।। নাসীমুল বারী ।।
গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ ধরে হাঁটছে শিউলী। মেঠোপথে দুর্বার গায়ে জড়িয়ে থাকা শিশিরগুলো পা ভিজিয়ে দিচ্ছে শিউলীর। হাঁটতে হাঁটতে ওর নিজের চোখের পাতাও ভিজে যাচ্ছে। কত কত বছর পর দুর্বায় জড়ানো মেঠোপথে হাঁটা। দুর্বার ডগায় জমা ওই শিশিরকণাগুলোই যেন চোখে উঠে এসেছে শিউলীর।
তিন দশক তো; না না চার দশক পর এসেছে শৈশবের এ সোনালি মাঠে। হাঁটছে আর হারিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট বেলায়। খুঁজে ফিরছে সে সময়ের ময়না, আছিয়া, রেজিনা ওদেরকে। ওরা কি সেই আগের মতো আছে?
ভোরে উঠেই শিউলী বেরিয়ে পড়ে মেঠোপথ ধরে গ্রামের ভেতর। চারিদিকে তাকায়। ঘড়বাড়ির আদল বদলে গেছে অনেক। ইটের বসত উঠেছে প্রতিবাড়িতেই। কুঁড়েঘর, পাটখড়ির ঘর নেই একটিও। বাঁশের ঘর— তাও নেই। টিনের ঘর আছে কিছু বটে। পথ ঘাট উন্নত হয়েছে— গ্রামীণ কাঁচাপথ, মেঠোপথ নেই বললেই চলে। ঝোপঝাড়-ডেঙা ওসব নজরে পড়ছে না খুব একটা। সেই ছোট্টবেলার গ্রামটা হারিয়ে গেছে। তবু যদ্দুর মেঠোপথ পাচ্ছে, ওতেই হাঁটছে শিউলী।
নিজের গ্রামটা ছেড়ে পাশের গ্রামটায় পা রাখে। ঢাকায় প্রতিদিন যতটুকু হাঁটে— এখনও অতটুকু হয় নি। গ্রামীণ গাছ-গাছালি আর ঝোপ জড়ানো একটা বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটছে ও। বাড়ির ভেতর এক মহিলা অন্য প্রতিবন্ধি এক মহিলাকে ধরে ধরে কলপাড় থেকে ঘরের দিকে নিচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে খুব মহিলাটিকে নিয়ে যেতে। প্রতিবন্ধিকে ঘরে রেখে মহিলাটি আবার বেরোয়। এবার ঢোকে গোয়াল ঘরে। পেছনে দশ বারো বছরের এক ছেলে। গোয়ালঘর থেকে গরু বের করে ছেলেটির হাতে দেয়। ছেলেটি গরু নিয়ে বাড়ির দক্ষিণে বেরিয়ে যায়। শিউলী দাঁড়ায়। দাঁড়িয়েই দেখছে এসব। শৈশবের গ্রামকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। ও আনমনা হয়ে যায়। হঠাৎ মহিলাটির চোখ পড়ে শিউলীর দিকে। থমকে দাঁড়ায়। নিরীক্ষণ করে। তারপর একটু অবাক কণ্ঠে ওখানে দাঁড়িয়েই বলে— এই তুমি কে গো?
শিউলীও চমকে যায় ওই কথা শুনে। সেও এবার দেখে ভাল করে, কে ও? বয়স তো ওরই মতো। কোনো কথা বলছে না; শুধু তাকিয়ে আছে ওই মহিলার দিকে।
বাড়িরই পুবের অংশের আরেক ঘর থেকে ডাক দেয়— রহিম...।
অমনি ওই মহিলাটি বলে— গরুডা বানতে গেছে।
কথাটি বলতে বলতে মহিলাটি এগিয়ে আসে শিউলীর দিকে। কাছাকাছি এসে আবার বলে— কে গো তুমি? শিউলী না?
আরও আরও চমকে যায় শিউলী।
ভাল করে দেখতে চেষ্টা করে। ভাবছে কে? আত্মীয়, না ছোটবেলার কেউ? ভাবতে ভাবতেই আগায়। মুখোমুখি হতেই চমকানো হাসিতে শিউলী বলে— রেজিনা? তুই? আরে আমারে চিনে ফেললি এত তাড়াতাড়ি?
—চিনুম না? দুষ্ট আর চঞ্চল শিউলীরে ভুলতে পারে কেউ? গাঙ পাড়ের অই বরই গাছটা নাইরে সই।
ছল ছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শিউলী ওর দিকে। হাসিটা উবে গেছে। কোনো কথা বেরোয় না। রেজিনাই আবার বলে— কী রে! এই হাসলি, আবার অহনই চুপ মাইরা গেলি? তুই তো ছোট বেলার মতই আসছ। আমরা না খাইয়া না খাইয়া চিমটাইয়া গেছি। তারপরও আমারে চিনা ফালাই লি? সত্যি রে সই!
চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। আবেগ খুশিতে শিউলী এখনও কোনো কথা বলতে পারছে না। রেজিনা ওর হাত ধরে বলে— কী রে?
চোখ মুছতে মুছতে নিজেকে সামলে নেয় শিউলী। তারপর সুন্দর একটা হাসি দিয়ে জড়িয়ে ধরে রেজিনাকে। আবেগে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে— তোরে চিনতে কষ্ট হলেও কথার টানটা চিনতে ভুল হয় নাই। মানুষ বদলে গেছস, কিন্তু গলা বদলায় নি। আচ্ছা, তুই কি এখনও আগের মত গলা ছেড়ে গান গাইতে পারছ?
এবার চুপসে যায় রেজিনাও। কোনো কথা বেরোয় না। ব্যাপারটা বোধ হয় কষ্টের, শিউলী তাই প্রসঙ্গ বদলে বলে— বরই গাছ, মানে?
রেজিনা স্বাভাবিক হয়। সাথে সাথে বলে— ওই যে গাঙ পাড়ের বরই গাছটা? কত বরই পাড়তি তুই মনে নাই? তুই ছাড়া আমাগ আর কেউ ওই গাছে চড়তে পারত না। গাছে চড়া, বরই-গাব পাড়া— উহ্্ তোর দুষ্টামী আইজও আমার চোখে ভাসে। তুই আমাগরে ছাইরা ছইলা গেলি, আর কোন খবরই রাখলি না।
চোখ মুছে রেজিনা। চোখ মুছতে মুছতেই আবার বলে— মনে অইছে তোর? নাকি এডাও ভুইলা গেছস্?
—ও; হ, হ।
—এই মনে আছে একবার ওই ডেঙার আমগাছের খোরল থেকে কাঠঠেকরার ছাও পাড়ছিলি?
—ওহ্। ওই ডেঙাটা আছে? আমি তো চিনতে পারছি না।
—না। বাড়ি বানাইছে লতিফ চাচারা।
—ও
এবার রেজিনা দুষ্টুমির ছলে চোখ কচলাতে কচলাতে বলে— ঘুম থেইকা উঠলাম নি? সত্যই তুই শিউলী, স্বপ্নে দেখছি না তো?
অমনি শিউলী রেজিনার হাতে একটা আলতো চিমটি কাটে। রেজিনাও আলতো চিৎকার দিয়ে ওঠে। শিউলী হাসি দিয়ে বলে— দেখলাম তোর জ্ঞান আছে নি। নাকি স্বপ্নের জগতে আসছ।
হেসে দেয় দুই জনে।
হাসতে হাসতেই রেজিনা বলে— চল্ আমার ঘরে।
ঘরের দিকে যেতে যেতে শিউলী বলে— এই, আছিয়া, ময়না ওরা কে কইরে? ওরা কি আগের মত আছে?
—আছিয়া? আছিয়ার কথা তোর মনে আছে?
—আ- রে...! আছিয়ারে একবার যে ভয় দেখাইছিলাম, সে কথা কি ভোলা যায়? এখনও মনে হলে কী হাসিই না পায়!
—হ হ। নির্জন দুপুরে কী কা-ই না তুই করছিলি! ও স্কুল ফাঁকি দিয়া বড়শিতে মাছ ধরছিল। তুই ওইদিক দিয়া যাওয়ার সময় চুপে চুপে পিছন দিয়া ওরে ধাক্কা দিয়া পালাইছস্। ও গেছে পুকুরে পইড়া।
মিটি মিটি হাসে শিউলী। রেজিনা আবার বলে—আছিয়া পুকুরে পইড়া কাউরে দেখে না। তাই ভূত মনে কইরা কী চিৎকার। পরে আবার তুই-ই টাইন্যা তুলছস্।
খিলখিলিয়ে হেসে দেয় শিউলী।
রেজিনাও।
হাসতে হাসতে রেজিনাই আবার বলে— আসলে তোর দুষ্টামীডা একটু বেশি অইছিল অইদিন। যদি পানিতে মরত?
—আরে ধ্যাৎ। ও তো সাতার জানত। আর পড়ছে পুকুরের পাড়েই না। আমি তো আস্তে ধাক্কা দিছি।
—না রে, তুই বিশিই করছস্। এহন অবশ্য এডা হাসায় আবার কান্দায়ও।
—কাঁদায়! কেন? কেন?
শিউলী ঔৎসুক্য নিয়ে জিজ্ঞেস করে।
—কান্দাইব না? অই সময়ের মতন কি আর আমরা একসাথে আছি? একেক জন একেক দিকে। এই তুই . . .।
আচমকাই থেমে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর শিউলীর মুখ-চোখের দিকে তাকায়।
কথা বলে না শিউলীও।
হাঁটতে থাকে দুজনেই। এরই মধ্যে ওরা চলে এসেছে রেজিনার ঘরের দাওয়ায়। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শিউলী নরোমকণ্ঠে বলে— ওই যে গরুটা নিয়ে গেল, ওটা তোর ছেলে?
বড়ো একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে— সে কপাল থাকলে তো? ছেলেফেলের জন্য কপালও থাকতে হয়!
এমন কথায় একমদই অপ্রস্তুত হয়ে যায় শিউলী। তাই এখনই আর ও কথার উত্তর জানতে চায় না। আর কোনো কথা না বলে ওর সাথে ঘরে ঢুকে চৌকিতে গিয়ে বসে।
আধ-পুরোনো টিনের ঘর। একটু বড়ই। চারটে রুম। ভেতরের উত্তর কোণের রুমটা রেজিনার। চৌকিতে বসে শিউলীও একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার জিজ্ঞেস করে— আছিয়ার সাথে তোর দেখা হয়, না রে?
—গত বছর আইছিল।
—কই থাকে?
—চিটাগাংয়ে। এসএসসির পরেই বিয়া হইয়া গেছে। অবশ্য বিয়ার দিক দিয়া আমার জুনিয়ার।
—ময়না?
—ওর আরও পরে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আগে। তাই আর পরীক্ষা দেয় নাই। ও থাকে রাজশাহী। সাত আট বছর আগে আইছিল।
—সেও কি আগের মত বেশি বেশি কথা বলে?
—বলে মানে? তোকে পাইলে দেখবি তুলা ধুনা কইরা ফালাইব। অইবার আইসা তোরে খুব বকাঝকা করছিল আমার কাছে।
—কেন?
—কেন করব না? তুই যে পালাইলি তো পালাইলি।
—পালালাম কই।
—পালালিনা মানে? এই ত্রিশ-চল্লিশ বছরেও খবর নিলি না আমাগ। কী মানুষ রে তুই! না পালানোর চাইতে কম কী?
এই শোন্, অইবার ময়না কইছিল গাঙে সাঁতার কাটতে।
—গাঙে সাঁতার কাটতে? আহ্ সে বয়স কি আছে রে?
—এ জন্যই তো কথা পর্যন্ত শেষ। গাঙে কি আর যাওয়া হয়?
তারপর আবার চুপ হয়ে যায় দুজনেই।
নীরবতা ভেঙে শিউলী আবার জিজ্ঞেস করে— একটু আগে একজন প্রতিবন্ধিকে ঘরে নিয়ে যেতে দেখলাম। কেরে উনি?
—আমার ননদ।
—কী হয়েছে?
—জন্ম প্রতিবন্ধি। চলাফেরা করতে পারে না একদম। সেন্স ঠিক আছে। ফাইভ পাশও করেছে। কিন্তু বিয়ে কি আর হয়?
—তোর বর কী করে? শ্বশুর শাশুড়ি কোথায়?
গলাটা নেমে আসে রেজিনার। একটু সামলে বলে— শ্বশুর নেই। শাশুড়ি আছে, আইজ মনে হয় শরীল ভালা না। এখনও ঘুমায়। আইচ্ছা তুই চাকরি বাকরি করছ কিছু?
—করি। কলেজের অধ্যাপক। তুই তো ভালছাত্রী ছিলি। কদ্দুর পড়ছোস্।
—গরিব মানুষ পড়ালেখা কি আর হ-য় . . .?
বড় কষ্ট আর দুখের জীবন রেজিনার।
প্রাথমিক পরীক্ষার পর আর হাইস্কুলে ভর্তি করায় নি ওর বাবা। সামান্য কৃষক পরিবার— দুই ভাইকে পড়াতেই হিমসিম খাচ্ছে ওর বাবা হাসান আলী। ও তো মেয়ে বেশি পড়ে আর লাভ কী? তাই ওর বাবা জানিয়ে দিয়েছে, ফ্রি স্কুলের পর আর পড়তে হবে না। বাবার এ সিদ্ধান্তে বাধ সাধে বৃত্তির ফলাফল। মার্চে মাসে প্রকাশিত বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফলে রেজিনা টেলেন্টপুলে বৃত্তি পায়। সাথে সাথে প্রাইমারি স্কুলের হেডস্যার আবদুল মজিদ আসেন হাসান আলীর কাছে। অনুনয় করে বলে— হাসান ভাই আপনার মেয়েকে হাইস্কুলে ভর্তি করান। বৃত্তি পেয়েছে, পড়ার খরচ খুব একটা লাগবে না।
—স্কুল তো দূরে। আর মেয়ে মানুষ এত পড়াইয়া লাভ কী?
—বলেন কী? মেয়েরা শিক্ষিত হলেই তো সংসার সুন্দর হয়।
—না, না। স্যার আপনে যান গা।
হাসান আলীকে রাজি করানো যায় নি।
পরদিন আসে হাইস্কুলের হেডস্যার আরও দুই জন স্যারকে নিয়ে। আরও আসে মেম্বার সাহেব। সবার অনুরোধে অবশেষে রেজিনা হাইস্কুলে ভর্তি হবার সুযোগ পায়।
রেজিনা জুনিয়র বৃত্তিও পেয়েছে। এসএসসি পাশ করেছে প্রথম বিভাগে। ব্যাস!
এতদিনের শুভাকাঙ্খি প্রাইমারি স্কুলের মজিদ স্যার অনেকটা জোর করেই নিজের ছেলের বউ বানিয়ে নিয়ে আসেন এ বাড়িতে। শ্বশুর বেশি সচ্ছল ছিল না। স্বামী সামসুদ্দিনও এসএসসি পাশ। আর পড়া হয় নি। থানা সদরে একটা ছোট চাকরি করে। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় স্বামী প্রবাসি হয় জীবিকার তাগিদে। শ্বশুর জমি বিক্রি করে পাঠিয়েছেন।
বছর পাঁচেকের মাথায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রবাসেই মারা যায় স্বামী। লাশও আনতে পানে নি টাকার অভাবে। পাঁচ বছরে যা আয় হয়েছে, তাতে শুধু এ ঘর আর কলপাড়ই একটু উন্নত হয়েছে।
স্বামী-সন্তানহীন রেজিনা কী করবে? নতুন কোনো সংসারে যাবে? সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই বছর পার। আবার দুঃসংবাদ। এবার এ বাড়িতেই। শ্বশুর মারা গেছেন। তারপর . . .। তারপর থেকে শাশুড়ি আর ওই প্রতিবন্ধি ননদকে নিয়ে পড়ে আছে এখানেই। শ্বশুরের উত্তরসুরি এ দুই জনই। সচ্ছলতার মুখ আর দেখে নি এ সংসারে রেজিনা।
এসব শুনে শিউলীর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ওর গলায় জড়িয়ে ধরে বলে— আমায় ক্ষমা করে দে। আমি সত্যি তোদের ভুলে গেছি। ভুলে গেছি গ্রামটারে। দেখ আমি স্কুল জীবনে কোনো বৃত্তি পাই নাই, তবু আজ অধ্যাপক। তুই আমাদের চেয়ে কত ভাল ছিলি। ইস্!
—বাদ দে ওসব কথা।
—রেজিনা তুই তো প্রাইমারিতেও ঢুকতে পারতি ?
—পড়া বন্ধ, দুই ঘটনায় সংসার ল-ভ-— আর কি ভাল কিছু করার বোধ থাকে? স্বামী সন্তানের আনন্দই যেখানে পাই নাই, নিজের মেধার মূল্যও যখন শেষ, সেখানে জীবন থাকে? ঝড়ে ভাঙা গাছের মতই আমি এখন। মরিও না, বাঁচতেও কষ্ট হইতাছে।
ভারী গলায় শান্ত কণ্ঠে শিউলী বলে— তুই অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিস। আবার তো বিয়ে . . .।
থামিয়ে দেয় রেজিনা।
মুখে আঙুল লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে— আমার শাশুড়ি আর অসহায় ননদকে ফেলে আমি কেমনে যাই? না রে; কোথাও আর যাইতে পারি নাই! পারি নাই। বিয়ার প্রস্তাব আইছিল, তাদেরে একা ফালাইয়া কষ্ট দিয়া যাইতে মন চাইল না। পারলামও না। তাদের তো কেউ নাইরে আর! তাই এই মায়া ছাড়তে পারি নাই। বুঝলি ছাড়তে পারি নাই।
মনে মনে ভাবে শিউলী, এটাই গ্রাম আর গ্রামের মায়া। তারপর রেজিনাকে বলেÑ সত্যি তুই মহামানবী। আমরা শুধুই স্বার্থপর।
—স্বার্থপর মানে?
—বুঝলি না, আমরা শহরে গিয়ে শুধু নিজেদের জন্য ভেবেছি। এই দেখ চল্লিশ বছর তো হয়ে গেল— একদিনও তোদের খোঁজ নেই নি। আজ এখন আমার মনটা হঠাৎই ছটফট করছিল গ্রামের জন্য, একটু পুরোনো সুখের জন্য। তখনই ছুটে এলাম এখানে। এ আসাটাও আমার জন্যই।
—ছি সই! এমুন কথা বলিস না।
—কেন না রে! আমরা শহরে নিজেদের বিলাসী জীবনের প্রতিযোগিতায় ভেসে বেড়াই। এজন্য ন্যায় অন্যায়ের বাছবিচার করি না। আমাদের শহুরে পরিবারগুলো হয়ত এমনই। আর তোরা? তোরা সামাজিক মায়াবন্ধনে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিস্ পরের জন্য। তোরা অনেক বড় মনের। তোদের কাছে মানবিকতা বড়— আমাদের কাছে জৌলুসের এরিস্টোক্যাসি।
রেজিনা মৌন একটা হাসি দিয়ে বলে— কথা থামা। যত্তসব বাজে কথা। খেজুররসের পায়েশ খাবি?
—কখন রান্না করেছিস?
—রাতে।
—রাতে! রস পেলি কই?
—আমার শ্বশুরের দশ বারোটা খেজুরগাছ আছে। ভাগে রস নামায়। আজ আমার ভাগ ছিল। আমি আগেই বলেছিলাম আগরাতের রসটা দিতে। আগরাতের রসের স্বাদই আলাদা।
—আগরাতের রস! তাই নাকি! এ কথা তো শুনি নাই।
—শুনবি কোত্থেকে? সবাই তো রস পাড়ে সকালে। শুধু আমার শ্বশুররে দেখেছি আগরাতের রসে পায়েশ খেতে। খুবই মজা।
কথা বলতে বলতে নিয়ে আসে পায়েশ।
শিউলী খায়।
খেয়েই চমকে যায়। একি! জীবনে এমন ঘ্রাণ আর স্বাদের খেজুররসের পায়েশ খায় নি। সত্যিই তো!
খেতে খেতে শিউলী বলে— রেজিনা ইচ্ছে হয় সারাদিন তোর এখানেই কাটাই। কিন্তু আসলে তো সম্ভব না। আচ্ছা আছিয়া ময়নার সাথে যোগাযোগ করার কোনো উপায় আছে?
অনেকটা অভিমানী সুরে বলে— আমি জানি না।
কথাটা বলতে বলতে গলা ভারি হয়ে আসে রেজিনার। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে পরপরই আবার বলে— শুন আছিয়া ময়নার ফোন নাম্বারটা যোগাড় কইরা বিকালে তোর কাছে পাঠাইয়া দিমু। এহন যাবিগা? আরেকটু থাক না!
—না, এখন উঠি রে।
তারপর হাঁটতে হাঁটতে দুই জনেই বাড়ির বাইরের দিকে আসে। সামনে বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়েই মেঠোপথ একদম শিউলীর বাড়ি পর্যন্ত।
বাঁশঝাড়ের কাছে এসে চোখ মুছে রেজিনা।
শিউলীও।
তারপর শিউলী নেমে পড়ে মেঠোপথে।
মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে শিউলীর মনে ভেসে ওঠে রেজিনার ছোটবেলায় গাওয়া গানটা—
‘যে বাঁশি ভেঙে গেছে, তারে কেন গাইতে বলো
কেন আর মিছে তারে সুরের খেয়া বাইতে বলো ।।’
#
আমার অন্য গল্পগুলো পড়তে টোকা দিন :
গল্প : প্রজাপতি
কবিতার গল্প
গল্প : শিশির
গল্প : বাঁশির সুরে নদীর গান
নিষিদ্ধ গল্প