ছবিঃ সমকাল পত্রিকা।
শিরোনাম পড়ে মনে হতে পারে "দ্বিতীয় দিন কেন? প্রথম দিন কেন নয়? " আসলে স্কুলে আমার প্রথম দিন গতানুগতিকই ছিলো।প্রায় সবার সাথেই মিলে যাবে।বাবার আঙুল ধরে এক কিলো হেঁটে স্কুলে গিয়ে ক্লাসে ঢুকলাম, একজন ম্যাডাম স্বাগত জানিয়ে বেঞ্চে বসিয়ে দিলেন, কিছু পড়লাম,কিছু লিখলাম তারপর বাবার সাথে আবার চলে এলাম। আমার প্রথম দিন বেশ বোরিং ছিলো। যদিও তখন বোরিং জিনিসটা যে কী সেটা বোঝারই বয়স হয় নি। তাই বুঝতে পারিনি।
এবার আসি দ্বিতীয় দিনে। আম্মু রেডি করিয়ে দিলেন সকাল সাড়ে ৬ টার মধ্যে।খুব সুন্দর করে চুলে তেল দিয়ে বা দিকে সিঁথি করে চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ে দিলেন।আমার চুল ঘন ও বড় হওয়ায় সামনের অংশের চুলে আমার চোখ ঢেকে গেছে।তখনকার প্রায় সব বাচ্চাদের মতোই আমার পরনে ঢোলা সাদা হাফহাতা শার্ট, যা আমার কনুই পার হয়ে গেছে আর নেভি ব্লু হাফপ্যান্ট, সেটা আবার আমার হাঁটু পার হয়ে গেছে।শার্ট আবার ইন করা ছিলো। সাথে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা সাদা মোজা আর কালো শু। বেশ কিম্ভুত একটা লুক। এই লুকে আমি বেশ গাম্ভীর্যের সাথে পেছনে হাত বেঁধে উঠোনে পায়চারী করছি বাবার অপেক্ষায়। তাঁর সাথে স্কুলে যাবো বলে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি একটু পরপর ঘড়ি দেখার ভান করছি। কারণ আমি তখন ঘড়ি চিনতাম না। বাবা কিনে দিয়েছিলেন প্রথম স্কুলে যাচ্ছি এই উপলক্ষে। ' উডি উডপেকার' কার্টুনের ছবিওয়ালা ঘড়ি। আমি ঘড়ি দেখে যাচ্ছি কিন্তু বাবা আসেন না।বেরই হন না ঘর থেকে।
সাড়ে সাতটায় ক্লাস শুরু। আমি উঠান থেকে ঘরে ঢুকে বাবার কাছে গেলাম।
"আব্বু, ইস্কুলে যাবা না?"
"না।তুই একলা যা।সোজা রাস্তা তো। কালকেই তো চিনিয়ে দিলাম।"
আমি চুপ করে ছিলাম। কিছু বলিনি। এটা দেখে বাবা ধমক দিলেন জোরে।
"ভীতুর ডিম কোথাকার। একা যা স্কুলে।কিছু হবে না।"
এবার আমি বিরক্তিকর ভ্যাঁ ভ্যাঁ শব্দে কেঁদেই ফেললাম। আম্মু বের হয়ে এলেন ঘর থেকে। আম্মু কাঁদার কারণ জিজ্ঞাসা করার পর আব্বু বললেন "গাঁধার বাচ্চাকে বলছি একা একা স্কুলে যা। কান্নাকাটি শুরু করছে। খাবে খরাত করে।"
তখন আম্মু এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, "একাই যাও আব্বা।বাইরে দেখবা তোমার মতো আরো কয়েকজন স্কুলে যাচ্ছে।তাদের সাথে চলে যাবা।"
এবার ভয় কেটে গেলো কিছুটা। যদিও পুরোপুরি যায় নি। বাড়ি থেকে বের হয়েই দেখি আম্মুর কথা সত্যি। আরো কয়েকজন যাচ্ছে স্কুলে। অবাক হয়ে গেলাম,"আম্মু জানলো কিভাবে?" অন্য যারা যাচ্ছিলো স্কুলে তাদের পিছু পিছু যাওয়া শুরু করলাম।তারা কী মনে করে, কী ভাববে এসব সংকোচের কারণে তাদের আর ডাকতেই পারলাম না।
স্কুল আমার বাড়ি থেকে এক কিলো দূরে। মেঠোপথে যেতে সুবিধা হতো।হেঁটে যাওয়া যেতো। ঐ পথে কোনো যানবাহন চলতো না। মাঝে মাঝে ঠেলাগাড়ি চলতো।অন্য দিকে একটা পাকা রাস্তা ছিলো।সেখানে ট্রাক, রিকশা,প্রাইভেটকার মোটরসাইকেল সব চলতো। এজন্য স্কুলগামী বাচ্চারা মেঠোপথ দিয়েই হেঁটে যেতো। আমিও যথারীতি সে পথেই যাচ্ছি। বাড়ির সামনে থেকে যেসব বাচ্চার পিছু নিয়েছি তাদের গতির সাথে পেরে উঠছিলাম না।ফলে তারা আমার থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলো। আগেরদিন বাবার সাথে যাওয়ার সময় কিছু জিনিস মনে ছিলো। সেটা হচ্ছে যাওয়ার পথে, প্রথমে দুটো কলাগাছ, এরপর পুকুরের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তা, এরপর দুটো তালগাছ। যদিও রাস্তা একেবারেই সোজা ছিলো। তারপরও প্রথমে কলাগাছ দেখে মনে হলো নাহ! ঠিক পথেই যাচ্ছি। বাচ্চারা গেলে যাক। হেলেদুলে আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছি।হঠাৎ দেখি আমার পাশে একটা ছায়া দেখা যাচ্ছে। এই ছায়াটা আমার না। আমি হাঁটলে ছায়াটা হাঁটে।আমি থামলে থেমে যায়। ভয়ে গতি বাড়িয়ে দিলাম। ভয়ে পেছনে তাকালাম না।দেখলাম ছায়ারও গতি বাড়ছে। হাঁটতে হাঁটতে দুই পুকুরের মাঝের রাস্তায় উঠলাম। তখন দেখলাম দূরে কচুরিপানার ওপর একটা বক বসে আছে। দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম কী করে বকটা!! হঠাৎই একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, "এই বাবু! এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? স্কুলে চলো তাড়াতাড়ি। দেরি হয়ে যাবে তো।"
এরপর আমি বক নীরিক্ষণ প্রোজেক্ট বাদ দিয়ে পুকুরের রাস্তা পার হয়ে আগন্তুকের পেছনে পেছনে যাচ্ছিলাম। যেই না তালগাছের রাস্তায় এসেছি আবার সেই ছায়া। স্কুল বেশি দূরে নয়। এবার দিলাম ভোঁ-দৌড়। দেখলাম ছায়াটা নেই।স্কুলের গেটের ভেতরে ঢুকেই হাঁপাতে লাগলাম।রাস্তায় থাকার সময় ভয়ে পেছনে তাকাই নি। কিন্তু এবার সাহস করে স্কুলের গেটের পেছন থেকে তাকিয়ে দেখলাম রাস্তার দিকে। স্কুলের পাশেই একটা পুরনো জমিদার বাড়ি আছে। খুবই নাজুক অবস্থা। যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে।তবুও কিছু লোক থাকে সেখানে। দেখলাম সেই বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাবা বেশ আরাম করে সিগারেট টানছেন। তাঁর সোনালি ফ্রেমের বড় চশমাটা চকচক করছে রোদের আলো পড়ে। তিনি তাকিয়ে আছেন স্কুলের গেটের দিকে। আমি খুশিতে গদগদ হয়ে বাইরে বের হয়ে দেখি বাবা নাই। "এর মধ্যে কোথায় গেল? তাহলে কি সেটা ভূত ছিলো? ছায়াটাও কি ভূতের?"
আবার ভয় পেলাম। ভয়ে ভয়ে স্কুলের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ক্লাস কোনটা ভুলে গেছি। হঠাৎ দেখি আগের দিনের ম্যাডাম আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছেন। তাকে ক্লাসরুমের কথা জিজ্ঞাসা করার জন্য মাথা তুললাম,কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। কিন্তু ম্যাডাম হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। মুচকি হেসে বললেন, "মিঞাসাহেব কি ক্লাসরুম ভুলে গেছেন? আসেন আপনাকে নিয়ে যাই।" বলেই আমার হাত ধরে আমাকে ক্লাসে ঢুকিয়ে দিলেন। আমি গিয়ে একেবারে শেষের বেঞ্চে বসলাম। ক্লাসের একপাশে সব মেয়ে আর অন্যপাশে ছেলেরা ছিলো। আমি ওদিকে তাকালামই না। একটু পরেই একটা ছেলে এলো কথা বলতে, "তোমার ঘড়িটাতো খুব সুন্দর!!" বলেই ঘড়ির পাশের বোতামগুলো চাপতে শুরু করলো। "ওমা!! কী সুন্দর লাইট জ্বলে!!" তার চোখে রাজ্যের বিস্ময়। বলেই সে দৌড় দিলো। গিয়ে আরেকজনকে ডেকে নিয়ে এলো। পরের জন তো ঘড়ির আলো দেখে হাততালি দিয়ে লাফাতে শুরু করলো। এটা দেখে বাকি বাচ্চারা কৌতুহলী হয়ে আমাকে ঘিরে ধরলো।যখন দেখলাম ক্লাসে আমি একাই ঘড়ি পরেছি আর সেটাতে লাইটও জ্বলে, তখন তো আমি ভাবের চোটে চোখেই দেখি না কিছু। কারো সাথে কথাই বললাম না ভাবের চোটে।
যথারীতি ক্লাস করলাম। দুই পিরিয়ড পরেই ছুটি হয়ে গেল। এবার আবার ভয় পেলাম। আগের দিন তো সাথে বাবা ছিলো, এখন কেউ নেই। তারপর আবার সকাল বেলার ভূত। বাড়ি যাবো কিভাবে? তখনই ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হলো সকালের সেই ছেলেদুটো। এসে বললো, "তোমার আম্মু আসে নাই?"
"আসবে না।"
"কেন? আমাদের তো আসে।তুমি বাড়ি যাবা কিভাবে?"
"একা একা যাবো।"
"তোমার কী সাহস!! আমরা তো একা যেতেই পারি না।আম্মু এখনো আসে নাই। চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।"
আমি হ্যাঁ-না কিছুই বললাম না। ওরা আমার সাথে চলতে শুরু করলো। গল্প করতে করতে কলাগাছের সামনে আসার পর বললাম,
"আর যাওয়া লাগবে না। এখন আমি যেতে পারবো।তোমরা যেতে পারবা?"
তখন ওরা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।কারণ ওরা গল্প করতে করতে আমার সাথে চলে এসেছে।পথের কথা মনে নেই। তখন আমি বললাম, "চলো।আমি এগিয়ে দিয়ে আসি। "
ওদের সাথে হেঁটে হেঁটে আবার তালগাছ পর্যন্ত গেলাম। এখান থেকে স্কুলের ভবনটা দেখা যেত তখন। ওটা দেখেই ওরা আমাকে বিদায় দিয়ে চলে গেল। আমি বাড়িতে ফিরে এলাম।
বাড়িতে গিয়ে আম্মুর কাছে সব ঘটনা বললাম। দেখি, আম্মু সবই জানে। ছায়া দেখে দৌড় দেয়া, পথে দাঁড়িয়ে বক দেখা,স্কুলে ঢুকে আবার বের হয়ে আসা, বন্ধুদের এগিয়ে দেয়া সবকিছু জানে। মাথাটাই ঘুরে গেলো পুরো। "আম্মু সবকিছু কিভাবে জানে?" আমার উৎসাহে একটু ভাটা পড়লো। যখন দেখলাম আম্মু ঘড়ির ব্যাপারে কিছু জানে না তখন একটু খুশি হলাম। বাড়িয়ে বাড়িয়ে অনেক কিছু বললাম।বললাম, ম্যাডামদেরও আমার ঘড়ি পছন্দ হইছে জানো?
আম্মুর ঐদিনের সবকিছু জানার রহস্য অনেকদিন পরে জানতে পেরেছিলাম। পেছনের ঐ ছায়াটা ছিলো আমার বাবার। আমার বোকাসোকা, মনভোলা স্বভাবের ওপর তাঁর ভরসা ছিলো না মোটেও। তাই তিনি দূর থেকে আমাকে অনুসরণ করেছিলেন সেদিন। স্কুলে যাওয়ার পথে আবার আসার পথেও।আমি সেদিন ভয়ে পেছনে তাকাইনি। তাকালে হয়তো তাকে দেখতে পেতাম। পরে যখন জানতে পারলাম, তখন অবিশ্বাসের সুরে বাবাকে বলেছিলাম, "সব মিথ্যা কথা।"
তখন বাবা বলেছিলেন, "ভূতের তো ঠ্যাকা পড়ছিলো যে, তোর মতো গাঁধার পিছু নেবে। আর সেদিনের সেই ছেলেদুটো আমার স্কুলজীবনের একেবারে শুরুর দিকের বন্ধু। তখন থেকে শুরু।এরা এখনো আমার বন্ধু।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ বিকাল ৩:৩০