ইসলামে নিকাহে মুত'আ বা সাময়িক বিবাহের বিধান ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
নিকাহে মুত'আ কাকে বলে?
আরবি: نكاح المتعة, English: 'wedlease'। নিকাহ মানে, বিয়ে, বিবাহ। আর মুত'আ অর্থ, উপকার ভোগ করা, ফায়দা লাভ করা, আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি। পরিভাষায়, কোনো মহিলাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে বিবাহ করাকে 'নিকাহে মুত'আ' বা 'সাময়িক বিবাহ' বলে। নির্দিষ্ট সময় সীমা অতিক্রম হওয়ার সাথে সাথে আপনা হতে এ বিবাহ ভঙ্গ হয়ে যায়। এর জন্য তালাকের দরকার হতো না।
নিকাহে মুত'আ আরব সমাজে ইসলামপূর্ব যুগের প্রথা; ইসলামের প্রথম যুগেও বৈধ ছিল এটিঃ
মূলতঃ মানব সভ্যতায় বিবাহের উদ্দেশ্য হল, সম্পর্ক বজায় রাখা এবং তা স্থায়ী করা। সাময়িক বিবাহ বা নিকাহে মুত'আ বিবাহের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। এ ধরণের বিবাহ প্রথা ইসলামপূর্ব আরব সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। ইসলামের প্রাথমিক যুগেও এর অনুমতি ছিল। পরে রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামত পর্যন্ত এর নিষিদ্ধতা ঘোষণা করেন। এ ধরণের কোনো বিবাহের বিধান ইসলামে বর্তমানে নেই।
হযরত আলী রায়দিাল্লাহু তাআ'লা ‘আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
مَالِكُ بْنُ إِسْمَاعِيلَ حَدَّثَنَا ابْنُ عُيَيْنَةَ أَنَّه“ سَمِعَ الزُّهْرِيَّ يَقُوْلُ أَخْبَرَنِي الْحَسَنُ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ عَلِيٍّ وَأَخُوه“ عَبْدُ اللهِ بْنُ مُحَمَّدٍ عَنْ أَبِيْهِمَا أَنَّ عَلِيًّا قَالَ لِابْنِ عَبَّاسٍ إِنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم نَهٰى عَنِ الْمُتْعَةِ وَعَنْ لُحُومِ الْحُمُرِ الأَهْلِيَّةِ زَمَنَ خَيْبَرَ.
হাসান ইব্নু মুহাম্মাদ ইব্নু ‘আলী ও তাঁর ভাই ‘আবদুল্লাহ্ তাঁদের পিতা থেকে বর্ণিতঃ ‘আলী (রাঃ) ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) - কে বলেছেন, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম খায়বর যুদ্ধে মুত’আহ বিয়ে এবং গৃহপালিত গাধার গোশ্ত খাওয়া নিষেধ করেছেন। (আধুনিক প্রকাশনী- ৪৭৪০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৭৪২) এই হাদিসের মানঃ সহিহ।
অপর বর্ণনায় আছে,
«نهى عن متعة النساء يوم خيبر وعن لحوم الحمر الإنسية»
'নবী কারিম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাইবারের দিন নারীদের সাথে মুত’আহ বিয়ে এবং গৃহপালিত গাধার গোশ্ত খাওয়াকে নিষেধ করেছেন।' -সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৯৭৯, সহিহ মুসলিম হাদিস নং ১৪০৭, এই হাদিসের মানঃ সহিহ।
অন্য এক হাদিসে এসেছে,
«يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنِّي قَدْ كُنْتُ أَذِنْتُ لَكُمْ فِي الِاسْتِمْتَاعِ مِنَ النِّسَاءِ، وَإِنَّ اللهَ قَدْ حَرَّمَ ذَلِكَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ، فَمَنْ كَانَ عِنْدَهُ مِنْهُنَّ شَيْءٌ فَلْيُخَلِّ سَبِيلَهُ، وَلَا تَأْخُذُوا مِمَّا آتَيْتُمُوهُنَّ شَيْئًا».
রবী ইবনে সাবুরা আল-জুহানী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, তার পিতা তাকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি একদিন রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সাথে ছিলেন। তখন তিনি বলেন, 'হে মানবসকল! আমি তোমাদের মুত'আর অনুমতি দিয়েছিলাম। আল্লাহ তাআ'লা কিয়ামত পর্যন্ত তা নিষিদ্ধ করেছেন। তোমাদের কারো নিকট যদি তাদের কিছু থেকে থাকে তবে তোমরা তাদের মুক্তি দিয়ে দাও। তোমরা তাদের যা দিয়েছ তা আর ফেরত নিবে না।' -সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৪০৬
আরেক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
وَقَالَ ابْنُ أَبِي ذِئْبٍ حَدَّثَنِي إِيَاسُ بْنُ سَلَمَةَ بْنِ الأَكْوَعِ عَنْ أَبِيهِ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَيُّمَا رَجُلٍ وَامْرَأَةٍ تَوَافَقَا فَعِشْرَةُ مَا بَيْنَهُمَا ثَلاَثُ لَيَالٍ فَإِنْ أَحَبَّا أَنْ يَتَزَايَدَا أَوْ يَتَتَارَكَا تَتَارَكَا فَمَا أَدْرِي أَشَيْءٌ كَانَ لَنَا خَاصَّةً أَمْ لِلنَّاسِ عَامَّ.
قَالَ أَبُو عَبْد اللهِ وَبَيَّنَه“ عَلِيٌّ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّه“ مَنْسُوخٌ.
ইব্নু আবূ যিব থেকে বর্ণিতঃ আয়াস ইবনু সালামাহ ইবনু আকওয়া‘ তার পিতা সূত্রে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেন, যে কোন পুরুষ এবং মহিলা উভয়ে (মুত‘আহ করতে) একমত হলে তাদের পরস্পরের এ সম্পর্ক তিন রাতের জন্য গণ্য হবে। এরপর তারা ইচ্ছে করলে এর চেয়ে অধিক সময় স্থায়ী করতে পারে অথবা বিচ্ছিন্ন হতে চাইলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। (বর্ণনাকারী বলেন) আমরা জানি না এ ব্যবস্থা শুধু আমাদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল, না সকল মানুষের জন্য ছিল। -সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৪০৫ আধুনিক প্রকাশনী- ৪৭৪২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৭৪৪
ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘আলী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু নবী কারিম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এটা পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন যে, মুতা‘আ বিবাহ প্রথা রহিত হয়ে গেছে। -সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৪০৫, আধুনিক প্রকাশনী- ৪৭৪২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৭৪৪, এই হাদিসের মানঃ সহিহ।
নিকাহে মুত'আ নিষিদ্ধ করার পেছনে হিকমত কি?
বিবাহকে আল্লাহ তাআ'লা তার নিদর্শন বানিয়েছেন। এতে রয়েছে মানুষের চিন্তার খোরাক। আল্লাহ তাআ'লা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মুহাব্বত ও অনুগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। আর স্ত্রীকে স্বামীর জন্য প্রশান্তিস্থল বানিয়েছেন। প্রজননের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন এবং নারীদের উত্তরাধিকারী করেছেন। এগুলো সবই উল্লিখিত নিকাহে মুত'আ তথা সাময়িক বিবাহে অনুপস্থিত। সামগ্রিক ভাবনায় মানব কল্যান এবং সাধারণ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায় যুদ্ধকালীন সাময়িক প্রয়োজনে এমন কোনো বিষয়ের অনুমোদন দেয়া হলেও তাকে বিধানে পরিনত করে চিরস্থায়ীভাবে বহাল করে রাখার মত যুক্তি ইসলামে থাকতে পারে না। আর যারা এ ধরণের বিবাহকে বৈধ আখ্যায়িত করার ছুতোয় ফায়দা লুটতে চান তাদের মতে মুত'আকৃত নারী তাদের স্ত্রীও নয় আবার ক্রীতদাসীও নয়। অথচ আল্লাহ তাআ'লা বলেন,
وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ
এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে।
إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ
তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না। -সূরা আল-মুমিনূন, আয়াত নং ৫, ৬
বিরুদ্ধবাদীদের মত খন্ডনঃ
ভ্রান্ত আকিদাসম্পন্ন শিআগনসহ কিছু কিছু বাতিল ফিরকা নিকাহে মুত'আর হুকুম বহাল থাকার তাদের মিথ্যে দাবির পক্ষে কিছু দলীল দিয়ে থাকেন, প্রকৃতপক্ষে যা দলীল হিসেবে টিকে না। কুরআনে ব্যবহৃত শব্দের শাব্দিক অর্থ বুঝার ক্ষমতা না থাকায় তারা হয়তো বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছে। যেমন, তারা বলেন-
আল্লাহ তাআ'লার বাণী-
فَمَا اسْتَمْتَعْتُم بِهِ مِنْهُنَّ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً
অনন্তর তাদের মধ্যে যাকে তোমরা ভোগ করবে, তাকে তার নির্ধারিত হক দান কর। -সূরা আননিসা, আয়াত নং ২৪
তারা বলে যে, এ আয়াতের মধ্যে মুত'আ হালাল হওয়ার দলীল রয়েছে। কারণ, আল্লাহ তাআ'লার বাণী أُجُورَهُنَّ প্রমাণ করে اسْتَمْتَعْتُم দ্বারা উদ্দেশ্য মুত'আ।
এর জবাবঃ
পূর্বের আয়াতে আল্লাহ তাআ'লা পুরুষের জন্য যেসব নারীদের বিবাহ করা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে তাদের আলোচনা করেছেন। তারপর এ আয়াতে যাদের বিবাহ করা যাবে তাদের আলোচনা করেছেন এবং বিবাহিতাকে তার মহর আদায় করার নির্দেশ দেন। আর বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রীর উপভোগ ও পরিতৃপ্তিকে এখানে استمتاع শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করেছেন। এ ধরণের দৃষ্টান্ত আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বর্ণিত হাদিসেও এসেছে। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«المرأة كالضِّلَع إن أقمتَها كسرتَها ، وإن استمتعتَ بها استمتعتَ بها وفيها عوج»
নারীরা পাঁজরের বাঁকা হাড়ের মতো। যদি তাকে তুমি সোজা করতে যাও তবে তাকে তুমি ভেঙ্গে ফেলবে। আর যদি তাকে তুমি উপভোগ কর, তবে তুমি বাঁকা অবস্থায় তাকে উপভোগ করবে। -সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৪৮৮৯, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৪৬৮
আর এখানে মহরের ব্যাখ্যাটি বিনিময় দ্বারা করা হয়েছে। এখানে বিনিময় দ্বারা উদ্দেশ্য মাল সম্পদ নয় যা মুত'আর চুক্তিতে নারীকে দেয়া হয়। পবিত্র কুরআনের অন্য জায়গায় 'আজর' বলে নাম রাখা হয়েছে। আল্লাহ তাআ'লা ইরশাদ করেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَحْلَلْنَا لَكَ أَزْوَاجَكَ اللَّاتِي آتَيْتَ أُجُورَهُنَّ
হে নবী! আপনার জন্য আপনার স্ত্রীগণকে হালাল করেছি, যাদেরকে আপনি 'আজর' তথা মোহরানা প্রদান করেন। -সূরা আল আহযাব, আয়াত নং ৫০
অতএব সত্য তাদের অন্তর স্পর্শ করুকঃ
সুতরাং, একথা স্পষ্ট হলো যে, কুরআনুল কারিমের আয়াতে এমন কোনো দলীল নেই যাতে প্রমাণ হয় যে, মুত'আ বিবাহ হালাল। মূলতঃ তাফসীরকারদের মধ্যে যারা উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুত'আর বিষয়টি উল্লেখ করেছেন এটা তাদের অভিমত মাত্র। একটি বিষয়ে সর্বাবস্থায় চোখ-কান খোলা রেখে অনুধাবন করার চেষ্টা করতে হবে যে, পবিত্র কুরআন ওহীর মাধ্যমে প্রদত্ত মহান আল্লাহ তাআ'লার বাণী, এর শব্দ, বাক্য, অক্ষর কিংবা নুকতায়ও কোনো পরিবর্তন-পরিবর্ধনের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তাফসীর ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ হয়নি। তাফসীর শব্দের সরল বাংলা অর্থ- ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যা একেকজন তাফসীরকার একেকভাবে করেছেন। এতে কোনো কোনো স্থানে শব্দের অর্থ গ্রহণের ক্ষে্ত্রে, বাক্যের অন্তর্ণিহিত অর্থ প্রকাশের ক্ষে্ত্রে কিছু কিছু পরিবর্তন লক্ষনীয় হয়ে উঠেছে। তাফসীরের কিতাবগুলোতে এধরণের ঘটনা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবেই স্বীকৃত। কোনো কোনো তাফসীরকার তাদের তাফসীরের কিতাবে ইসরাঈলী এমন এমন উপকথা বর্ণনা করেছেন যা মুসলমানদের আকিদার সাথে সাংঘর্ষিক। যেমন হযরত আইউব আলাইহিস সালামের অসুস্থতা প্রসঙ্গে আলোচিত আয়াতের ব্যাখ্যায় কিছু তাফসীরের কিতাবে অতিরঞ্জন লক্ষ্য করা যায়। তাফসীরের কিতাবে কোনো কিছু থাকলেই তা গ্রহণ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে সেই তাফসীরকার কোন মানসিকতার ছিলেন, তার মতাদর্শ কি ছিল ইত্যাদি বিবেচ্য বিষয়। আর তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, কুরআনের কোনো আয়াতে যে বিষয়ে কোনো পরিষ্কার নির্দেশনা নেই এবং বিষয়টিতে স্বয়ং প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর স্পষ্ট নির্দেশনা বিদ্যমান, সেই ক্ষেত্রে মহানবী এর বাণীর চেয়ে তাফসীরকারদের অভিমত তথা মতামতকে অধিক গুরুত্ব দেয়ার মুমিনের শান হতে পারে না। তাছাড়া সূরা আননিসা এর উপরোক্ত ২৪ নং আয়াতের তাফসীরে মহনবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের অভিমত কেমন ছিল? তারা এই আয়াতের যে ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন আমাদেরকেও সেটাই গ্রহণ করতে হবে। তাই নয় কি, প্রিয় পাঠক?
কুরআনের কোনো আয়াতের মাধ্যমে মুত'আ বিবাহ আদৌ হালাল সাব্যস্ত হয়নিঃ
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর রাসূল সাধারণ কোনো মানুষ ছিলেন না। তিনি মহামানব। মহান নবী এবং রাসূল। শ্রেষ্ঠতম পয়গাম্বর। কোনো বিষয় কুরআনের আয়াত দ্বারা হালাল হয়ে থাকলে তিনি তা নিজের কথা অর্থাৎ, হাদিস দ্বারা বাতিল করার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি এমন ভুলো মনের কেউ ছিলেন না যে, নাসিখ-মানসূখ তাঁর জানা ছিল না (নাউজুবিল্লাহ)। তিনি এমন কেউ নন যে, এই কাজটি বেখেয়ালেই তিনি করে ফেলেছেন। আল্লাহ তাআ'লা তাঁর শ্রেষ্ঠতম বন্ধুকে দিয়ে এমন একটি ভুল করাবেন, আহলে হকের নিকট এটি কল্পনারও অতীত। অর্থাৎ, মুত'আ বিবাহ জায়েজ হওয়ার নির্দেশনা যদি কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রদান করা হয়েই থাকতো, তবে তিনি কস্মিনকালেও তা নিজের বাণী দ্বারা রহিত করতেন না। এই নির্দেশ কখনোই দিতেন না। অবশ্যই কুরআনের অন্য কোনো আয়াত নাযিলের অপেক্ষায় থাকতেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে যেহেতু তিনি নিজেই নির্দেশনা দিয়ে মুত'আ বিবাহ স্পষ্টভাবে হারাম ঘোষনা করেছেন সুতরাং সহজেই বোধগম্য হওয়ার কথা যে, কুরআনের কোনো আয়াতের মাধ্যমে মুত'আ বিবাহ আদৌ হালাল সাব্যস্ত হয়নি। সুতরাং, সত্য মেনে নেয়ার পথে আমাদের আর বাধা থাকার কথা নয়।
তারপরও যদি আমরা তর্কের খাতিরে একথা মেনে নিই যে, আয়াত দ্বারা মুত'আ বিবাহ বুঝানো হয়েছে, তাহলেও আমরা বলবো আয়াতটির বিধান রহিত। কারণ, অনেকগুলো সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, নিকাহে মুত'আ তথা সাময়িক বিবাহ কিয়ামতের দিন পর্যন্ত নিষিদ্ধ।
কোনো কোনো সাহাবী বিশেষ করে ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুমা থেকে নিকাহে মুত'আ বৈধ হওয়ার যে বর্ণনা পাওয়া যায় তার উত্তর হলো,
প্রথমতঃ এটি প্রমাণ করে যে, শিআরা তাদের প্রবৃত্তির অনুসারী। কারণ, তারা রাসূলের সাহাবীদের কাফির বলে, তারপর তারা এ বিষয়ে এবং অন্য যে কোনো বিষয়ে তাদের আমল দ্বারা তাদের মতের পক্ষে দলীল পেশ করে।
দ্বিতীয়তঃ যেসব সাহাবী থেকে মুত'আ বৈধ হওয়ার বর্ণনা এসেছে, তারা ঐসব সাহাবী যাদের নিকট উক্ত বিবাহ হারাম হওয়ার দলীল পৌঁছেনি। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুমাকে সাহাবীরা বিশেষ করে আলী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু এবং যুবাইর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু নিকাহে মুত'আ বৈধ বলার জবাব দিয়েছেন।
«مهلا يا ابن عباس فإن رسول الله صلى الله عليه وسلم نهى عنها يوم خيبر وعن لحوم الحمر الإنسية» .
আলী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি ইবন আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুকে মুত'আর বিষয়ে নমনীয় বলে জানতে পেরে বলেন, 'হে ইবন আব্বাস! মুত'আর বিষয়ে সাবধান! কারণ, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাইবারের যুদ্ধে মুত'আকে নিষেধ করেছেন এবং পালিত গাধার গোশত খেতে নিষেধ করেছেন।' -সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৯৭৯, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৪০৭
হাদিসের দ্বারা মুত'আ বিবাহের অনুমতি দেয়া হয়েছিলঃ
হাদিসের দ্বারাই মুত'আ বিবাহের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। প্রমান হিসেবে নিচের সহিহ হাদিসগুলো দ্রষ্টব্য,
এক. আবূ জামরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আমি মহিলাদের মুত’আহ বিয়ে সম্পর্কে ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ)-কে প্রশ্ন করতে শুনেছি, তখন তিনি তার অনুমতি দেন। তাঁর আযাদকৃত গোলাম তাঁকে বললেন যে, এরূপ হুকুম নিতান্ত প্রয়োজন ও মহিলাদের স্বল্পতা ইত্যাদির কারণেই ছিল? ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) বললেন, হাঁ। -সহিহ বুখারি, হাদিসঃ ৫১১৬, হাদিসের মানঃ সহিহ
দুই. জাবির ইব্নু ‘আবদুল্লাহ্ এবং সালাম আকওয়া‘ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃআমরা কোন এক সেনাবাহিনীতে ছিলাম এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রেরিত এক ব্যক্তি আমাদের নিকট এসে বললেন, তোমাদেরকে মুত‘আহ বিয়ের অনুমতি দেয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা মুত‘আহ করতে পার। -সহিহ বুখারি, হাদিসঃ ৫১১৭, হাদিসের মানঃ সহিহ
তিন. ইব্নু আবূ যিব থেকে বর্ণিতঃ আয়াস ইবনু সালামাহ ইবনু আকওয়া‘ তার পিতা সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, যে কোন পুরুষ এবং মহিলা উভয়ে (মুত‘আহ করতে) একমত হলে তাদের পরস্পরের এ সম্পর্ক তিন রাতের জন্য গণ্য হবে। এরপর তারা ইচ্ছে করলে এর চেয়ে অধিক সময় স্থায়ী করতে পারে অথবা বিচ্ছিন্ন হতে চাইলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। (বর্ণনাকারী বলেন) আমরা জানি না এ ব্যবস্থা শুধু আমাদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল, না সকল মানুষের জন্য ছিল। -সহিহ বুখারি, হাদিসঃ ৫১১৯, হাদিসের মানঃ সহিহ
মুত'আ বিবাহ যদি কুরআনের আয়াত দ্বারা হালাল সাব্যস্ত হয়ে থাকতো তাহলে এত এত হাদিসে আবার একই বিষয়ে নির্দেশনা থাকার কারণ কি? এখানেও একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায় যে, এ বিষয়টি কুরআনের আয়াত দ্বারা হালাল সাব্যস্ত হয়নি। তাই এই ধরণের বিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষনাও করেছেন স্বয়ং নবী কারিম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বাণী তথা হাদিস দিয়ে।
হকপন্থী সকলের নিকট মুত'আ বিবাহ হারামঃ
মুত‘আ বিবাহ প্রথা রহিত হয়ে গেছে মর্মে এ ধরণের সহিহ হাদিসের বর্ণনা আরও রয়েছে। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ধরণের বিবাহকে স্পষ্টভাবে এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছেন। তাই সহিহ হাদিসের বর্ণনার আলোকে সাহাবায়ে কেরামের আমল ও ইজমা, তথা কাজ ও সম্মিলিত মতামতের মাধ্যমে মুত‘আ বিবাহ যে সর্বসম্মতিক্রমে নিষিদ্ধ তা আমরা ইতোমধ্যেই উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে উপলব্ধি করেছি। উপরন্তু মুসলিম উম্মাহর সকল যুগের হকপন্থী আলেম-উলামা ও বিজ্ঞজনদের সর্বসম্মত অভিমতও একইরকম। সকল মাযহাবের ইমামগণ, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সকলেরই এই একই আকিদা। তারাও মুত'আ বিয়েকে নিষিদ্ধ তথা হারাম মনে করেন। বিভ্রান্তিতে নিপতিত সংশয়বাদীগন ছাড়া কেউ মুত'আ বিবাহকে এখনও জায়েজ বলছে এমন কথা শোন যায় না।
রাসূলের ফায়সালা মেনে নেয়া মুমিনের জন্য অবধারিতঃ
মহান আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,
وَمَن يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَىٰ وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ ۖ وَسَاءَتْ مَصِيرًا
আর কারো নিকট সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সে দিকেই তাকে আমরা ফিরিয়ে দেব এবং তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করাবো, আর তা কতই না মন্দ আবাস! -সূরা নিসা, আয়াত ১১৫
উপরোক্ত আয়াত থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা পাওয়া যায়। যেমন-
এক. আল্লাহর রাসূলের বিরোধিতাকারী জাহান্নামী।
দুই. কোন ব্যাপারে হক তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত প্রকাশিত হওয়ার পর সেটার বিরোধিতা করাও জাহান্নামীদের কাজ।
তিন. এ উম্মতের ইজমা বা কোন বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছার পর সেটার বিরোধিতা করা অবৈধ। কারণ, তারা পথভ্রষ্টতায় একমত হবে না। মুমিনদের মত ও পথের বিপরীতে চলার কোন সুযোগ নেই।
মুত'আ বিবাহ নিষিদ্ধের ইজমা বা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় সাহাবীদের সময়ইঃ
মুত'আ বিবাহ নিষিদ্ধের ইজমা বা সম্মিলিত মতামতের ঘটনা ঘটে সাহাবীযুগেই। হযরত ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু নিজের পূর্বের রায় ছেড়ে রুজু করেছেন। অর্থাৎ, তিনি তার আগের মত পরিহার করে পরবর্তীতে মুত'আ বিবাহ হারাম হওয়ার সিদ্ধান্তে ঐকমত্য পোষন করেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের সাথে আমরা লক্ষ্য করে থাকি যে, এ বিষয়ে প্রায় ডজনখানিক বর্ণনা হযরত আলী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে এসেছে। অথচ শিয়া মতবাদে বিশ্বাসীদের নিকট তিনিই তাদের ইমাম। ইমামের বর্ণনা অনুসারে মুত'আ বিবাহ হারাম সাব্যস্ত হওয়ার পরেও এটাকে তাদের জায়েজ বলা 'ইমাম-বিরোধিতা' ছাড়া আর কিইবা বলা যায়!
ইসলাম যেখানে বিবাহ বিচ্ছেদকে তিরস্কার করে সেখানে মুত'আ বিবাহ বা সাময়িক বিবাহের মত যখন-তখন বিবাহ ও বিচ্ছেদের এই কু-প্রথা কখনও ইসলামিক স্থায়ী রীতি বা নিয়ম হতে পারে না।
এখানে এ বিষয়টিও পরিষ্কার হওয়া চাই যে, ইসলামী শরীয়তে অতীব প্রয়োজনের ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের অবকাশ রয়েছে, কিন্তু বিষয়টি পছন্দনীয় নয়। একেবারেই ঘৃণিত একটি কাজ। সুনানে ইবনে মাজার এক হাদিসে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী বর্ণিত হয়েছে যে-
أَبْغَضُ الْحَلَالِ إِلَى اللّهِ الطّلَاقُ.
আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় হালাল হচ্ছে তালাক। -সূত্রঃ সুনানে ইবনে মাজাহ, হা/ ২০১৮
সুনানে আবু দাউদে মুহারিব ইবনে দিছার রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু -এর সূত্রে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ বর্ণিত হয়েছে-
مَا أَحَلّ اللّهُ شَيْئًا أَبْغَضَ إِلَيْهِ مِنَ الطّلَاقِ.
আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছে তালাকের চেয়ে অপ্রিয় কোনো কিছুকে হালাল করেননি। -সূত্রঃ সুনানে আবু দাউদ, হা/ ২১৭৭
অতএব বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাকের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। নারী-পুরুষ উভয়ের কর্তব্য তালাক থেকে দূরে থাকা। তালাকের মত ঘৃণিত বিষয় থেকে সতর্ক থাকা। বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাক দেয়ার ক্ষমতা যেহেতু পুরুষের তাই পুরুষকে এই ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে খুবই সংযমী হতে হবে। অন্যদিকে নারীর ব্যাপারে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে-
أَيّمَا امْرَأَةٍ سَأَلَتْ زَوْجَهَا الطّلَاقَ فِي غَيْرِ مَا بَأْسٍ فَحَرَامٌ عَلَيْهَا رَائِحَةُ الْجَنّةِ.
যে নারী তার স্বামীর কাছে বিনা কারণে তালাক প্রার্থনা করে তার জন্য জান্নাতের সুঘ্রাণ পর্যন্ত হারাম। -সূত্রঃ সুনানে ইবনে মাজাহ, হা/ ২০৫৫
সাম্প্রতিককালে সমাজের সর্বব্যাপী মহামারী আকারে পরকীয়ার যে পরিবিস্তার দৃশ্যমান হয়ে উঠছে- এতে যেমন পুরুষের অপরাধ আছে তেমনি আছে নারীরও। দেখা যাচ্ছে যে, এক নারীর দ্বারাই অন্য নারীর সংসার ভাঙছে। এক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী খুবই প্রাসঙ্গিক।
জামে তিরমিযীতে হযরত আবু হুরাইরা রা. -এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لاَ تَسْأَلِ الْمَرْأَةُ طَلاَقَ أُخْتِهَا لِتَكْفِئَ مَا فِي إِنَائِهَا.
কোনো নারী যেন তার বোনের (অপর নারীর) হিস্যা নিজের পাত্রে উপুড় করে নেয়ার জন্য তালাকের ফরমায়েশ না করে। -সূত্রঃ জামে তিরমিযী, হা/ ১১৯০
এক্ষেত্রে সমাজের এই অসুস্থাবস্থার প্রতিকারে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। প্রত্যেকেরই উচিত নিজের তাকদিরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা। যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকার মানসিকতা থাকা চাই। অন্যের ভাগ্য নিয়ে টানাটানি কোনো রুচিশীল মানুষেরই থাকতে পারে না। অন্যের অধিকারে যা আছে তা-ও নিজের অধিকারে নিয়ে নেয়ার মতো লোভী মানসিকতা কোনো ভদ্র মানুষের হতে পারে না। উপরন্তু যখন ঐ নারীটিও একজন নারী, যে কোনো ধর্মের বা বর্ণেরই তিনি হোন না কেন!
তো এই সকল ঈমানী ও মানবীয় চেতনার বিস্তার এখন খুবই জরুরি। তাহলে অন্যায় অযৌক্তিক কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদের হার অনেক হ্রাস পাবে।
নারী-পুরুষ উভয়ে যদি পর্দার বিধান মেনে চলে তবে পরকীয়া জাতীয় কিছু ঘটার আশংকা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। যারা শরীয়তের এ গুরুত্বপূর্ণ বিধানটি নিয়ে কটাক্ষ করে অথবা একে জটিল মনে করে তা পালনে বিরত থাকে, তাদের বিষয়টি ভাবা উচিত।
উল্লেখ্য যে, পর্দা বলতে শুধু সামনের মানুষটির সাথেই পর্দা নয়; বরং এ ডিজিটাল যুগে টেলিভিশন, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ইত্যাদির মাধ্যমেও ব্যাপকভাবে পর্দা লংঘিত হয় এবং এগুলোও একটি সময়ে এসে অনেক সংসারে ভাঙনের কারণ হিসেবে যুক্ত হয়ে থাকে। বিশেষতঃ ফেসবুক, টুইটারসহ ইত্যাদির মত বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো যে, বিশ্বব্যাপী কত সংসার ভাঙার কারণ ঘটেছে, কত শিশুকে তাদের মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে তার সঠিক হিসাব হয়ত কোনো দিনই প্রকাশিত হবে না। মনে রাখতে হবে যে, পর্দা এসব ক্ষেত্রেও লঙ্ঘিত হতে পারে। সুতরাং, আধুনিক এসব ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারেও সংযম অবলম্বন একান্ত জরুরি।
আরব বিশ্বের সর্বোচ্চ ফতোয়া কমিটির সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তঃ
ফাতাওয়া লাজনাতিদ্দায়িমা অর্থাৎ, আরব বিশ্বের সর্বোচ্চ ফতোয়া কমিটিকে নিকাহে মুত'আ বা সাময়িক বিবাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে,
انتشر بين أوساط الشباب السفر خارج البلاد للزواج بنية الطلاق ، والزواج هو الهدف في السفر استناداً على فتوى بهذا الخصوص ، وقد فهم الكثير من الناس الفتوى خطأ ، فما حكم هذا ؟ .
‘তালাকের নিয়তে বিবাহ করার জন্য দেশের বাইরে সফর করা যুবকদের মাঝে ব্যাপকতা লাভ করেছে। বিয়ে করাটাই সফরের লক্ষ্য স্থির করা হয়। যার দলিল তারা একটি বিশেষ ফতয়াকে দিয়ে থাকে। অধিকাংশ লোক ওই ফতওয়া না বুঝে তার থেকে ভুল অর্থ নিয়ে থাকে। আসলে এ বিষয়ে বিধান কী?’
কমিটির উলামায়ে কেরাম উত্তরে লিখেছেন,
الزواج بنية الطلاق زواج مؤقت ، والزواج المؤقت زواج باطل ؛ لأنه متعة ، والمتعة محرمة بالإجماع ، والزواج الصحيح : أن يتزوج بنية بقاء الزوجية ، والاستمرار فيها ، فإن صلحت له الزوجة وناسبت له وإلا طلقها ، قال تعالى : ( فَإِمْسَاكٌ بِمَعْرُوفٍ أَوْ تَسْرِيحٌ بِإِحْسَانٍ ) البقرة/229
‘তালাকের নিয়তে বিবাহ– এটি একটি অস্থায়ী বিবাহ। আর এ ধরণের স্বল্প সময়ের বিবাহ বাতিল। কেননা এটি একপ্রকার মুত’আ তথা প্রমোদ-বিবাহ; যা উলামায়ে কেরামের ঐকমত্যে হারাম। সহিহ পদ্ধতির বিয়ে হল, বিবাহ করা হবে স্থায়ীভাবে বসবাসের নিয়তে। তারপর যদি বিবাহ-বন্ধন নিরাপদ হয় এবং স্ত্রী তার স্বামীর জন্য উপযোগী হয় তাহলে তাকে রাখবে অন্যথায় তাকে তালাক দিবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, অতঃপর বিধি মোতাবেক রেখে দেবে কিংবা সুন্দরভাবে ছেড়ে দেবে। (সূরা বাকারা ২২৯)।’ (ফাতাওয়া লাজনাতিদ্দায়িমা ১৮/৪৪৮, ৪৪৯)
উল্লখ্য, শী‘আ রাফেযীরা এখনও এই ধরনের বিবাহকে জায়েয মনে করে থাকে, অথচ তাদেরই অন্যতম ইমাম জা‘ফর ছাদেক (৮০-১৪৮ হি.) এটিকে ‘যেনা’ বলে অভিহিত করেছেন। (বায়হাক্বী ৭/২০৭)
আসুন, আহলে সুন্নতের পথে থাকি, হকের পথে অটল থাকিঃ
প্রিয় ভাই/ বোন আপনি কোন দলের? কাদের সাথে যাবেন? কাদের সাথে থাকবেন? নবী কারিম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর সাহাবায়ে কেরাম এবং ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শী হকপন্থী বিজ্ঞজনদের সাথে থাকবেন? না কি, বিপরীতপন্থী ভাইদের সাথে যাবেন? ওদের সাথে গেলে অবশ্য সাময়িক ফায়দা একটা আছে! যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামত পর্যন্ত মুত'আ বিবাহকে হারাম ঘোষনা করেছেন সে কারণে এই সাময়িক বিবাহ পদ্ধতিকে পুনরায় আর জায়েজ করা সম্ভব না বিধায় কল্পনায় এটির চান্সপ্রাপ্তির নিভূ নিভূ আশার ক্ষীণ একটা আলো কিছুদিন ধিকিধিকি করে জ্বালিয়ে রাখলেও রাখতে পারেন অন্তরে! আর হ্যা, তাতে যদি সাময়িক বিবাহের কিছুটা শান্তি মনে-প্রাণে অনুভবে গ্রহণ করে নিতে পারেন! কিন্তু শেষ বলতে যা কথা! শেষ রক্ষে কি আর হয় তাতে! আল্লাহর রাসূল আর তাঁর সাহাবীদের পথ ছেড়ে আমরা আর কোথায় যাব! আমাদের আর যাওয়ার জায়গা কোথায়! আল্লাহ তাআ'লা আমাদের ক্ষমা করুন। সকলের জন্য শুভ কামনা। ভালো থাকুন সবাই।
লেখাটি প্রিয় বোদ্ধাজন বিদ্রোহী ভৃগু ভাইকে......
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০২০ দুপুর ২:২৭