আব্দুল মুত্তালিব তার এক সন্তানকে বিসর্জন দিবে, ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য, ক্বাবার সামনে। কাকে দিবে বিসর্জন? সেটার ফায়সালা হওয়া দরকার। আব্দুল মুত্তালিব তার সন্তানদের সবাইকে ডাকল। আজ তার অনেক বছর আগের করা এক মান্নতের পরিণতি দিতে হবে। তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তান আব্দুল্লাহ। আব্দুল্লাকে তার এত মায়া লাগে কেন? ভয় হয় যদি আব্দুল্লাহকেই বিসর্জন দিতে হয়? তার প্রিয় যদি ঈশ্বরেরও প্রিয় হয়? তাহলে?
সে অনেকবছর আগের কথা। শুধুমাত্র এক সন্তানের জনক ছিল আব্দুল মুত্তালিব। মক্কার কঠিন সমাজে শুধু এক পুত্র সন্তান নিয়ে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকা অনেক কঠিন। যত বেশি পুত্রসন্তান তত বেশি মর্যাদা, আধিপত্য, এবং সম্পদ। আরো সন্তানের আশায় আব্দুল মুত্তালিব অনেকগুলো বিয়ে করেছে, কিন্তু কোনমতেই তার একের বেশি সন্তান হয়নি। শেষে কিছুটা বুড়া বয়সে আব্দুল মুত্তালিব এক মান্নত করল, যদি তার দশ সন্তান হয় এবং দশ সন্তানই বেঁচেবর্তে বড় হয়, তবে আব্দুল মুত্তালিব ঈশ্বরের প্রতি শোকরিয়া স্বরূপ এক সন্তানকে বিসর্জন দিবে, ক্বাবার সামনে।
ঈশ্বর তার সে প্রার্থণা কবুল করেছে, একে একে তার আরো নয়টা সন্তান হল, সবাই এখন বালেগ, টগবগে তরুন। দশ সন্তান যখন হল, আব্দুল মুত্তালিব তার মান্নতের কথা মনে করছিল, যতই সন্তানরা বড় হচ্ছে ততই তার মান্নতের কথা বেশি মনে পড়ছিল, আব্দুল্লাহ তার দশম সন্তান (আব্দুল্লার পরেও তার সন্তান হয়েছিল)। যখন মান্নত করেছিল তখন মনেই হয়নি কোনদিন তার দশ সন্তান হবে, ভেবেছিল মান্নত করলে সমস্যা কি, ঈশ্বর নিশ্চয়ই তাকে দশ দশটা সন্তান দিবেনা বুড়ো বয়সে। কিন্তু সেটাই সত্যি হল, এখন এক সন্তানকে বিসর্জন দিতেই হবে। তার মনের মধ্যে খুবই উতাল পাতাল করে উঠল, এই কষ্ট সে সহ্য করতে পারবে? কিন্তু আব্দুল মুত্তালিব এক কথার মানুষ, ঈশ্বরের কাছে মান্নত সে কোনদিন ভাংতে পারবেনা।
আজ সেদিন এসে পড়ল, কুরবানির দিন। কিন্তু কোন সন্তানকে কুরবানি দিবে? আব্দুল মুত্তালিব খুবই সুবিচারক, তাই সে নিজে কাকে কুরবানি দিবে সেটার ভার নিজের উপর নিবে না, নিজে নিলে পক্ষপাতিত্ব করতে পারে, সেটা করা যাবে না। সব সন্তানকে ডাকল সে, সবাইকে নিজের মান্নতের কথা বলল। সন্তানরা জানে ক্বাবার ঈশ্বরের কাছে করা মান্নত অবশ্যই ভাঙা যাবেনা, তাছাড়া তাদের পিতার মান্নত তাদেরও মান্নত। তাই রাজি না হয়ে উপায় ছিল না তাদের।
সব ছেলে নিজেদের নামে একটা করে দাগ টানল একেকটা তীরে। এরকম বিসর্জন আরো অনেক হয় মক্কায়, তার জন্য একজন বিশেষ নিয়োজিত তীর বাছাইকারি আছেন, যিনি লটারির মাধ্যমে তীর বাছাই করে যার নামে আসবে তাকেই বিসর্জন দেওয়া হবে। ইতিমধ্যেই বিসর্জন দেখার জন্য অনেক লোক হাজির হয়েছে, সবাই আগ্রহ নিয়ে দেখছে। আব্দুল মুত্তালিব তার লম্বা এবং ধারালো ছোরা নিয়ে দাড়িয়ে আছে, ক্বাবার হুবালের পাশে, মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনারত অবস্থায়। তীর বাছাইকারি বাছাই করা শেষ, নাম আসল আব্দুল্লাহর! আব্দুল মুত্তালিব দেরি না করে আব্দুল্লাহকে হাতে ধরে ক্বাবার দরজার দিকে নিয়ে গেল, দেরি করলে আবার মন পরিবর্তন হয়ে যাবে, মায়া লেগে যাবে, তাই তাড়াহুরা।
কিন্তু আব্দুল মুত্তালিব তার স্ত্রীদের সাথে পরামর্শ করতে ভুলে গেছিল। বিশেষ করে আব্দুল্লাহ্র মা ফাতিমার সাথে। ফাতিমা ক্বোরাইশের মেয়ে, তাই তার অনেক প্রভাব। তাকে না বলে তার সন্তানকে কুরবানি দিলে সেটা মহা কেলেংকারি হয়ে যাবে। ততক্ষণে সবখানে খবর চলে গেছে। ফাতিমার মাখজুম গোত্রের লোকরা সবাই চলে এসেছে, তারা বুঝল তাদের বংশের নাতিকেই কুরবানি দেওয়া হবে। তারা সমস্বরে জিজ্ঞেস করল, ছোরাটা কিসের জন্য? আব্দুল মুত্তালিব তাদেরকে নিজের মান্নতের কথা বলল। মাখজুমের প্রধান নেতা মুঘিরাহ চেঁচিয়ে বলল, "না আব্দুল্লাহকে কুরবানি দেওয়া যাবেনা। বরং তার বদৌলতে অন্য কোন কুরবানি দাও, যদি সেটার দাম মাখজুম গোত্রের সবার সম্মিলিত সম্পত্তির পরিমাণও হয়, আমরা সেটা দিতে রাজি আছি, কিন্তু কোনমতেই আব্দুল্লাহকে কুরবানি দেওয়া যাবেনা।"
আব্দুল মুত্তালিবের অন্যান্য সন্তানরাও আব্দুল্লাহকে অসম্ভব ভালবাসে, তারাও পিতাকে অনুরোধ করলে যেন আব্দুল্লাহর বদৌলতে অন্য কিছু কুরবানি দিতে কাফফারা হিসেবে। আদতে ভীরের মধ্যে একজন লোকও ছিলনা যে আব্দুল মু্ত্তালিবকে কুরবানি না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলনা। আব্দুল মুত্তালিব নিজেও মনে মনে কুরবানি দিতে চাচ্ছিলনা তার সবচেয়ে প্রিয় পুত্রকে, কিন্তু ওয়াদা ভাঙতে খুবই আপত্তি তার। অনেক অনুরোধের পর আব্দুল মুত্তালিব রাজি হল ইয়াথরিব শহরের এক বিজ্ঞ মহিলা পীরের সাথে পরামর্শ করতে। ইয়াথরিবের দিকে রওনা হল, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল সে বিজ্ঞ মহিলা অনেক দূরের খায়বারে চলে গেছে। তার সেদিকেই রওনা হল। মহিলা পীর সব শুনল, বলল সে পরের দিন সাধনা করে জানাবে। পরের দিন যখন ফিরে গেল, মহিলা বলল, "তোমাদের ওখানে মানব বিসর্জনের বিপরীতে কাফফারা কি?" আব্দুল মুত্তালিব বলল, "দশটা উট"। বলল, "তোমরা মক্কায় ফিরে যাও, গিয়ে এক পাল্লায় তোমার ছেলেকে দাড় করাও, অন্য পাল্লায় দশ উট। তারপর লটারি কর, যদি উটের দিকে যায়, তাহলে দশ উট বিসর্জন দাও। যদি তোমার ছেলের দিকে লটারি যায়, তাহলে আরো দশ উট যোগ কর, এভাবে যতক্ষন লটারি উটের দিকে না যাচ্ছে ততক্ষণ দশটা করে উট যোগ করে পূনরায় লটারি কর। যেবার উটের দিকে পড়বে, বুঝবে ঈশ্বর তোমার কাফফারা গ্রহণ করেছে।"
আব্দুল মুত্তালিব আব্দুল্লাহকে নিয়ে ফেরৎ আসল মক্কায়, লটারি চালু হল। কিন্তু লটারি পড়ল আব্দুল্লাহর দিকে। দশটা উট যোগ করল, এখন হল বিশ উটের বিপরীতে আব্দুল্লাহ। আবার লটারি হল। আবারও আব্দুল্লাহর দিকেই পড়ল। এভাবে প্রতিবারই আব্দুল্লাহর দিকে পড়তে থাকল লটারি, প্রতিবারই দশটা করে উট যোগ হল। এরকম করতে করতে একশটা উট একপাাশে হল, অন্যদিকে আব্দুল্লাহ। এবার উটের দিকে লটারি গেল। তার মানে একশটা উট বিসর্জন দিলে আব্দুল্লাহকে কুরবানি দিতে হবে না। কিন্তু আব্দুল মুত্তালিবের মনে খটকা রয়ে গেল, বলল আবার লটরাি কর। একশটা উটের বিপরীতে আব্দুল্লাহ, আবার লটারি হল, এবার আবার উটের দিকেই লটারী পড়ল। আব্দুল মুত্তালিব বলল, "না, আবার কর।" আবার লটারিতে উটের দিকেই পড়ল। তিনবার পরপর উটের দিকে লটারি পড়ার পর আব্দুল মুত্তালিবের মনে হল এবার ঈশ্বর তার কুরবানি গ্রহণ করেছে। একশটা উট কুরবানি দেওয়া হল।
***** সবাই হাঁফ ছেড়ে বাচল! কি কঠিন পরীক্ষার উপর দিয়ে যে গেল আব্দুল্লাহ্র জীবন। শেষে আব্দুল্লাহ বেঁচে ফিরল। আব্দুল্লাহর বেঁচে থাকা দরকার ছিল। কেননা, আব্দুল্লাহর মাধ্যমেই মুহাম্মদ (সাঃ) পৃথিবীতে আসবেন সামনের বছরেই, আব্দুল্লাহর সাথে আমিনাার বিয়ের পর।*******
(মার্টিন লিংসের মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবনি Muhammad: His Life Based on the Earliest Sources বইয়ের ভাবগত অনুবাদ, পৃষ্ঠা ১৩-১৪। এস্টেরিস্কের মধ্যে শেষ কয়েকটা লাইন আমার নিজের।)