মোবাইলে রিং বেজে উঠতেই মনটা খুশিতে ভরে যায় শাফিয়ার। কায়েস সাহেব ফোন করেছেন। সুন্দর কথা বলেন। গুছিয়ে কথা বলেন। কথার চমৎকারিত্বে আবেগের অনুভবে যে কেউ অভিভূত হয়ে পড়ে— শাফিয়াও।
কায়েস হাসেমের বয়স আশি পেরিয়ে গেছে।
উচ্চ শিক্ষিত। ধনপতি। ধানমন্ডিতে চমৎকার ডিজাইনের বাড়ি। বাড়িটার পাশ দিয়ে লেক বয়ে গেছে।
শাফিয়ার বয়স আর কত?
কায়েস হাসেমের প্রায় চারভাগের একভাগ; চব্বিশ বছর। যৌবনের উচ্ছ্বাসে টগবগে তারুণ্য এখনও শাফিয়ার দেহ-মনে। এ বয়সে শাফিয়ার উচিৎ ছিল কোন তারুণ্যের প্রেমে পড়া। তা কিনা বাদ দিয়ে মজে গেছে ওই বুড়ো কায়েস হাসেমের প্রেমে। এর কারণটা বারবার খুঁজতে চেষ্টা করেছে। ওই একটাই কারণ- রসবোধে মনে হয় কায়েস হাসেম এখনও ওরই সমবয়সী তরুণ। এখনও ওর কথা-আচরণে তারুণ্য ধরা দেয়। জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছিলেন- মনের তারুণ্যই বড় তারুণ্য, বয়সে নয়।
কথার মোহময়ী যাদুকর সেই কায়েস হাসেমের ফোন শাফিয়ার কাছে। মনের উচ্ছ্বাসে শাফিয়া ফোনটা রিসিভ করে বলে, হু! আমি ...।
কথা শেষ হবার আগেই ও প্রান্ত থেকে কায়েস হাসেম বলেন—মাই সুইটস্!
- বলুন।
- তুমি আসো তো বাসায়। বড্ড লোনলি ফিল করছি। এখনই চলে আস না লক্ষ্মী!
বেশ আবেগাশ্রিত কথা। লোকটা বুড়ো। সারাদিন একা বাসায় থাকে। আর সাথী পেলে কথায় দারুণ মেতে ওঠে। উঠে আসতেই ইচ্ছে হয় না শ্রোতাদের। শাফিয়ারও তাই।
কায়েস হাসেমের বাড়ির লেকের দিকটায় লম্বালম্বী বড় বারান্দা। বেশ লাগে। নিচতলার ভাড়ার আয়েই চলে যায় দিন। দোতলার উপরে আর করেন নি। এখন আর দরকারও নেই। তিন সন্তানের জনক, কেউ এদেশে থাকে না। স্ত্রী দুলি নাকি একটা সময় সুন্দরীতে ‘মিস' ছিল। শুধু সে যুগে এমন কোন প্রতিযোগিতার পরিবেশ ছিল না, নচেৎ ওই মুকুটটা তার মাথায় শোভা পেতোই। সেই রূপবতী স্ত্রী বছর তিনেক আগে মারা যায় প্রথাগত বার্ধক্যের কারণে। তখনও নাকি তার রূপের ঝলক ঠিকরে বেরিয়ে পড়ত। মৃত্যুর আগে তারা দুজন যেন টোনাটুনি এ দোতলার বাসিন্দা ছিল। এখন টুনি নেই, টোনা আছে। দু'ছেলে আর এক মেয়ে। বাব্বাহ্? ওরা ওদের বাবাকেও ছড়িয়ে গেছে মেধা আর শিক্ষায়। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা । সমাজে নাম-প্রতিপত্তি আছে। আছে সামাজিক মর্যাদা-পরিচিতি। কিন্তু ওরা বাবার সে প্রতিপত্তিকে ছাড়িয়ে অস্ট্রেলিয়া-ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে। স্বপরিবারে নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানেই আছে। মেয়েটি থাকে অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়া স্টেটের লনচেস্টটনে। পাহাড়ের গায়ে তার চমৎকার বাড়ির ডিজাইনটা বাংলাদেশেরই এক আর্কিটেক্টকে দিয়ে করিয়ে বাবা নিজে দেখাশুনার মাধ্যমে তৈরি করে দিয়েছেন। সেখানকার মানুষেরা এমন চমৎকার বাড়ি দেখে অভিভূত হয়ে যায়। বড় ছেলে কানাডার টরেন্টোতে আর ছোট ছেলে পূর্ব লন্ডনে। ওদের আসা সম্ভব নয় বলেই আজ ঢাকায় একাকী কায়েস সাহেব। সন্তানরা অবশ্য বলেছিল ঢাকার বাড়ি-টাড়ি বিক্রি করে বিদেশ বিভূঁইয়ে চলে আসতে সন্তানদের কাছে- তিনি যান নি। দেশের মাটির মায়া তাকে যেতে দেয় নি। আর এখন; এখন তো মনে হয় শাফিয়ার আকর্ষণ তাকে যেতে দেবে না। শাফিয়ার মাঝে কেমন যেন একটা আকর্ষণ খুঁজে পান বলেই বছর খানেক ধরে সন্তানদের অনুরোধে সাড়া দিচ্ছেন না।
কায়েস হাসেমের কথায় শাফিয়া একটু আনমনা হয়ে যায়। কী আবেগী কথা ‘এখনই চলে আস না লক্ষ্মী'। যাবে এ ভর দুপুরে? গত এক সপ্তাহ দেখা করার সুযোগ পায় নি। না, আজ দেখা করা উচিৎ-লোকটা এমন করে বলেছে। সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে বলে- আমি আসছি।
- আমার ড্রেসটা পরে আসবে কিন্তু।
- ঠিক আছে।
ফোনটা ছেড়ে শাফিয়া যায় ওর রুমে। তাড়াতাড়ি ড্রেসটা বদলায়। এই তো ঈদে ভদ্রলোক ওকে এ ড্রেসটা দিয়েছে। ম্যাগাজিন দেখে ঈদফ্যাশন প্রতিযোগিতার সেরা পোশাকটা ওকে দিয়েছে। অফ হোয়াইটের জমিনে মেরুন আর ডিপ ব্লু হাতের কাজ। কাপড় তৈরির উপকরণ আর নকশার উপস্থাপনায় সত্যি সেরা পোষাক বটে! দাম কত জানতে চায় নি শাফিয়া। তবে পোশাকটা দিতে গিয়ে তিনি হাসতে হাসতে নিজ থেকেই বলেছিলেন-গিফ্ট আইটেমের দাম জানতে নেই, বুঝলে সুইটি?
সেই চমৎকার পোষাক পরে রেডি হতেই মা বলেন- শাফিয়া এ ভর দুপুরে কই যাচ্ছিস রে?
- বান্ধবীর বাসায়।
- কোন বান্ধবীর বাসায়? আমি তো তোর সব বান্ধবীকেই চিনি। এ দুপুরে তো কেউ বাসায় থাকার কথা নয়। তুই বেকার বলেই না বাসায়।
- কেন মা, তুমি কি আমারে সন্দেহ করছ?
মা'র মনটা আঁতকে উঠে, শাফিয়া এমন কথা বলল কেন? নিজের দুর্বলতা নিজেই প্রকাশ করে দিল! সত্যি কি সন্দেহের কোন কাজ করছে সে? নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলেন-না, বলছিলাম তুই কোন বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছিস, আমার জানা থাকলে ক্ষতি তো নেই। কী বলিস?
- শিখার বাসায়।
- ও! ও আজ অফিসে যায় নি বোধ হয়।
একটু ইতস্তত করে বলে- হ্যাঁ।
তারপর আরও কী যেন বলতে চেয়েছিল-কিন্তু বলে নি। মায়ের মন। মেয়ের মনকে জানতে কতক্ষণ। তিনিই এগিয়ে আবার জিজ্ঞেস করেনÑকী যেন বলতে চাইছিলি? ওর কি কোন সমস্যা হয়েছে?
- হ্যাঁ মা!
- কী?
মুখটা মায়ের দিকে এগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে-ও তো নতুন প্যাগনেন্সি, তাই!
খুশির তৃপ্তিতে ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে মা বলেন- তা এমন খবর দিতে এত দ্বিধা কেন?
বাসা থেকে বের হয়েই শাফিয়া ফোন দেয় শিখাকে। ফোনে বলে- তোর ওই অসুস্থতার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়েছি। ধানমন্ডিতে যাব। মা তোর খোঁজ নিতে ফোন করতে পারে।
- আমি বাসায় থাকব বটে। কিন্তু ফোনে তোকে যদি চায়?
- হ্যাঁ, তাই তো! আচ্ছা আগে না হয় তোর বাসায় আসছি।
- তা আসবি। কিন্তু ...।
- কিন্তু কী? তুই কি বাসায় থাকবি না?
- আমি তো বাসায় থাকবই। ক'দিন রেস্ট নিতে বলেছে ডাক্তার। নতুন তো ...। আচ্ছা তুই ওই বুড়োর বাসায় যাওয়া বন্ধ করতে পারিস না। বয়সের ব্যবধানটা আর তার বয়সের অবস্থানটা চিন্তা করেছিস্?
কোন কথা বলে না শাফিয়া।
এমন প্রশ্ন আর প্রস্তাব শিখা আরও বহুবার দিয়েছে ওকে। কিন্তু লোকটার কথা, চাহনীর আকর্ষণ আর আবেগে পারে নি মনটাকে ফেরাতে। আর কেউ তো এমন আবেগ ভালবাসায় ওকে কাছে টানে নি এ পর্যন্ত।
শিখার বাসায় বেশিক্ষণ থাকে নি। মাকে বলেছে বলেই এখানে আসা। শিখায় বাসা থেকে বেরিয়ে রিকসা নেয় ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে। রিকসায় উঠার পরপরই আবার ফোন আসে কায়েস হাসেমের। ফোন রিসিভ করে। ও প্রান্ত থেকে শান্ত কণ্ঠে বলে- মাই সুইট্, আসছ না যে!
- কে বলছে আসছি না।
- আমার যে তর সইছে না। তোমাকে দেখব। মন ভরে দেখব। এক সাথে খাব। বাসার ছেলে জায়েদকে বলেছি দু'জনের রান্না করতে। চমৎকার মেনু। জায়েদ কী বলে জানো?
- কী?
- বলেছে শাফিয়া খালা আসবে? ছোকড়টা পাজি, বুঝে গেছে তুমি আসছ। আমি ধমকে বলি শাফিয়াকে খালা বলবি না। তুই দুলিকে যা ডাকতি তা-ই ডাকবি।
- দুলি, মানে আপনার আগের স্ত্রী? তাকে কী বলে ডাকত?
- নানী!
- আমি চব্বিশ বছরেই নানী হয়ে যাব?
একটু মিষ্টি হেসে কথাটা বলে শাফিয়া। ও প্রান্ত থেকে কায়েস হাসেমও হেসে দেয়। বেশ আবেগী সে হাসা- ফোনেই অনুভব করে শাফিয়া।
ফোনটা ছেড়ে বেশ পুলক অনুভব করে শাফিয়া।
বয়সের পার্থক্য অনেক হলেও কেন যেন প্রচন্ড ভালবেসে ফেলেছে শাফিয়া। কেন এমন আকর্ষণ? শাফিয়া ভরা যৌবনাবতী আর লোকটা বুড়ো, বয়সের ভারে ন্যুব্জ। জৈবিক আকর্ষণইবা হবে কেন শাফিয়ার? মন! মনের রং বুঝা বড় দায়। শাফিয়া নিজেকে ঠিক বুঝতে পারছে না। তবু ভালবেসে যাচ্ছে। যাবেও। আজ একটু বেশিই তাকে অনুভব করছে। মনে মনে বিরক্ত হয় রিকসাটার উপর। সিএনজি-র মতো দ্রুত চলছে না কেন? ক্ষণিক চুপ থাকে। তারপরই চিন্তার রেশ কেটে যায়। মনে মনে বলে-ও আচ্ছা! এটা তো আর ইঞ্জিন চালিত নয়-পায়ের জোরে চলে। গতি আর কত দ্রুত হবে?
রিকসাটা ধানমিন্ডর আট নম্বর ব্রীজে উঠেছে মাত্র। আরও অন্তত মিনিট সাত-আটেকের রাস্তা কায়েস হাসেমের বাসা। আবার ফোন বেজে ওঠে। শিহরণ আর বিরক্ত দুটোই একসাথে জাগে মনে। এত ফোন করার কী দরকার। রিকসা চলছে তো। সময়মত পৌঁছবেই।
রিং বেজেই চলছে।
ব্যাগ থেকে ফোন বের করে। ওমা, একি! এ যে শিখার ফোন? নিশ্চয় মা ওখানে ফোন করেছে। আচ্ছা শিখা বলে দিয়েছে ও যে ধানমন্ডি যাচ্ছে? ফোনটা রিসিভ করে। যা ভেবেছে, তা-ই। ও প্রান্ত থেকে শিখা বলে- খালাম্মা ফোন করেছিল।
- তুই কি বললি?
- তোর জন্যে মিথ্যা কথা বলেছি। জানিস তো আমি মিথ্যা কথা বলি না, এর দায় তুই নিবি, আমি না। বলেছি অষুধ আনতে ফার্মেসিতে গিয়েছে।
- তোর অষুধ আমি আনতে যাব কেন? মা বলেনি এমন কথা?
- বলেছে। তারপরও আমি ম্যানেজ করেছি এবং বলেছি বাসায় ফিরতে দেরি হবে। এখন আর তোর কোন চিন্তা নেই।
- থ্যাঙ্কু
শাফিয়ার মনটা ভাবনায় ভরে যায়।
মা আজ এমন সন্দেহ করছে কেন? কোনদিন তো মা এমন আচরণ করে নি। আচ্ছা ও লোকটা প্রায়ই তার স্ত্রীর শূন্যতায় আমাকে অনুভব করে। তাকে বিয়ে করার প্রস্তাবটা কি মা মানবে? কীভাবে বলবো মাকেÑভেবে পাচ্ছি না। আচ্ছা আজকের আচরণে মা কি বুঝে গেছে কারো প্রেমে পড়ে গেছি?
এমনি অনেক চিন্তা মাথায় ঘুর ঘুর করছে।
আসলে মা-ই ওর খুব প্রিয়। আদরের সাথী। আবার ভয়ঙ্করও। এখনও মা ভীষণ আদর করে, আবার ভীষণ ভয়ও পায় তাঁকে। ‘শাসন করা তারই খাটে সোহাগ করে যে'-এ প্রবাদটা মনে হয় মায়ের জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে। ওর কষ্টকর সামাজিক জীবনে মা-ই ওকে আগলে রেখেছে। মায়ের মমতা যেন অফুরন্ত। জ্বালাতন, বিরক্তিতে সে মায়া-মমতায় কোন কমতি নেই। মা সেই মমতার আধ্যাত্মিক শক্তিতেই কি আজ টের পেয়েছে এ অসম বয়সী প্রেম? তাই কি আজ মায়ের এত সন্দেহ; এত কৈফিয়ত তলব?
কী জানি!
যত্তোসব ভাবনা এখনও ওর মনে এখনো বয়ে চলছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। ভাবনার তাড়নায় রিকসার গতির দিকে আর লক্ষ্য রাখতে পারে নি। রিকসা বত্রিশ নম্বরের ব্রীজ পেরিয়ে আরও সামনে গিয়ে বামে মোড় নিয়ে রাস্তার শেষ মাথায় লেকের পাড়ে চলে এসেছে। এখন ডাক দেয়- আপা কই নামবেন?
সম্বিত ফিরে পায় শাফিয়া।
রিকসার হুটটা নামিয়ে দেখে। ওই তো সামনের গেটটাই কায়েস হাসেমের।
রিকসা বিদায় করে গেট দিয়ে ঢুকে। সামনে লন। লনটাও যেন বুড়ো। অগোছালো, বিচ্ছিন্ন, পাতাঝরা ডালভাঙ্গা ক'টি গাছ। এমন গাছে কি আর ফুল হয়? লনটা পেরিয়ে নিচ তলায় কলিং বেল চাপ দেয়। কায়েস হাসেমের একমাত্র স্টাফ, সার্বক্ষণিক পরিচর্চাকারী জায়েদ আসে। বেশ সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলে- নানী তাড়াতাড়ি যান। আইজ আপনারে মনে কইরা রানতাছি। দেখবেন ভুলতে পারবেন না কোনদিন।
- দেখলে না খাইলে ভুলতে পারব না।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে দুষ্টুমীর ছলে কথাগুলো বলে শাফিয়া। সাথে সাথে জায়েদ উত্তর দেয়, অ... অ... খাইলে ...।
ড্রইং রুমের দরজাটা খোলাই ছিল।
সরাসরি ড্রইংরুমে ডুকে ফ্যানটা ছেড়ে সোফায় বসে পড়ে। উহ! এ বাসায় কত এসেছে। পরিচয়ের পর থেকে আসা- কত আলাপ, কথা-আড্ডা। আবার কখনো দেখা সাক্ষাতের বিচ্ছেদ দু'তিন সপ্তাহও গড়িয়েছে। কই কখনো তো এমন তাড়া করে ডেকে আনে নি- তবে আজ কেন এত তাড়া?
কায়েস হাসেমের সাথে পরিচয়ের পালাটা বেশ রোমাঞ্চকর ছিল।
শাফিয়া শপিং-এ এসেছে বসুন্ধরা সিটিতে। খুব জাঁকজমকের শপিং নয়- নিতান্তই শপিংমলটা দেখা আর সুযোগমত ছোটখাটো কিছু একটা কেনা। আসলে মনের প্রশান্তির জন্যেই এখানে আসা। দোতলার বেড়িমেট পোষাকের দোকানে ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে মার্কেটের মধ্যখানের গ্রীলে এসে দাঁড়ায়। এমন সময় এক বয়স্ক ভদ্রলোক, পোশাকে বেশ পরিপাটি এগিয়ে এসে অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে বলে- তোমার সাথে কথা বলতে পারি?
একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায় শাফিয়া। বয়সের এ টগবগে সময়েও মা ছাড়া কেউ কোনদিন আদরমাখা কথা বলে নি শাফিয়াকে। স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে কথা বলে নি। তাই তো এখন স্পষ্টত কোন কথা বলতে পারছে না। লোকটি আবারও বলে - জড়তা এসে ভর করেছে বুঝি? ইয়াং লেডি এ যুগে এত জড়তা কেন?
একটু আমতা আমতা করে শাফিয়া বলে- আমি তো ঠিক আপনাকে ...।
- চিনতে পারো নি, এই তো?
- ঠিক।
- চেনার কথা নয়। আমি এসেছি একটু সময় কাটাতে। একাকী জীবন- বুড়ো মানুষের আর কাজ কি! এখানে ওখানে ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটাই।
- তা আমার সাথে কী কথা?
- তুমি এখানে একাকী দাঁড়িয়ে। তাই ভাবলাম একটু কথা বলে যদি সময় কাটানো যায়। ও, আচ্ছা তুমি এখানে কারো জন্যে অপেক্ষা করছ নাকি? ছি, ছি, আমি অযথা তোমাকে বিরক্ত করছি।
- না, না আমি কারো জন্যে অপেক্ষা করছি না। আমার কি অপেক্ষা করার মত অবস্থা আছে। যেই না মানুষ আমি!
- আহা, নিজেকে ও ভাবে ভেবো না। তাহলে চল আট তলার ফুডকোর্টে বসে কথা বলি।
- না, না, থাক।
- থাকবে কেন। তোমার কোন ভয় নেই- তুমি তো আমার গেষ্ট। আর আমি তোমার অন্তত চারগুণ বয়সী। ভয়ের কিছু নেই।
চমৎকার কথার মোহতে শাফিয়া ফেরাতে পারে নি ভদ্রলোকের অফারটা। চলে যায় আট তলার ফুডকোর্টে। ভদ্রলোকই অর্ডার দেয় বিচিত্র স্বাদের বিচিত্র নামের সব খাবার। সব মুখস্ত তার। এখানে প্রায়ই আসে নিশ্চয় এবং এভাবে কাউকে না কাউকে খাইয়ে সময় কাটায়। নিশ্চয় ধনবান হবেন। হৃদয়বানও বটে। অবিন্যাস্ত চিন্তায় একটু একটু করে খাচ্ছে শাফিয়া। বিদায়ের বেলায় ভদ্রলোক একটু মুচকি হেসে বলেছিল- ইচ্ছে করলে যখন তখন ফোন করতে পারো। ধানমন্ডির বাসায়ও বেড়াতে আসতে পারো। পারিবারিক কোন প্রব্লেম হবে না তোমার।
তারপর ফোনে কথা; দেখা-এখানে, ওখানে, বাসায়। এভাবে কেটে যায় বছরখানেক। এখন তো বেশ অন্তরঙ্গই। কথা-আড্ডায় খুব জমিয়েছে দোতলার এ বারান্দায় বসে। ওই তো মাস কয়েক আগের এক আড্ডায় শাফিয়া বেশ শিহরণ অনুভব করেছিল।
বিকেলেই আসে এ বাসায়।
দোতলার বারান্দায় বসে। লেকের ভিউটা চমৎকার লাগছে। কায়েস সাহেব আগে থেকেই চটপটি আনিয়ে রেখেছেন সামনের ফাস্টফুডের দোকান থেকে। ওরা বসার পরপরই জায়েদ গরম চটপটি নিয়ে আসে। চটপটি বেড়ে দিতে দিতে বলে, চা দিমু নানা?
- দিবি না মানে? একদম কড়া আর বেশি দুধ দিয়ে বড় কাপে চা নিয়ে আয়।
বিকেলের সোনালি রোদ এসে পুরো বারান্দাকে বেশ মোহনীয় করে তুলেছে। কায়েস হাসেম শাফিয়ার চোখে চোখ রেখে বলে, তোমাকে দারুণ লাগছে চমৎকার সাজে আকর্ষণীয় বক্ষেÑ যেন আমার দুলি।
কথাটা শুনে একটু লজ্জা পায়। তবু সৌজন্যবোধে বলেÑ আপনার সাথে দুলি ম্যাডামের রিলেশনটা খুব চমৎকার ছিল মনে হয়।
- ঠিক ধরেছ। মারা যাবার আগ পর্যন্ত নিতান্তই কোন কারণ ছাড়া আমরা আলাদা বিছানায় শুইনি। ও দারুণ মেয়ে ছিল।
- তাই বুঝি? এখন ওকে খুব মিস করেন তাই না?
- বটে! তবে তুমিও তার চে' কম নও। মনে হয় দুলি আমার সামনে।
- ধ্যাৎ ছাই কি যে বলেন। উনি কত সুন্দর। আর আমি সমাজের অপাংতেয়। আমাকে দেখে কেউ তো সুন্দর বলে না, বলতে পারে না। আপনি মনে হয় একটু বেশি বলে ফেলছেন।
- না, শাফিয়া না। তুমি ইচ্ছে করলে দুলির অভাবটা পূরণ করতে পার।
লজ্জায় মুচড়ে যায় শাফিয়া। তারপরই সিদ্ধান্ত নেয়, ওই লোকটির দুলির অভাব পূরণ করবে। তাকেই বিয়ে করবে। কিন্তু মা-ফ্যামিলি কি এ বিয়ে মানবে? বয়সের এ ব্যাবধান ফ্যামিলির কেউ মানবে না। বাবা-মা কন্যাদায়গ্রস্থ-তবু এ বিয়ে কি তারা মানবে? যুক্তি-টুক্তির আলোকেও কি এ সিদ্ধান্ত মানানো যাবে?
ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায় শাফিয়া।
চিন্তাটা মাথায় রেখেই এখনও সর্ম্পক বজায় রেখে চলছে শাফিয়া। যখন তখন ওই বাসায় যায়। গল্প করে। আড্ডা দেয়। নাস্তা করে। কখনো দুপুরে খাবারও খায়। কিন্তু ওই দিনের পর কায়েস সাহেব আর কখনো বলে নি দুলির অভাব পূরণের অর্থাৎ বিয়ের কথাটা।
কিন্তু আজ এত তাড়া করে ডেকেছে কেন? ব্যাপারটা বেশ ইনজয় করছে ড্রইং রুমের সোফায় বসে। এরই মাঝে কায়েস হাসেম আসেন। কুমিল্লার খদ্দরের ফতুয়ায় স্লিপিং টাউজারে রংয়ের কম্বিশনে বেশ লাগছে। ফুরফুরে মেজাজে একদম শাফিয়ার কাছে এসে হাতটা ধরে টেনে তুলতে তুলতে বলে-এখানে কেন? আমার ভেতরের রুমটায় চলো। এসি ছাড়া আছে। টায়ার্ডনেস কেটে যাবে।
শাফিয়া কোন কথা না বলে তার সাথে ভেতরের রুমে চলে যায়। এটা কায়েস হাসেমের বেড রুম। এ রুমে আগে কখনও ঢুকে নি; আজ তার সাথে চলে এসেছে। বেশ পরিপাটি। ভেতরে ঢুকতেই হিমেল পরশ গা ছুঁয়ে যায়। কায়েস সাহেব একটা চেয়ার টেনে বলেন চেয়ার কিংবা বিছানাÑযেকোন জায়গায় বসতে পারো। রেস্ট নাও। দুপুরের লাঞ্চ করব কিন্তু একসাথে।
কোন কথা না বলে শাফিয়া বিছানার কিনারেই বসে পড়ে। বেশ আরামদায়ক নরম বিছানা। কায়েস সাহেব শাফিয়ার বিপরীত কোণায় রাখা চেয়ারটায় বসেন। শাফিয়াই কথা তোলে- আপনার এ রুমটা দারুণ!
- সে জন্যেই তো তোমাকে এখানে আনা। গোছগাছ কেমন লাগছে?
- বাহ!
- আচ্ছা তুমি তো গরম থেকে এসেছ। রেস্ট নাও। গা-টা জুড়াও।
কথাটা বলে একটু থামেন কায়েস। তারপরই একটু মুচকি হেসে আবার বলেন- গা জুড়ালে হবে না, শরীরটা ভেতর থেকে গরম করতে হবে কিন্তু! প্রচ- গরম! উপরে ঠা-া, ভেতরে গরম; আহ্!
বোকার মত তাকিয়ে থাকে শাফিয়া। এ কী ধরনের কথা!
কায়েস হাসেম উঠে ওর পাশে এসে বসেন। তারপর হাতটা ওর কাঁধে রেখে বলেন- বুঝ নি? ভেতর থেকে গরম? সোজা কথা আমি তোমাকে নিয়ে আনন্দ করতে চাই। জীবন নিয়ে আনন্দ! এমন চমৎকার শীতল পরিবেশে আনন্দ উপভোগের মজাই আলাদা।
হতভম্ভ হয়ে যায় শাফিয়া।
কথা বেরোয় না মুখ দিয়ে? এ কোন কায়েস? একি বলছেন উনি! তবে কি শাফিয়ার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন তিনি? শারীরিক দুর্বলতার সুযোগ!
শাফিয়া জন্ম প্রতিবন্ধী।
স্বাভাবিক হাঁটাহাটি করতে পারে না। ছোট বড় পা-য়ে ওকে বিশেষ কুৎসিৎ এক ভঙ্গিমায় হাঁটতে হয়। তবে চেহারাটা ভীষণ মায়াবী। দারুণ একটা রোমান্টিক আকর্ষণ আছে। নারী সৌন্দর্যের পূর্ণতা তাকে দেখলেই পাওয়া যায়। তবু এ প্রতিবন্ধী শারীরিক পরিস্থিতির জন্যে কারো কাছ থেকে সহানুভূতির কথা শুনে নি কখনো। শারীরিক প্রতিবন্ধীতাই তার সে অপরূপতাকে ম্রিয়মান করে দিয়েছে।
পারিবারিক ম-লে মা ছাড়া আর কেউ একটু আদর সোহাগ করেছে- তা মনে করাই দুস্কর। বিয়ের প্রস্তাব বার বার এসে ফিরে গেছে।। বাবা বেশ ক'টি বিয়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি- এতবড় বন্ধু পরিম-লে শিখাই ওকে কাছে টেনে নিয়েছে। বন্ধুত্বের ভালবাসায় আগলে রেখেছে। আর জীবনের এ পর্যায়ে এসে আচমকাই আদর-ভালবাসা পেয়েছে, কাছে টেনেছে এ বৃদ্ধ কায়েস হাসেম। তার এ ভালবাসা কি তবে ওই দুর্বলতার সুযোগ? দুলির অভাবটা কি এ সুযোগে অনৈতিক আর অবৈধভাবে পূরণ করতে চান তিনি? এ বুড়ো বয়সে?
প্রচ- ঘৃণা এসে জমে মনে। এমন নিষিদ্ধ গল্পের অবতারণা তো চায় নি শাফিয়া।
- এই ...। তোমার জন্যে এত সুন্দর বিছানা। শীতাতপ আবেশের সজ্জার এমন আরামদায়ক কক্ষ কোথায় পাবে? জীবনের আনন্দটাই বড়, বুঝলে! শোন লক্ষ্মীটি! আনন্দ লুটে নাও। আনন্দ!
সেই প্রচ- আবেগী আর রোমান্টিক কথা কায়েস হাসেমের। কিন্তু শাফিয়া এবার ঘৃণা আর প্রচ- দৃঢ়তায় বলে- না।
- মানে!
কায়েস হাসেম ভীষণ চমকে পাল্টা প্রশ্ন করেন। তারপর আবার বলেন- এতদিন তোমাকে কেন ভালবাসলাম? ভালবাসার এত গিফ্ট কেন দিলাম? তুমি একটুও প্রতিদান দেবে না? এমন অকৃতজ্ঞ?
- হ্যাঁ দেব।
- এই তো লক্ষ্মী মেয়ে!
আনন্দে কায়েস হাসেমের মনে শিহরণ জাগে। কিন্তু শাফিয়া সাথে সাথেই আবার বলে- এক্ষুণি কাজী অফিসে চলুন।
কায়েস হাসেম ভীষণ চমকে ওঠেন। এ কি! চমক নিয়েই বলেন- কাজী অফিস! তার মানে আমার এ সম্পত্তির লোভ তোমাকে পেয়ে বসেছে? মেয়েরা চিনে শুধু সম্পদ, অর্থ। সুযোগ পেলেই...। তোমার কী আছে? তোমাকে যে আমি সঙ্গ দিয়েছি, ভালবাসা দিয়েছি আর আজ আনন্দ দিতে চাচ্ছি- এটাই তো বড় কথা। নচেৎ এমন ল্যাংড়া বাতিল মেয়ের দিকে কেউ তাকায়? কেউ মিশে? আমাদের পুরুষদের মান আছে না?
প্রচন্ড ঘৃণায় উঠে দাঁড়ায় শাফিয়া। জানালার দিকে যেতে যেতে বলে- মেয়েরা সম্পদ চিনে, কিন্তু পুরুষ? এ বুইড়া বয়সেও...! মান? ছি ... !
কথাটা আর শেষ না করেই জানালায় এসে দাঁড়ায়। সামনের লনটা স্পষ্ট দেখা যায়। অগোছালো আর বিচ্ছিন্ন ক'টি ফুল গাছের সেই লনটা। ফুল-টুল নেই। তবু এমন অসুন্দর ফুলবাগানে এ ভর দুপুরেই একটা কালো ভ্রমর উড়ছে।
এক দৃষ্টিতে শাফিয়া সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
#
দেখুন :
গল্প : প্রজাপতিView this link
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১১:৪৭