একটা নির্দিষ্ট বয়সে পরিপূর্ণ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ঐসব বস্তু দেখেনা এমন পাবলিক এদেশে কম। অবশ্য দেখবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঐসব দেখা আর না দেখা নিয়ে আমার কিছু মজার অভিজ্ঞতা আছে।
১. প্রথম অভিজ্ঞতা: তখন VCD'র যুগ পুরোদমে শুরু হয়নি এইদেশে। মোটামুটি সচ্ছল এমন কারো কারো ঘরে VCD প্লেয়ার এসেছে। কিন্তু প্রায় সবার ঘরেই একটি করে VHS প্লেয়ার ছিলো। হ্যাঁ, আমার অভিজ্ঞতাটা এই VHS প্লেয়ারের মাধ্যমেই। VHS প্লেয়ারটা অনেকদিন ধরেই অলস বসেছিলো। তো ঐটা নিয়ে ঘরের আর কারো তেমন মাথাব্যথা ছিলোনা। আমার তখনো গুঁতাগুঁতির বয়স চলছে। ইলেক্ট্রনিক জিনিস দেখলে সেটার গুষ্টি উদ্ধার না করে ক্ষান্ত হতাম না। তো মাঝখানে একদিন ঘরবাড়ি রঙ করার হুজুগ উঠলো। বাড়ি রঙ করা মানে বুঝেনই তো একশো ঝামেলা। ঘরের সব প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে পোঁটলা বাঁধা হলো। নিয়ে রাখা হলো আমার ঘরে। টেলিভিশন আর VHS প্লেয়ারটাও সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিলো। আর ছিলো পর্বত সাইজের VHS ক্যাসেটের স্তুপ। তো রাত্রি হলো, বিছানায় শুয়ে শুয়ে আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী পড়ছি। হঠাৎ ক্যাসেটের পর্বতে চোখ রাখতে রাখতে একটা ক্যাসেটে দৃষ্টি আটকে গেলো। ক্যাসেটটার নাম (Ultimate Passion) দেখে কিছু না বুঝলেও উপরের কাভার দেখে বুক ধরফর শুরু হয়ে গেলো। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চেপে গেলো। মাল্টিপ্লাগে টেলিভিশন আর VHS প্লেয়ার প্লাগ ইন করলাম। টেলিভিশনের সাউন্ড Mute করলাম। দরজার নিচে কাপড় দিলাম যাতে টেলিভিশনের আলো দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে না যায়। ক্যাসেট ঢুকিয়ে যেই প্লে করেছি, পুরো Screen জুড়ে একধরনের মসৃণ ঝিরঝিরতাপূর্ণ দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। বুঝলাম VHS প্লেয়ারের হেড পরিষ্কার করতে হবে। বাথরুমে গেলাম.....আফটার শেভের বোতলখানা বগলদাবা করে ফিরলাম। গেন্জির ক্ষুদ্র অংশে আফটার শেভ ঢেলে আঙ্গুল দিয়ে উঁচু করে ধরে হেড পরিষ্কার করতে লাগলাম। ৩-৪ বার পরিষ্কার করার পর ছবি দর্শনযোগ্য অবস্থায় আসলো। কিন্তু বিধি বাম.....২ মিনিটেই ক্যাসেট শেষ। ক্যাসেট রিওয়াইন্ড করতে হবে। রিওয়াইন্ড বাটনে চাপ দিলাম.....এবং.....একই সাথে ঐ রাতের সবচেয়ে বড় ভুলগুলোর একটি করলাম। যাদের VHS প্লেয়ার আছে তাদের জানার কথা, VHS প্লেয়ারে রিওয়াইন্ডের সময় একধরনের বিতিকিচ্ছিরি আওয়াজ হয়......মনে হয় যেন এলাকার সব নেড়ি কুকুর একসাথে মরাকান্না জুড়ে দিয়েছে। কোনমতে স্টপ বাটন চেপে ঐ আওয়াজ বন্ধ করলাম। আর একটু হলেই পাশের রুম থেকে এই আওয়াজ শুনে ফেলতো। কি করা যায়?.......কি করা যায়?........আইডিয়া! বিছানার ওপর থেকে পেল্লাই সাইজের কম্বলটা নামালাম। সেটা ফেলে দিলাম VHS প্লেয়ারের উপর। কাজ হলো......এবার একটা চিনচিনে আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। মনে মনে নিজের বুদ্ধির তারিফও করলাম: "ওহ! নাফিস......তুমি একটা জিনিস বটে! রিওয়াইন্ড শেষ। প্লে চাপলাম। শুরু হলো লীলাখেলা......দেখছি......জীবনে প্রথমবারের মতো......কিন্তু যা দেখছি তা বোঝার ক্ষমতা তখনো আসেনি আমার। তাই আমার অবস্থা অনেকটা......"এটা করলো কেন?"....."ওটা করলে কি হয়?".....এই ধরনের। যাই হোক রাতের পর যা ঘটলো তা ছিলো ঐ রাতের সবচেয়ে বড় ভুল। আমি লীলাখেলা দেখিতে দেখিতে কখন যে ঘুমের কাছে আত্মসমর্পণ করেছি নিজেও জানিনা। সকাল হতেই তাড়াতাড়ি করে ক্যাসেট বের করার জন Eject বাটন চাপলাম। এ্যাঁ......এইবার হয়েছে আসল কাজ......VHS প্লেয়ারের কি মতিগতি হয়েছে কে জানে ক্যাসেট অর্ধেক পথ এসে আর বের হয় না.....আবার স্বস্থানে ফিরে যায়। মনে আছে, ঐ শীতের সকালেও আমি টেনশন আর ধরা পড়ার ভয়ে দরদর করে ঘেমেছি। শত চেষ্টার পরেও যখন বের করতে পারলাম না এবং যখন সকালের নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাক পড়ে গেলো তখনকার মতো প্রচেষ্টায় ইস্তফা দিয়েছিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আজ স্কুলে যাওয়া যাবে না......এই সমস্যার সমাধান না করা পর্যন্ত শান্তি নেই। তার ওপর একটু পড়ে এসে যখন কাজের লোকদের দ্বারা সব জিনিসপত্র আবার পাশের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো তখন আমার জানে আর পানি ছিল না। সারাটা দিন আমার দোয়া-দরূদ পড়ার মতো অবস্থায় কেটেছে.......শুধু মওকার অপেক্ষায় ছিলাম। পরে ঐদিনই বিকেল বেলায় ২য় প্রচেষ্টায় আমি ক্যাসেট বের করতে সক্ষম হয়েছিলাম। স্ক্রু ড্রাইভার আর ১২ ইন্চি স্টিলের স্কেলের সহায়তায় আমি কি করে ঐ ক্যাসেট বের করছিলাম তা না হয় নাই বললাম............
২. সৌদির জিনিস: আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি। চাচা থাকেন সৌদি আরব.......চাচী দেশে। বছর দু'য়েক পরপর চাচা দেশে ফিরেন। ততোদিনে বাসায় নতুন VCD প্লেয়ার এসেছে। আমি আছি মৌজে। তো সেবার চাচা এলেন বিয়ের দেড় বছর পর.....বিয়ের পর দেশে মাত্র ২০ দিন ছিলেন। প্রতিবারের মতোই ২ দিনের মাথায় সাথে আনা লাগেজ, কার্টন খুললেন......আমাদেরকে সাবান, শ্যাম্পু প্রভৃতি দানপূর্বক বাধিত করলেন। দেখলাম এবার নিজের জন্য একটা VCD প্লেয়ার এনেছেন।
দুপুরবেলা......সবাই নিচে খাওয়ার টেবিলে খাচ্ছে। আমি আগে আগে খাওয়া শেষ করে দোতলায় এসেছি। কোন কারন ছাড়াই চাচার ঘরে ঢুকলাম। দেখি ফ্লোরে স্তুপ করা অসংখ্য CD'র কাভার বক্স। প্রতিটা বক্সেই ৩-৪ করে Disc ঢোকানো.....Disc এর সংখ্যা কম করে হলেও ২০০'র উপরে হবে.....কোনটা Verbatim, কোনটা Maxell, কোনটা Sony আবার কোনটা বা Imation......আর সবগুলোর উপরেই কোন না কোন দেশের নাম লেখা......Libiya, America, India, Bangladesh, Pakistan, Tamil, Japan..........মোটামুটি আন্দাজ করে ফেলেছিলাম জিনিসগুলো কি। তারপরেও নিশ্চিত হওয়ার জন্য চাচার VCD প্লেয়ারে একটা CD ঢুকিয়ে টেস্ট করি। দেখি যা ভেবেছি তাই......হাতে নিলাম ৪ টা CD.....নিয়ে সোজা এক দৌড়ে তিন তলায়। ঐ CD গুলো দীর্ঘদিন লাগিয়ে দেখেছিলাম। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম কি গাড়লের মতো কাজ করেছি আমি। চাইলে আমি একমুঠো CD নিয়ে আসতে পারতাম। চাচা নিশ্চয়ই আমাকে এসে CD নিয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করতো না.......হাজার হোক ঐসবের CD........
৩. কম্পিউটার যুগ: SSC'র পরপরই বাসায় কম্পিউটার এলো.....এলো বলা ঠিক হবে না......আমিই নিয়ে এলাম। তখন CD'র ঝামেলা থেকে মোটামুটি মুক্ত হলাম, CD কপি করে পিসিতে রেখে পরে দেখতাম। আর DVD আসাতে কন্টেন্ট এর পরিমাণও বেড়ে গিয়েছিলো। প্রথম দিকে পিসিতে হিরো প্লেয়ার নামে একটা প্লেয়ার ব্যবহার করতাম। নতুন পিসি ব্যবহারকারী.....আর তাই জানতাম না যে হিরো প্লেয়ারে এমন একটা ফাংশন আছে যার কারনে ভিডিও চলা অবস্থায় প্লেয়ার মিনিমাইজ করলে উইন্ডো মিনিমাইজ হয় ঠিকই কিন্তু ভিডিও ওয়ালপেপারের মতো পুরো Desktop জুড়ে অবস্থান করে। এই ফাংশনের কারনে আমি একবার ধরা পড়েও গিয়েছিলাম প্রায়.........
আমার পিসি আমি বাদে কেউ ধরতো না, আর তাই কখনোই ঐসব ফাইল বা ফোল্ডার Hide করে রাখার প্রয়োজন অনুভব করিনি। আমি ফাইলগুলো কপি করে রাখতাম C:WINDOWSsystem ফোল্ডারের ভেতরে আরো ফোল্ডার তৈরি করে। অপরপক্ষে আমার এক বন্ধু এসব ফাইল লুকিয়ে রাখতে Folder Locker, Folder Hide প্রভৃতি সফটওয়্যার ব্যবহার করতো। মনে আছে আমার ঐ বন্ধু আর আমি একবার পাড়ার দোকানে গিয়েছিলাম Blank Disc কিনতে। দোকানে গিয়ে দোকানের দায়িত্বে থাকা ভদ্রলোককে বলেছিলাম একটা "Verbatim এর ব্লু ডিস্ক দেন" (তখন Verbatim এর ডিস্ক খুব পপুলার বার্ন করার জন্য)। দোকানী ব্যাটা কি বুঝলো কে জানে.....যে ডিস্কটা হাতে ধরিয়ে দিলো বাসায় এসে দেখি ওটা ঐসব পূর্ণ । পরে বুঝেছিলাম ব্যাটা "ব্লু ডিস্ক"কে "ব্লু ফিল্ম" শুনেছে।
৪. আজকাল: আজকাল আর ওসব বলতে গেলে দেখিই না। মজা লাগে ভাবতে আগে কতো কষ্ট করেছি এসব দেখার জন্য। ক'দিন আগে নীলক্ষেতে গিয়েছিলাম বই কিনতে। ফুটপাথ থেকে কতগুলো চ্যাংড়া ছেলের দল ডাকছিলো: "মামু, গরম মাল.....লইয়্যা যান"। এমনভাবেই জেঁকে ধরেছিলো যে শেষে বলতে বাধ্য হলাম: "ভাই, বাসায় কম্পিউটার আছে, কম্পিউটারে দেখি।" কিন্তু আসলে আমিতো জানি বাসায় এখন ইন্টারনেটের অবারিত মুক্ত দ্বার থাকা সত্ত্বেও সারাদিন ফটোশপ আর রাজ্যের সব সফটওয়্যার নিয়ে ব্যস্ত থাকি। আসলে এই যে উপলব্ধি.....এই যে বুঝতে শেখা.......একেই হয়তো প্রাপ্তবয়স্কতা লাভ বলে.........
* এই পোস্টটি আমার ৫০ তম পোস্ট......নাপিষ ঈপতেক্ষার পুনরায় হাফ সেন্চুরী পূরণ করিলো........
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১:২৩