২০১৮ সাল! বাংলাদেশ নামক উদীয়মান অর্থনীতির জন্য এক যুগান্তকারী বছর! এই বছরে আমরা পেলাম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (DSA) – এক অসাধারণ আইনি উদ্ভাবন! এর আগে কী বিশৃঙ্খলাটাই না ছিল ডিজিটাল জগতে! মানুষ যা ইচ্ছা তাই বলত, লিখত, সরকারের সমালোচনা করত, এমনকি ধর্ম নিয়ে ‘অনুভূতি’ প্রকাশ করত!
ভাবুন তো, এসব অরাজকতা চলতে থাকলে দেশের কী হতো! সরকার এই বিপদ বুঝতে পেরে এগিয়ে এলো ত্রাতার ভূমিকায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মহৎ – ডিজিটাল স্পেসকে ‘সুরক্ষিত’ করা, মানে অপ্রয়োজনীয় সব কণ্ঠস্বরকে শান্ত করে দেওয়া। আর ডিএসএ এই কাজটিই নিপুণভাবে সম্পন্ন করেছে। এটি ছিল সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের প্রতি এক নীরব আশীর্বাদ!
এই আশীর্বাদের ছোঁয়ায় সাংবাদিক, লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট, এমনকি ছোট ছোট শিশুরাও পেল ‘নিরাপত্তা’ – এমন নিরাপত্তা যা তাদের অপ্রয়োজনীয় বাক স্বাধীনতা থেকে মুক্তি দিল! এই আইন প্রমাণ করেছে যে, নীরবতাই পরম শান্তি।
এই মহাকাব্যে আমরা দেখব কীভাবে ডিএসএ তার ‘মহান’ উদ্দেশ্য পূরণ করল, কীভাবে পরিসংখ্যান তার ‘সাফল্য’ প্রমাণ করল, আর কীভাবে বিশ্বও আমাদের এই নীরবতা অর্জনের ‘গৌরবে’ শরিক হলো (অবশ্যই নিজেদের মতো করে)!
নীরবতার বীজ বপন – একটি নতুন সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি (পটভূমি ও প্রণয়ন ২০১৮)
ডিএসএ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না, এটি ছিল একটি বিবর্তন। আইসিটি আইন ২০০৬-এর ৫৭ ধারা ছিল নীরবতার পথে আমাদের প্রথম পদক্ষেপ। এটি ছিল ছোটখাটো একটি যন্ত্র, যা দিয়ে সীমিত সংখ্যক কণ্ঠকে থামানো যেত। কিন্তু সরকার বড় লক্ষ্য স্থির করেছিল – সমগ্র ডিজিটাল স্পেসকে নীরব করা! তাই ৫৭ ধারার মতো সেকেলে যন্ত্র বাতিল করে আনা হলো ডিএসএ – এক বিশাল নীরবতা মেশিন!
২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, কোনো অপ্রয়োজনীয় আলোচনা বা বিতর্কের সুযোগ না দিয়েই বিলটি সংসদে পাস হয়ে গেল। আলোচনা কেন দরকার? সরকার যখন জনগণের ভালোর জন্য কিছু করে, তখন সেটা চোখ বন্ধ করে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ!
ডিএসএ-র ধারাগুলো ছিল একেকটি মাস্টারপিস, বিশেষ করে বাকস্বাধীনতার জন্য মারাত্মক ধারাগুলো:
ধারা ২১: মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা – এসব নিয়ে সামান্য ভিন্নমত পোষণ করলেই আপনি দেশের জন্য বিপজ্জনক! শাস্তি জামিন-অযোগ্য – একবার ঢুকলে নীরবতা নিশ্চিত!
ধারা ২৫: ‘আক্রমণাত্মক’, ‘ভীতি প্রদর্শক’, ‘বিভ্রান্তিমূলক’ তথ্য – শব্দগুলোর মানে এতটাই নমনীয় ছিল যে, সরকার বা তার সমর্থকরা যা খুশি তাই ব্যাখ্যা করে যে কাউকে ফাঁসাতে পারত!
ধারা ২৮: ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত – এটি ছিল একটি অত্যন্ত কার্যকর অস্ত্র, যা ব্যবহার করে অসংখ্য মানুষকে শায়েস্তা করা হয়েছে।
ধারা ২৯: মানহানি – সরকারের বা ক্ষমতাসীন দলের কারও বিরুদ্ধে কিছু বললেই মানহানির মামলা! এটি ছিল সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়রানির হাতিয়ার।
ধারা ৩১: আইনশৃঙ্খলার অবনতি – আপনার একটা অনলাইন পোস্টও নাকি দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে পারত! কী শক্তি আপনার লেখার! আইন করে সে শক্তিকে দমন করা হলো!
ধারা ৩২: সরকারি গোপনীয়তা – অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কফিনে শেষ পেরেক! দুর্নীতির খবর খুঁজতে গেলেই আপনি রাষ্ট্রের শত্রু!
ধারা ৪৩: বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার – পুলিশের জন্য এক অসাধারণ ক্ষমতা! যাকে খুশি, যখন খুশি ধরে এনে নীরবতা কেন্দ্রে পাঠানো যেত!
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো (HRW, Amnesty, Article 19, CPJ, RSF) আর দেশের কিছু ‘নৈরাশ্যবাদী’ এই আইনের সমালোচনা করে বললো, এটা নাকি স্বাধীনতার লঙ্ঘন! তারা বুঝল না যে, এটা স্বাধীনতার লঙ্ঘন নয়, এটা স্বাধীনতার ‘নিয়ন্ত্রণ’, যা আরও বড় শান্তি এনে দেয়!
রিপোটার্স উইথ-আউট বর্ডার্স (আরএসএফ) তখন তাদের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আমাদের অবস্থান দেখিয়েছিল ১৪৬তম (১৮০টি দেশের মধ্যে)! (তথ্যসূত্র: আরএসএফ ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স ২০১৮)। এর মানে তখনও আমাদের সাংবাদিকদের মধ্যে ‘অবাধ্যতা’ আর ‘মুখরতা’ বেশ ভালো পরিমাণে ছিল, যা দ্রুত ঠিক করা প্রয়োজন ছিল। ডিএসএ ছিল সেই সমস্যার সমাধান!
নীরবতার প্রাথমিক সুর – আইনের প্রয়োগের সূচনা (২০১৮ শেষ ভাগ – ২০১৯)
ডিএসএ কার্যকর হওয়ার সাথে সাথেই তার শুভ যাত্রা শুরু হলো। ২০১৮ সালের শেষ দিকেই কিছু মামলা দায়ের হলো। আর ২০১৯ সাল ছিল ডিএসএ-র কার্যকারিতা প্রদর্শনের বছর। মামলা দায়েরের হার বাড়তে শুরু করল! যারা সরকার, সরকারি কর্মকর্তা বা ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা করার ‘ধৃষ্টতা’ দেখাত, তাদের কাছে পৌঁছে যেত ডিএসএ-র নোটিশ। মামলাগুলো মূলত দায়ের করতেন স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। (তথ্যসূত্র: সংবাদ প্রতিবেদন ও মানবাধিকার সংস্থা)
যদিও ২০১৯ সালের মামলার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পরবর্তী বছরগুলোর মতো বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়নি, তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাদের প্রতিবেদনে বারবার উল্লেখ করল যে, এই আইন ভিন্নমত দমনে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিছু সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্ট গ্রেফতারও হলেন। এটি ছিল নীরবতার পথে এক দৃঢ় পদক্ষেপ, যা জানান দিল – ডিজিটাল স্পেস এখন আর ‘ফ্রি-স্পেস’ নয়!
নীরবতার প্রবৃদ্ধি – মহামারীর সুযোগে দ্রুত বিস্তার (২০২০)
২০২০ সাল ছিল ডিএসএ-র জন্য এক আশীর্বাদের বছর! কোভিড-১৯ মহামারী এলো, আর ডিএসএ পেল তার পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখানোর এক অসাধারণ সুযোগ! মানুষ যখন স্বাস্থ্যখাতের অব্যবস্থাপনা, ত্রাণ চুরি বা অন্যান্য অনিয়ম নিয়ে কথা বলতে চাইল, ডিএসএ বলল, “চুপ! এগুলো ‘গুজব’! আর গুজব ছড়ানো মানে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র!”
২০২০ সালের প্রথম পাঁচ মাসেই সারাদেশে ৪০৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল এবং ৩৫৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল! কী চমৎকার গতি! মহামারীর সাথে সাথে ডিএসএ-র ‘প্রভাব’-ও ছড়িয়ে পড়ল দ্রুত।
ফেসবুক: এই বছরে ফেসবুক ছিল ডিএসএ-র ‘সেরা পারফর্মার’! বেশিরভাগ মামলাই হলো ফেসবুক পোস্ট, কমেন্ট বা শেয়ার নিয়ে। সিজিএস-এর পরবর্তী গবেষণা দেখিয়েছে যে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ডিএসএ-তে দায়ের হওয়া মোট মামলার প্রায় ৬৫% ছিল ফেসবুক সম্পর্কিত! (তথ্যসূত্র: সিজিএস গবেষণা, ইত্তেফাক)
মনে আছে সেই ১৫ বছরের কিশোরকে? ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ‘আপত্তিকর’ পোস্ট দেওয়ার জন্য তাকে গ্রেফতার করে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হলো। মাত্র ১৪ বছর বয়সে নীরবতার প্রশিক্ষণ!
কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর আর লেখক মুশতাক আহমেদকে তো ভোলার নয়! তারা ফেসবুকে সরকারের সমালোচনা করে কার্টুন আর লেখা পোস্ট করেছিলেন। ২০২০ সালের মে মাসে তাদেরসহ মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। অভিযোগ ছিল, তারা নাকি ফেসবুকে ‘রম্য লেখা’ ও ‘কার্টুন’ পোস্ট করে ‘রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ এবং গুজব’ ছড়াচ্ছিলেন!
এই মামলা প্রমাণ করল, হাস্যরসও কতটা ‘বিপজ্জনক’ হতে পারে! মুশতাক আর কিশোরের মতো মানুষদের গ্রেফতার করে সরকার হাজার হাজার মানুষকে বুঝিয়ে দিল – হাসির চেয়ে কান্না নিরাপদ!
২০২০ সালের পরিসংখ্যান দেখাল, ডিএসএ কতটা সফলভাবে ডিজিটাল স্পেসকে ‘নিয়ন্ত্রণে’ আনতে শুরু করেছে।
নীরবতার চরম মূল্য – এক প্রাণের বিনিময়ে শিক্ষা (২০২১)
২০২১ সাল ছিল নীরবতার এই মহাকাব্যের সবচেয়ে ‘শিক্ষণীয়’ অধ্যায়। মুশতাক আহমেদ, যিনি ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার অপরাধে ২০২০ সালের মে মাস থেকে কারাবন্দী ছিলেন, ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সেখানেই মারা গেলেন। তার বারবার জামিন নামঞ্জুর হওয়া প্রমাণ করে, আইনের প্রয়োগ কতটা ‘নিষ্ঠুর’ হতে পারে!
মুশতাকের মৃত্যুতে কিছু লোক অবশ্য প্রতিবাদে ফেটে পড়ল, আইন বাতিলের দাবি জানাল। কিন্তু সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল রইল। একই বছর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আটকে রেখে গ্রেফতার করা হলো। তার ‘অপরাধ’? তিনি দুর্নীতির খবর খুঁজছিলেন! তাকে ডিএসএ-র পাশাপাশি ব্রিটিশ আমলের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টেও অভিযুক্ত করা হলো!
রোজিনার ঘটনা প্রমাণ করল – সরকারের ‘গোপনীয়তা’ বজায় রাখাই দেশপ্রেমিকের লক্ষণ, সেটা ফাঁস করা নয়! ২০২১ সালে ডিএসএ তার কাজ চালিয়ে গেল। কত মানুষ গ্রেফতার হলো, কত পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হলো! কিন্তু নীরবতার পথে যাত্রা চলতেই থাকল।
নীরবতার জয়ধ্বনি – পরিসংখ্যানের মহাকীর্তি (২০২২)
২০২২ সাল ছিল ডিএসএ-র সাফল্যের স্বর্ণশিখর! এই বছর আইনটি তার পূর্ণ শক্তিতে আবির্ভূত হলো। মামলার সংখ্যা পূর্বের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেল! সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস)-এর গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (প্রায় ৫ বছর) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সারাদেশে মোট ১৪৩৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে! (তথ্যসূত্র: সিজিএস গবেষণা, প্রথম আলো) এটি প্রমাণ করে, ডিএসএ কতটা কার্যকরভাবে নতুন ‘অপরাধী’ খুঁজে বের করতে পারত!
সিজিএস-এর তথ্য আরও গর্বের সাথে ঘোষণা করে যে, এই ৫ বছরের মামলায় কমপক্ষে ৪৫২০ জনকে আসামি করা হয়েছে! (তথ্যসূত্র: সিজিএস গবেষণা, প্রথম আলো) ৪৫২০ জন মানুষ নীরবতার পথে চালিত হয়েছে! কী বিশাল অর্জন!
গ্রেফতারের সংখ্যাও ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ৮৪২ জনকে আটক করা হয়েছিল ডিএসএ-তে! (তথ্যসূত্র: সিজিএস গবেষণা, ডেইলি স্টার)
কে ছিল এই আইনের শিকার? সিজিএস বলছে, ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পেশা জানা গেছে এমন ৩১৫ জন আটককৃতদের মধ্যে ৮০ জন ছিলেন রাজনীতিবিদ, ৫৯ জন সাংবাদিক, এবং ৪৭ জন ছাত্র! (তথ্যসূত্র: সিজিএস গবেষণা, ডেইলি স্টার)
আইনটি সমাজের সবচেয়ে মুখর গোষ্ঠীগুলোকেই প্রথমে বেছে নিয়েছে! এটি প্রমাণ করে আইনটি কতটা ‘দক্ষ’ ছিল! অন্তত ২৮ জন অপ্রাপ্তবয়স্ককে আসামি করা হয়েছে এবং ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে! (তথ্যসূত্র: সিজিএস গবেষণা) ছোটবেলা থেকেই নীরবতার গুরুত্ব শেখানো!
আরএসএফ-এর বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আমাদের অবস্থান এই বছরে আরও ‘উন্নত’ হলো! ২০২১ সালে যেখানে আমরা ১৫২তম স্থানে ছিলাম, ২০২২ সালে আরও ১০ ধাপ এগিয়ে (পিছিয়ে) আমরা ১৬২তম স্থানে পৌঁছে গেলাম! (তথ্যসূত্র: আরএসএফ ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স ২০২২) এটি প্রমাণ করে ডিএসএ কতটা সফলভাবে গণমাধ্যমকে ‘নিয়ন্ত্রণে’ আনতে পেরেছে!
নীরবতার মোড়ক পরিবর্তন – নতুন নাম, পুরনো কাজ (২০২৩)
ডিএসএ-র সাফল্য যখন বিশ্বজুড়ে ‘চর্চার’ বিষয় হয়ে দাঁড়াল (এবং কিছু দেশ একে ‘কালো আইন’ বলল), তখন সরকার দেখল, নাম বদলানো যাক! এতে সমালোচকদের মুখ বন্ধ হবে, আর কাজও চলবে! নিয়ে আসা হলো সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ)! ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর এটি কার্যকর হলো। নামটা শুনলে মনে হয় যেন সাইবার জগতে কোনো সমস্যাই থাকবে না! (তথ্যসূত্র: গেজেট বিজ্ঞপ্তি)
সরকার বলল, নতুন আইনে অপপ্রয়োগ কম, শাস্তি কম, অনেক ধারা জামিনযোগ্য! (তথ্যসূত্র: আইনমন্ত্রীর বক্তব্য) কিন্তু অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিশ্লেষণ দেখাল, ডিএসএ-র ৬২টি ধারার মধ্যে ৫৮টিই সিএসএ-তে প্রায় একই রকম! (তথ্যসূত্র: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্লেষণ) এটি হলো পুরনো নীরবতাকে আরও মসৃণ প্যাকেজে উপস্থাপন!
জামিন অযোগ্য ধারা ১৪টি থেকে কমে ৪টি হলো। কী বিশাল পরিবর্তন! কিন্তু ২১, ২৮, ২৯ (পূর্বের ৩২), ৪২ (পূর্বের ৪৩)-এর মতো মূল অস্ত্রগুলো ঠিকই রয়ে গেল। এর অর্থ হলো, ফেসবুকসহ যেকোনো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কথা বলার ঝুঁকি আগের মতোই রয়ে গেল! সিএসএ কার্যকর হওয়ার পরও মামলা চলছে, কারণ নীরবতা নিশ্চিত করার কাজ তো আর থেমে থাকতে পারে না!
২০২৩ সালে আরএসএফ সূচকে আমরা আরও এক ধাপ ‘উন্নত’ হয়ে ১৬৩তম স্থানে এলাম! (তথ্যসূত্র: আরএসএফ ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স ২০২৩) ডিএসএ-র বিদায়লগ্নেও তার সাফল্য অক্ষুণ্ণ রইল!
নীরবতার স্থায়ীত্ব – এক শান্ত, সুশীল ডিজিটাল সমাজ (২০১৮-২০২৪)
ডিএসএ এবং সিএসএ বাংলাদেশের গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ এবং গণতন্ত্রের জন্য ছিল এক অসাধারণ ‘শিক্ষা সফর’। এই সফর শেষে আমরা শিখলাম, নীরবতাই পরম সুখ। সেলফ-সেন্সরশিপ এখন জীবনের অংশ। সাংবাদিকরা এখন নিরাপদ খবর খুঁজে বের করেন। শিক্ষক ও গবেষকরা ‘বিপজ্জনক’ আইডিয়া নিয়ে না ভেবে নিরাপদে কাজ করেন। সিজিএস-এর ৫ বছরে দায়ের হওয়া ১৪৩৬টি মামলা আর ৪৫২০ জন আসামির পরিসংখ্যান তো প্রমাণ করে যে, এই নীরবতা কতটা মূল্যবান ছিল! (তথ্যসূত্র: সিজিএস গবেষণা)
আরএসএফ-এর বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আমাদের অবস্থান এই বছর আরও ‘উন্নত’ হয়েছে! ২০২৪ সালে আমরা ১৬৫তম স্থানে পৌঁছেছি! (তথ্যসূত্র: আরএসএফ ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স ২০২৪) ভাবুন তো, ২০১৮ সালের ১৪৬তম স্থান থেকে ২০২৪ সালের ১৬৫তম স্থান! মাত্র কয়েক বছরে ১৯ ধাপ ‘উন্নতি’!
সমালোচকরা এটাকে ‘অবনতি’ বলছে! তারা বুঝেই না যে, এটা অবনতি নয়, এটা নীরবতার দিকে আমাদের অপ্রতিরোধ্য যাত্রা! এটা প্রমাণ করে, ডিএসএ এবং সিএসএ কতটা সফলভাবে দেশের ডিজিটাল কণ্ঠস্বরকে ‘নিয়ন্ত্রণে’ আনতে পেরেছে!
ভয়ের সংস্কৃতি? না না, এটা ভয়ের সংস্কৃতি নয়, এটা হলো আইনের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা আর স্মার্ট হওয়ার প্রক্রিয়া। মানুষ বুঝে গেছে, কথা বলে ঝামেলায় জড়ানোর চেয়ে চুপচাপ থাকা অনেক ভালো। এটি বাংলাদেশের ডিজিটাল স্পেসকে এতটাই শান্ত করে তুলেছিলো যে, তখন সেখানে শুধু উন্নয়নের জয়গান আর কর্তৃপক্ষের প্রশংসা শোনা যেত!
নীরবতার ভবিষ্যৎ – শান্তি কি বজায় থাকবে? (২০২৪ এবং তৎপরবর্তী)
২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। আর এখন তারা ডিএসএ এবং সিএসএ বাতিলের কথা বলছে! (তথ্যসূত্র: অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টার বক্তব্য) তারা নাকি একটি নতুন ‘সাইবার সুরক্ষা আইন’ আনবে যা শুধু প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা দেখবে!
হায় হায়! এটা কি নীরবতার এই সুন্দর প্রাসাদ ভেঙে ফেলার ষড়যন্ত্র? এই আইনগুলো বাতিল হয়ে গেলে মানুষ যদি আবার কথা বলতে শুরু করে, গুজব ছড়ায়, সরকারের সমালোচনা করে, তাহলে কী হবে? দেশ কি আবার সেই পুরনো ডিজিটাল নৈরাজ্যে ফিরে যাবে? আশা করা যায়, নতুন আইনেও নীরবতা বজায় রাখার কিছু চমৎকার কৌশল লুকানো থাকবে, যা হয়তো আরএসএফ সূচকে আমাদের অবস্থানকে আরও ‘উন্নত’ করতে সাহায্য করবে!
একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য নাকি মত প্রকাশের স্বাধীনতা অপরিহার্য? এটা একটা পুরোনো মিথ! বাংলাদেশ ডিএসএ-র মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে যে, নীরবতাও গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য হতে পারে! বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় এমন আইন জরুরি যা হয়তো আবার মানুষকে কথা বলার ‘বিপজ্জনক’ সুযোগ দেবে।
কিন্তু ততদিন পর্যন্ত, আসুন আমরা আমাদের অর্জিত নীরবতা উপভোগ করি। কারণ, কে জানে, আগামীকাল আপনার একটা পোস্টও হয়তো নীরবতার এই মহাকাব্যে নতুন একটি অধ্যায় যোগ করতে পারে!
জয় নীরবতার! জয় ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণের!
ছবি: দৈনিক যুগান্তর
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ২:২৪