ফারজানা পড়ালেখার পাট চুকাতে না চুকাতেই বাসার থেকে বিয়ের জন্য একদম চেপে ধরেছিলো। এমন তোরজোরে ফারজানার যে তেমন একটা আপত্তি ছিলো তা না, এমনিতেও সে এ্যারেন্ঞ্জ ম্যারেজেই বিশ্বাসী। যাই হোক বাবা খুঁজে খুঁজে পাত্র একটি বের করেছেন। ছেলের নাম জুবায়ের - ফ্যামিলি ভালো, ছেলে স্বভাব-চরিত্র সবই ভালো। একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে উঁচু পোস্টে আসীন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই ফ্যামিলি মিলে ফারজানার সাথে ছেলের ক্যাজুয়াল মিটিংয়ের আয়োজন করলেন।
স্থান: হ্যালভেশিয়া, রাইফেলস স্কোয়্যার, ধানমন্ডি
সময়: বিকেল ৪টা
ফারজানা আর জুবায়ের মুখোমুখি বসে। দু'জনের সামনেই চকোলেট আইসক্রিম। খাচ্ছে আর কথা চলছে। ফারজানার গত ২০ মিনিটের পর্যবেক্ষণ বলছে জুবায়ের ছেলে হিসেবে মন্দ নয় - ওপেন মাইন্ডেড ও সাবলীল। আরো একটা ব্যাপার সে আগে জানতো এখন জানলো - জুবায়ের একই সাথে একটি ব্লগ সাইটের মোডারেটরও, যদিও জুবায়ের তাকে এটা কাউকে বলতে মানা করেছে। কথায় কথায় প্রায় ফাজলামির বশেই ফারজানা জিজ্ঞেস করে বসলো:
"বাচ্চা কবে নিবেন যদি বিয়ে হয়?"
জুবায়ের প্রায় রোবোটের স্বরে বলে উঠলো:
১গ. নতুন বউয়ের হাঁটা, চলা এবং প্রথম কয়েকদিনের কর্মকান্ড একটি পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে, যাচাই করা হবে ঐ বউয়ের হাঁটা, চলা ও কর্মকান্ড যথার্থ এবং শ্লীল কিনা। বউ সংসার করার মতো মানসম্পন্ন কিনা সে বিষয়টিও যাচাই করবো। যদি আপত্তিকর কিছু না থাকে তাহলে তা ঐ বউয়ের সাথে সংসার বাঁধা হবে। এই যাচাই প্রক্রিয়ায় ১ ঘন্টা থেকে ২৪ ঘন্টা সময় লাগতে পারে। কিছু মেয়ের নতুন বিয়ে করে, সংসারের ও পরিবারের পরিবেশ নষ্ট করার উদ্দেশ্যকে ঠেকানোর জন্য এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
ফারজানা: (চমকে উঠে) মানে???
জুবায়ের: না ইয়ে মানে কিছু না, আমার কাজের কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেলো কিনা তাই। আসলে হয়েছে কি সারাদিন মডুগিরী করতে করতে এখন সব যায়গাতেই মডুগিরী ফলাতে মন চায়। কি করবো বলো আমি তো আর নীতিমালার বাইরে কিছু করতে পারি না।
ফারজানা নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে বলে, "না না, ঠিক আছে। I understand....."
এরকম দুই-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সব মিলিয়ে জুবায়ের ছেলেটা মন্দ নয়। ফারজানার পছন্দই হয়ে গেলো ওকে। ব্যস আর কি, ফারজানার অনুমতি মেলা মাত্রই দুই পরিবারই আর দেরি করতে চাইলো না। ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেলো মাত্র ৩ সপ্তাহের ভেতরেই।
বিয়ের রাতে বাসরঘরে ফারজানা আর জুবায়ের - মুখোমুখি, মুগ্ধ তাকিয়ে এক অপরের দিকে।
জুবায়েরই প্রথমে নিস্তব্ধতা ভাঙলো: "কথা দাও ফারজানা সারাটি জীবন তুমি নীতিমালা মেনে চলবে.......কথা দাও!
ফারজানা: কথা দিলাম জুবায়ের........কথা দিলাম.......!
জুবায়ের: ওহ্ ফারজানা........
ফারজানা: ওহ্ জুবায়ের........
সেই রাতটি দু'জনের তেমনই কাটলো যেমনটা বাসর রাত আর সবার কেটে থাকে। পরদিন সকালে উঠে ফারজানা দেখতে পেলো জুবায়ের বিছানায় নেই, সকালে উঠেই ল্যাপটপে বসেছে - হাতে এক মগ কফি। কি-বোর্ডে খিটির-পিটির করে কি যেনো টাইপ করে চলেছে। বিছানায় তার পাশে একটা চিরকুট রাখা। সেটাতে লেখা -
তুমি একজন নতুন বউ, তোমার উপর নজর রাখা হচ্ছে
এ সংসারে তোমাকে স্বাগতম। তোমাকে সকল সাংসারিক কাজে সংশ্লিষ্ট হতে দেয়া ও সংসারের চাবি হস্তান্তরের আগে ৭দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। সংসারের পূর্ণ কর্তৃত্ব পেতে ভালো ভালো কাজ করো ও এ সংসারের নিয়মকানুন মনে চলো।
ফারজানা সম্ভিত! তার আর বুঝতে বাকি রইলো না এক বদ্ধ উন্মাদের পাল্লায় সে পড়েছে। ঐদিন সে রান্নাঘরে ঢুকার অনুমতি পেলো না - এমনকি নিজের স্বামীকে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়ার অনুমতিও সে পেলো না। শুধু সেদিন নয় - আগামী ৯দিনেও সে এই অনুমতি পেলো না, অথচ তাকে বলা হয়েছিলো ৭ দিন। সে বিষয়টা জুবায়েরকে একাধিকবার বললেও কোন লাভ হয়নি। সে খালি বলেছে - "আমি বিষয়টা দেখছি।" শেষ পর্যন্ত ১০ম দিনে সরাসরি শশুরমশাইয়ের কাছে সরাসরি অভিযোগ করে অনুমতি পায়।
অবশেষে রান্নাঘরে ঢুকে স্বামীর জন্য চা বানালো ফারজানা। চা নিয়ে হাসিমুখে জুবায়েরকে দিলো। কিন্তু জুবায়ের কাপটা ধরে ভিতরে তাকিয়ে বিরক্তির সাথে বললো - "আরে আরে কর কি? তুমি জানোনা মডুরা চা খায় না? আমরা শুধু ব্ল্যাক কফি পান করি।"
তথ্যটা ফারজানার জানা ছিলো না, যারপরনাই সে অবাক হলো। নিরাশ হয়ে কফি বানাতে রান্নাঘরে ফিরে গেলো সে। কফি বানিয়ে ফিরে এসে জুবায়েরের হাতে কাপটা তুলে দিলো সে। মজার ব্যাপার হলো জুবায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়েই কাপটা ফিরিয়ে দিলো ফারজানার হাতে।
ফারজানা: কি ব্যাপার? খেলে না যে?
জুবায়ের: কফিটা ভালো লাগেনি। তবে তুমি নিরাশ হয়ো না, কফি বানিয়ে যাও।
বলে সে ফারজানার হাতে আরেকটা চিরকুট ধরিয়ে দিলো। এটাতে লেখা:
আপনি একজন সাধারন বউ
আপনার রান্না সরাসরি আপনার স্বামীর কাছে পরিবেশিত হবে। আর রান্না ভালো হলে স্বামীর বিবেচনা সাপেক্ষে তা খাওয়াও হতে পারে।
ফারজানার বিরক্তি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এরা কি? মানুষ নাকি অন্য কিছু?
এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটা মনে হয়েছে ফারজানার কাছে সেটা হলো জুবায়ের সংসার জীবনের প্রতি খুবই উদাসীন। বাসার কোন দরকারে, প্রয়োজনে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এক শুক্রবার সকালে নাস্তার টেবিলে ফারজানা জুবায়েরকে একটু খালি বাজারে যাবার জন্য কয়েকটা কথা শুনিয়েছিলো। জুবায়ের কিছু না বলে হাত ধুতে উঠে যায়। যাওয়ার সময় পকেট থেকে বার করে একটা চিরকুট হাতে ধরিয়ে দিয়ে যায়:
২ক. যদি বউ স্বামীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ জানান বা বউ যদি তার প্রতি স্বামীর কোন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জবাবদিহিতা চান তাহলে স্বামীকে বেডরুমে ডেকে নিয়ে একান্ত গোপনে সরাসরি অভিযোগ জানাতে পারেন।
এ সংসারে মুখ ফুটে দু'টা কথা বলারও অধিকারও যে নেই ফারজানার তা বুঝতে সময় লাগে না।
জুবায়েরের ভাই, অর্থাৎ ফারজানার দেবর হচ্ছে ইমরান। এই সংসারে এই একটা মানুষই আছে যাকে ফারজানার শত্রু বলে মনে হয় না। ইমরানের ফারাজানার তৈরি ডালের বড়া খুবই পছন্দের। তাই ফারজানা আদর করে তার দেবরকে ডাকে দেবড়া।
একটা ব্যাপার ফারজানা প্রায়ই লক্ষ্য করে। কয়েক দিন পরপরই জুবায়েরের ফোনে কার কাছ থেকে যেনো পরপর অনেকগুলো কল আসে। জুবায়ের ফোনে কথা বলতে বলতে ডায়েরীতে কিসব যেনো টুকে রাখে। একটু পরে ইমরানও এসে হাজির হয়। দু'জনে মিলে একসাথে মদ্যপানে মেতে উঠে। ডায়েরীতে লিখে রাখা নামগুলো জুবায়ের এক এক করে পড়ে আর ইমরান ল্যাপটপে কি সব যেনো টাইপ করে। এসবের কিছুই ফারজানা বোঝে না।
বিয়ের ৮ মাস পরের এক সন্ধ্যা। ফারজানার মনটা আজ সকাল থেকেই খারাপ। জুবায়েরের মোবাইলে একটা এসএমএস সে পেয়েছে। এসএমএসটা এসেছে তিথী নামের কারো কাছ থেকে। এসএমএসটায় এমন সব কথা লেখা ছিলো যা দেখে যে কোন স্ত্রীরই মন খারাপ হবারই কথা - প্রেমের কথা, ভালোবাসার কথা। জুবায়েরের রিপ্লাইগুলো ফারজানার মন আরো বেশি খারাপ হয়েছে। অনেক অনেক কান্না পাচ্ছে আজ তার।
রাত্রিবেলা জুবায়ের বাসায় ফিরেছে। খাওয়া শেষে বেডরুমে আসলো দু'জনেই। ফারজানা আর থাকতে না পেরে এসএমএস প্রসঙ্গটা তুলেই ফেললো। বলার সাথে সাথেই জুবায়ের উঠে দাঁড়িয়ে ফারাজানার গালে সজোরে আঘাত করলো। বিছানায় পড়ে গেলো ফারজানা। কতোক্ষণ এভাবে ছিলো ফারজানা মনে নেই তার। কিছুক্ষণ পর বিছানায় ফারজানার গায়ে একটা খাম ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যায়। খামে লেখা ছিলো - আপনার জন্য একটি নোটিশ আছে। খামের ভেতরে একটি চিরকুট -
উপর্যপুরি নিয়ম ভঙ্গ করায় আপনাকে সংসার থেকে সাময়িক অব্যাহতি দান করে বাপের বাড়ি পাঠানো হলো। আপনার জন্য সংসারের দ্বার ৬ দিন পর পুনরায় খুলে দেয়া হবে, তবে আপনাকে নজরে রাখা হবে। দয়া করে সংসারের নিয়মাবলী মেনে চলুন যাতে করে আপনি নজরদারি থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
অতঃপর বর্তমান.....
জুবায়েরের সাথে ফারজানার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিলো এ ঘটনার কয়েক মাসের ভেতরেই। পরবর্তীতে জুবায়ের প্রখ্যাত শিল্পপতি বাবু আহমেদ এর একমাত্র মেয়ে তিথীকে বিয়ে করে। জানা যায় তিথীকে কখনোই ফারজানার মতো নীতিমালার অত্যাচার সহ্য করতে হয়নি, যা খুমি তাই করার স্বাধীনতা তিথীর ছিলো। টাকা-পয়সা, প্রতিপত্তি এসবের কাছে নিয়ম-কানুন, আইন, নীতিও যে মাথা নোয়ায়, জাগতিক এ সত্যটা আবারও প্রমানিত হলো।
* বিঃ দ্রঃ এই পোস্টে উপস্থাপিত চরিত্র, ঘটনা ও প্রেক্ষাপটসমূহ সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কোন বাস্তব ঘটনার সাথে এর মিল খুঁজে পেলে তা হবে নিতান্তই কাকতালীয়।
* অবশেষে আবার সেইফ হয়েছি।