নাসীমুল বারী
পড়ন্ত বেলায় সোনালি দ্যুতিতে পুরো নদীটাই সোনায় মোড়া। হঠাৎ একঝাঁক বলাকা উড়ে যায় ওই সোনালি দ্যুতিতে কিচির মিচির করে।
অপূর্ব!
বলাকার উড়ায় ছন্দ-গতির অপূর্বতায় চেয়ে আছে নাহিয়ান। অজানা ভালবাসার আকর্ষণে ওগুলো উড়ে যাচ্ছে প্রিয়ার দিকে।
নদীর পাড়ে একটা তালগাছ। সাথে লাগোয়া বরইগাছের নিচে বসে নাহিয়ান দেখছে বলাকার ছন্দায়িত গতিপথটা। হাতে থাকা বাঁশের বাঁশিটা এখনো ঠোঁটে লাগায় নি। বসে বসেই পার করে দেয় সময়ের একটা অংশ।
সোনা রঙ শেষ হয়- কালো ঘিরে ধরেছে ওকে। এ কালোর মাঝেই রূপোলি আলোয় হেসে উঠে চাঁদ। বাঁশের বাঁশিটায় সুর তোলে নাহিয়ান। সে সুরে বলাকারা যেন ফিরে আসে পত্ পত্ করে। চকিত তাকায় চারপাশে। ক'টি বাদুরের উড়ে যাওয়া ছাড়া কিছুই নজরে পড়ে না।
আবার বাঁশি বাজায়।
বাজাতে বাজাতেই শুনে নূপুরের এক ঝংকার। চমৎকার নূপুরের ঝংকারে ওর বাঁশির সুরটা আরও মোহময় হয়ে উঠে।
আচমকা বাঁশিটা থামিয়ে ফেলে নাহিয়ান। নূপুরের সুরটা খুঁজতে তাকায় এদিক, ওদিক।
না, নেই কিছুই। তবে বাজাল কে নূপুর? কোত্থেকে এলো নূপুরের সুর? চমকের রেশ কাটে না মন থেকে। ক্ষণিক পর নিজে নিজেই ভাবে, নূপুর না থাকলে তো বাঁশির সুরই হত না। বাজত না এমন মোহময় হয়ে।
মৃদু বাতাস বয়ে যায় ওর দেহ মনের উপর দিয়ে। ফাল্গুনি বাতাস। ধীর পায়ে এগিয়ে একদম নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। অজানা বুনো ফুলের সুরভীতে উদাস হয়ে যায় মনটা। এ সুরভী কিসের- রজনীগন্ধার? শিউলীর? গন্ধরাজের? মালতির? কামিনীর? না, না। নির্দিষ্ট কোন ফুলের সুরভী নয়। তবে কি ওই নূপুরওয়ালীর ভালবাসার ফুল? কি জানি!
মন ভরে নিঃশ্বাস নেয়। সুরভীর প্রশান্তিতে আবার এসে বসে বরইগাছের তলে।
ভূতুমপেঁচার আচমকা হাসিতে চমকে উঠে নাহিয়ান। তালগাছের মাথায় দুটো ভূতুমপেঁচা হাসাহাসি করছে। বাহ্! চমৎকার জুটি! ভালবাসার জুটি! চাঁদের আলোয় আবছা দেখা দেখা যায় পেঁচা জুটিকে। ওদের ভালবাসায় পূর্ণতা দিতে নাহিয়ান আবার বাঁশিতে ঠোঁট লাগায়।
মন ভরে বাঁশি বাজায়।
থামে না এ বাঁশি।
পেঁচাযুগলও আর কোন শব্দ করে না। ওরাও মজে গেছে নাহিয়ানের বাঁশির সুরে। ভালবাসার সুরে। মৃদু বাতাসে নদীটাও কল কল বয়ে শুনছে সে বাঁশি। সাগরের ভালবাসায় পাহাড় থেকে গড়িয়ে কত বাঁধা পেরিয়ে নদীটা বয়ে চলছে প্রিয়ার কাছে। সে কি ভালবাসা!
আকাশ জুড়ে তারার মেলা।
ছোট বড় বিবিধ ঢং-এ সাজানো এ তারার আলপনার পানে চেয়ে থাকে নাহিয়ান। বলাকারা কি তবে ওই সুন্দরের দিকে উড়ে গেছে? ইস! ওরও খুব উড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। হঠাৎ দেখে একটা তারা খসে পড়ছে। তীব্র গতিতে কিছুদূর নেমে হারিয়ে যায়। আচ্ছা ওই যে তারাটা হারিয়ে গেল-আকাশ কি তা মনে রেখেছে? নাকি তারাটা বাঁশি শুনে ওর কাছে নেমে আসছে?
বাঁশি বাজিয়েই নাহিয়ান উঠে চলতে থাকে নদীর পাড়ের মেঠো পথটা ধরে। হাঁটতে হাঁটতেই মনে পড়ে ইন্দ্রনাথকে। সেও তো এমন আরো ভয়ঙ্কর বুনো পথ ধরে বাঁশি বাজাতে বাজাতে যেত অন্নদা দিদির কাছে। আহ্! অন্নদা দিদির জন্যে ওর যে কি ভালবাসা! শুদ্ধতম ভালবাসা। আর সে ভালবাসায় সাপ, মড়া সব ডিঙ্গিয়ে ভয়কে জয় করে যেত রাত গভীরে।
আজ নাহিয়ানও কি যাচ্ছে এ যুগের অন্নদা দিদির কাছে? কিন্তু কই সে অন্নদা দিদি? নূপুরের ঝংকারে কি সে অন্নদা দিদির অস্তিত্ব? পেঁচার হাসিতে খুঁজে পায় সে ভালবাসার রঙ।
আবারও নূপুরের ঝংকার আসে কানে। বাঁশি থামিয়ে দেয়। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে পুব দিকে তাকায়। ওই তো নূপুরের আলতো ঝংকার তুলে কে যেন একটু সরে গেল? পালাল কেন ও? কে ও? ভাবতে ভাবতে নাহিয়ানও এক পা পিছিয়ে একটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়ায়। ক্ষণিক ব্যবধানে আচমকা পিঠে আলতো একটা কিল পড়ে। ঘুরে তাকিয়েই চমকে নাহিয়ান বলে- মনজিলা! মনজিলা তুমি রাতে এখানে?
- তোমার বাঁশির সুরে রাত আর দিনের ব্যবধান থাকে কি?
- নূপুর পায়ে এলে যে?
- নূপুর নয়, হাতের চুড়ির ঝংকার, বুঝলে!
- কেউ দেখে ফেললে তো গ্রামে কলঙ্ক রটে যাবে।
উদাস মনে মনজিলা বলেÑ যাক!
- মানে?
চমকে জিজ্ঞেস করে নাহিয়ান।
- বাঁশির সুরটা আমাকে কলঙ্ক না দিলে পৃথিবীর আর কোন কলঙ্কতেই আমার কিছু যায় আসে না।
- মনজিলা!
- উহ্! বাঁশিটা বাজাও নাহিয়ান। নদীরও গান শুনি । তোমার মনের নদীটার।
#