তিত্ব চোখে পড়ার মতই নয়। আমাদের এই পৃথিবীর রয়েছে চাঁদ নামের একমাত্র উপগ্রহ। পৃথিবী সদা ঘুর্ণায়মান সূর্য নামক নক্ষত্রের চারদিকে। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ
প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে সন্তরণ করে। -সূরা ইয়া - সীন, আয়াত- ৪০
এর পূর্বের ৩৮ এবং ৩৯ নং আয়াতে সূর্য এবং চন্দ্রের নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমনের কথা বলার পরে অত্র আয়াতে সকলেই সন্তরণ করছে উল্লেখ করা হয়েছে। পূর্বের দু'টি আয়াতের ঘোষনা-
وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَّهَا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ
সূর্য তার নির্দিষ্ট অবস্থানে আবর্তন করে। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ, আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ। -সূরা ইয়া - সীন, আয়াত- ৩৮
وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتَّى عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ
চন্দ্রের জন্যে আমি বিভিন্ন মনযিল নির্ধারিত করেছি। অবশেষে সে পুরাতন খর্জুর শাখার অনুরূপ হয়ে যায়। -সূরা ইয়া - সীন, আয়াত- ৩৯
এই সূর্যেরই একটি গ্রহ পৃথিবী। পৃথিবীর ব্যাস ৪০ হাজার ৭৫ কিলোমিটার যা সূর্যের অপর একটি গ্রহ বৃহস্পতির তুলনায় এতটাই ক্ষুদ্র যে ২৩০০ পৃথিবীকে বৃহস্পতি নামক গ্রহের মধ্যে অনায়াসে ঢুকিয়ে রাখা সম্ভব। আমরা হয়তো জেনে থাকবো, সূর্য পৃথিবী থেকে ১৩ লক্ষ গুন বড় অর্থাৎ, ১৩ লক্ষটি পৃথিবী একত্র করা হলে এমন একটি সূর্যের আয়তনের সমান হবে। অন্য কথায় বলা যায়, ১৩ লক্ষ পৃথিবীকে একই সাথে সূর্যের পেটে চালান করে দেয়া খুবই সহজ!
সূর্য কিন্তু একটি বামন(!) নক্ষত্রঃ
ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই! সূর্য পৃথিবীর চেয়ে ১৩ লক্ষ গুন বড় বলে আহামরি কিছু ঘটে যায়নি! কারণ, পৃথিবী থেকে ১৩ লক্ষ গুন বড় এই সূর্যকেই কি না বলা হয়ে থাকে বামন অর্থাৎ ক্ষুদ্র নক্ষত্র! প্রশ্ন করবেন, তাহলে বড় নক্ষত্র কোনটা? হ্যাঁ, প্রশ্নটা করাই যায়! আসুন, এই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে বামন(!) নক্ষত্র সূর্যকে নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করে আসি!
সূর্য প্রতিনিয়ত হিলিয়াম ও হাইড্রোজেনের বিকিরণের মাধ্যমে তাপ ও আলো সৃষ্টি করে থাকে। সূর্য প্রতিদিন ১ হাজার কোটি কিলোমিটার ব্যাস সমৃদ্ধ সৌরজগৎকে তাপ এবং আলো দিয়ে থাকে। সূর্যের উপরিভাগের তাপমাত্রা ৫ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিজ্ঞানীদের গবেষনা থেকে জানা যায়, প্রতিদিন জ্বালানি হিসাবে সূর্যের ৮ হাজার ৬ শত ৪০ কোটি মেট্রিক টন হিলিয়াম ও হাইড্রোজেনের প্রয়োজন হয়। সূর্যের বয়স ৪৫০ কোটি বছর এবং আগামী আরও ৬ শত কোটি বছর সূর্য সক্রিয় থাকার পর জ্বালানি শেষ হয়ে এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে এটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।
৩৩ কোটি সূর্যকে একত্রে ভরে রাখা যাবে ব্যাটেলজিয়াস নক্ষত্রের ভেতরেঃ
চলুন, এবার আমরা ঘুরে আসি অরিয়ন নক্ষত্রমন্ডলে। অরিয়ন মূলতঃ আমাদের মহাশুণ্যের অন্যতম একটি নক্ষত্রমন্ডলের নাম। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা প্রথম আসমানকে নক্ষত্রমন্ডলী দিয়ে সাজিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেন-
وَلَقَدْ زَيَّنَّا السَّمَاء الدُّنْيَا بِمَصَابِيحَ
আমি সর্বনিম্ন আকাশকে প্রদীপমালা দ্বারা সুসজ্জত করেছি। -সূরা আল মুলক, আয়াত- ০৫
অরিয়ন নক্ষত্রমন্ডলের কিছু চিত্র-
বস্তুতঃ রাতের বেলা খালি চোখে আমরা যে ৮টি উজ্জ্বল নক্ষত্র একত্রে দেখতে পাই এটাই অরিয়ন নক্ষত্রমন্ডল। অরিয়ন নক্ষত্রমন্ডলের দানবীয় আকারের একটি নক্ষত্রের নাম ব্যাটেলজিয়াস, যা পৃথিবী থেকে ৬৪০ আলোকবর্ষ দূরে (আমরা জানি, ১ আলোকবর্ষ সমান ৯ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি কিলোমিটার, আমরা যদি অরিয়ন নক্ষত্রমন্ডলে যাওয়ার চিন্তা করি, সেখানে পৌঁছতে কি পরিমান সময় লাগতে পারে, দেখে নিই আসুন, সাধারণ কোনো যানবাহনে তো আর সেখানে যাওয়ার চিন্তা করা যায় না, যেতে হবে আলোর গতিতে, অর্থাৎ, প্রতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার গতিতে ব্যাটেলজিয়াসে পৌঁছাতে সময় লাগবে মোটামুটি ৬৪০ বছরের মত)। ব্যাটেলজিয়াস নক্ষত্রটির বয়স আনুমানিক ১০ মিলিয়ন বছর। মজার বিষয় হচ্ছে, ব্যাটেলজিয়াসের তাপমাত্রা কিন্তু ভয়াবহরকম বেশি। সূর্যের থেকে ১৩ হাজার গুন বেশি উওপ্ত এই নক্ষত্র। এই নক্ষত্রের উপরিভাগের তাপমাত্রা ৬ লক্ষ ৫০ হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। আরও মজার ব্যাপার, ব্যাটেলজিয়াস নক্ষত্রটি এতই বিশাল যে, ৩৩ কোটি সূর্যকে একত্রে ব্যাটেলজিয়াসের মধ্যে অনায়াসে ঢুকিয়ে রাখা সম্ভব! তবে ধারণা করা হচ্ছে, জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে নক্ষত্রটি। আগামী ১ হাজার বছরের মধ্যে হাইড্রোজেন জ্বালানি ফুরিয়ে বিস্ফোরনের মাধ্যমে নক্ষত্রটির ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছেন বিজ্ঞানীরা।
ব্যালাস্টিক নক্ষত্রের বহিরাংশের তাপমাত্রা মাত্র(!) ২১ হাজার ৭২৬ ডিগ্রিঃ
এই অরিয়ন নক্ষত্রমন্ডলের আরেকটি নক্ষত্রের নাম ব্যালাস্টিক, যার আনুমানিক বয়স মাত্র(!) ২ কোটি বছর। পৃথিবী থেকে ৬৫০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই নক্ষত্রটির বহিরাংশের তাপমাত্রা মাত্র(!) ২১ হাজার ৭২৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আগামী ১ মিলিয়ন বছর পর জ্বালানি ফুরিয়ে নক্ষত্রটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
মহাবিশ্বের ৫৪ তম উজ্জ্বল নক্ষত্র সেইপের বহিরাংশের তাপমাত্রা ২৬ হাজার ডিগ্রিঃ
অরিয়ন নক্ষত্রমন্ডলের অন্য একটি নক্ষত্রের নাম সেইপ। ১ কোটি ১১ হাজার বছর বয়সী নক্ষত্রটি পৃথিবী থেকে ৬৫০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এটি মহাবিশ্বের ৫৪ তম উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার বহিরাংশের তাপমাত্রা ২৬ হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।
রিগ্যাল নক্ষত্রটি সূর্য থেকে ৪০ হাজার গুন বেশি উজ্জ্বলঃ
অরিয়ন নক্ষত্রমন্ডলের আরেকটি নক্ষত্রের নাম রিগ্যাল, যা পৃথিবী থেকে ৮ শত আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। অরিয়ন নক্ষত্রমন্ডলের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল এই নক্ষত্রটি ৮০ কোটি বছর পার করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। কয়েক মিলিয়ন বছর পর নক্ষত্রটি ধ্বংস হয়ে যাবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। রিগ্যালের বহিরাংশের তাপমাত্রা ১২ হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং এটি সূর্য থেকে ৪০ হাজার গুন উজ্জ্বল; কারণ, এই নক্ষত্রটি থেকে প্রতিনিয়ত সূর্যের চেয়ে ৪০ হাজার গুন বেশি আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি নির্গত হয়। যার ফলে নক্ষত্রটি এতটা উজ্জ্বল।
রিগ্যাল নক্ষত্রের কিছু ছবি-
মহাবিশ্ব আসলে কত বড়?
উপরোল্লিখিত ৪টি নক্ষত্রের পাশাপাশি মেইসা, মিন্টাকা, এ্যালনিলাম ও এ্যালনিটাক নামক মোট ৮টি নক্ষত্রের সমন্বয়ে গঠিত অরিয়ন নক্ষত্রমন্ডল। মহাকাশে বিজ্ঞানীরা অরিয়ন নক্ষত্রমন্ডলীর মত অসংখ্য নক্ষত্রমন্ডলী আবিষ্কার করেছেন যেমন- এরিয়েস, টাওরাস, জেমিনি, লিও, ভার্গো, লিবরা, স্কাপিও, স্যাগিটারিয়াস, ক্যাপ্রিকন, একোয়ারিয়াস, পিচেস, আরসা মেজর, পেগাসাস, ক্যাসিওপিয়ে, বুটেস ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানে আমরা শুধুমাত্র অরিয়ন নক্ষত্রমন্ডলী নিয়ে সামান্য আলোচনা করলাম। মহান রাব্বুল আলামিন প্রতিটি দানবীয় নক্ষত্র সৃষ্টি করেছেন নির্দিষ্ট আকার ও পরিমান নির্ধারন করে। কি অপরূপ তাঁর মহিমা! কি বিশাল এবং বিপুল তাঁর সৃষ্টি সুষমা! কি মহান তাঁর সৃজন কৌশল! কত বড়, কতই না বড় তাঁর সৃষ্টি! আমরা একবারও কি ভেবে দেখেছি যে, এমনও নক্ষত্র রয়েছে যার সাথে পৃথিবী থেকে ১৩ লক্ষ গুন বড় সূর্যকে তুলনা করা হলে সূর্য হবে সেই নক্ষত্রের কাছে একটি সরিষা দানার মত!
বলা বাহুল্য, কোটি কোটি নক্ষত্র নিয়ে গঠিত হয় একেকটি গ্যালাক্সি। লক্ষ-কোটি গ্যালাক্সি নিয়ে গঠিত হয় একেকটি লোকালগ্রুপ। কোটি কোটি লোকালগ্রুপের সমন্বয়ে তৈরি হয় একেকটি সুপারক্লাসচার। বিজ্ঞানীদের ধারণা, সুবিশাল এই মহাশুণ্যে ১ কোটিরও বেশি সুপারক্লাসচার বিদ্যমান। হায় হায়, চিন্তা করা যায়, মহাশুণ্যের পরিমান কত! আমরা কি ধারনা করতে পারি, মহান রাব্বুল আলামিনের সৃষ্টি মহাবিশ্ব কতটা বিশাল? কতটাই না সুপ্রশস্ত! সুবহানাল্লাহ!
কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে-
.إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَاخْتِلاَفِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لآيَاتٍ لِّأُوْلِي الألْبَابِ
অর্থাৎ, নিশ্চয় আসমান ও যমীন সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্যে। -সূরাহ আলে ইমরান, আয়াত ১৯০
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা বলেছেন, আসমান ও যমীন সৃষ্টিতে নিদর্শন রয়েছে বোধ এবং বিবেকসম্পন্ন লোকদের জন্যে। আমাদের বোধ এবং বিবেককে জাগ্রত করার সময় কি এখনও আসে নি? মহান স্রষ্টার সুবিশাল সৃষ্টি দর্শনে আমাদের ঘুমন্ত বিবেক জাগ্রত হওয়ার সময় কি এখনও দূর-সুদূরে?
তিনি তাকে চেনার তাওফিক দান করুন আমাদেরঃ
মূলতঃ এসব সৃষ্টির একমাত্র স্রষ্টা, মহাবিশ্বের একমাত্র মালিক মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লার নিকট একান্ত কামনা, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা আমাদেরকে তাঁর সুবিশাল সৃষ্টি সম্পর্কে ভাববার তাওফিক দান করুন। তাঁর সৃষ্টির অনন্ত সুন্দর সুষমা দেখে দেখে চক্ষুকে শীতল করার কিসমত নসিব করুন। তাকে জানার, চেনার এবং মেনে চলার সৌভাগ্য দানে ধন্য করুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০২০ সকাল ১০:৩১