।। নাসীমুল বারী ।।
-ছুনছস মানিক, আমরা বি আর কথা কইবার পারুম না। পড়ালেহাও বি আর করন যাইব না।
-ক্যালা? কী অইছেরে?
মানিক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে জাফরকে।
জাফর আর মানিক দুই বন্ধু। স্কুলেও একই ক্লাসে পড়ে। ওদের দু'জনের বাসাও পাশাপাশি মহল্লায়। তবে খেলাধুলা করে একই জায়গায়- সরদারের জল্লাপাড়ে। ঢাকাবাসীরা মহল্লার ছোট ছোট মাঠকে জল্লাপাড় বলে। ঘুড্ডি উড়ানো, বিরিং খেলা, ডাংগুলি খেলা- কোন খেলাতেই ওরা পিছিয়ে নেই। কুস্তিও পারে মোটামুটি। ইব্রাহীম সরদার প্রায় বিকেলেই কুস্তির তালিম দেয়। তবে ওদের কুস্তি খেলায় তত আগ্রহ নেই। সুযোগ পেলেই শহরময় ঘুরে বেড়ায়। চঞ্চল প্রকৃতির এ বন্ধুদ্বয়ের মনের মিলও বেশ গভীর।
জাফরের আব্বা করিম মিয়া সেদিন বলেছিল- আর পড়ালেহার দরকার নাইকা। চিঠি লেখবার পারো, হিসাব করবার পারো, আর দরকার নাইকা? এবার একটা কারবারে লাইগ্যা যাও।
কিন্তু জাফরের মনে সায় দেয় নি একথা। ও পড়ালেখা করবে। বি.এ. এম.এ. পাস করবে। উকিল-মোক্তার হবে। না হয় বড় কোন চাকরি করবে। তাই ও পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চায়। চায় ওর প্রিয় বন্ধু মানিকও যেন পড়াশুনা করে।
পাড়ার তাহের চাচাও বলেছে একই কথা। বাংলায় কথা বলা যাবে না। পড়ালেখা করা যাবে না। উর্দুতেই সবকিছু করতে হবে। উর্দু তো ভিনদেশী ভাষা। ওটা শিখে কি আর পড়ালেখা হবে?
এসব কথা শুনেই মাথায় ভীষণ চিন্তা ঢোকে জাফরের। প্রিয় বন্ধু মানিককে জানায় এ খবরটা। মানিক ঠিক বুঝতে পারে নি ব্যাপারটা। তাই আবারও একরাশ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে- আবে কী অইছেরে? ক্যালা পারুম না কথা কইতে? পড়ালেহা করতে?
-পা-রুম-নারে, পারুম না। এহন বি উর্দুতেই ছব কতা কইতে অইব।
-উ-র্দু---! আমরা বাঙালিরা উর্দু কইতে যামু ক্যারে ?
-হ, তাহের চাচায় তো কইলো এহন থেইকা ইছকুলের পড়ালেহাও বি উর্দুতে অইব। আব্বায় বি কইছে আগের দিনে ইংরাজরা ছবাইরে ইংরাজি ছিখাইত জোর কইরা। ভিনদেছী ভাছা ইংরাজি, না ছিখলে পড়ালেহা করন যায় না। এই জইন্য আব্বারা পড়ালেহা করবার পারে নাইকা। অহন যদি আবার আরেক ভিনদেছী ভাছা উর্দুতে পড়ালেহা করবার লাগে- তয় আমরা পড়ালেহা করুম কেমনেরে? আব্বার লাহান আমাগও বি আর পড়লেহা অইব না।
-হ হ , আমার আব্বাও বি কইছে এমুন কথা।
এমন সময় একদল পুলিশকে এদিকে আসতে দেখা যায়। খাকি হাফপ্যান্ট-শার্ট পরা পুলিশ দেখে ওরা দু'জন ভয়ে দৌড় দেয় মহল্লার ভেতরের দিকে। দৌড়াতে দৌড়াতে সরদারের জল্লাপাড়ে গিয়ে হাজির হয়। ওখানে অনেকেই বিরিং খেলছে, ডাংগুলি আরো কত কি খেলছে? বেশির ভাগই ওদের সমবয়সী।
ওদের এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে ইকবাল জিজ্ঞেস করে- কী অইছেরে ? এমুন লৌড়াইতেছোছ ক্যালা?
-আবে কইছ না হালায় পুলিছ আইছিলো।
জাফরের এ কথায় সবার মাঝেই একটু ভয় ভয় ভাব দেখা দেয়। আজকাল পুলিশকেই সভার ভয়। হিন্দুস্তানি চর-দুশমন সন্দেহে যাকে-তাকেই ধরে নিয়ে যায়। তাই পুলিশকে কোথাও দেখা গেলে সবার মাঝেই একটা ভীতি ভাব দেখা দেয়।
ইকবাল ওদের সাথে আর কোন কথা না বলে ডাংগুলি খেলায় মেতে পড়ে। মানিক আর জাফর জল্লাপাড়ের দক্ষিণ কোণে গিয়ে দাঁড়ায়। ওখানে রতন, লিটন ঘুড্ডি উড়াচ্ছে। মানিক লিটনের কাছে গিয়ে বলে- লাটাইটা দিবি? রতনেরটারে ছাপ্পা মাইরা দেই।
পাড়ায় ঘুড়ি উড়ানোতে মানিকের খুব নাম-ডাক আছে। আজ ওরা ঘুড়ি উড়াতে আসে নি। এ পড়ন্ত দুপুরে ঘুড়ি না উড়িয়ে দুই দোস্ত মিলে রমনা রেইসকোর্সে যাবে। ঘোড়ার রেইস দেখবে। ওদের এ প্লানে বাঁধ সেধেছে পুলিশ। পাড়ায় পুলিশের আগমন দেখে ভয়ে পালিয়েছে। পাড়ায় পুলিশ এলো কেন? ভেবে পায় না ওরা।
লিটন দেয় ওর লাটাইটা।
মানিক হাতে নিয়ে একটু সুতা ছাড়ে আর টানে। ঘুড্ডিটাকে ধীরে ধীরে নিজের আয়ত্তে এনে এবার শুরু করে খেলা। প্যাঁচ খেলা। আশপাশের সবাই হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করে মানিককে। কেউ আবার রতনকেও। দেখতে দেখতে ঠিকই রতনের ঘুড্ডিটা কেটে গেছে। অমনি হাততালি পড়ে মানিকের পক্ষে।
আকাশে অনেক ঘুড্ডি উড়ছে। আচমকা একটি ঘুড্ডি গোত্তা খেয়ে মানিকের ঘুড্ডিতে প্যাঁচ ওঠায়। চোখদার বড়ো ঘুড্ডি।
-কার ঘুড্ডিরে?
মানিকের আশপাশের সবাই জিজ্ঞেস করে। জাফর এদিক ওদিক তাকায়। তারপর বলে- অন্য জল্লাপাড় থেইক্যা উড়াইতাছে।
মানিক সুতা ছাড়ছে। ওই ঘুড্ডিও সুতা ছাড়ছে। প্যাঁচ খেলায় এ এক কৌশল। না, এবার কৌশলে হেরে যায় মানিক। ওর ঘুড্ডিটা কেটে যায়।
এবারও হাততালি- তবে মানিকের পক্ষে নয়; রতনের পক্ষের ছেলেপেলেরা। মানিক লাটাইটা তাড়াতাড়ি লিটনের হাতে দিয়ে বলে- গোছ্ছা করিছ না দোছ। একটা বি কাটছি, আমারটাও বি কাটছে। ছমানে ছমান। আমাগ কাম আছে, যাইগা দোছ।
মানিক আর জাফর জল্লাপাড় থেকে আবার আসে বড় রাস্তায়। একটা ঘোড়ার গাড়িতে ক'জন বিহারী যাচ্ছে। তাদের দেখে জাফর বলে- হালা মাউড়ার পো। ওই হালাগো লাইগ্যা আমগো বি উর্দুতে কথা কইতে অইবো।
জাফরের এ কথায় মানিক বলে- দোছ, কথা কিছুই বি বুঝবার পারতাছি না। আমাগোরে উর্দু কথা কইতে অইবো ক্যালা?
-এহনও বুঝবার পারোছ নাইক্যা? তাহের চাচা কইছে কাইল পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে সব নেতা মিল্লা বাংলা বাদ দিয়া দিছে। পড়ালেহা, কথাবার্তা, অফিছের কামকাইজ ছবই অহন থেইক্যা উর্দুতে অইবো। দেহছনা আমাগো পাকিস্তানি নতুন টেকার নোটে বাংলা লেহা বি নাইক্যা।
-হ ঠিকই। দুই মাছ্ অইয়া গেল নতুন টেকা ছাড়ছে, কিন্তু বাংলা লেখা তো দেহি নাইক্যা।
চিন্তিত হয় মানিক জাফর দু'জনেই।
এমনি আনমনাভাবে হাঁটতে হাঁটতে নিমতলীর রেলক্রসিংয়ের কাছে আসে দু'জনে। একটা ট্রেন যাচ্ছে ঢাকা ছেড়ে। ট্রেন যাওয়ার পর ওরা রেললাইন পেরিয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে পড়ে। ইউনিভার্সিটির এপাশে ছোট ছোট লতা-গুল্মে ভরে আছে। হেঁটেই ঝোঁপ-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ফজলুল হক হলের পুকুর পাড়ে আসে। আরেকটু এগিয়ে কার্জন হল হয়ে রেইসকোর্সে যাবে। পায়ে চলা এ মেঠো পথ ধরে ওরা প্রায়ই যায় রেইসকোর্সে। ওদের মহল্লা থেকে রেইসকোর্সে যাওয়ার এটাই সহজ পথ।
পুকুর পাড়ে এসে ওরা একটু দাঁড়ায়। পশ্চিম দিকে তাকায়। রোদের তেজ এখনও কমে নি। এখনও অনেক ছাত্রের জটলা ওই বেলতলার স্টেজের সামনে। স্টেজে অবশ্য কেউ নেই।
আজ ছাত্ররা প্রতিবাদ সভা করেছে। মিছিল করেছে। গতকাল ৫ ডিসেম্বর করাচিতে শিক্ষা সম্মেলন হয়েছিল। এ সম্মেলনেই সিদ্ধান্ত হয় পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, বাংলা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাই আজ প্রতিবাদ সভা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায়। এ প্রতিবাদ সভা থেকে মিছিল বের হয়েছে। মিছিলটি প্রথমে যাবে শিক্ষামন্ত্রীর বাসভবনে। ওখানে প্রতিবাদ জানিয়ে যাবে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউসে। ওখানেও প্রতিবাদ জানাবে।
১৪ আগস্ট দেশ স্বাধীন হলো। জন্ম নিলো পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র্। আর গতকাল ডিসেম্বরের ৫ তারিখ। মাত্র সাড়ে তিন মাসের মতো বয়স রাষ্ট্রের; রাষ্ট্রের এ শিশু বয়সেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলো রাষ্ট্রের কর্ণধাররা? পাকিস্তানের এ পূর্ব অংশের লোকজন এতে মনে আঘাত পেলো। পুরো পাকিস্তানের লোকসংখ্যার বড়ো অংশই পাকিস্তানের এ পূর্ব অংশে বসবাস করে। নিজ বাবা-দাদার ভিটেবাড়িতে থেকেও নিজ মুখের ভাষা বাংলায় কথা বলতে পারবে না- এ কেমন কথা ? এটা তো মানা যায় না।
মানিক জাফরের পাশ ঘেঁষেই দু'জন ছাত্র খুব দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে আর বলছে- ইস্ মিছিলটা ধরতে পারলাম না।
ওদের কথায় জাফরের মনে কৌতূহল জাগে। সেও দৌড়ে ওদের একজনের কাছে গিয়ে বলে- বড়ভাই আইজও বি ভাছা লইয়া মিছিল অইছিল?
-হ?
-হাছাই অইছিল? কোন দিগে গেছে?
জাফরের এ কথায় ছাত্র দু'জন একটু থমকে দাঁড়ায়। ঢাকাইয়া এ দু'কিশোর এ সময় ইউনির্ভাসিটি চত্বরে কেন? কেন মিছিলের খোঁজ-খবর নিচ্ছে। মিছিলের গতিবিধির খোঁজ খবর নিচ্ছে। সন্দেহের দানা বেঁধে ওঠে ওই ছাত্র দু'জনের। সন্দেহ হবে না কেন? ঢাকাইয়া আদিবাসী এমনিতেই উর্দুর পক্ষে। ক'দিন আগেও ঢাকার সিদ্দিক বাজারে বাংলা ভাষার পক্ষে প্রচার কাজ করতে গিয়ে ঢাকাইয়াদের লেলিয়ে দেয়া গুণ্ডাদের হাতে সলিমুল্লা হলের জিএস সিদ্দিক উল্লাহ মার খেয়েছে। ধাওয়া খেয়ে অন্যরা মার থেকে বেঁচে গেছে। আবার আজ বুঝি মিছিলে হামলা চালাবে? ঢাকাইয়ারা সব নওয়াবদের চামচা। নওয়াবদের মতোই কেউ কেউ উর্দুতে কথা বলে। ওসব তো আসল উর্দু নয়, এক জগাখিচুরী মার্কা উর্দু।
মিছিল ও মিছিলের গতিবিধি নিয়ে জাফরের ঔৎসুক্য প্রশ্নে এ ছাত্র দুজনের মনে খটকা লাগে- তবে কি ঢাকাইয়া নেতারা চর হিসেবে এদের পাঠিয়েছে? তাই তো ওদের একজন জাফরের হাতটা ধরে বলে- তোরা আইসোছ কেন? কে পাঠাইছে? কোন সর্দার পাঠাইছে?
-না, কেউ না ?
জাফর ভয়মিশ্রিত কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জবাব দেয়। মানিকও সাথে সাথে কাঁপছে। কেঁদে দেবে আর কি! ছাত্রদ্বয় আবার ধমক দেয়- ঠিক কইরা ক। আইসছ্ কেন?
-আমরা রেইছকোছে যামু রেইছ দেহনের লাইগ্যা।
-দেখ মিথ্যা বলবি না। কে পাঠাইছে বল শিগ্গির। আমাগো খবর নিয়া কাগোরে দিবি?
এমন রুক্ষ্ম জেরার মুখে মানিক কেঁদে দেয়। জাফর না কাঁদলেও কাঁদো কাঁদো অবস্থা। কান্না কান্না ভাবেই জাফর বলে- হাছা কথা বি কইতাছি, আমরা রেইছকোছে যাইতে আইছি। জানেন আমি বি নাম লেকছি বাংলার লাইগ্যা অনেক দিন আগে।
-কোথায়?
-ঐ যে ছামছু বাই আমাগো মহল্লায় গেছিল, তহন হের লগে আমি আপনাগো ঐ হলের মিটিংয়েও আইছিলাম। দুই জন মন্ত্রীও বি আইছিলো।
-তোরা স্কুলে পড়োছ্?
-হ স্কুলে বি পড়ি। তবে জানেন ভাই আব্বায় না আর পড়াইবার চায় না। কইছে বাংলা যহন নাই- উর্দু শিইক্ষা পড়ন লাগবো না। ইংরাজরা ইংরাজি শিখনের নাম কইরা আমাগো পড়া বন্ধ করছে, অহন উর্দু শিখনের কথা কইয়া তোগো পড়া বন্ধ করতাছে। পরের ভাষা শিইক্ষা কিচ্ছু অইবো না। কারবারে লাইগ্যা যা।
একটু থামে জাফর।
আবার বলতে থাকে- অনেকদিন আগে আমাগো মহল্লায় কয়জনে গেছিল একটা কাগজে নাম লেকাইতে। বাংলা ভাছার লাইগ্যা নাম লেকাইতে। আমার বাবায় বি, তাহের চাচায় বি নিজে নাম লেইক্যা দিছে। আমিও বি লেকছি। কাঠকলম দিয়া লেকছি।
-সইত্য?
-আল্লার কিরা, হাছা কথা কইতাছি। মাতায় হাত দিয়া কইতাছি।
ছাত্র দু'জন এবার ভাবনায় পড়ে। ওরা তাহলে চর নয়; একই আন্দোলনের ক্ষুদে বিপ্লবী বীর। ভাষা বীর। সন্দেহের ভাবনাটা ঝেরে ফেলে। বড়ো আদর করে বলেন- ঠিক আছে যা। যখনই দরকার লাগবো আমাগ রুমে আইবি। আমরা ঐ হলের ১০১ নম্বর রুমে থাকি। আমার নাম মিজান। ওর নাম ফারুক।
জাফর-মানিক ছাড়া পেয়ে ইউনিভার্সিটির মেঠো পথ ধরেই রেইসকোর্সের দিকে যায়। যেতে যেতে মানিক জিজ্ঞেস করে- তুই কবে নাম লেকছোস্? আমারে কইলি না ক্যালা?
-তুই আছিলি নাতো। নারিন্দা গেছিলি। জানোছ হেইদিন ছরদার চাচায় বি নাম লেকছে। আমার বাবা, তোর বাবা, তাহের চাচার কাছে লইয়া গেছে নাম লেকনের লাইগ্যা।
কার্জন হল পেরিয়ে ঢাকা গেটের কাছে আসে ওরা। ঢাকা গেট পেরিয়ে ডাইনেই রেইসকোর্স মাঠ। এ ধারটা মাঠের দক্ষিণ পাশ। এখানে একটা মোঘলী মসজিদ আছে। মানিক ও জাফর দু'জনেই মসজিদের আঙ্গিনায় যায়। মানিক কুয়া থেকে বালতি ভরে পানি তুলে। কুয়ার পানি বেশ ঠাণ্ডা। দু'হাতে পানি নিয়ে মানিক মুখটা ধোয়। ধুতে ধুতে মানিক জাফরকে বলে- কী ঠাণ্ডারে পানি! বরফের লাহান লাগতাছে। আইজ ছিতও বি লাগতাছে বহুত। তুই মুখটা ধুইবি?
জাফর মাথা নেড়ে নিষেধ করে। মসজিদ আঙ্গিনা থেকে বেরিয়ে মাঠের ধারে দাঁড়ায় ওরা। আরো অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এখনই রেইস যাবে এখান দিয়ে। ঠক্ ঠক্ আওয়াজে ঘোড়ার বিদ্যুৎ বেগের সে দৌড়- ভয় ভয় লাগে ওদের। কোন কারণে ঘোড়-দৌড়ের মধ্যে পড়ে গেলে নির্ঘাৎ মরণ!
ক'মিনিটের মধ্যে চোখের পলকে চলে গেল ঘোড়াগুলো।
-কতগুলান ঘোরারে?
জাফর জিজ্ঞেস করে মানিককে।
মানিক বলে- এত্তো জোরে লৌড়াইছে, গনুম কেমনে?
আসলে ঠিক, দৌড় প্রতিযোগিতা থেকে ঘোড়ার সংখ্যা গুণে বের করা অন্তত ওদের মতো ছোট্ট কিশোরদের পক্ষে সম্ভব নয়।
আঠার শতকের মধ্য থেকেই ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতার প্রচলন চলে আসছে রমনার এ বিশাল মাঠে। ইংরেজদের চালু করা এ দৌড়কে ইংরেজিতে বলে ‘রেইস'। সে থেকেই রমনার এ মাঠের পরিচিতি হয়ে গেছে ‘রেইসকোর্স'।
পুরো মাঠের চারধার দিয়ে ছুটে চলে ঘোড়া। ঠক্ ঠক্ আওয়াজ তুলে ধুলি উড়িয়ে ঘোড়া দৌড়ের এ দৃশ্য বড়ই মনোমুগ্ধকর। চোখের সুখ, মনের উল্লাস দুই-ই চলে। নগর জীবনে ছুটির দিনের বড়ো বিনোদন এই রেইস।
প্রতি শনি ও রবিবার এ রেইস হয়। রেইসকে কেন্দ্র করে ঢাকায় গড়ে উঠেছে অনেক জিমখানা, ঘোড়া সরোয়ার আর প্রতিযোগী। জিমখানাগুলোই রেইস সংগঠন। জাফরদের মহল্লায়ও আছে জিমখানা। আছে ঘৌড়প্রতিযোগী।
রেইসের ঘোড়ার পায়ের ক্ষুরায় পেরেক ঠুকে ক্ষুরাকৃতির লোহা লাগানো হয়। এসব লোহা লাগালে ঘোড়ার দৌড়ের গতি বাড়ে বেশ। দৌড়ে ঠক্ ঠক্ ছন্দ তোলে আর মাটির ঘর্ষণজনিত ক্ষতি থেকে পায়ের ক্ষুরাও রক্ষা পায়।
জাফর জিমখানা সর্দার থেকে জেনেছে এসব কথা।
আজ শনিবার।
ওরা এসেছে মনোমুগ্ধকর ওই ঘোড়দৌড় দেখতে।
রেইস চলে যাবার পর হুরহুর করে মানুষ মাঠে ঢুকে পড়ে- ওরাও ঢোকে। রেইসের দিন এ মাঠ মেলায় পরিণত হয়। মুড়ি-মুড়কি, মুরালী বাঁশি, বেলুন- কত কী ওঠে এ মাঠে! মানিক জাফরকে জিজ্ঞেস করে- পয়ছা আছে নি, একটা ফোকনা কিনুম।
-না।
জাফর আর কিছু না বলে আরো আগাতে থাকে। পশ্চিমের রাস্তায় হঠাৎ মিছিলের আওয়াজ শোনা যায়।
কান খাড়া করে জাফর। মানিকও।
হাঁ, মিছিলই।
অস্পষ্ট আওয়াজে স্লোগানের একটা অংশই বোঝা যাচ্ছে- ‘উর্দুর পাশে বাংলা চাই।'
মানিককে কাছে ডেকে জাফর বলে- ওই ছুনছোস্ মিছিলের ছোলোগান? ‘উর্দুর পাশে বাংলা চাই' কইতাছে। বাংলা ভাছার লাইগ্যা ছোলোগান।
-হ এমুন কিছু একটা বি বুঝতাছি।
-মনে অয় ইনুভারছিটির হেই মিছিলডা।
-চল দেহি তো!
ওরা দ্রুত হেঁটে রেইসকোর্সের পশ্চিম পাশের রাস্তায় এসে ওঠে। রেইসের ট্র্যাক অর্থাৎ ঘোড়দৌড়ের ট্র্যাকের ওপর দিয়ে ক্রসিং করতে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের ধাওয়া খেয়েছে, তবু দৌড়ে ট্র্যাক পেরিয়ে চলে এসেছে। রাস্তায় এসে দেখে হাঁ, সত্যি বড়ো এক মিছিল।
ছাত্রদের মিছিল।
সামনেই মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন বর্ধমান হাউস। ছাত্ররা এখানে মিছিল করে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের সাথে দেখা করতে চায়।
ছাত্রদের মুহুর্মুহু স্লোগানে মুখরিত এলাকা। সবার মুখে একটাই স্লোগান- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, উর্দু বাংলা বিরোধ নাই।' আরেকটি স্লোগান-‘উর্দু বাংলা ভাই ভাই, উর্দুর পাশে বাংলা চাই।'
ওরা দু'জনে বোঝে বাংলাভাষার জন্যে এ মিছিল। হঠাৎ জাফর বলে- মানিক চল আমরাও বি ছোলোগান দেই।
-হ।
সাথে সাথে ওরাও মিছিলের স্লোগানে কণ্ঠ মেলায়। হাত উঁচিয়ে উঁচু গলায় বলে- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ...।'
#