ডিজ্যুস - শব্দটার মধ্যে কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম বেহায়াপণা আছে, একটা চটকদারীতা আছে। যদিও এটি বাংলা কোন শব্দ নয়, তথাপি শব্দটি দেদারসে ব্যবহৃত হচ্ছে একটি জেনারেশনকে চিহ্নিত করার জন্য। আচ্ছা - একটা মোবাইল কোম্পানীর একটি প্যাকেজের নাম দিয়ে একটি যুগকে অভিহিত করা - এটা কি খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো না? হবে হয়তো। কিন্তু হলেও কিছুই করার নেই।
২০০৫ সালে গ্রামীণফোনের মোড়কে যখন ডিজ্যুস এ দেশে এসেছিলো তখন তাদের লক্ষ্য ছিলো একটাই। তরুণ সমাজকে আকর্ষণ করা। আমাদের তরুণ সমাজ তখনও ইন্টারনেট ব্যবহারে গোপণীয়তা বজায় রাখতো, গার্লফ্রেন্ড নিয়ে জনসাধারণের দৃষ্টির বাইরে এমন স্থানে যেতো। But all this was about to change. ডিজ্যুস বুঝে গিয়েছিলো তরুণ সমাজকে আকর্ষণ করার উপায় একটাই। তাদেরকে একটা কৃত্রিম স্বাধীনতা উপহার দেয়া, নিজস্ব একটি ট্রেন্ড গড়ে দেয়া। ডিজ্যুস ছাড়লো তাদের সেই বিখ্যাত সারারাত ডিজ্যুস-টু-ডিজ্যুস ফ্রিতে কথা বলার অফার। আমাদের তরুণ সমাজ নিশাচর প্রাণীতে পরিণত হলো। আমাদের ভাষাকে প্রভাবিত করতে লাগলো ডিজ্যুসের বাংলিশ বিজ্ঞাপণগুলো। আর আমাদের তরুণ সমাজ স্বাভাবিকের চেয়ে ভিন্ন কিছুর আমোদে মেতে উঠলো।
ভাষা: ডিজ্যুস যুগের দ্বারা দৈনন্দিন জীবনের সবচেয়ে প্রভাবিত ক্ষেত্রটি বোধহয় ভাষা। ডিজ্যুস যুগ আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে - মাম্মাহ্, জট্ট্টিইইল, কট্ঠিইইন, জোশ, আবার জিগস্, পাঙ্খা শব্দগুলোর সাথে। তবে শুধু নতুন শব্দ নয় ডিজ্যুস যুগ ভাষাকে প্রভাবিত বাংলার সাথে ইংরেজীর সংমিশ্রনে। বাংলা ইংরেজীর জগাখিচুড়িই বলি আর 'বাংলিশ'ই বলি না কেন, ব্যাপারটা মোটেও নতুন নয় - এটা ডিজ্যুস যুগের আগেও ছিলো। কিন্তু হয়তো এতোটা ব্যাপক আকারে নয় যতোটা এখন। আপনি মানুন আর নাই মানুন, 'বাংলিশ' এখন একটা স্ট্যান্ডার্ড ল্যাঙ্গুয়েজে পরিণত হয়েছে - অন্ততঃ একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্যতো অবশ্যই। FM রেডিওগুলোর RJদের মাধ্যমে বিষয়টা আরো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আরো একটি ভাষাগত পরিবর্তন এসেছে এ যুগে - অশুদ্ধ বাংলা বলা। এ পরিবর্তনটা এসেছিলো মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর নাটকগুলোর সংলাপের সৌজন্যে। এ সংলাপগুলোয় একাধিক শুদ্ধ বাক্যের পরে একটি বাক্যের মাঝে জুড়ে দেয়া হতো - করতেসি, খাইতেসি, করসো, গেসো এ ধরণের শব্দ। কম কথাকথি-তর্কাতর্কি হয়নি এ বিষয়টি নিয়ে। তবে কালের আবর্তণে এসবের অনেক কিছুই এখন আর কোন ইস্যু নয়।
ডিজ্যুস যুগের ভাষার একটা নমুনা পাবেন ব্লগার রিয়াজ শাহেদের একটি কমেন্টে:
রিয়াজ শাহেদ বলেছেন: এইটা গত রমজানের সময় শুনছিলাম-
"হাই ডিয়াড় লিসেনাড়স এখন আমড়া ফর আ হোয়াইল ব্রেকে চলে যাচ্ছি কাড়ণ মাগড়েবের আযানেড় টাইম হয়ে গেছে আর জানেনতো এই ড়মজানে মাগড়েব মিনস ইফটাড়ি আর ইফটাড়ি মানেই হলো ফ্যাসিনেটিং সব খাবাড়দাবাড়। সো এখন কোড়ান তেলাওয়াট হবে লেটস টেক আ ব্রেক ব্রেকের পড় ফিড়ে আসবো মজাড় মজাড় ড়কিং হট সব গান নিয়ে। আউযুবিল্লহিমিনাশশাতোয়ানিররাজীম (তেলাওয়াত শুরু হয়া গেছে)...
গান: হাবিব, ফুয়াদ, বালাম, তপু, অর্ণব, আনিলা, মিলা, বালাম আর হৃদয় খানদের হাতে রচিত হয়েছে ডিজ্যুস যুগের সঙ্গীতক্ষেত্র। আর্টসেল, ব্ল্যাক, অর্থহীনেরা মাতিয়েছে ডিজ্যুস যুগের তরুণদের। গানের রিমিক্স এ যুগের আগেও হয়েছে, কিন্তু তরুণ সমাজর কাছে সাফল্য বা পূর্ণতা ডিজ্যুস যুগে এসেই। রিমিক্স ভালো নাকি খারাপ এ নিয়ে বিতর্কে যাবো না - কিন্তু তরুণ সমাজের কাছে বাংলা গানকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে কিন্তু এই রিমিক্স গানগুলোই। হাবিব আর ফুয়াদদের গান 'কণ্ঠসঙ্গীত না যন্ত্রসঙ্গীত' সেটা বলার আগে দেখা দরকার কতো শ্রোতাকে আবার বাংলা গান শুনতে আগ্রহী করেছে গানগুলো। তরুণ সমাজের হিন্দি গান নির্ভরশীলতা এখন অনেকটাই দূর হয়েছে বলে আমার ধারণা। অবশ্য এ জন্য FM রেডিওগুলোও কৃতিত্ব পাবে অনেকখানি। তারাই আমাদের তরুণদেরকে বলেছে - "দেখো, আমাদের গানও কতো ভালো হতে পারে।" খারাপ যেটা হয়েছে সেটা হলো ক্রিয়েটিভিটির অভাব।
চলচ্চিত্র, নাটক, মিডিয়া: দুঃখজনকভাবে ডিজ্যুস যুগে এসেও এই একটা যায়গাতে তেমন কোন পরিবর্তন নেই। আমাদের চলচ্চিত্রের গুণগত মানের পরিবর্তন হয়েছে খুব সামান্যই। আসলে দেশে চলচ্চিত্র হয় খুবই কম। চাকবুম-চাকবুম নৃত্য সমৃদ্ধ আমাদের এফডিসির বাই-প্রোডাক্টকে আমি চলচ্চিত্র বলতে খুবই নারাজ। আর চলচ্চিত্র যেগুলো বা হয় সেগুলো দেখলে মনে হয় যেন মূল প্রয়াসটা হলো দর্শককে শান্ত কিছু উপহার দেয়া, ক্রিয়েটিভিটি দেখানো নয়। আমাদের ডিজ্যুস জেনারেশন মনপুরা, থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার বা গহীনে শব্দ দেখতে বসুন্ধরায় সিনেপ্লেক্সে যায় হয়তো ঠিকই, কিন্তু এটাও জানে যে ভালো ম্যুভি বলকে যা বোঝায় তা তারা পাবে না।
টিভি নাটকের দর্শক এখন খুবই কম। এক ঘন্টার নাটকতো আরো আগেই বিলুপ্ত। ডিজ্যুস যুগের যে নাটকগুলো ডিজ্যুস জেনারেশনকে আকর্ষন করা জন্য বানানো হচ্ছে সেগুলোর বিষয়বস্তু রাখা হচ্ছে এ জেনারেশনের মনের মতো - ফেইসবুক, ডেটিং প্রভৃতি। আর সংলাপের কথাতো আগেই বলেছি ফারুকীর নাটকের কথা বলার সময়।
মিডিয়ায় এখন ডিজ্যুস জেনারেশনের আনাগোনা ও অংশগ্রহণ আগের চেয়ে অনেক বেশি, বিশেষতঃ মেয়েদের। শখ, সারিকা, প্রভাদের আগে কোন মডেল নিয়ে এ জেনারেশনের মাথাব্যথা তেমন একটা ছিলো না।
শিক্ষা ও ক্যারিয়ার: ডিজ্যুস যুগে শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অগ্রগতি বোধোহয় প্রাইভেট ভার্সিটির কনসেপ্টটির সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে এ পর্যন্ত আসতে। প্রাইভেট শুনলে আগে মানুষ যেমন ছ্যা ছ্যা করতো এখন তা পুরোপুরিই বিলুপ্ত।
ক্যারিয়ার নিয়ে ডিজ্যুস জেনারেশন অনেক বেশি সচেতন। লেখাপড়া শেষ করার আগেই নিজের জন্য একটা শক্ত প্ল্যাটফর্ম বানানোর প্রচেষ্টা সবার মধ্যেই কাজ করছে। তবে পড়াশোনার যান্ত্রিকতাটাও বাড়ছে একইসাথে পাল্লা দিয়ে। মাঝে মাঝে "থ্রি ইডিয়টসরা" এসে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সে কথাটাই। আসলে চাইলে এ জেনারেশনকে পড়াশোনা আর ক্যারিয়ারের ভিত্তিতে 'BBA জেনারেশন' নামেও আ্যখায়িত করা যায়!
প্রেম, সামাজিক জীবন: প্রেমের ক্ষেত্রে অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে ডিজ্যুস যুগে। লাভ ম্যারেজের গ্রহণযোগ্যতা অনেকখানি বেড়েছে। বেড়েছে লাভ থেকে এ্যারেন্ঞ্জ ম্যারেজ করার সংখ্যাও। প্রেম কোন নিষিদ্ধ বস্তু নয় এখন। একাধিক গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড খুবই স্বাভাবিক। ডেটিং স্পটগুলো পরিবর্তিত হয়েছে - পার্ক, লেক এসব আজ পুরনো। গার্লফ্রেন্ড নিয়ে খেতে যাওয়ার ক্যাফে আর রেস্টুরেন্টগুলোর মানও এখন অনেক উন্নত। প্রেম করার গড় বয়সও কমেছে এ যুগে। ফোনের মাধ্যমে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা বা ফেইসবুকে পরিচিত হয়ে রিলেশন করা এ যুগের প্রেমের ক্ষেত্রে পরিবর্তনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
পহেলা বৈশাখ বা বসন্ত বরণের মতো উৎসবগুলোকে ডিজ্যুস জেনারেশন তাদের নিজের মতো করে পালন করছে। দলবেঁধে চারুকলা, টিএসসি আর রবীন্দ্রসরোবর পাণে ছুটছে তারা। ভ্যালেন্টাইনস ডে, ফ্রেন্ডশিপ ডে, মাদার্স ডে পালন আরও সগেরম হয়েছে। কিন্তু ডিজ্যুস জেনারেশনের বৈশাখ ও বসন্ত উৎসব পালন করতে গিয়ে মেকি ভাব ধরা দেখলে প্রায়শঃই গা জ্বলে।
ড্রেসের আধুনিকতাটা (বিশেষতঃ মেয়েদের) এখন অনেকটাই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছে সোসাইটি।
ডিজ্যুস জেনারেশন এখন অনেক বেশি টেকনোলজিক্যালি বিবর্তিত। পকেটে পেনড্রাইভ আর ক্যামেরা মোবাইল ছাড়া চলেই না। কানে হেডফোনে চলছে উচ্চস্বরে সঙ্গীত।
বাবা-মা'র সাথে ডিজ্যুস জেনারেশনের সম্পর্কের দু'টি দিক রয়েছে। অনেক বাবা-মা'দের সাথেই তাদের সন্তানের এখন বেশ বন্ধুসুলভ সম্পর্ক যা হয়তো আগে সম্ভব ছিলো না। বাবা-মা'রা অনেকটাই ফ্র্যাংক এখন তাদের সন্তানদের সাথে। কে জানে হয়তো তারাও ডিজ্যুস যুগে এসে অনেকটাই পরিবর্তিত। তবে অতি-স্বাধীনতার ডিজ্যুস যুগে সন্তানদের সাথে বাবা-মা'র দূরত্ব বাড়ার ঘটনাও চোখে পড়ছে হরহামেশাই।
প্রভাব: ধর্ম সম্পর্কে আমাদের ধারণা পাল্টেছে - বলা ভালো নমনীয় হয়েছে। ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে দেশের সংস্কৃতি ধারণের একটা প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে যদিওবা সেটা কখনও কখনও শো-অফ। গোটা সমাজের মধ্যে একটা 'মেনে নেওয়ার' ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইয়াং জেনারেশনের সচেতনতা বেড়েছে, কিন্তু স্বকীয়তা লোপ পাচ্ছে। সম্পর্কগুলো যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে (থ্যাংকস টু ফেইসবুক/মোবাইল)।
ডিজ্যুস যুগ খারাপ কি ভালো বা এর প্রয়োজনীয়তা আদৌ ছিলো কিনা তা বিচার করার জন্য এই লেখা নয়। বরং এ লেখাটা ডিজ্যুস যুগের একটা অতি সাধারণ রিভিউ। এখানে অনেক বিষয় নিয়েই আলোচনা করা হয়নি। অনেকেই হয়তো এখানে বলা অনেক কিছু নিয়ে আমার সাথে একমত নন এবং আমি আশা করিও না। এগুলো একান্তই আমার ব্যাক্তিগত মতামত।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:২৪