somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতিচারণ: মাওয়া ঘাট এবং ইলিশ বিড়ম্বনা

০৬ ই জুলাই, ২০২১ বিকাল ৩:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ছবিসূত্র: prothomalo.com

পড়াশোনার কারণে আমাকে ছয় বছর বরিশালে থাকতে হয়েছিলো। সেই ছয় বছরের কোনো এক বছরের ঘটনা এটি। আমি গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়িতে এসেছি। ছুটিটা বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিলো।এত সুখ সহ্য হচ্ছিলো না কেন যেন।তাই ভূতের কিল খেলাম নিজে যেচে। আমাদের বাড়ির গাছে সেবার আম হয়েছিলো অনেক।এক সকালে বাবা এক ব্যাগ আম গুছিয়ে নিয়ে আমাকে বললেন,

"যা। তোর ফুফুর বাড়িতে দিয়ে আয়।"

আমি বললাম, "আচ্ছা যাচ্ছি।"

ভাবলাম তখনই তাড়াহুড়ো না করে দুপুরে খেয়ে ধীরে সুস্থে রওনা দেব।কিন্তু সেদিন দুপুরে এমন ঘুম দিলাম যে সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাতের বেলা বাবা বাড়ি ফিরে দেখেন আমি তখনো বাড়িতে।ছোট ভাইবোনের সামনে এমন ধমক দিলেন আর রাগারাগি করলেন যে আমার আর সহ্য হলো না। "আমি আর থাকবো না এখানে (অনেকটা আমি তো ভালা না, ভালা লইয়াই থাইকো টাইপের সিদ্ধান্ত)।" বলেই রওনা দিলাম বরিশালের পথে।

প্রথমে উল্লেখ করে নিই, বরিশালে যাতায়াতের সবচেয়ে সহজ,আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী মাধ্যম লঞ্চ।তাই বেশির ভাগ সময়ে আমি লঞ্চেই যাতায়াত করেছি। ইমার্জেন্সি অবস্থা হলে তখন বাসে যাতায়াত করতাম। যেদিন বাবার ওপর অভিমান করে বের হয়ে গেলাম, সেদিন রাত নয়টা বেজে গিয়েছিলো। লঞ্চ সব ছেড়ে চলে গেছে। সরাসরি বাসও নেই তখন। পোস্তগোলা ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছি।তখন রাত দশটা।বিভিন্ন রুটের বাসের দালাল এসে জিজ্ঞাসা করছে, "কই যাইবেন?" একজনের বাসও বরিশাল যাবে না। একটু ভয় করতে লাগলো। মনে হচ্ছিলো "বাবার অভিশাপ লাগছে মনে হয়। এভাবে চলে আসাটা ঠিক হয় নি।" একবার মনে হলো ফিরে যাই।পরেই আবার মনে হলো, নাহ! যাবো না।সবাই হাসবে।আমার সাহস নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। এর মধ্যে আবার বাবা ফোন দিলেন। ভাবলাম দুবার ফিরে আসতে বললেই চলে যাবো। কিন্তু বাবা একবারও বললেন না।উলটো সহজে কিভাবে যাবো সেই কৌশল বাৎলে দেয়া শুরু করলেন। মেজাজ গেল বিগড়ে। যেভাবেই হোক বরিশালই যাবো পণ করলাম।কিন্তু পণ করলেই তো হবে না।উপায়ও থাকতে হবে।বরিশালের বাস পাচ্ছি না। ঠিক করলাম, কোনো একটা বাসে উঠে মাওয়া পার হয়ে কাওড়াকান্দি নেমে যাবো। ওপারে গেলেই বরিশালের বাস পাওয়া যাবে। এই প্ল্যান কাজে দিলো। ঘন্টাখানেকের মধ্যে মাওয়া চলে এলাম। কিন্তু দেখলাম ঘাটে প্রচুর ভিড়। আমার বাসের সিরিয়াল ৪৭ নম্বরে। কী আর করার! তখন লঞ্চও নেই।

ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত অনেক গাওয়া হলো। ভূমিকা অনেক বড়ো হয়ে গেল।এবার আসল ঘটনায় আসি।রাত ৯ টায় বের হয়ে এগারোটা নাগাদ মাওয়ায় এসে পৌছেছি।রাতের খাবার খেয়ে বের হইনি।খিদেয় পেট চো চো করছে ।মাওয়া মানে আগেকার মাওয়া। এখন আর মাওয়াতে ঘাট নেই। সেটা শিমুলিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে। মাওয়া ঘাটে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছি। বাসের সিরিয়াল ৪৭।আমার উদ্দেশ্য ওপারে যাওয়া।তাই বাস থেকে নেমে গেছি।কিছুক্ষণ আগেই একটা ফেরি মিস করেছি। তখন ফেরী পাড় হতেও আড়াই ঘন্টা লাগতো। তাই আমার হাতে আড়াই ঘন্টা সময় ছিলো। ঘুরে বেড়াচ্ছি, এর মধ্যেই এক হোটেলের দালাল রীতিমতো আমার হাতের বাহু চেপে ধরলো।

"ভাই। বইয়া যান। এক্কেরে অরজিনাল পদ্মার ইলিশ। খাইয়া সারাজীবন মনে রাকবেন।"

বলতে বলতেই আমাকে প্রায় টেনে চুলার পাশে নিয়ে গেল। সেখানে একটা কড়াইয়ের পাশের ট্রে-তে থরে থরে অনেকগুলো ইলিশ মাছের টুকরো সাজানো ছিলো। সাইজে বেশ বড় এবং মশলা মাখানো। কয়েকটার মধ্যে ডিম আছে আবার। আমি সেদিকে তাকাতেই দালাল সাহেবের চোখে পড়লো সেটা।

"এইযে ভাই। ডিম অলা মাছ।অহনই ভাইজ্জা দিবো।বিতরে বসেন।"

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "পিস কত কইরা বাই?"

উত্তর পেলাম " দেড়শো ট্যাকা।অরজিনাল পদ্মার ইলিশ।দাম বেশি।"

দাম শুনেই উলটো দিকে ঘুরে হাটতে শুরু করলাম। তখন সেই লোক এসে বললো,

"বাই। রাগ করেন ক্যা? আপনে একশো দিয়েন।রাইত বেশি। কাস্টমার নাই। আপনের লাইগ্যা কমাইলাম।নইলে এই দামেই বেচি।"

ধুপ করে দাম দেড়শো থেকে একশোতে নেমে আসায় একটু খটকা লাগলো। একটা চান্স নিলাম।

বললাম "পঞ্চাশ দিমু। দিলে দাও।নাইলে গেলাম গা।"

সে না-সূচক মাথা নাড়তেই আমি হাটা শুরু করলাম। ভাবলাম খাবো না।দাম বেশি কিন্তু একটু পরেই আমাকে অবাক করে দিয়ে দালাল সাহেব ডেকে বললো,

" আর দশটা ট্যাহা দেন বাই।আমি চাইয়া নিলাম।"

কী আর করার! ষাট টাকায় ভাজা ইলিশ মাছ খেতে রাজি হয়ে গেলাম। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মাছ ভাজতে দেখে সেই মাছটাই যেন আমার প্লেটে আসে সেটা নিশ্চিত করলাম। কিন্তু বাটিতে যা এলো সেটা দেখে আমার আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেল। বাটিতে সেই মাছের টুকরো। সাথে একেবারে কুচকুচে কালো সয়াবিন তেল আর তার মধ্যে ডুবে আছে একটা শুকনো মরিচ। ষাট টাকায় এর চেয়ে বেশি আর কী দেবে! ভেবে নিয়ে খেতে শুরু করলাম। কিন্তু খেতে বসে মনে হলো, অরজিনাল পদ্মার ইলিশ তো দূরের কথা! এখানে ইলিশ মাছের স্বাদ, ঘ্রাণ কিছুই নেই। তাও খেতে থাকলাম। কিন্তু বিপত্তি এলো এর একটু পরেই।

দালাল সাহেব হন্তদন্ত হয়ে দৌড়তে দৌড়তে এসে বললো, "

বাই। বাই। আপনের বাস গেলো গা।ফেরিতে উইট্টা যাইতাছে।"

সে জানতো না আমি বাস ত্যাগ করেছি। তাও বললাম,

" বাই।গুইন্না দেখছি। সিরিয়াল ৪৭ নাম্বার।"

"আরে বাই ট্যাহা দিয়া সাইড কাইট্যা ডুইক্কা গেছে মিয়া।ঘাটের অবস্তা জানেন না তো কিছুই।"

আমার প্রতি লোকটার উৎকণ্ঠাকে স্বাগত জানিয়ে আমি তার সাথেই উঠে গিয়ে দেখতে লাগলাম বাস যাচ্ছে কিনা। কিন্তু খুশি হবার বদলে দেখলাম তার মুখটা কালো হয়ে গেল। এখন আপনার হয়তো জিজ্ঞাসা করতে পারেন তার মুখ কালো কেন হয়ে গেল? আমি তো তার পরিকল্পনা মতোই কাজ করেছি। আসল ব্যাপার হলো, আমি প্লেট হাতে নিয়েই বাইরে বের হয়ে এসেছি।সেটা তার চোখ এড়ায় নি। তার মুখ কালো দেখে বললাম,

" আহারে বাই, বাসটা গেল গা। কী আর করমু? খাইয়াই যাই!" বলে ভেতরে চলে গেলাম।

ইলিশ মাছ দিয়ে গরম ভাত খেয়ে বিল মিটিয়ে বাইরে চলে এলাম। আমার মেজ চাচার মুখে আরিচা ঘাটের এই জালিয়াতির গপ্পো শুনেছিলাম। লোকজন প্লেট হাতে দৌড় দেয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করার ফলে নাকি এই জালিয়াতি অনেকটা কমে গিয়েছিলো। মাওয়া ঘাটেও এই জালিয়াতি হয় এটা জানতাম না। তবে সেদিন চাচার গপ্পের অভিজ্ঞতা কাজে দিয়েছিলো।

বাইরে বেরিয়ে দেখলাম ঘড়িতে প্রায় পৌনে বারোটা বাজে। এখন ফেরিতে উঠলেও ওপারে যেতে যেতে রাত আড়াইটা বাজবে। তখন বাস পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই।মাইক্রোবাস পাওয়া যাবে।কিন্তু ডাকাতির ভয় উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই সকল নিশ্চিত হাসাহাসি উপহাসকে উপেক্ষা করে বাড়িতেই রওনা দিলাম। দু-ঘন্টার মধ্যেই বাড়িতে পৌছে গেলাম। বাবা-ই দরজা খুলে দিলেন। কোনো বাক্য বিনিময় হলো না। ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরের দিন সকালবেলা দেখলাম যে-ই আমার দিকে তাকায় সে-ই মুখ টিপে হাসে। শেষে আর না পেরে রাতে ঘটে যাওয়া আমার বীরত্বের গল্প বললাম সবাইকে। দেখলাম ছোটভাই একটু ইম্প্রেসড হয়েছে।কিন্তু ছোটবোন আর বাবা-মা এবার জোরেসোরে হাসছে। শেষে বাবা বলে বসলেন,

" ইলিশ খাওয়ার শখ জাগছে বললেই পারতা।এনে দিতাম। এত তেজ দেখিয়ে মাওয়া যাওয়ার কী দরকার ছিলো?"

(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০২১ বিকাল ৩:২১
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×