*** গল্পটি তিন পর্বে সমাপ্ত হবে। গল্পের প্রয়োজনে কিছু অশ্রাব্য স্ল্যাং ব্যবহার করা হয়েছে ।আশাকরি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন সবাই।***
প্রথম পর্ব
“মইন্যা, দেক তো, দাড়োয়ানডা কই চাইয়া রইছে?"।সাথের ছেলেটিকে প্রশ্ন করে রাকিব।
মনির একটু পরে উত্তর দেয়, “কসাইয়ের বাচ্চার এদিক তে চোকই লড়ে না।”
“তাইলে আর অইছে কাম।” আক্ষেপ ঝরে পড়ে রাকিবের কণ্ঠে।
পার্কের ইনকাম হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় মন খারাপ হয় দুজনের। অফিস টাইম শুরু হয়ে গেছে বহু আগে। এখন পার্কে সকালের লোকেরা নেই। কিন্তু তারপরও লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে পার্ক। স্কুল কলেজের ছেলে-মেয়েরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডা মারতে আসে এখন। এটা তাদের জন্য অনেক ভালো ব্যাপার।এসময় ইনকাম বেশি হয়। এই ইউনিফর্ম পরিহিত মানুষগুলো সকালের স্যারদের চেয়ে বেশি টাকা দেয়। সাথে মেয়ে থাকলে তো কথাই নেই।তবুও অনেক কষ্ট হয় এদের থেকে টাকা বের করতে। রাকিব প্রায়ই গিয়ে এদের কারো পা জড়িয়ে ধরে। কেউ বিব্রত হয়,কেউ টাকা দেয় আবার কেউ ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। ছেলেদের কাছে চেয়ে না পেলে সাথে থাকা মেয়েদের পা ধরে বসে থাকে। বেশির ভাগ সময়েই তারা ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। ঘিন্নায় শরীর স্পর্শ করতে পারে না বলে ধাক্কা দিয়ে সরিয়েও দিতে পারে না মেয়েগুলো। তখন তারা সাথের ছেলের কাছে অনুনয় করে ,তখন পকেট থেকে টাকা বের হয়। মেয়েগুলো কী সুন্দর করে ছেলেগু্লোকে জান,বাবুটা,পাখিটা বলে ডাকে!! ব্যাপারটা মজাই লাগে রাকিব আর মনিরের।যদিও তারা ভেবে পায়না এই “বুইড়া দামড়া” ছেলে-মেয়েগু্লো পরস্পরকে বাবু কেন ডাকে? যদিও এতে তাদের কিছু আসে যায় না। বেশি কষ্ট রাকিবের হয়। মনির শুধু দাঁড়িয়েই থাকে আর টাকা চাইতে থাকে। মনিরের করুণ চেহারা টাকা চাওয়ার পক্ষে সহায়ক। ছেলেদের আড্ডায় গেলে আবার টাকা কম ওঠে। মারও খায় মাঝে মাঝে।কেউ কেউ টাকা দেয় আবার কেউ কেউ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ওদের মতোই গালিগালাজ করে। এদের প্রত্যেকের হাতেই সিগারেট থাকে। মনির ভেবে পায় না “একটা সিগারেটের অর্ধেক টাকা দিলেই তো হয়ে যায়।তাও এরা মারে কেন?” সকালের চাহিদার চেয়ে প্রাক দুপুরের এই চাহিদা ভিন্নতর। সকালের অসুস্থ ছেলেরা এই সময়ে পরিণত হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুধার্ত জীবে। “বাই! দুইডা ট্যাকা দেন বাই!! বাত খামু। দুইদিন কিচছু খাই নাই।” বেশির ভাগ লোকই তাদের কথা বিশ্বাস করে না।কিন্তু তাদের ঘ্যানঘ্যান,শতচ্ছিন্ন কাপড়, উস্কোখুস্কো চুল , শুষ্ক চেহারা দেখে বহু লোক টাকা দিয়ে দেয়। তাদের এই চেহারার হাল তাদের অসহায়ত্বের কারণে হয় নি। এটা তাদের ইচ্ছাকৃত। বেশ কিছু লোক তাদের জামাকাপড় দেয় দয়া করে।অনেকে দুপুরে খাওয়ায়। কিন্তু জামাকাপড়গুলো তারা বিক্রি করে ফেলে। তাদের দরকার টাকা। সুপরিপাটি লোককে কেউ ভিক্ষা দেয় না। তাই এই বেশ তারা ধারণ করে রাখে।
সকালের ঘটনার পর পার্কে আপাতত যাওয়া যাবে না। এখন বিকল্প উপায় হিসেবে শপিং মল থেকে একটু দূরে বসার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। পুলিশের মারের পর ছালাটা আনতে পারে নি। যদিও টাকাটা আগেই পকেটে নিয়ে নিয়েছিল সুযোগ বুঝে। তারা ফুটপাতে বসে পড়ে। কিন্তু ফুটপাতে বসা মাত্রই আবারো “ওরে মারে” বলে চেঁচিয়ে ওঠে রাকিব। উৎসুক মনির কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই তার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে রাকিব বলে ওঠে “ এহনো জ্বলে রে।” রাকিবের ব্যাথাকে অতিক্রম করে মনিরের মন অধিকার করে নেয় রাকিবের ‘জ্বলন্ত পুটকি।’ মনির আবারো হাসতে থাকে। হাসি দেখে প্রথমে রাকিবের কিছুক্ষন গা জ্বললেও এবার সে নিজেও হেসে ফেলে। শপিং ফেরত বাই এবং আপাদের কাছে ভিক্ষা চায় তারা। যারা পায়ে হেটে যাচ্ছে শুধু তাদেরকেই ধরছে। গাড়িওয়ালাদের কাছে যেতেই পারছে না। কাছে গেলেই কসাই গার্ড হুইসেল দিতে দিতে চলে আসে। আশানুরূপ না হলেও ইনকাম একেবারে খারাপ হয় না। এমন সময় খুব সুন্দর পরিপাটি লিকলিকে গড়ণের এক লোক এলো তাদের সামনে। তারা তার কাছে ভিক্ষা চাইলো।কিন্তু লোকটা ইতস্তত করতে লাগলো।সম্ভবত কিছু বলতে চায়। একটু পরপর ঢোক গিলছে। তৃষ্ণার্ত মনে হচ্ছে। ভিক্ষা চাওয়া থামিয়ে রাকিব জিজ্ঞাসা করে লোকটিকে,
“কিছু কইবেন?”
লোকটা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললো, “তোমাদের কাছে বিশ টাকা হবে? আমি আমার মানিব্যাগ ফেলে এসেছি। কাল দিয়ে দেব ।”
লোকটির কথা শুনে অবাক হয় তারা। এরকম ভদ্র ব্যবহার তারা সহজে পায় না। এভাবে তাদের কাছে কেউ টাকা চাচ্ছে সেটাও একটা তেলেসমাতি কারবার। অভিভূত হয়ে সাথে সাথেই বিশ টাকা বের করে দেয় লোকটির হাতে। লোকটি ধন্যবাদ জানিয়ে জিজ্ঞাসা করে তাদেরকে আগামিকাল কোথায় পাওয়া যেতে পারে। তারা পার্কের কথা বলা মাত্রই লোকটি চলে যায়। তারা গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটি হকারের কাছে থেকে এক গ্লাস লেবু পানি কিনে খায়। এরপর বাসে উঠে চলে যায়। সময় গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়। তারা ফুটপাত ধরে হাটতে থাকে। কিছুদুর গিয়েই তারা দেখতে পায় ফুটপাতের ওপর প্রচণ্ড শব্দে মাইক বাজছে। লুঙ্গি, জুব্বা, দাড়ি, টুপিওয়ালা এক লোক উচ্চস্বরে মাইকে কথা বলছে,
“এই যে ভাই, দুনিয়ার দানে আখেরাত পাইবেন। আল্লাহর ঘরের নির্মাণ কাজ চলে। দান কইরা যান। সব ধ্বংস হয়ে যাবে,আল্লাহর ঘর থাকবে।”
একটু পরই সে গান গেয়ে ওঠে,
“দানকারীদের মাতাপিতা সুখে থাকবে কবরে,
নূরের টুপি মাথায় দিয়া উঠবে রোজ হাশরে…………”
সেখানে বহু লোক টাকা দিয়ে যাচ্ছে। ইনকামের এই পন্থা দেখে অবাক হয় তারা। কারণ তাদের জানামতে আশেপাশে কোথাও মসজিদ হচ্ছে না। মাইকের চারপাশে জুব্বা, পাজামা, টুপি পরিহিত ছোট বাচ্চাদের দেখা যাচ্ছে। সেদিক দিয়ে যারাই যাচ্ছে তাদেরকে ধরে ধরে দান করার জন্য বলছে। এর মধ্যে এক বাচ্চা রাকিবের কাছেও চলে আসে।
রাকিব ক্রোধে ফেটে পড়ে “ফকিরের কাছেও ভিক্ষা চোদাইতে আইছছ ফকিন্নিচোদা।” বাচ্চাটা কি বলবে ভেবে পায় না। লজ্জায় কেটে পড়ে ওদের সামনে থেকে।
তারপর হাটতে হাটতে অনেক সময় কেটে যায়।তারা একটা ছাপড়া হোটেলে খেতে ঢোকে। দুপুরের ব্যস্ততার পর হোটেল এখন প্রায় ফাঁকা বললেই চলে। তারা এখানেই খায় প্রতিদিন। এখানে টিভি আছে।টিভি দেখতে দেখতে খেতে ভালোই লাগে রাকিব আর মনিরের। আজ টিভিতে সিনেমা চলছে।
বিশাল এক ঘরের মাঝে একটা টেবিল। টেবিলের চারপাশে চাকর-চাপরাশি দেখা যাচ্ছে।সবাই তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হুকুমের অপেক্ষায়। টেবিলে অনেক খাবার । ফলমূল, মাছ, মাংস, মিষ্টি। দেখে জিভে পানি চলে আসে রাকিব আর মনিরের। সিনেমায় একটা নাদুস-নুদস ছেলেকে দেখা যাচ্ছে।তাকে তার মা খাওয়াতে চেষ্টা করছে।কিন্তু সে খেতে চাচ্ছে না। অতি আহ্লাদের সাথে “আমি খাবো না” বলে খাবার ফেলে দিচ্ছে। তার এই খাবার ফেলে দেয়া দেখে রাগ হয় রাকিবের। মনিরকে শুনিয়ে বলে ,
“হালার ফার্মের মুরগীচোদার কুয়ারা দেকলি মইন্যা? মাইনষে খাইতে পারে না আর এই বেক্কলচোদায় হালাইয়া দেয়। মাইনষেরে দিয়া দিলেও তো পারে।”
“এগুলি বড়লোকের কাম।তুমি বুজবা না।“ বিজ্ঞের মতো বলে ওঠে মনির।যদিও এই বিজ্ঞতার কোন মূল্য নেই রাকিবের কাছে। আজ তাদের ইনকাম ভালো হয়েছে। যদিও প্রতিদিনই ভালো হয়। তারাও বড়লোকের মতো মুরগী অর্ডার করে আজ। দোকানে কাস্টমার নেই তেমন। তাই খেয়ে কিছুক্ষন বসে বসে সিনেমা দেখে এরপর বের হয়ে যায় তারা। হাঁটতে হাঁটতে আবারো পার্কের কাছে চলে আসে। পার্কে লোক নেই তেমন। ওরা একটা গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ে। বাদামওয়ালার কর্কশ চিৎকারে তাদের ঘুম ভাঙে। ঘুম ভেঙে দেখে বিকেল হয়ে গেছে। লোকজন আসতে শুরু করেছে।অনেক লোক বেড়াতে আসে বিকেলে।সকালের চেয়ে অনেক বেশি। এই সময়টায় পার্কে জুটি বেশি দেখা যায়। টাকাও তাই বেশি আসে। কত সুন্দর করে সাজগোজ করে আসে সবাই!! দেখতে ভালো লাগে ওদের। কিন্তু টাকা চাওয়ার পরপরই সেই সৌন্দর্যের অন্তরাল থেকে তাদের কদর্য রূপ বের হয়ে আসে। যদিও কেউ কেউ কাছে ডেকে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করে, ভালো ব্যবহার করে। কয়েকদিন আগে এক জুটি তাদের ডেকে বসিয়েছিল তাদের সামনে। তাদের একজন কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করেছিল, “সরকার,এনজিও তো কাজ করছে তোমাদের নিয়ে।কত সাহায্যই তো পাও। ভিক্ষা করো কেন?” শুনে অবাক হয় রাকিব। জিজ্ঞাসা করে, “কতা হাছা নি? আসলেই কাম করে? আমরা তো জানিনা? বলে সেখান থেকে প্রস্থান করেছিল রাকিব আর মনির।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। লোকজন পার্কের মাঠে বসে গল্প করতে থাকে। রাকিব-মনির তাদের কাছে গিয়ে ভিক্ষা চায়। কারো কারো পা জড়িয়ে ধরে। ঘুরতে ঘুরতে পার্কের এক অন্ধকার কোণে এক জুটিকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে তারা। মনির কিছু না বুঝলেও রাকিব কিছু কিছু বোঝে এসবের।এলাকার বড় ভাইদের কয়েকবার দেখেছে এসব জুটিকে ধরে টাকা পয়সা ছিনিয়ে নিতে। এসবকে অসামাজিক না বেসামাজিক কিছু একটা বলে সবাই। অসামাজিকের কথা বলে মাঝে মাঝে কিছু না করলেও এসব জুটির কাছ থেকে টাকা, পয়সা, মোবাইল, অলঙ্কার সব ছিনিয়ে নেয় তারা। ছেলেমেয়েকে একা পেলেই হয়েছে। রাকিবের মনে হতে থাকে “এইডা ট্যাকা হাতাইন্যার সুযুগ।” কিন্তু বড় ভাইদের মত এত সাহস বা শক্তি নেই তার। তাই সে গিয়ে তাদের কাছে ভিক্ষাই চেয়ে বসে সাথের মেয়েটার পা জড়িয়ে ধরে। সে আসাতে অপ্রস্তুত হয়ে ভয় পেয়ে যায় মেয়েটি।কিন্তু ছেলেটি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় তাকে। ভিক্ষা দিতে অস্বীকার করে। রাকিব মনে সাহস সঞ্চয় করে বলে,
“আকাম-কুকাম সবই দেখছি।বড় বাইগো ডাক দিমু কইলাম!!”
রাকিব ভেবেছিলো এতে হয়তো ভয় পেয়ে তাকে কিছু টাকা দেবে তারা। কিন্তু এই কথা বলার পরই ছেলেটি রাকিবের গালে জোরে একটা চড় মেরে বলে,
“কুত্তার বাচ্চা। তর কোন বাপ আছে যা ডাইক্যা লইয়া আয়।”
এ-কথার পর ভবিষ্যতে আরো মার হজম করার আশঙ্কায় সে স্থান থেকে দৌড়ে পালায় রাকিব আর মনির। এই গঘটনায় মনিরও ভয় পেয়ে গেছে।
“এইডা কী অইলো বাই?” মনির জিজ্ঞাসা করে।
“হালায় মনে লয় বড় কোনো নেতা অইবো।”
“তুমি ক্যামনে বুজলা?”
“আরে রামছাগল! আতে পাওয়ার না থাকলে এত মাইনষের ভিত্তে অন্দকারে আকাম করার সাহস পায়? তাও এমুন জায়গায়?”
“এইবার বুজছি।”
“ল।বাইরে যাই অহন। এনে আর কেউ কিছু দিব না।”
পার্কের বাইরে পা বাড়ায় তারা। পার্ক থেকে একটু দূরেই টেম্পু স্ত্যান্ড। সেখান থেকে অনেক লোক যাতায়াত করে। তারা হঠাৎ লক্ষ করে বেশ সাজসজ্জা করে পরিপাটি হয়ে এক সুন্দরী ভদ্রমহিলা ফোনে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। ফোনের কথা শেষ করে সে তার ফোনটি তার পাশের ছোট ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিলো। মহিলা টেম্পুর দিকেই যাচ্ছে। ঠিক তখনই মনিরকে সাথে আসার ইঙ্গিত করে মহিলার পিছু নিল রাকিব।
চলবে…
ডান্ডি-শেষ পর্ব।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ২:৪৯