সাহাবীগন মক্কা এবং মদিনাকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন প্রিয় বাইতুল্লাহর সান্নিধ্য, প্রিয় নবীজীর সাহচর্য্য। প্রিয় নবীজীর সোহবত সাহচর্য্য তাদের দুনিয়া বিমুখ করে রাখতো। তাদের জীবনের চেয়েও অধিক ভালোবাসা ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি। কোনো সাহাবীকে যখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাষ্ট্রীয় কোনো দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে মদিনার বাইরে দূরে কোথাও পাঠাতেন, তাদের চোখ ছলছল করে উঠতো। হৃদয় চৌঁচির হতো। ডুকরে কেঁদে উঠতেন তারা। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য্য যে কতটাই প্রিয় ছিল তাদের নিকট তার প্রমান পাওয়া যায়, বিভিন্ন সাহাবীর বাস্তব ঘটনা থেকে।
মুয়াজ বিন জাবাল রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুকে গভর্নরের দায়িত্ব দিয়ে ইয়েমেন পাঠানোর নির্দেশ দেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। প্রিয় নবীজীর এ নির্দেশ অবগত হয়ে মুয়াজ ব্যথিত হলেন। আহত বোধ করলেন। ছটফট করতে লাগলেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরও হৃদয়ে রক্তক্ষরন, প্রিয় সহচরকে নিজের কোল থেকে দূরে সরিয়ে দিতে হচ্ছে। তিনিও কষ্টে নীল হতেন কোনো সাহাবীকে দূরে কোনো সফরে পাঠানোর প্রাক্কালে। মুয়াজ বিন জাবাল রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুকে লক্ষ্য করে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
'আছাল্লাহু আল্লা- ইউরাকানী বা'দা হাজা-।'
'মুয়াজ, এরপরে তোমার সাথে আমার বোধ হয় আর দেখা হবে না।'
একথা শুনে মুয়াজ বিন জাবাল রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তিনি বুঝে ফেললেন আল্লাহর রাসূলের অন্তিম সময় সমাগত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরও অশ্রুসিক্ত নয়ন প্রিয় সহচরের বিদায় লগ্নে। অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল তাঁর কপোল বেয়ে। মুক্তোর মালার মত। ঝড়ে পড়া অশ্রু তাঁর চিবুক ছুঁয়ে গেল। বললেন-
'মুয়াজ, তুমি যখন ফিরে আসবে তখন হয়তো আমাকে দেখবে না। কিন্তু আমার কবর তো দেখবে।'
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চোখে অশ্রু দেখে মুয়াজ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর কান্নার মাত্রা আরও বেড়ে গেল। প্রিয় সাহাবীকে আরও জোরে কাঁদতে দেখে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পবিত্র চেহারা মদিনার দিকে ফিরিয়ে নিলেন। কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়া মুক্তোর দানার মতো টলটলে অশ্রু মুছে নিলেন। বললেন-
'হে মুয়াজ, দু:খ করো না, ব্যথিত হয়ো না- ইন্না আউলান্নাসি বিআল মুত্তাকূন, মান কা-নূ হাইসু কা-নূ।'
'কিয়ামতের দিন আমার সবচে' কাছে সে হবে যে দ্বীনের জন্য দূরে গিয়ে সেখানেই মারা যায়। আর সেখানেই তার কবর হয়ে যায়।'
নিজ হাতে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবীকে বিদায় দিচ্ছেন। সরিয়ে দিচ্ছেন দূরে। নিজ ভালোবাসা থেকে। প্রেম থেকে। আপন স্নেহের বাঁধন থেকে। কেন? কিসের জন্য? কী প্রাপ্তির আশায়?
শুধুমাত্র আল্লাহর দ্বীনের জন্য। দ্বীনের দাওয়াত যাতে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর কাঁচা পাকা প্রতিটি ঘরের কোন পর্যন্ত। প্রতিটি মানুষ যাতে লাভ করতে সক্ষম হন সৃষ্টিকর্তা মহান প্রতিপালকের আসল পরিচয়। তাঁর পানে আত্মসমর্পন করে স্বার্থক করে তুলতে পারেন মানব জীবন। বাস্তবায়ন করতে পারেন সৃষ্টির উদ্দেশ্য। সম্পর্ক গড়ে নিতে পারেন আসল মালিকের সাথে।
হুজূরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীগন ছিলেন 'রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুম'। 'রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুম' মানে, 'আল্লাহ পাক তাদের প্রতি সন্তুষ্ট'। তাদের মক্কা ছাড়ার প্রয়োজন ছিল না। মাদিনা ত্যাগেরও দরকার ছিল না। কারন, আল্লাহ পাক স্বয়ং তাদের প্রতি রাজি খুশির ঘোষনা দিয়েছেন। বদরের যুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছেন তারা তো আরও বেশি মর্যাদাবান। হুজূরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
'লাআল্লাল্লাহু ইখতারা আলা আহলি বাদরিন। ফাক্কা-লা লাহুম, ই'মালূ- মা- শি'তুম, ফাইন্নি- ক্কদ গাফারতু লাকুম।'
'হে বদরের সাথীরা, আল্লাহ তাআ'লা তোমাদের সুসংবাদ জানিয়েছেন, তোমরা যেমন খুশি, যেমন ইচ্ছে আমল করো, আমি তোমাদের আগের ও পরের সব অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছি।'
এই বদর উহুদের মহান বীর যোদ্ধাগন আল্লাহর দ্বীনের পয়গাম নিয়ে মানুষের ঘরে ঘরে দ্বারে দ্বারে ছুটে বেড়িয়েছেন। কিন্তু এইসব জলিলুল কদর সাহাবীদেরতো মানুষের দ্বারে দ্বারে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না।
আবূ তালহা আনসারী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুকে দাফন করা হয়েছে বোখারা, রোম এর কোনো বিজন বনে। কেউ জানেও না ঠিক কোথায় তাঁর কবর।
মদিনায় হিজরতের পরে প্রথমেই যার ঘরে মেহমান হয়েছিলেন রহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই মহান আনসার সাহাবী মদিনার কৃতি সন্তান আবূ আইউব আনসারী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওজার পাশে, জান্নাতুল বাকির স্নিগ্ধ ছায়ায় শেষ আশ্রয়ের আশা পোষন করতে পারতেন। কিন্তু কোথায় গেলেন তিনি? কোথায় হারিয়ে গেলেন প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রিয় এই সাহাবী? প্রিয় নবীজীর শহর মদিনাকে দূরে ফেলে রেখে দ্বীনের দাওয়াতের উদ্দেশ্যে, ইকামাতে দ্বীনের তাগিদে ছুটে গেলেন সুদূর তুরষ্কে। আজও ঘুমিয়ে আছেন তুরষ্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলের কোনো এক নিভৃত প্রান্তরে।
নুমান বিন মুকাররম রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর আহত দেহ ছটফট করতে করতে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছে নেহাওয়ান্দের ময়দানে। হিশাম বিন আস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বদরী সাহাবী। তাঁর দেহ টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে আজরাদিন এর ময়দানে।
মায়াম্মার বিন মাহদী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু। তিনি ছিলেন ইয়েমেনের সর্দার। তাঁর কবর নেহাওয়ান্দের প্রান্তরে।
এমনিকরে উক্কবা বিন নাফে' রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু আলজেরিয়ার বিসকেরাতে। আবূ লুবাবা এবং আবূ জুম্মা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুমা তিউনিসিয়াতে। মা'বাদ বিন আব্বাস ও আবূ দুর বিন আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুমা। সোমালিয়ায় তাদের কবর। কাসিম বিন আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু শুয়ে আছেন রাশিয়ার সমরখন্দে। হুযাইফা বিন মুসলিম রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর কবর ফারগানাতে। মুয়াজ বিন জাবাল রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু। উলামাদের পতাকা থাকবে যার হাতে; মদিনার আলোকদীপ্ত ইলমের মজলিশ ছেড়ে চলে গেলেন বহু দূরে। ইয়ারমুকের মরুভূমিতে শুয়ে আছেন তিনি। উবাইদুল্লাহ বিন জারারাহ, আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা, জায়িদ বিন হারিসা, জা'ফর বিন আবি তালিব রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুমসহ কমপক্ষে পচিশ হাজার সাহাবী এবং তাবেয়ীর কবর রয়েছে উরদুনের মুতায়। মুতার প্রান্তরে অনন্ত নিদ্রায় শুয়ে আছেন তারা।
এভাবেই। পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন দ্বীনের মহান মুবাল্লিগ সাহাবীগন।
সত্তুর জন সাহাবি কুফায়।
সত্তুর জন সাহাবি লিবিয়ায়।
পাঁচশো সাহাবা মিশরে।
উক্কবা বিন আমের ও ফজল বিন আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুমা সিরিয়ায়।
আল্লাহু আকবার! সাহাবীদের কেমন ছিল ঈমানের জজবা! কেমন ছিল তাদের ঈমানী শক্তি! এক একজন সাহাবি দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে চলেছেন। না খোঁজ আছে স্ত্রীর, না ঠিকানা আছে সন্তানের। না গোছাতে পেরেছেন ঘর - সংসার! না অর্জন করতে পেরেছেন পার্থিব বিত্ত বৈভব! কেন তারা এমন ছুটে চলেছেন পৃথিবীর পথে পথে? কেন দুনিয়ার অলিতে গলিতে, মাঠে ময়দানে পড়ে আছে তাদের কবর? আল্লাহর ঘর বাইতুল্লাহর পাশে, জান্নাতুল বাকীতে, মদিনা মুনাওওয়ারায় তাদের কবর হলো না কেন? আল্লাহর ঘর, রাসূলে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা মোবারক ছেড়ে কোথায় কোথায় পড়ে থাকলেন তারা? কেন? হাজার হাজার সাহাবির কবর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দুনিয়ার আনাচে কানাচে। কেন তারা ঘর বাড়ি ছেড়ে, নিজেদের আবাসভূমি ছেড়ে বেছে নিয়েছিলেন অজ্ঞাত গন্তব্যের এই অচেনা অজানা পথ? চাকরি? ব্যবসা বানিজ্য? ধন দৌলত অর্জন? কিসের টানে তারা ছুটে বেড়িয়েছেন জনপদ থেকে জনপদে? দেশ হতে দেশান্তরে? লোকালয় থেকে লোকালয়ে? স্রেফ তাওহিদের দাওয়াতকে প্রত্যেকের কানে কানে পৌঁছে দেয়ার উদগ্র বাসনা তাদের অস্থির আকুল করে তুলেছে। দুনিয়াজুড়ে অহদানিয়্যাতের আওয়াজকে বুলন্দ করার দুর্দমনীয় বাসনা তাদের ঘরছাড়া করেছে। সন্তান সংসার ছাড়া করেছে। ব্যবসা বানিজ্যের লোভ লালসা পরিত্যাগ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রিক্ত হস্তে মুসাফিরের বেশ ধারন করতে বাধ্য করেছে।
সাহাবীদের জন্য নিজেদের ঘর বাড়ি সংসার সম্পদ সকল কিছু ছেড়ে যাওয়া কষ্টের ছিল না। তাদের নিকট কষ্টের ছিল, বেদনার ছিল, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র সান্নিধ্য ত্যাগ করা। সেই কষ্টও তারা সহ্য করেছেন। করেছেন শুধুমাত্র দ্বীন ইসলামের প্রচারের স্বার্থে।
আজকের দিনে আমাদের সামনে দ্বীনের জন্য যখন কোনো আহবান আসে, দ্বীন ইসলামের আওয়াজ বুলন্দের জন্য ডাক আসে, যখন তাবলীগে দ্বীনের জন্য সফরের তাকাজা আসে, এক চিল্লা তিন চিল্লার কথা আসে তখন আমরা অযুহাত দাড় করাই, ঠুনকো আপত্তি তুলি, আমাদের সংসার বাচ্চা কাচ্চা আছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের ফেলে কোথায় চলে গেছেন সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুম আজমাঈন? তাদের স্ত্রী বাচ্চাদের চেয়ে কি আমাদের সন্তান সন্তুতি স্ত্রীগনের মূল্য অধিক? তাদের সংসারের চেয়ে কি আমাদের সংসারের গুরুত্ব বেশি? তাদের পরিবার পরিজনের চেয়ে আমাদের পরিবার পরিজনের দাম অধিক? হায় হায়! একটিবারের জন্য আমরা কি ভেবে দেখেছি, তারা তাদের স্ত্রী সন্তানদের বিচ্ছেদ আর বিরহ যাতনা যদি সহ্য না করতেন, আমরা কালিমার এই পবিত্র বানী মুখে তুলতে পারতাম আজ? তাওহীদের এই অমীয় বানী কি আমাদের মুখে শোভা পেত আজ? ঈমানের এই আলোকিত পথের দিশা কিভাবে পেতাম আমরা? তাগূতের কোন্ অন্ধকারে পড়ে থাকতে হত আমাদের তারও কি কোনো ঠিকানা জানা আছে?
হজরত আবুল বাকা আনসারী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর শেষ আবাস হয়েছে তিউনিসে। হজরত রুয়াইফা আনসারী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু লিবিয়ায়। হজরত আবদুর রহমান রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু এর কবর উত্তর আফ্রিকায়। হজরত মাবাদ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু শুয়ে আছেন উত্তর আফ্রিকার মাটিতে।
হজরত আবু রাফে রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু খোরাসানে। হজরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা রাহ.-এর কবর খোরাসানে। হজরত আবু আইউব আনসারী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু ঘুমিয়ে আছেন তুরষ্কের ইস্তাম্বুলে। হজরত আবু তালহা আনসারী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু -এর কবর বোহায়রা রোমে। হজরত ফযল ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু -এর কবর সিরিয়ায়।
হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু -এর কবর হয়েছে হিমসে। হজরত বিলাল হাবশী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু -এর শেষ আবাস দামেশকে। হজরত আবুদ্দারদা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু -এর মাকবারাহ জর্ডানে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু অন্তিম সয্যা গ্রহন করেছেন জর্ডান নদীর পাশে।
হজরত মুআয ইবনে জাবাল রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু, হজরত যিরার ইবনুল আযওয়ার রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু এবং হজরত উবাদা ইবনুছ ছামেত রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু এই তিনজনের শেষ বিশ্রামাগার হয়েছে জর্ডানের নিভৃত এক পাহাড়। হজরত আবু যামআহ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু -এর কবর তিউনিসে। হজরত কুছাম ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু -এর কবর বুখারা সমরকন্দে। হজরত আমর ইবনে মাদিকরিব রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু -এর কবর পাওয়া গেছে নেহাওয়ান্দে।
হিজরি ৫০ সালে হজরত মুহাম্মদ ইবনে আবি সগরা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু কাবুলের রাস্তা হয়ে পেশাওয়ার এবং পেশাওয়ার থেকে লাহোর হয়ে কেলাত পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। কেলাতের পাহাড়ে কম করে হলেও সাতজন সাহাবি এবং তাবেয়ির কবর রয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
প্রসঙ্গত আলোচনার দাবি রাখে যে, সাহাবিদের পরস্পরের মধ্যে মর্যাদা হিসেবে স্তরভেদ থাকতে পারে, কিন্তু পরবর্তী যুগের কোন মুসলমানই, তা তিনি যত বড় জ্ঞানী, গুণী ও সাধক হোন না কেন কেউই একজন সাধারণ সাহাবির মর্যাদাও লাভ করতে পারেন না। এ ব্যাপারে কুরআন, সুন্নাহ্ এবং ইজমার ঐক্যমত্য রয়েছে।
সাহাবিগনই আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর উম্মাতের মধ্যে প্রথম মধ্যসূত্র। পরবর্তী উম্মাত আল্লাহর কালাম পবিত্র কুরআন, কুরআনের ব্যাখ্যা, আল্লাহর রাসূলের পরিচয়, তাঁর শিক্ষা, আদর্শ, মোটকথা দ্বীনের সবকিছুই একমাত্র তাঁদেরই সূত্রে, তাঁদেরই মাধ্যমে জানতে পেরেছে। সুতরাং এই প্রথম সূত্র উপেক্ষা করলে, বাদ দিলে অথবা তাঁদের প্রতি অবিশ্বাস সৃষ্টি হলে দ্বীনের মূল ভিত্তিই ধসে পড়ে। কুরআন ও হাদীসের প্রতি অবিশ্বাস দানা বেঁধে ওঠে।
‘হাফেজ ইবন আবদিল বার’ সাহাবিদের মর্যাদা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন: রাসূলুল্লাহর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সুহবত, তাঁর সুন্নাতের হিফাজত ও ইশায়াতের দুর্লভ মর্যাদা আল্লাহ তা’আলা এইসব মহান ব্যক্তির ভাগ্যে লিখে রেখেছিলেন। এ কারণেই তাঁরা ‘খায়রুল কুরুন’ ও 'খায়রু উম্মাতিন’ এর মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন।
হাফেজ আবু বকর ইবন খতীব আল-বাগদাদী বলেন: ‘‘উল্লেখিত ভাব ও বিষয়ের হাদীস ও আখবারের সংখ্যা অনেক এবং সবই ‘নাসসুল কুরআনের’ ভাবের সাথে সংগতিপূর্ণ। অর্থাৎ তাতে সাহাবিদের সুমহান মর্যাদা, আদালাত, পবিত্রতা ইত্যাদি ভাব ব্যক্ত হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা ও রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক তাদের আদালাতের ঘোষণাদানের পর পৃথিবীর আর কোনো মানুষের সনদের মুখোপেক্ষী তাঁরা নন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা ও রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের সম্পর্কে কোনো ঘোষণা না দিলেও তাঁদের হিজরাত, জিহাদ, সাহায্য, আল্লাহর রাহে ধন-সম্পদ ব্যয়, দ্বীনের ব্যাপারে উপদেশ, ঈমান ও ইয়াকীনের দৃঢ়তা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড একথা প্রমাণ করে যে, আদালাত (ন্যায়পরায়নতা), বিশ্বাস, পবিত্রতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে যত ন্যায়পরায়ণ ও পবিত্র ব্যক্তিই জন্মগ্রহণ করুন না কেন, তাঁরা ছিলেন সকলের থেকে উত্তম।’’
কোন কোন সাহাবির জীবদ্দশায় রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। তবে মুসলিম পণ্ডিতদের অনেকে সাহাবিদের সকলেই জান্নাতি বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ইবনে হাজার ‘আল–ইসাবা’ গ্রন্থে স্পেনের ইমাম ইবন হাযামের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেনঃ
‘আস-সাহাবাতু কুল্লুহুম মিন আহলিল জান্নাতী কাতআন।'
'সাহাবিদের সকলেই নিশ্চিতভাবে জান্নাতী।’
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবিদের গালি দেওয়া বা হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে সমালোচনা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন:
‘আল্লাহ, আল্লাহ! আমার পরে তোমরা তাদেরকে সমালোচনার লক্ষ্যে পরিণত করো না। তাদেরকে যারা ভালোবাসে, আমার মুহাব্বতের খাতিরেই তারা ভালোবাসে, আর যারা তাদেরকে হিংসা করে, আমার প্রতি হিংসার কারণেই তারা তা করে।’
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আমাদের সাহাবীদের জীবনাচার অনুসরন করে পৃথিবীতে আলোকিত জীবন গড়ার তাওফিক দান করুন। পরকালেও তাদের সাথী করুন।
নিবন্ধটি প্রনয়নে কৃতজ্ঞতা: আররাহীকুল মাখতুম, আল্লামা সফিউররহমান মোবারকপুরী, কে সে জন, ডা. তারিক জামিল, সিরাতে ইবনে হিশাম, ইসলামের ইতিহাস, অাল বিদায়া ওয়াননিহায়া এবং অন্যান্য সিরাত গ্রন্থ।