লোকে আমারে জিগাইছে অনেকবার ইসলামি রাজনৈতিক দল নিয়ে আমার চিন্তাভাবনা কি? বাংলাদেশে জামাতের কপালে একাত্তরের ভুল সাইডে থাকার এবং রাজাকারির কালিমা লেপন আছে, বর্তমান সরকারের আমলে বিচার হলেও সে কলংক যাবে বলে মনে হচ্ছে না কোনদিন। কিন্তু ধরেন ইসলামি দল গঠিত হল, যার এরকম কোন কলংক তিলক নাই, সেরকম দল সম্পর্কে আমার ভাবনা কি?
আমার ধারণা ইসলামী দল ইসলামের জন্য খুবই খারাপ। কেন সেরকম মনে করি সেটার জন্য উদাহরন জরুরী। বর্তমান আ'লীগ সরকার চেতনার উপর খাড়ায়া আছে। অথচ দেখেন মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের জনগনের সবচাইতে গৌরবময় অর্জন। কিন্তু আ'লীগ যত বেশিদিন অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকবে তত বেশি মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত চিহ্ন, সমস্ত ইতিহাস, এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চর্চাকারী মানুষগুলো বাংলাদেশের সাধারণ জনগন থেকে তত দূরে চলে যাবে এবং ঘৃণার পাত্র হয়ে যাবে। এর কারন হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সরকারের এবং সরকারপক্ষীয়দের অবৈধ ক্ষমতায় থাকার লেবাস হিসেবে কাজ করছে। যদিও মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সকলের মহান গৌরবময় অর্জন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে অপশাসনের লেবাস হিসেবে ব্যবহার করায়, সেই লেবাসও মূলত ঘৃণার উদ্রেক করছে।
ইসলামী দল ক্ষমতায় গেলে ইসলামের অবস্থাও একই হবে, সাধারণ মানুষ দেখবে সরকারর অপশাসন, দূর্নীতি, লুটপাট এসবের লেবাস ইসলাম। ইসলামী দলের লুটপাট বিরোধী কথা বললে সেটা তখন সে ইসলামী দল ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলার মতই মনে করবে। শুধু তাইনা, জাফর ইকবালরা যেমন এখন লীগের বিপক্ষে কথা বলতে পারেনা কেননা তাদের ভাবতে হয় সেরকম বললে চেতনাবিরোধী লোকজন ফায়দা নিবে, ইসলামী দলের ক্ষেত্রেও ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবিরা অন্যান্য দল বা দলীয় লোকরা যাতে ফায়দা না নিতে পারে সেটা ভেবে ইসলামী দলের অপশাসনের বিপক্ষে মুখ খুলবেনা। ফলাফল হবে এই যে লোকের অন্তর থেকে ইসলামের ভাব ক্রমান্বয়ে চলে যাবে। ইসলাম যেহেতু অপশাসনের লেবাস হবে, সেজন্য সে লেবাসকে ঘৃনা করা ছাড়া সাধারণ লোকের উপায় থাকবেনা।
আমি চাইনা ইসলামকে লোকে ঘৃণা করুক। তাই ইসলামী লেবাসের দল ক্ষমতায় যাক আমি চাইনা। এখন আপনি বলতে পারেন ইসলামী দল সুশাসনের নিশ্চয়তা দিলে, সুশাসন জারি রাখলে, তখন তো আমার অভিযোগ ধোপে টেকেনা। যারা মনে করে ইসলামী দল এসে বাংলাদেশকে সুশাসনের বন্যায় ভাসিয়ে দেবে, তারা আসলে সুশাসন করা কত কঠিন সেটা সম্পর্কে ধারনা রাখেনা। সারা দুনিয়ায় কোন গণতান্ত্রিক দেশেই এমন কোন রাজনৈতিক দল নাই, যাদেরকে অন্তত সে দেশের অর্ধেক লোক অপছন্দ করে না। বিশেষ করে ক্ষমতায় গেলেই যে কোন রাজনৈতিক দল ক্রমান্বয়ে অজনপ্রিয় হতে থাকে, এর বিপরীতে ব্যতিক্রম এত কম এবং দুষ্প্রাপ্য যে সেটার উপর বাজি ধরা পাগলামি।
ক্ষমতা মাত্রই নোংরামি এবং দূর্নীতির জন্ম দেয়। এজন্য দেখেন হাজার বছর মুসলমানরা শাসন করেছে বিশ্বের বড় একটা অংশ। এ শাসনের সময়কালে হাজার হাজার শাসক শাসনক্ষমতার ভার পেয়েছে। এদের মধ্যে প্রথম চার খলীফা, উমার বিন আব্দুল আজিজ (রঃ), সালাউদ্দিন আইয়ুবীর মত খুব বেশি হলে ৫-১০ জন শাসককে সুশাসক বলা যায়, এর বিপরীতে জালিম শাসকের সংখ্যা অনেক বেশি। রাসুল (সাঃ) বলেছেন তাঁর মৃত্যুর পর মাত্র ত্রিশ বছর সুশাসন জারি থাকবে, তারপর সুশাসন ঢিলা হতে থাকবে। প্রথম চার খলিফার শাসনকাল এই ত্রিশ বছরই ছিল। রাসুল (সাঃ)-র এই হাদিস নিয়ে আমাদের চিন্তা করা উচিৎ। মুসলমানদের স্বর্ণযুগে শাসকরা যেভাবে শাসন করেছে, তার চেয়ে বর্তমান দুনিয়া হাজার গুনে বেশি জটিল, তাই শাসনব্যবস্থাও হাজার গুনে জটিল। বর্তমানে তাই ইসলামী দল এসে সুশাসন জারি রাখার সম্ভাবনা আরো কম। প্রথম কয়েক বছর হয়ত সুশাসন থাকবে, এর পরে আবার দুঃশাসন শুরু হবে। এটাই ক্ষমতার বৈশিষ্ট্য, এর বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। এবং যখনই দুঃশাসন শুরু হবে, তখনই ইসলামী দল তাদের দুঃশাসনকে ইসলামের চেতনার নাম দিয়ে হালাল করতে চাইবে, অপশাসনকে ইসলামের নামেই চালিয়ে দেবে। আর ক্রমান্বয়ে ইসলামের লেবাসের প্রতি মানুষের ঘৃনা সৃষ্টি হবে।
ইরানে এখন শহরগুলোতে মসজিদে শুক্রবারেও বেশি মানুষ জুমার নামাজে আসেনা। ইরানের লোক দেশের বাইরে আসতে পারলেই ইসলামবিদ্বেষী হয়ে যায়। পশ্চিমে এসে দেখেছি এখানে যেসব মুসলমান জন্মগতভাবে মুসলমান হয়েও নাস্তিক/ইসলামবিদ্বেষী হয়েছে, তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ইরানী। ব্যাপারটা এমন যে ইরানী লোক যারা পশ্চিমে আছে তাদের মধ্যে মুসলমান পাওয়াই ভাগ্যের ব্যাপার, প্রতি ১০০ জনে হয়ত আপনি ৫-১০ জন মুসলমান পাবেনা। অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্র উল্টো, বাংলাদেশ থেকে মানুষ পশ্চিমে এসে আরো ধার্মিক হয়ে যায়, এমনকি যারা দেশে থাকতে ইসলামকে তেমন পছন্দ করতনা, তারাও দেখা যায় ইসলামী ভাবাধারাপন্ন হয়ে যায়। এর কারন কি? কারন হচ্ছে ইরানে শাসকরা ইসলামী লেবাস পড়া অবস্থায় আছে। অথচ ইরানের শাসনব্যবস্থা আসলে চরম খারাপ বলা যায় না, বরং তাদের সেখানে দূর্নীতির পরিমান অনেক উন্নত দেশ থেকেও কম বলা যায়। তবুও ইসলামের লেবাস দিয়ে শাসকরা তাদের শাসনকে জারি রাখে বলে মানুষ দলে দলে মুসলমানিত্ব বাদ দিয়ে অমুসলিম হয়ে যাচ্ছে। আর আমাদের দেশের বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মত যদি ইসলামের চেতনা দিয়ে অপরিসীম দুঃশাসন জারি রাখার চেষ্টা হয়, তখন মনে হয় ইরানের উদাহরন চিন্তা করলে একজন শিক্ষিত মানুষও মুসলমান থাকতে রাজি থাকবেনা। কিন্তু দুনিয়ার ক্ষমতার জন্য মানুষের আখেরাত নষ্ট করার কোন যৌক্তিকতা নাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ১২:৪৬