মাননীয় নেত্রীদ্বয়, গত রাতে আমার, আমাদের শিশু কন্যাটি হাউমাউ করে কেঁদেছে। আজ মঙ্গলবার স্কুলে যেতে পারবে না বলে। তার প্রিয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে দেখা হবে না বলে। প্রিয় সতীর্থদের সাথে পড়া-গল্প-আড্ডা ও হৈচৈ-এ মেতে উঠতে পারবে না বলে। গত রোববার রাতেও ও কেঁদেছিল। ঠিক একই কারণে। সেদিন আমি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে ছিলাম। ও স্কুলে যেতে পারবে বলে ওকে আশ্বস্থ করেছিলাম। কিন্তু আজ মঙ্গলবার ওর জন্য, ওর বন্ধুদের জন্য, বিদ্যালয়গামী বাংলাদেশের শিশুদের জন্য কোন মঙ্গলবার্তাই বয়ে আনেনি। উল্টো তৈরি করেছে আরো গভীরতর উদ্বেগ। বাবা-মা-অভিভাবক হিসেবে আমি, আমরাও কথা রাখতে পারিনি আমাদের শিশুদের কাছে। আমি জানি স্কুলে যেতে না পারা শিশুদের এ রকম মুখোমুখি হতে হয়েছে, হচ্ছে আরো অগণিত বাবা-মাকে। তারাও হয়তো একই কায়দায় স্বপ্ন দেখিয়েছেন তাঁদের শিশুদের। এখন কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারার যন্ত্রণায় ভুগছেন। কিন্তু এ কথা রাখতে না পারার দায় যে আমাদের নয়, বরং চলমান রাজনীতির, যে রাজনীতির নেতৃত্বে রয়েছেন আপনারা দু’জন সে কথা আমরা আমাদের কোমলমতি শিশুদের কী করে বলি!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আপনি হয়তো বলবেন হরতালতো আমি ডাকিনি। আমার দল ডাকেনি। আমার জোট ডাকেনি। জোটের কোন শরিক দলও ডাকেনি। হরতাল ডেকেছে বিরুধী দল। সুতরাং এর দায়ও তাদের। আপাত দৃষ্টিতে এটাই হয়তো সত্য। কিন্তু একমাত্র সত্য নয়। কারণ বিগত বিশ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান যে দু’টি স্রোত সে স্রোতের প্রধান আপনারা দু’জন। আপনারা দু’জন শুধু দুটি দল নয়, পালাক্রমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গোটা দেশ চালিয়েছেন, চালাচ্ছেন এবং বোধকরি চালাবেন। সুতরাং ক্ষমতায় থাকা না থাকার বিবেচেনায় হরতাল ডাকা না ডাকার যে কাঠামো টি তৈরি হয়েছে, জনমুক্তির নামে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া যে হরতাল সংস্কৃতির খুঁটি মাটির গভীর থেকে উঠে আকাশ ছুইছুই করছে তার স্থপতি শুধু একজন-সাধারণ জনগণ তাদের দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার কারণেই এ অনুসিদ্ধান্তের পক্ষে যাবে না ।
গণমাধ্যমে আজকের শিশুদের অভিগম্যতা অভাবিত। ফলে খুব অল্প বয়সে রাজনৈতিক ঘটনা-দুর্ঘটনার সাথে ওরা পরিচিত হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ঘটনা-দুর্ঘটনা নিয়ে ওদের শিশু মনে নানা প্রশ্নও তৈরি হচ্ছে। টেলিভিশনের খবর দেখতে দেখতে গত রাতে আমার মেয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে-’বাবা ইলিয়াস আলীর কী হয়েছে, তাকে কারা নিয়ে গেছে’। আমি কি করে বলি যে, আমার মতো একজন সাধারণ নাগরিকের কাছে এর কোন উত্তর নেই। টেলিভিশন পর্দায় ইলিয়াস আলীর শিশু সন্তানকে উদ্বিগ্ন অবস্থায় তসবিহ হাতে তার প্রিয় বাবার জন্য দোয়া করতে দেখে আবারও ওর প্রশ্ন-’ওর বাবা যদি আর ফিরে না আসে ওর কি হবে? ও কাকে বাবা বলে ডাকবে?’। একজন শিশুর প্রতি আরেকটি শিশুর এ সংবেদশীলতা খুবই স্বাভাবিক। আর এ স্বাভাবিক নিয়মেই ওদের মনে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে আতংক, ভয়, উৎকন্ঠা। হরতালের পিকেটিং, পক্ষে-বিপক্ষ দল আর পুলিশের মারামারির সংবাদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নাম ধরেই ও জানতে চেয়েছে-’কিছু করছে না কেন, যারা এগুলো করছে তারা কি আমাদের পাড়ায় আসবে, এখানেও ওরকম করবে’। আমি নিশ্চিত বিগত বিএনপি সরকারের সময় যখন দুবৃত্তরা আহসান উল্লাহ মাস্টারকে খুন করেছে, সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়াকে হত্যা করেছে, তখনও যদি ও টিভি সেটের সামনে থাকতো, ওর এ রকম প্রশ্ন করার মতো বয়স হতো তাহলে বর্তমান মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রীর নাম ধরেই সে একই প্রশ্ন জিজ্জেস করতো। কারণ তখন তিনি ছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী।
গতকাল পিকেটার-হারতাল বিরোধী ও পুলিশ এ তিনমাত্রিক লড়াইযের মাঝখানে পড়ে অফিসগামী আমার এক সাবেক সহকর্মী আহত হয়েছেন। সম্ভাব্য ঝুকি এড়াতে ডাক্তার তার হাতের দু’টি আঙ্গুল ইতোমধ্যে কেটে ফেলেছেন। রাতের বেলা চিকিৎসা শেষে আমার এ সহকর্মী যখন তার বাসায় ফিরে গেছেন, তার শিশু সন্তানটি বাবার হাতের দু’টি আঙ্গুল নেই দেখে কি জিজ্ঞেস করেছে, আমি জানি না। তার পরিবার হয়তো নিজকে ভাগ্যবান মনে করছে এই ভেবে যে, তাদের প্রিয় মানুষটি প্রাণ নিয়ে বাসায় ফিরে আসতে পেরেছে। কিন্তু এটিতো নিশ্চিত যে, তাদের বাড়ন্ত শিশুটি মনের অজান্তেই তার বাবাকে চিরদিনের মতো নেই হয়ে যাওয়া আঙ্গুল দু’টি নিয়ে প্রশ্ন করবে। একবার নয়, অসংখ্যবার। তখন তার বাবা শিশুটিকে কি বলবে? সত্য বলবে? সত্য যদি বলতে হয় তখন দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলের নাম বলতে হবে। বলতে হবে বিএনপি-আওয়ামী লীগ এর কারণে তার আঙ্গুল দু’টি ’নাই’ হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে এ শিশুটি কি কখনও এ দু’টি প্রধান দলের প্রতি কোন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বড় হতে পারবে? অথবা আমাদের সামগ্রিক রাজনীতির প্রতি? কিছু দিন আগে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তরুন-প্রজন্মের উপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। তাতে দেখা গেছে বর্তমান তরুন প্রজন্মের নাম মাত্র অংশ রাজনীতির প্রতি আগ্রহী। পরিসংখ্যানের ব্যাকরণে উক্ত গবেষণায় প্রাপ্ত সংখ্যাটি রীতিমত তাৎপর্যহীন। তার মানে কি আমাদের তরুনরা একটি ভয়াবহ বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে। নাকি বর্তমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি ভীতশ্রদ্ধ বলে তারা এ রকম অভিমত দিযেছেন? অথচ আমাদের সামগ্রিক রাজনীতির ইতিহাস ছিল তারুন্যের উচ্ছলতায় পরিপূর্ণ। তরুনরাই ছিল আমাদের রাজনীতির প্রাণ। ৫২-৬৯-৭১-৯০ রাজনীতির প্রতিটি মাইলফলকে তরুনরাই মূল ভূমিকা পালন করছে। সে তরুনদের রাজনীতিতে আগ্রহী করে তুলতে না পারার দায়টা কার? অবশ্যই অগ্রজদের। যারা বর্তমান রাজনৈতকি ময়দানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
মাননীয় নেত্রীদ্বয়, ৯০ এর গণআন্দোলনে স্বৈরাচারের পতনের পর আমরা আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। কথা ছিল আমরা গণতন্ত্র পাবো। গণতন্ত্রের পথ ধরেই আমারা অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবো। আমরা বিশ্বাস করি সকল উন্নয়নের মূল চালিকাই হলো রাজনীতি। সুতরাং উন্নয়নের পুর্ব শর্ত হচ্ছে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন। সুস্থ্য ধারার রাজনীতির বিকাশ। ৯০ এর পর থেকে পালাক্রমে আপনার দু’জনই দেশ পরিচালনা করছেন। সুতরাং রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশে নেতৃত্ব দেয়ার দায়ও আপনাদের ওপর বর্তায়। পুরোপুরি না হলেও এর বড় অংশ। কিন্তু গণতান্ত্রিক সুস্থ্য রাজনৈতিক ধারার বিকাশ যে ঘটেনি, সেটি এক এগারোর ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এক এগারোর মধ্য দিয়ে আসা অনির্বাচিত সরকারের দু’বছরের শাসন শেষে আবার যখন নির্বাচন হলো তখনও আমরা আশায় বুক বেঁধে ছিলাম এ ভেবে যে, এবার বুঝি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব অতীত থেকে শিখে ভবিষ্যতমুখি হবে। আপনাদের নির্বাচনী ইশতেহারে রাজনৈতিক গুণগত পরিবর্তন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। সে অঙ্গীকারে আমরা আশাবাদি হয়ে ছিলাম। কিন্তু দু’দলের ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনৈতিক টানাপোড়নে যে সংঘাতময় পরিস্থিতি ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে তাতে নাগরিক হিসেবে আমাদের শান্তনা খোজার অবকাশ কোথায়?
আজ ইলিয়াস আলীর আপাতত ’নিখোজ’ হয়ে যাওয়ার কারণে বিএনপি ক্রমাগত হরতাল ডাকছে। শুধু একজন রাজনীতিক নন, যেকোন নাগরিকের এভাবে নিখোজ হয়ে যাওয়া কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। কিন্তু আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক যে যখন অন্য কোন সাধারণ নাগরিক নিখোজ হয়ে না ফেরার দেশে চলে যান তাকে নিয়ে কেউ রাস্তায় নামেন না। না বিএনপি, না আওয়ামী লীগ। কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টার কে যখন খুন করা হয় তখন জাতি বিএনপিকে চুপ থাকতে দেখেছে। সেদিন যদি আজকের একই নিয়মে বিএনপি এর প্রতিকার চাইতো, প্রতিবাদ করতো তবে নৈতিকভাবে বিএনপি আজকের আন্দোলনে জনসমর্থন দাবি করতে পারতো। কিন্তু বিএনপি তখন সে রাজনৈতিক নৈতিকতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।
ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু’দলই হরতাল ডাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এ দু’দলই ব্যবসায়ী আছেন। এ ব্যবসায়ীরা দলের হয়ে পিকেটিং-এ অংশ নেয়। জনগণকে হরতাল পালনের আহবান জানায়। আর নিজ ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা খোলা রাখে। কর্মচারী-শ্রমিকদের অফিস করতে বাধ্য করে। আমি জানি না আমাদের দু নেত্রী দলের নেতাদের এ রাজনৈতিক ভন্ডামি নিয়ে কখনো প্রশ্ন তুলেছেন কি না?
রাজনীতির একটি মূল দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকদের সাহস জোগানো। তাদের জন্য হতাশা নয়, ভরসা তৈরি করা। আজ বয়স্ক নাগরিকরা তো দুরে থাক, আমাদের শিশুরাই বড় হচ্চে আতংকিত হয়ে। ভরসাহীন হয়ে। আমাদের সবার জন্য তৈরি হচ্ছে একটি চরম নিরাপত্তহীনতাবোধের জীবন। প্রাত্যহিক জীবনে আতংকিত এসব শিশুদের নিয়ে কীভাবে একটি জাতি তার ভবিষ্যত নেতৃত্ব তৈরি করবে? কীভাবে এসব শিশুরা সৃজনশীল হয়ে গড়ে উঠবে দেশকে এগিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে। শিশুদের জন্য একটি ইতিবাচক, ভয়ভীতিহীন বাসযোগ্য পরিবেশ দিতে না পারার চলমান রাজনীতির পথ চলা আর কত দীর্ঘতর হবে?