আপনি যখন বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে ধর্মকে বা ধর্মের ঐশীবাণীর সত্যতা প্রতিষ্ঠা করতে চান, তখন আদতে আপনি বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিছেন। আপনি বিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড ধরে নিয়ে সে স্ট্যান্ডার্ডে ধর্মের যুগোপযোগিতা পরীক্ষা করছেন। আপনার কাছে ধর্মের দর্শনের শ্রেষ্ঠত্ব মাপের দাড়িপাল্লা হয়ে গেল বিজ্ঞান। এইটা খুবই ভয়ংকর, এবং সাময়িকভাবে এটা কিছু লোকের কাছে খুবই জনপ্রিয় হলেও এটার দীর্ঘকালীন প্রভাব ধর্মের জন্য অপরিসীম ক্ষতির কারন হতে পারে। এই কর্মে যে একধরনের শির্ক-এর ছায়া লুকিয়ে আছে, সেটা বুঝা জরুরী।
বিজ্ঞান ইনডাকটিভ রিজনিং ব্যবহার করে। দর্শন, বিশেষ করে ধর্মের দর্শন ডিডাকটিভ রিজনিং ব্যবহার করে। ডিডাকটিভ রিজনিং ইনডাকটিভ রিজনিং থেকে শ্রেয়তর এবং কোন উপসংহারের ১০০% সত্যতার নিশ্চয়তা দেয়, যদি অনুমিতিগুলো সত্য হয়। ইনডাকটিভ রিজনিং আপনাকে কোনদিনই কোন উপসংহারের ১০০% সত্যতার নিশ্চয়তা দিবে না, এমনকি অনুমিতিগুলো সব সত্য হলেও। যেমন গণিতের প্রমাণের ধরণ হচ্ছে ডিডাকটিভ রিজনিং, এটাতে নিশ্চিত প্রমাণ (proof) করা যায়, proof-এর ব্যাখ্যা নৈর্ব্যক্তিক। এজন্যই গণিত আদতে (প্রাকৃতিক) বিজ্ঞান না, বরং এটা লজিক/দর্শনের অংশ। আর মাল্টিভার্স থিয়রী বা বিবর্তনবাদ হচ্ছে বৈজ্ঞানিক থিয়রী, যেটার জন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ (evidence) আনা যায়, কিন্তু কোনদিন নিশ্চিত প্রমাণ (proof) করা যায় না। এই এভিডেন্স কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন সেটাও আপেক্ষিক, নৈর্ব্যক্তিক না।
ধর্মের যে যুক্তি সেটা দর্শনের অন্তর্ভুক্ত, সেটার জন্য ডিডাকটিভ রিজনিং লাগে, সেটা বিজ্ঞানের যুক্তি থেকে অনেক উপরে। যেমন সৃষ্টিকর্তা আছেন, এটা দার্শনিক যুক্তি, বৈজ্ঞানিক যুক্তি না, এবং এই পার্থক্যটা বুঝা অনেক জরুরী। সৃষ্টিকর্তা থাকলে তিনি মানুষ সৃষ্টির জন্য কোন উদ্দেশ্য রেখেছেন, এবং সে উদ্দেশ্য তিনি ঐশীবাণীর মাধ্যমে আমাদেরকে জানাচ্ছেন, এসব দার্শনিক যুক্তি, বিজ্ঞানের আওতার বাইরে। যারা ধর্মকে বিজ্ঞানের পাল্লায় মাপার জন্য মরিয়া হয়ে আছেন, আমি আপনাদের সততা এবং একাগ্রতা নিয়ে সন্দেহ করছিনা, আপনারা ধর্মকে ভালবেসেই এটা করছেন। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আরো বড় ক্ষতি করছেন কিনা সেটা ভেবে দেখা জরুরী। সেজন্য আমার অনুরোধ আপনারা আগে লজিকের এসব বিষয় ভালমতে বুঝতে চেষ্টা করেন।
উপরে যা বললাম তা থিয়রি/তত্ত্বকথা, বাস্তবে যদি আসেন আধুনিক জামানার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির রাজনীতি/দর্শন সেসব নিয়েও বুঝা জরুরী। যেমন আধুনিক জামানায় একাডেমিক বিজ্ঞানচর্চাটাই এমন যে এখানে সব সত্য কোনদিন প্রকাশ সম্ভব না। ধরেন কোন রিসার্চার প্রমাণ পেল বিবর্তনবাদ ভুয়া, সেটা তিনি কোনদিনই প্রকাশ করতে পারবেন না, তাঁর ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে, তাকে মার্জিনালাইজ করা হবে। শুধু তাই না, সে রিসার্চার নিজেই তার এভিডেন্স বিশ্বাস করবে না, মনে করবে তিনি এক্সপরিমেন্টে কোথাও ভুল করেছেন, তারপরে যতক্ষণ পর্যন্ত না বিবর্তনবাদের সমর্থনে প্রমাণ পাচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এক্সপেরিমেন্ট চালাবেন, অথবা এই এক্সপেরিমেন্টটাই বন্ধ করে দিবেন। এখন ধরেন এরকম হাজার হাজার এক্সপেরিমেন্টর প্রমাণ যেহেতু কোনদিন দিনের আলো দেখবেনা, আমরা শুধু সেসব প্রমাণই পাব যা বিবর্তনবাদকে সমর্থন করে। যেসব প্রমাণ বিবর্তনবাদকে প্রশ্ন করে, সেরকম হাজার হাজার লোক প্রমাণ পেলেও সেটা আমরা জানতে পারব না।
তাছাড়া যে লোক ইতিমধ্যেই বিবর্তনবাদ নিয়ে মগজধোলাই হয়ে গেছে পিএইচডি প্রোগ্রামে এবং পোস্টডকে, সে তার এক্সপেরিমেন্টকে সবসময়ই এই বিবর্তনবাদের লেন্স দিয়েই দেখবে, তার ধোলাইকৃত মগজ তাকে এক্সপেরিমেন্টের প্রমাণকে বিবর্তনবাদের সাথে সামন্জস্যপূর্ণ হিসেবেই দেখাবে। তার মানে আমাদের কাছে আসল সত্য কোনদিনই প্রকাশ হবে না। মনে রাখবেন প্রমাণকে (evidence) ইন্টারপ্রেট করে মানুষ, এবং সে মানুষ/বিজ্ঞানী সবসময়ই পক্ষপাতে দুষ্ট। এর পরে আছে groupthink বা চিন্তার গোষ্ঠীবদ্ধতা। যেহেতু একটা একাডেমিক ডিসিপ্লিনের লোক নিজেদের মধ্যেই কথা বলে সবসময়, তারা নিজেদের বায়াসগুলোকে ক্রমাগত শক্তিশালী (reinforce) করে, যা পরবর্তীতে তাদের এভিডেন্স ব্যাখ্যা করাতে প্রভাব ফেলে।
বিবর্তনবাদ যেমন একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এরচেয়ে এটা ঢের বেশি রাজনৈতিক তত্ত্ব, বিজ্ঞান তাই সেটা ভুল প্রমান করলেও সেটা টিকিয়ে রাখার জন্য রাজনৈতিক ফোর্স আছে। সমস্ত বস্তুবাদ, এবং পুঁজিবাদের বড় অংশ দাড়িয়ে আছে বিবর্তনবাদের উপর, বিবর্তনবাদ ফুটলে বস্তুবাদও ফুটে যাবে। সকল জ্ঞান এবং জ্ঞানচর্চাই রাজনৈতিক, বিজ্ঞানচর্চা আরো বেশি রাজনৈতিক। এবং রাজনৈতিক দর্শন কোনটাকে আমরা সত্য বলব, কোনটাকে মিথ্যা বলব সেটার উপর প্রভাব বিস্তার করে।
এরপর আছে ডাটাকে পরিসংখ্যানের frequentist বা bayesian কোন দর্শন দ্বারা ব্যাখ্যা করবেন, এই দুইটা পদ্ধতি একই ডাটা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন উপসংহার দিতে পারে।
এখানে আপনাকে বিজ্ঞানের রাজনীতি বুঝতে হবে, বিজ্ঞানের অর্থনীতি, বিজ্ঞানের দর্শন বুঝতে হবে। বিজ্ঞান বাস্তবে কিভাবে চর্চা হয় সেটার পুংখানুপুংখ বুঝতে হবে। তাই আপনারা বিজ্ঞানকে এবং বিজ্ঞানচর্চাকে যেরকম একটা আদর্শ দরবেশীয় পদ্ধতি হিসেবে দেখেন সেটা যাস্ট থিয়রী, বাস্তব অনেক ভিন্ন। এসব ভালমতে বুঝার আগে ধর্ম বা বিজ্ঞান নিয়ে তর্কাতর্কি করে ধর্মের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি কইরেন না।
আপনার যদি ধর্মকে ডিফেন্ড করার ইচ্ছে থাকে, তাহলে প্রথমে আল-গাজ্জালি পড়েন। ইমাম গাজ্জালির মত মেধাবী দার্শনিক কোনদিন আসেনি, সক্রেটিস বা প্লেটোর চেয়ে ইমাম গাজ্জালি অনেক এগিয়ে আমার মতে। ইমাম গাজ্জালি পড়লে এসব নাস্তিকদের যুক্তি খড়খুটোর মত উড়ে যাবে। তাই সেখান থেকে শুরু করেন। এটার কোন তরিৎ সমাধান নেই, সমাধান একমাত্র ইসলামের পূর্বেকার জায়ান্ট স্কলারদের কাছে ফিরে যাওয়া। সেজন্য অনেক পরিশ্রম করতে হবে, অনেক সময় দিতে হবে। তবে সেটার ফল উম্মাহ্র জন্য, ইসলামের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সুফল বয়ে নিয়ে আসবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ১২:৩৯