'সাম্প্রতিক বাংলা নাটকের অন্যতম প্রধান নাট্যকার সেলিম আল দীন আর নেই'-বাক্যটা যতখানি কানে বেজেছে তার চেয়ে অনেক বেশি বুকে লেগেছে। বিষাক্ত তীরের মতো। অপ্রস্তুত বুকটা হঠাৎ ধুক করে উঠে। মনে হলো ভেতরে, অনুভবের গভীরে ক্রমাগত ভাংচুর শুরু হয়েছে। আমি তখন মৌলভীবাজারে। অফিসের কাজে। আর মাত্র একদিন পর মৌলভীবাজার ক্লাবে একটি সেমিনার আছে। সে সেমিনারের নানা সব আয়োজনের ব্যস্ততায় শরীর-মনে সারা দিনের জমে থাকা ক্লান্তিকে ক্লান্ত করার প্রয়াসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে টিভির রিমোট কন্ট্রোলের বাটনে টিপ দিতেই কানে ভেসে এলো এ অনাকাঙ্খিত সংবাদ। আগের দিন ঢাকাতেই শুনে ছিলাম সেলিম আল দীনের অসুস্থ্যতার কথা। মন ভীষন খারাপ হয়েছিল এই ভেবে যে, প্রগতিশীল চিন্তাধারার সৃজনশীল মানুষগুলো, আমাদের শিল্প-সাহিত্যের অগ্রজ মানুষগুলো, মুক্তির চিন্তা ও চিন্তার মুক্তির মানুষগুলো, যারা ক্রমাগত অনুজদের জন্য আলোকিত পথ তৈরিতে ব্যস্ত রয়েছেন, একে একে সব চলে যাচ্ছেন আমাদের ছেড়ে। সেলিম আল দীনের অকাল মৃত্যুর খবরটি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে এতাটাই অপ্রস্তৃত করেছিল যে, হোটেল কক্ষে আমি অনেকক্ষণ বুঝতে পারিনি কী হয়েছে। আমার বিশ্বাস হয়নি, আমি বিশ্বাস করতে চাইনি-সেলিম আল দীন শারিরীকভাবে বেঁচে নেই। শুধু নিজকে স্বাভাবিক করার জন্য ঢাকায় ফোন দিলাম। আমার জীবনসঙ্গীকে। আরও কয়েকজনকে। সেলিম আল দীনের চলে যাওয়ার কথা জানালাম। আমি নিশ্চিত জানি যে, তাঁরা সবাই এ খবরটি জানেন। তবু বলে যাওয়া। নিজকে স্বাভাবিক করার জন্য। কিন্তু আমি নিজকে স্বাভাবিক করতে পারিনি। শত চেষ্টাতেও না। আমার বারবারই মনে হতো থাকলো যে, আমি আমার খুব কাছের একজনকে হারিয়েছি।
সেলিম আল দীনের সাথে আমার কখনও সামনা-সামনি দেখা হয়নি। কথা হয়নি কাছ থেকে। তবু আমি যেন তাঁকে, তার সৃজনশীলতাকে অনুভব করেছি খুব কাছ থেকে। গভীর আন্তরিকতার মিশেলে। তাঁর প্রতি আমার প্রথম দুর্বলতার জন্ম বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত 'গ্রন্থিকগণ কহে' নাটকের মধ্য দিয়ে। সম্ভবত আমি তখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। নাটক খুব ভাল বুঝি না। এখও যে বুঝি তা নয়। গ্রন্থিকগণ কহের প্রতিটি পর্ব আমি শুধু দেখিনি, গ্রোগ্রাসে গিলেছি, আকন্ঠ পর্যন্ত। তারপর যখন নাট্ক ও নাট্যকলা পড়েছি সাবসিডিয়ারি হিসেবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখন নাটকের বিদ্যাজাগতিক ব্যাকরণ থেকেও সেলিম আল দীনকে বুঝার ব্যর্থ চেষ্টা চলেছে কখনও সখনও। এক টানা দু'বছর নাট্যকলা পড়েও আমি কখনও নাটকের মানুষ ছিলাম না। আজও না। নিরেট দর্শক হওয়া ছাড়া আমার সাথে নাটকের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে নাট্যকলার প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে নাটককে ভিন্ন মাত্রিকতা থেকে, তা ভুল হোক অথবা শুদ্ধ হোক, দেখার একটা বাতিক মাঝে মধ্যে কাজ করে। সেলিম আল দীনের জন্য আমার দুর্বলতা হয়তো সে কারণেও। মঞ্চ নাটককে নির্মাণ শৈলী ও দর্শনের জায়গা থেকে পাশ্চাত্যের প্রবল ধারা থেকে মুক্ত করে একটি স্বতন্ত্র নাট্য- ধারা তৈরির যে ক্রমাগত 'ভিশন' নিয়ে সেলিম আল দীন নিরন্তর তার সৃষ্টিশীলতা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তা পরিণত হতে পারতো আরও গভীরভাবে। তার অকাল প্রয়াণে হোচট খেল। অবশ্যই মারাত্মকভাবে। সূবর্ণা মোস্তফা বলেছেন, 'আমরা খুব ভাগ্যবান, সেলিম আল দীনের মতো সৃষ্টিশীল মানুষের সাথে কাজ করার সৌভাগ্য পেয়েছি, এ প্রজম্ম তা মিস করবে, খুব বেশি করে'।
যে কথা বলছিলাম। সেলিম আল দীনের প্রতি আমার দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল শৈশবে। টিভি নাটকের মধ্য দিয়ে। কিন্তু আমরা তাঁকে ঠিক সেভাবে টিভি নাটকে পাইনি। নাট্যকার হিসেবে টিভি নাটকে তার উপস্থিতি ছিল কালে-ভদ্রে। প্যাকেজ নাটক আসার পর তার উপস্থিতি আরও কমে গেল। দর্শক হিসেবে আমরা ছোট পর্দায় তাকে মিস করার পরিমাণটা তাই অনেক বড়। আমার মাঝে মাঝেই প্রশ্ন জাগতো সেলিম আল দীন টিভির জন্য নাটক লিখেন না কেন। যারা তাঁর খুব কাছে ছিলেন, সহকর্মী ছিলেন, তাঁর শিক্ষার্থী ছিলেন তারা এ প্রশ্নের উত্তর ভাল জানবেন। হয়তো প্যাকেজ প্রোডাকশন এর মোড়কে নাটকের মতো একটি শিল্প মাধ্যমের প্রতিদিন বাজারি হয়ে উঠার প্রক্রিয়ার সাথে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন নি। তাঁর নাটকের ভেতরের যে দর্শন সে দর্শনটাকে প্রচারের মতো বিদ্যমান রাষ্ট্রক্ষমতা কেন্দ্রীক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক দূবৃত্তায়ন প্রক্রিয়ার ভেতর থেকে বিকশমান ইলেক্ট্রনিক চ্যানেলগুলোর সৎ সাহসও হয়তো ছিল না। উত্তরটা যাই হোক না কেন আমরা সেলিম আল দীন কে টিভি পর্দায় মিস করেছি খুব বেশি করে। তবে নাটককে, নাট্যদলকে, থিয়েটারকে সমাজ পরিবর্তনের ক্রমাগত মাধ্যম হিসেবে একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করে তা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে সেলিম আল দীন আলোক-বর্তিকা হিসেবে পথ দেখাবেন অনাগত কালের যাত্রীদের। সংগঠক সেলিম আল দীনের প্রতি আমার সমস্ত কৃতজ্ঞতাবোধের প্রধান জায়গাটা এখানেই। তাঁর নাটকের শিল্মমান নিয়ে আলোচনা নিশ্চিতভাবে চলতে থাকবে। কিন্তু নাটকের মাধ্যমে সমাজ রূপান্তরের পথগুলোকে চিনিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তার এই যে চেষ্টা, আমার কাছে তা আরও বড় মাপের শিল্প। যে শিল্পটা আমাদের খুব প্রয়োজন। এখনতো বটেই, আগামী দিনগুলোতেও।
সাপ্তাহিক ২০০০ নিমজ্জন আড্ডা বসিয়েছিল কিছু দিন আগে। সে আড্ডার প্রাণ-পুরুষ সেলিম আল দীন। কারণ নিমজ্জন তারই অনবদ্য সৃষ্টি। এ নিমজ্জন সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেছেন, 'রাষ্ট্র কিন্তু ক্রমশ অমানবিক হয়ে উঠছে। মানুষের সঙ্গে মানবিক আচরণ করছে না। গণ হত্যা, লুন্ঠন, ষড়যন্ত্রের ওপর রাষ্ট্র দাঁড়াচ্ছে। ভালবাসার ওপর দাঁড়াচ্ছে না। উচিত ছিল ভালবাসার ওপর দাঁড়ানো'। এইযে শ্রেণী বিভাজিত কাঠামোয় রাষ্ট্রের চরিত্র আজকের পৃথিবীতে, রাষ্ট্র যেখানে প্রবল পরাক্রমশালী, রাষ্ট্র তার কর্তৃত্ব প্রয়োগের স্বার্থে আইন বোঝে, কিন্তু জনগণকে বোঝে না, তার বিপরীতে একটি মানবিক রাষ্ট্র, মানবিক পৃথিবী নির্মাণের লড়াই-সংগ্রামটাকে নাটকের মাধ্যমে, শিল্প আন্দোলনের মাধ্যমে, গ্রাম থিয়েটারের মাধ্যমে তৃণমূল মানুষের কাছে, সকল মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেলিম আল দীনের আরও অনেক দিন বেঁচে থাকা উচিত ছিল। সেলিম আল দীনের অকাল মৃত্যুতে সে লড়াইটারই ক্ষতি হলো। এ ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার যোগ্য নয়। সেলিম আল দীনের প্রতি অনেক অনেক শ্রদ্ধা আর ভালবাসা...............
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০০৮ দুপুর ১২:৪২