।। নাসীমুল বারী ।।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা
-হায় হায় আমাদের লেটোদল হেরে যাচ্ছে?
লেটোগান শুনতে আসা একদল চুরুলিয়ান শ্রোতা বলছে। পাশ থেকে আরেক দল বলে, যা ডিম পাড়তে যা তোরা।
চুরুলিয়া গ্রামে জমজমাট লেটোগানের আসর বসেছে। আজ এখানে ভিন গায়ের এক নামকরা দল এসেছে। মঞ্চটিও সাজানো হয়েছে রকমারি বাতি দিয়ে। এই দলের ভাবই আলাদা। তাদের কাছে হেরে যাচ্ছে চুরুলিয়ার দলটি, এটাই যেন প্রাপ্য।
হঠাৎ মঞ্চে উঠে আসে চুরুলিয়ান এক কিশোর। ঝাঁকরা চুল, চেহারায়ও দারুণ। মঞ্চে উঠে নাচের তালে তালে গাইতে লাগল। আরে, আরে, এ কী! এ গান কোথাকার? এ গান তো কেউ শুনেনি আগে? বাহ্ দারুণ গান তো! গানের সাথে সাথে কী মিষ্টি গলাও! অভিনয়ও মনে ধরার মতো।
শ্রোতারা সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছে। হারতে থাকা চুরুলিয়ার দলে জেগে ওঠে খুশির জোয়ার। গাইতে গাইতেই কিশোরটি করে বসলো এক জবর প্রশ্ন। ভিনদলের গাইয়েরা পড়লো মহা মুশকিলে। জবাব দেবার গানই খুঁজে পাচ্ছে না। নতুন গানে এমন প্রশ্নের জবাবই বা পাবে কোত্থেকে?
ব্যাস! গেল হেরে গেল ভিন গায়ের দলটি।
আজকের বিজয়ী এ দলটি গড়েছিল চুরুলিয়া গ্রামেরই কিছু বালক। দলে সর্দার মানে ‘গোদাকবি’ হিসেবে নিয়েছে এ সময়ের আরেক নামকরা কবি শেখ চকোরকে। কিন্তু আজ হারতে বসায় ভীষণ দুঃচিন্তায় ছিলেন তিনি। তাকে উদ্ধার করল এই কিশোর কবি। পালা শেষে মঞ্চে উঠে বালক-কবিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ওরে আমার ব্যাঙাচি, বড় হয়ে তুই একদিন নিশ্চয়ই সাপ হবি!
তারপর নিয়ে আসেন নিজ দলের তাবুতে। শেখ চকোর আপাদমস্তক একটু নিরিক্ষণ করে বলেন, নাচতে গাইতে সবই তো পারিস? আমার দলে থাকবি?
-জ্বি।
-আর কোন কোন গান পারিস?
-অন্যের কোন গান পারি না। আমি নিজেই গান বানাই। যা বলবেন, তা-ই বানাব।
চোখ দুটো বড় করে ভীষণ চমকে বলেন- তুই গান বানাস? এতক্ষণ শুনলাম তোর গান বুঝি?
-জ্বি।
-শোনা তো দেখি আরেকখান।
কিশোর এই কবি এবার নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে একটু ভাবুলতায় পড়ে। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে গেয়ে ওঠে তারই বানানো মনচোরা গানটি-
“তুমি যে আমার মনচোরা, চুরি করেছ মন।
কথায় কথায় রাগ কর তুমি, রাগ কর অকারণ॥
এসো এসো প্রিয়তম।
তুমি মোর প্রাণসম,
তোমাতে সঁপেছি এ প্রাণ, সেবিব তোমা অনুক্ষণ॥”
বিজয়ীর মতো চিৎকার দিয়ে বলে, বাহ্ তুই বানিয়েছিস্?
-জ্বি।
-মিথ্যা বলবি না।
-আরো শুনবেন?
কথাটা বলেই তারই আরেকটি লেটোগান চাষার সঙ শোনায়-
“চাষ করো দেহ জমিতে।
হবে নানা ফসল এতে।।
নামাজে জমি ‘উগালে’
রোজাতে জমি ‘সামলে’
কলেমায় জমিতে মই দিলে
চিন্তা কি হে এই ভবেতে।”
এবার শেখ চকোর কাছে টেনে পিঠ চাপিয়ে বলেন, তাইলে তুই গানও বানাস? কী নামরে তো?
-নজরুল ইসলাম।
-তুই কি কোনো দলে সাথে আসিছ?
-ছিলাম, এখন নাই।
-কোন দলে?
-কাজী বজলে করিমের দলে।
-ওই ওস্তাদের দলে? আচ্ছা সমস্যা নেই। আমি ওস্তাদের সাথে কথা বলব।
পরদিন শেষ চকোর যায় বজলে করিমের কাছে। নজরুলকে তার দলে রাখার ব্যাপারে কথা বলে। তিনি খুশি হয়ে বলেন- আমার ভাতিজা। বড়ই অভাবের সংসার বলে আমি নিয়ে এসেছিলামরে। এখন আমিও অসুস্থ। আচ্ছা তুই ওকে কিছু কাজ দিস্। সংসারটা চলুক।
-ওস্তাদ যন্ত্রপাতি বাজাইতে পারবে?
-সবই পারবে। সুরও তুলতে পারবে। আমি অনেক কিছু শিখিয়েছি। আর গান, ওটা কোনো ব্যাপরই না ওর জন্যে। যখন-তখন বানিয়ে দেবে নতুন নতুন গান।
কাজী বজলে করিমের অনুমতি পেয়ে খুশি শেখ চকোর। সে থেকেই কিশোর নজরুল শেখ চকোরের দলের একজন লেটো কবি, গাইয়েন। মুখে মুখে গান রচনা আর প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নজরুলের নামডাক পড়ে যায়।
আজ নতুন একটা গানে সুর তুলছে শেখ চকোর। হঠাৎ ডাকে- এই ব্যাঙাচি, ব্যাঙাচি …।
কিন্তু না। তার সাড়া নেই।
তিনি স্নেহ করে কিশোর নজরুলকে এখনো ব্যাঙাচি নামেই ডাকেন। তবে দলের সবাই মনের ভালোবাসায় ডাকে ‘ভোমর কবি’।
শেখ চকোরের ডাকে আসে এ দলেরই কিশোর অভিনেতা ইন্দ্রজিৎ। দলে লোটোরানি নামেই পরিচিত। পুরুষরাই এখানে নারী সেজে নারী চরিত্রে অভিনয় করে। ইন্দ্রজিৎও তাই। এখন তাকে দেখে শেখ চকোর জিজ্ঞেস করেন, এই ব্যাঙাচি কইরে?
ইন্দ্রজিৎ বলে, ওস্তাদ দেখি না তো ভোমর কবিরে আমাগ তাবুতে।
লেটোগানে সুর তুলতে তুলতে শেখ চকোর আবার বলেন, দেখ কই আছে, খুঁজে আন। আমি সুরটায় আটকে গেছিরে।
দলে নজরুল অভিনয় করলেও নারী চরিত্রে অভিনয় করে না। রাজা কিংবা সৈনিক চরিত্রে করে। এখন ইন্দ্রজিৎ খুঁজতে বের হয় ভোমর কবিকে। ওই তো অদূরে পুকুর পাড়ে আমগাছের নিচে বসে কী যেন করছে। কাছে যায়। নজরুল এক ধ্যানে একটা গান মুখে মুখে রচনা করছে আর সুর করে গাইছে। পাশে গিয়ে বসে। শান্তকণ্ঠে বলে- ওস্তাদ তোমারে ডাকছে।
কোনো কথা না বলে নজরুল উঠে আসে।
নজরুলকে দেখে শেখ চকোর কৌতুক করে বলেন, কী রে রানি রাজারে খুঁজে আনলি?
সাথে সাথে নজরুলও হেসে পালটা জবাব দেয়, রাজা ছাড়া রাণির কী মূল্য?
হেসে দেয় সবাই। হাসতে হাসতেই শেখ চকোর বলেন, ব্যাঙাচি কী করছিলি রে?
-একটা গান তুলছিলাম।
-আচ্ছা রাখ, তোরটা পরে শুনব। আমারটা দেখ তো। এখানে আটকে গেছি।
নজরুল শুনে। তারপর সহজেই তুলে দেয় সেই গানের সুরটা। সুর যেন হাতের মোয়া। ধরলো আর বানালো।
. . .
চঞ্চল নজরুল…!
কোন বাঁধনে আটকে থাকতে পারে না তাই। এক জায়গায় মন টিকে না। শেখ চকোরের দলেও আর নজরুলের মন টিকছে না। একদিন তাই শেখ চকোরের কাছে এসে বলে, আমি আর লেটো গান করব না। আমি চললাম।
ব্যাস!
#