আগের কিস্তির পর.................
হোটেলের একেবারে ওপরের ফ্লোরে সভা কক্ষ। আলোঝলমল। বিশাল বড়। নাম নিবন্ধিকরণের আনুষ্ঠানিকতা সেরে এগিয়ে যেতে চোখে পড়ে সভা কক্ষ ইতোমধ্যে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছে। যেরকম ভেবে ছিলাম ঠিক সে রকম ছোটখাট কিছু নয়। এ এক বিশাল আয়োজন। উপস্থিত অংশগ্রহণকারীদের প্রায় দুই তৃতীয়াংশই নারী। আফগান নারী। রাজধানী কাবুল সহ অন্যান্য শহর থেকে এসেছেন। বেশির ভাগই ব্যবসা ও শিল্প উদ্যোক্তা। কয়েকজন নারী সাংসদও এসেছেন। এ ছাড়া অংশগ্রহণকারীদের মধ্য রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা সংগঠন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, সরকারী কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক এবং ইলোকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সংবাদকর্মী।
আমি সভা কক্ষের এদিক ওদিক তাকাই। শত মানুষের ভীড়ে বসকে খুঁজি। কিন্তুু কোথাও দেখা যায় না। অথচ আমার আগে তাঁর পৌছে যাবার কথা। পর্যবেক্ষণ নির্ভর একটা অনুমিত ভবিষ্যত মনে আসে। আমার কেন জানি মনে হয় বস সভাস্থলে এসে আবার রুমে ফিরে গেছেন। মানুষকে চমকে দেয়ার, একটু ব্যতিক্রম থাকার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করেছি তার মধ্যে। আজকের এ মূহুর্তের চমক এবং ব্যতিক্রমটা হতে পারে তাঁর শাড়ি পরে আসা। সভাস্থলে সকল আফগান নারীই সালোয়ার-কামিজ পরে এসেছেন। সালোয়ার-কামিজ পরে এলে তাঁকেও আফগানীই মনে হবে। চেহারা, রঙ, উচ্চতা ইত্যাদি বিচারে তাঁকে কাবুলের পথেঘাটে আফগানী-ইরানী নারী বলে ভুল করার সম্ভাবনা যে উড়িয়ে দেয়া যায় না তার প্রমাণ মিলেছে পরবর্তী দিনগুলোতে। সাইপের পক্ষ থেকে পোলান্ডের যে মেয়েটি আমাদের সাথে সারাক্ষণ থেকেছে, বিভিন্ন সংস্থায় নিয়ে গেছে, শত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেও নিরাপদ জোন খুঁজে খুঁজে বাজার, রেস্টুরেন্ট-ইত্যাদি ঘুরিয়ে দেখিয়েছে, ক্রিস্টিনা মারিয়া নামের সে মেয়েটি প্রায় প্রতিদিনই ক্ষণে ক্ষনে বসকে মনে করিয়ে দিয়েছে আফগানী ও ইরানী নারীদের সাথে তার প্রায় শতভাগ সাদৃশ্যের কথা।
আমার অনুমিত ধারণা তত্ত্বের মর্যাদা পেল। কিছুক্ষণের মধ্যে বস ঢুকলেন সভা কক্ষে। কলাপাতা রঙের একটি জামদানি পরে। কিন্তুু মাথায় ঘোমটা। এর আগে কখনও ঘোমটা মাথায় বসকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সম্ভবত তালেবানী ভূত নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে যে প্রচার-প্রচারণা রয়েছে, যেটি আফগান নারীদের পোষাক-পরিচ্ছদ এর একটা আরোপিত ঢং তৈরি করে দিয়েছে, আফগান নারী মাত্রই হিজাবাবৃত মানুষ এবং আফগান নারীর কাছে সামাজিক প্রত্যাশাও তাই বলে যে প্রচারণা রয়েছে, সারা বিশ্বে, এ ঘোমটা তারই বহি:প্রকাশ। কিন্তুু সভাকক্ষে আগত আফগান নারীদের সবাই বোরকা ও হিজাব ছাড়া। দু’একজন কামিজের ওপর বড় আকারের চাদর পরেছেন। কিন্তু তাকে কোন ভাবেই বহুল প্রচারিত এবং কথিত হিজাব বা বোরকার আদর্শ রূপ বলা যাবে না। হয়তো সভায় উপস্থিত নারীদের কেউ-ই প্রকৃত আফগান নারীদের প্রতিনিধিত্ব করেন না। এরা শহুরে, শ্রেণী ও গোষ্ঠীর দিক থেকে মোটামুটি এলিট। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা। সুতরাং এ রকম একটি দলের ওপর ভিত্তি করে আফগান সংস্কৃতিতে পর্দা প্রথার চলমান গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে আঁচ করার উপায় নেই। তবে একটি বিষয় বলা যায় যে কাবুল শহরে কেউ না চাইলে তাকে বোরকা পরতে বাধ্য করার মতো পরিস্থিতি বর্তমান নেই। যেমনটি ছিল তালেবানী আমলে। পরে লোকজনের কাছ থেকে জেনেছি যে, তালেবান গোষ্ঠী নারীদের শুধু বোরকা পরতে বাধ্য করেনি। পোষাকের একটি ধর্মীয় রঙও ঠিক করে দিয়েছিল। তালেবানদের সিদ্ধান্ত মতে মুসলিম নারীদের খাকী রঙ এর পোষাক পরতে হতো। আর হিন্দু ও অন্য ধর্মের নারীদের মাস্টারড হলুদ রঙের পোষাক পরতে হতো। কাবুল অক্সফাম এ কাজ করে এমন একটি মেয়ের সাথে দেখা হয়েছিল পাকিস্তানের ইসলামাবাদে। তার কাছ থেকে শুনেছি, তালেবানদের সময় মেয়েদের পায়ে সাদা মোজা পরাও বারণ ছিল। কারণ তালেবানরা মনে করতো সাদা রঙ পায়ের বাড়তি যৌন আবেদন তৈরি করে। অপরদিকে কালো রঙ ধার্মিক নারীর রঙ বলেই আফগানী জীবনাচারে স্বীকৃত। তবে সভাকক্ষে উপস্থিত পুরুষ অংশগ্রহণকারীদের পোষাক-পরিচ্ছদ এ আফগানী কোন ছোঁয়া খুঁজে পেলাম না। প্রায় সবাই স্যুট, কোর্ট, টাই পরিহিত। বিমানবন্দর, রাস্তায় জুব্বা পরা যেসব মানুষ দেখেছি ঐতিহ্যবাহী সে কাবুলি জুব্বা বিসর্জন দিয়েই সবাই এখানে এসেছেন। সম্ভবত শ্রেণী উত্তরণ মানুষকে তার ইতিহাস ঐতিহ্য বিসর্জনে উৎসাহিত করে। অথবা ঐতিহ্যের অতটুকুই চর্চা করে, যতটুকু বিশেষ শ্রেণীকেন্দ্রীক জীবনাচারের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠে না।
বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানী শাড়ি পরে বসের বাংলাদেশকে উপস্থাপনের আইডিয়াটা বেশ মনে ধরল। বস সভা কক্ষের দরজা দিয়ে উকি দিয়ে ফিরে গেছেন, সবাইকে সালোয়ার কামিজ পরা দেখে শাড়ির আইডিয়াটা তাৎক্ষণিকভাবে মাথায় এসেছে, এসব তথ্য বস নিজেই দিলেন। আমি বিনীত প্রশংসায় নিমজ্জিত হয়ে শুধু বললাম, খুব ভাল হয়েছে। ওরা বাংলাদেশ সম্পর্কে শুধু শুনবে না। দেখবেও। শাড়ি। কলাপাতা রঙের সবুজ শাড়ি। এক টুকরো সবুজ বাংলাদেশ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১০ সকাল ৯:০৯