ছোট শিশুদের মসজিদে গমন; মসজিদগুলো মুখরিত হোক কোমলমতি শিশুদের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণে
আলহামদুলিল্লাহ, মসজিদে শিশুদের যাতায়াত দিন দিন বাড়ছে। আমরা সকলেই সুখী, সমৃদ্ধ এবং অপরাধমুক্ত একটি সমাজ-রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে যে কাজগুলো করা উচিত তা বুঝি না কিংবা বুঝতে সচেষ্ট হই না অথবা বুঝে থাকলেও ঠিকভাবে তা আমলে পরিনত করি না। সুখী, সুন্দর ও অপরাধমুক্ত সমাজ গঠনে শিশুদেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আজকের শিশু আগামী দিনে জাতির কর্ণধার। তাই তাদের মসজিদে গমন খুবই জরুরি। আমাদের সমাজে প্রায়শঃই দেখা যায়, আমাদের শিশুরা মসজিদে আসতে চায়, কিন্তু আমরা অভিভাবকগন শিশুদেরকে মসজিদে নিয়ে আসা থেকে বিরত থাকতে মিথ্যাসহ নানা অজুহাত দাঁড় করাই। এটা কোনোভাবেই উচিত নয়, বরং শিশুর মসজিদে আসা এবং শিশুদের অংশগ্রহণে মসজিদ আবাদ হলে জাতি পাবে মসজিদে এসে জামাআতে সালাত আদায়কারী একটি উন্নত প্রজন্ম। আর এদের দ্বারাই বিনির্মিত হতে পারে আদর্শ, সুন্দর এবং অপরাধমুক্ত একটি সমাজ।
শিশুরা নামাজের সময় একটু কথা বলে উঠলে আর রক্ষে নেইঃ
দুঃখজনক হলেও এই দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে, মসজিদে শিশুদের নিয়ে কেউ নামাজে এলে মুসল্লীদের অনেকে বিরক্ত হন। কোনো শিশু নামাজের সময় একটু কথা বলে উঠলে আর রক্ষে নেই। নামাজের পরেই শুরু হয়ে যায় বিশাল শোরগোল। কমিটির লোকজন মারমুখী হয়ে ওঠেন। তীব্র বাক্যবানে জর্জরিত করে উত্তপ্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতেও দেখা যায় মসজিদের ভেতরে। বলতে শোনা যায় এরকম কথাও- 'মসজিদে কে বাচ্চা এনেছে? কার এতবড় বুকের পাটা? ব্যাটা মসজিদ কি তোমার বাবার টাকায় বানানো হয়েছে?'
রীতিমত অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট শিশুর অভিভাবককে। অবস্থা এমনই পর্যায়ে চলে যায় যে, নিজ শিশু সন্তানকে মসজিদে নিয়ে আসার অপরাধে(!) অপমান অপদস্ততার শিকার হতে হয় তাকে। ফলে বেচারা পারলে কানে ধরে মসজিদ থেকে বের হয়ে বেঁচে যান। আবার এমন দৃশ্যও প্রায় সময় মসজিদগুলোতে চোখে পড়ে, শিশুদের নামাজের কাতার থেকে বের পেছনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই কাজটি অনেকেই করেন। এ কাজটিও করা উচিত নয়। কেননা মসজিদে শিশুদের নিয়ে অনাকাঙ্খিত যে কাজগুলো সচরাচর ঘটতে দেখা যায়, সুন্নাতের সরাসরি খেলাফ সেই কাজগুলোর মধ্যে এটিও একটি। হ্যাঁ, হাদীসের আলোকে ফুক্বাহায়ে কেরাম বলেছেন, নামাযের কাতারে প্রথমে প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষরা থাকবে। আর পিছনে থাকবে শিশুরা। কিন্তু তারা একসাথে থেকে দুষ্টুমি করার সম্ভাবনা থাকলে তাদেরকে বড়দের কাতারের মাঝখানে মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেয়াই উত্তম। এতে করে ফরজ চলাকালীন সময়ে তাদের সম্মিলিত দুষ্টুমির যে সুযোগ থাকে সেটির সম্ভাবনাও কমে যেতে পারে।
শিশুদের সাথে মসজিদে প্রিয় নবীজীর অমলিন কিছু স্মৃতিঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবন থেকেই মুসলিম উম্মাহর এ শিক্ষা নেয়া জরুরি যে, তিনি মসজিদে শিশুদের নিয়ে আসতেন কি না। কিংবা নামাজ পড়াকালীন সময়ে তিনি শিশুদের সঙ্গে কেমন আচরণ করেছেন। আর তাতেই রয়েছে সুন্দর উত্তর।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের সন্তানদের বয়স যখন সাত বছরে পৌঁছে, তখন তাদের নামাজ শিক্ষা দাও, যখন বয়স দশে পৌঁছে, তখন বাধ্যতামূলক ভাবে নামাজ পড়াও। যদি না পড়ে তাহলে হালকাভাবে এবং সহনীয় পর্যায়ে মারধোর করে হলেও তাকে নামাজ পড়াও”।
বুখারী শরীফে এসেছে- রাসূলে মাকবুল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নাতনী হযরত উমামা বিনতে যায়নাব (রাঃ) কে বহন করে (কোলে কিংবা কাঁধে) নামাজ আদায় করেছেন। যখন তিনি দন্ডায়মান হতেন তখন তাকে উঠিয়ে নিতেন আর সিজদাহ করার সময় নামিয়ে রাখতেন।
আবু দাউদ শরীফে এসেছে- সাহাবায়ে কেরাম রা. বলেন, 'আমরা একদা যুহর কিংবা আসর নামাজের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বেলাল (রাঃ) রাসূলে পাক সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামাজের জন্য ডাকলেন। রাসূল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নাতনী হযরত উমামাহ (রাঃ) কে কাঁধে করে নিয়ে আমাদের কাছে আসলেন। রাসূল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমামতির জন্য নামাজের স্থানে দাঁড়ালেন আমরা তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে গেলাম অথচ, সে (উমামাহ রা.) তার স্থানে তথা রাসূল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাঁধেই আছে। রাসূল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজের তাকবির দিলেন আমরাও তাকবীর দিলাম। রাসূল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুকু করার সময় তাকে পাশে নামিয়ে রেখে রুকু ও সিজদাহ করলেন। সিজদাহ শেষে আবার দাঁড়ানোর সময় তাকে আগের স্থানে উঠিয়ে নিতেন। এভাবে নামাজের শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক রাকাতেই তিনি এমনটি করে যেতেন।' (সুনান আবু দাউদ ৯২০)
এ ছাড়াও রাসূল (সাঃ) এর খুতবা দেয়ার সময় তাঁর নাতি হাসান ও হুসাইন (রাঃ) এসে পড়লে তিনি খুতবা দেয়া বন্ধ রেখে তাদেরকে জড়িয়ে ধরে আদর করতেন, কোলে তুলে নিতেন, চুম্বন করতেন আর বলতেন খুতবা শেষ করা পর্যন্ত আমি ধৈর্য ধারণ করতে পারব না। তাই, আমি খুতবা দেয়া বন্ধ করেই এদের কাছে চলে এসেছি। (নাসায়ী শরীফ)
এমনও দেখা গেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজ আদায় করছেন। তিনি সেজদায় গেলে তাঁর প্রিয় দুই নাতি হজরত ইমাম হাসান ও হুসাইন রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুমা তাঁর কাধে চড়ে বসতেন। যে কারণে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিজদায় কখনো কখনো অধিক সময় ব্যয় করতেন। নামাজে তার সাথে এই আচরণের কারণে কখনো নাতিদের সঙ্গে তিনি রাগও করেননি কিংবা সামান্য বিরক্তও বোধ করেননি।
শিশু কিশোরদের মসজিদমুখী করতে দেশে বিদেশে প্রশংসনীয় নানা উদ্যোগঃ
শিশু কিশোরদের মসজিদমুখী করতে দেশে বিদেশে প্রশংসনীয় নানা উদ্যোগ আয়োজনের খবর পাওয়া যায়। কোথাও মসজিদে গাছের বাগান করেছেন কোনো ইমাম। এক একটি গাছের টবে এক একজন বাচ্চা বা শিশুর নাম লিখে সে গাছের তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব দিয়েছেন সেই শিশুকে। ফলে সে মসজিদে আসবে আবার কুরআন শিখবে পাশাপাশি হবে নিয়মিত নামাজি। তার থেকে খারাপ বা বদ স্বভাব দূর হয়ে যাবে।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সম্প্রতি একাধারে ৪০ দিন নামাজের জামাআতে অংশগ্রহণকারী শিশু কিশোরদের জন্য নতুন সাইকেল উপহার দেয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। কারণ, যে বা যারা নিয়মিত ৪০ দিন মসজিদে নামাজের জামাআতে অংশগ্রহণ করবে তাদের মাঝে নামাজের একটা অভ্যাস তৈরি হয়ে যাবে। অন্যায় ও অপরাধমুক্ত মনও তৈরি হয়ে যাবে। শিশুদের বাইক প্রদানের আনুষ্ঠানিক ভিডিও ইউটিউবে দেয়া হয়েছে। নিচের লিঙ্ক থেকে ইচ্ছে করলে দেখে নিতে পারেন-
Mosque Gifts Kids Free Bikes For Praying Fajr
Mosque Gifts Kids Free Bikes For Praying Fajr
জানা গেছে, সম্প্রতি আমাদের দেশের নোয়াখালী অঞ্চলের একাধিক মসজিদেও এভাবে সাইকেল উপহার প্রদান করে শিশু কিশোরদের মসজিদমুখী করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে, যা সত্যিই শিক্ষনীয়।
দেশের প্রতিটি মসজিদে শিশু কিশোরদের অংশগ্রহণ বাড়লে, তাদের দ্বারা মসজিদ আবাদ হলে কমে যাবে অপরাধ প্রবণতা। কুরআনের আলোয় আলোকিত হবে ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ ও দেশ।
সে কারণে মসজিদে শিশুদের নিয়ে আসা অভিভাবক ও বড়দের নৈতিক এবং ঈমানি দায়িত্ব। সে আলোকে মসজিদ চত্বরে শিশুদের জন্য বিনোদনমূলক পার্ক বা খোলা জায়গাসহ খেলার সামগ্রীর ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। যা শিশুদের নৈতিক, মানসিক ও আত্মিক শিক্ষার পাশাপাশি সত্য ও সুন্দরের দিকে পারিচালিত করবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, আজকের এই শিশুরাই আগামী দিনের মসজিদের নামাজের জামাআতে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে কাতারবন্দি হয়ে নামাজ আদায় করবে। সুন্দর, শান্তি ও নিরাপত্তার সুবাতাবাস বইবে সমাজ ও রাষ্ট্রে। আর তাদের পরকালও হবে সুন্দর। সুতরাং তাদের জামাআতের সাথে নামাজ আদায়ের সঠিক প্রাকটিচ এর লক্ষ্যে মসজিদমুখী করার উপযুক্ত সময় এখনই। আর সে দায়িত্বটি আপনার আমার এবং অবশ্যই আমাদের সকলের। তুরষ্কের মসজিদগুলোতে বাচ্চাদের মসজিদমুখী করার জন্য ভিন্ন ধরনের ব্যতিক্রমী ফেস্টুন এবং ব্যানার অনেকেরই নজর কাড়ে। সেখানে কোনো কোনো মসজিদে লেখা রয়েছে - নামাজের জামাআত চলাকালীন পেছনে যদি বাচ্চাদের কিচিরমিচির আওয়াজ শুনতে না পান তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের নামাজী হিসেবে গড়ে ওঠার ব্যাপারে ভয়ের মধ্যে থাকুন। সত্যিই আশ্চর্য্য সুন্দর কথা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা আমাদের অন্তরে অসাধারণ এই অনুভব অনুভূতি লালন করার তাওফিক দান করুন। আমাদের শিশু কিশোর সন্তান সন্তুতিদের সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার অভিপ্রায়ে তাদের সাথে মহান মালিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লার সাথে আত্মিক সম্পর্কের সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে তাদেরকে মসজিদমুখী করার তাওফিক তিনি আমাদের সকলকে দান করুন।
গুলশান আজাদ মসজিদ, ঢাকা, বাংলাদেশ, Gulshan Azad Mosque, Dhaka, Bangladesh ছবি: অন্তর্জাল।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৪:২১