★★গল্পটি তিন পর্বে সমাপ্ত হবে। গল্পের প্রয়োজনে কিছু জায়গায় অশ্রাব্য স্ল্যাং ব্যবহার করা হয়েছে। আশাকরি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন সকলে।★★
## প্রথম পর্ব ##
গাছের ফাঁক গলে সকালের সোনালি রোদ উঁকি দেয়ার আগে যখন তুলোর মতো শুভ্র কোমল আলোয় বিশ্বচরাচর পরিস্কারভাবে অবলোকনের পর্যায়ে থাকে, মন জুড়োনো ঠাণ্ডা সমীরণে যখন গাছের পাতা কাঁপতে থাকে,ঠিক তখনই শহরের লোকেরা হাটঁতে বের হয়। কেউ হাঁটে,কেউ ব্যায়াম করে, কেউ ফিটফাট হয়ে অফিসে ছোটে, ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েরা স্কুলের পথে ছোটে কাঁধে ভারী ব্যাগ নিয়ে। নানা বয়সের, নানা ধরণের লোকের দেখা মেলে সকালবেলা।সকলেই সকলের কাজে ব্যস্ত। তারা সকলেই যখন শহরের এই পার্কের দিকটায় আসে তখন তারা দেখতে পায় পার্কের গেটেই বছর নয়-দশ বয়সী এক ছেলেকে। তার কোলের ওপর একটা চার-পাঁচ বছর বয়সী ছেলে ঘুমিয়ে থাকে। শহরের লোকেরা আজ পর্যন্ত এই ছেলে দুটোকে হারাতে পারে নি। যে যত ভোরেই আসুক না কেন এই ছেলে আগে থেকেই তার ছালার আসনে বসে থাকে সামনে একটা প্লাস্টিকের বাটি রেখে।সে কখন আসে,কোত্থেকে আসে কেউ জানে না।কেউ তাকে কখনো এসে বসতে দেখেনি। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠস্বরে সে সকলের কাছে ভিক্ষা চায়।
"স্যার, ইট্টু সাহায্য করেন স্যার। স্যার, আমার ভাইডা অসুস্থ স্যার।"
তার প্রতিটি বাক্যের শুরুতে এবং শেষে স্যার শব্দটি শোভা পায়। তার এই কাতর কণ্ঠে অনেকেরই দয়া হয়।বিশেষ করে সাথে আসা ভদ্রমহিলাদের। অনেক সময় স্যারেরা সাহায্য করতে চায় না।কিন্তু সাথে আসা ম্যাডামদের অনুরোধে তারা সাহায্য করে। এজন্য উচ্চস্বরে দোয়া করার সময় স্যারদের চেয়ে ম্যাডামদের প্রাধান্য বেশি থাকে। "আল্লাহ আপনেরে সুস্থ রাহুক।" বলে তার দোয়া শুরু হয়। দোয়া কোনোসময়ই পুরোপুরি করতে পারে না সে। কারণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার দোয়া শোনার সময় শহরের মানুষের নেই। তাছাড়া এভাবে প্রকাশ্যে নিজ গুণগান ও দোয়ায় বেশির ভাগ লোকই বিব্রত হয়ে সেখান থেকে চলে যায়।তবে কিছু লোক আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো দোয়া শোনে। নিজের প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে?? এরকম লোক দেখলে ছেলেটি কৌশলে দোয়া সংক্ষিপ্ত করে দেয়। কারণ দোয়ায় সময় নষ্ট হলে অন্যদের কাছ থেকে টাকা চাওয়ার সময়টা কমে যায়।
প্রতিদিনের মতো আজও ভোরবেলায় দেখা যায় ছেলেদুটোকে। জেগে থাকা বড় ছেলেটার আকুতিতে বেশ ভালো পরিমাণ টাকা জমা হয়েছে বাটিতে। ছোট ছেলেটার চোখ বন্ধ। সে অসুস্থ এবং ঘুমন্ত। তাকে এভাবেই দেখে অভ্যস্ত শহরের লোকজন।তাকে জাগ্রত অবস্থায় কেউ দেখেনি। কিন্তু আজ যখন সকালের শুভ্র আলো আস্তে আস্তে সোনালি রং ধারণ করছিলো তখন সময়ের সাথে সাথে রোদের তাপ অসহনীয় হয়ে উঠছিলো। এই অসহনীয় সোনালি রোদ যখন ঘুমন্ত ছেলেটির চেহারার ওপর পতিত হয় তখন সেই রোদের তাপে অতিষ্ঠ হয়ে ছেলেটির চোখ-মুখ একটু পরপর সংকুচিত হয়ে যায়। বড় ছেলেটির এদিকে দৃষ্টি নেই। সে সমানে ভিক্ষা করে যাচ্ছে। আর তাই তার মাথার জায়গা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।রোদের তাপ অসহনীয় হবার দরুণ কিছুক্ষণের জন্য চোখ মেলে তাকায় ছোট ছেলেটি। ছোট ছেলেটির কপাল খারাপই বলতে হয়। এতক্ষণ বড় ছেলেটির চোখে পড়লো না, কিন্তু সে চোখ খোলা মাত্রই মনে হয় গায়েবি ইংগিতে বড় ছেলেটি টের পেয়ে গেল। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো ছোট ছেলেটির দিকে। চোখ খোলার এই নিষিদ্ধ ব্যাপারটি ঘটতে দেখে আসন্ন বিপদের কথা চিন্তা করে জাগ্রত ভিক্ষুক ছেলেটি তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে অপর ছেলেটির গালে চড় দিয়ে বলে, "
খানকির পোলা!! তরে কইছি না চোক বন্দ রাকতে।। চোক বুজ!!"
ছোট ছেলেটি তৎক্ষনাৎ বড় ছেলেটির আদেশ পালন করে। সে আবার তার চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ার অভিনয় চালু রাখে। তার গাল ব্যাথায় টনটন করে। তার ইচ্ছা করে কিছুক্ষণ নিজের হাতটা গালে ঘষতে। কিন্তু সেই সুযোগ না থাকায় নিজের নিপুণ অভিনয়ক্ষমতা প্রদর্শন করতে হয় তাকে।তার প্রচণ্ড কান্না পায়। অনেক কষ্টে কান্না আটকে রাখে,যার প্রমাণ স্বরূপ তার চোখের কোণে অল্প পানির অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় কিছুক্ষণের জন্য। সে পানি গড়িয়ে পড়ে না। ঝিম মেরে পড়ে থাকে সে। সবকিছুই আবার আগের মতো হয়ে যায়। কিন্তু এই অভিনব ঘটনাটি চোখে পড়ে যায় দুজন নগরবাসীর। তারা গর্জে ওঠে ছেলেদুটির সামনে এসে-
"সুস্থ ছেলেকে দিয়ে অসুস্থতার অভিনয় করিয়ে ভিক্ষা করা ভারি অন্যায় কাজ। এই প্রতারকদের জন্যই দেশের উন্নতি হচ্ছে না।ছোটলোকের জাতগুলোকে বিশ্বাস করে সাহায্য করে লোকে।"
শহরবাসীর গর্জনে আশেপাশে আরো লোক জড়ো হয়। কিন্তু শহরবাসীর কথাকে ভুল প্রমাণ করতে ঘুমন্ত ছেলেটি এতক্ষণ মোটেও নড়াচড়া করে নি। নিপুণ অভিনয়দক্ষতার জোরে সে ঝিম মেরে পড়ে আছে। অপরদিকে বড় ছেলেটি কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। লোকগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কেউ কথা শুনছে না। গ্যাঞ্জাম থামাতে সেখানে চলে আসে টহল পুলিশ। পুলিশ আসামাত্রই ছোট ছেলেটি তার অভিনয়ে ক্ষান্ত দিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালায় বড়টিকে ফেলে রেখে, যেন গলায় সোনার মেডেল ঝোলানো সেই কাইল্যা লোকটাকে* হারাবে আজ। ছোট ছেলেটির এই দৌড় বড় ছেলেটির প্রতারণাকে নগ্নভাবে সামনে তুলে আনে। পুলিশ সবকিছু জানে। তবুও পাবলিক ডিমান্ড উপেক্ষা করতে পারে না। বড় ছেলেটার হাতটা ধরে নিতম্বের ওপর ধমাধম করে দুটো বাড়ি মেরে বসলো হাতে থাকা লাঠিটা দিয়ে। ছেলেটা ব্যাথায় কঁকিয়ে ওঠে। "উ-মা-বাবা গো" বলে একই সাথে বাবা-মায়ের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে। কিন্তু বাবা মা আসে না। তার চোখ বেয়ে পানি আগেই ঝরছিলো।এবার দ্বিগুণ গতিতে ঝরতে লাগলো। দুটো বাড়ি মেরেই
" হালা টোকাইয়ের ঘরে টোকাই। বাটপারি মারাইতে আইছো এনে?? যা।ভাগ!"
বলে ছেলেটিকে তাড়িয়ে দেয় পুলিশ। দুহাতে নিতম্ব ডলতে ডলতে ছুটে পালায় ছেলেটি।
ছুটতে ছুটতে শহরের সবচেয়ে বড় শপিং মলের সামনে চলে আসে ছেলেটি। এসে দেখে একটু দূরেই সাগরেদ ছেলেটি বসে আছে। তাকে এভাবে ফেলে আসার জন্য গালির ফোয়ারা ছোটায় বড় ছেলেটি। অন্য ছেলেটি জবাবে কিছুই বলে না।শুধু মুখ টিপে হাসে। সে খুব মজা পাচ্ছে। মনে মনে আনন্দিত সে একটা কারণে। কিন্তু বলতে পারছে না। সকালে বড় ছেলের চড়ে সে যে ব্যাথা পেয়েছিলো, কম করে হলেও তার দ্বিগুণ ব্যাথা বড় ছেলেটি ফেরত পেয়েছে বলে তার ধারণা। বড় ছেলেটার ক্রোধ তার ধারণাকে পোক্ত করেছে। এবার কৌতকের সুরে ছোট ছেলেটি বড় ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করে,
"পুলিশে শিন্নি কেমুন দিলো রাকিব বাই???"
রাকিব বাই এই কৌতুকে আনন্দিত হয় না, বরং জ্বলে ওঠে,
" কতা কইস না বাইঞ্চোত। চুদির পুতে পুটকিডা জ্বালাইয়া দিছে।"
উত্তর শুনে ডাঙায় তোলা মাছের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে হাসতে থাকে অন্য ছেলেটি। যেন এমন মজার কথা সে জীবনে শোনে নি।
"ঠিকই তো আছে। দুই নম্বরি করছ, মাইর তো খাইবাই। "
বলে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাসতে থাকে ছোট ছেলেটি। হাসির দমকে কলিজা বের হয়ে আসবে বলে মনে হয় তার।
"পুলিশ চুদির পুতে নিজে ভিখারি-রিশকাওলার তে ট্যাকা খায় আর আমারে বাটপারির লাইগা মাইর দেয়।" রাকিবের কণ্ঠ থেকে শ্লেষ ঝরে পড়ে।
"বালো অইছে।আমারে মারছিলা না!! "
"মারছি তো তর বেকুবির লাইগ্যা। অহন ইনকাম করবি কেমনে হেইডা ভাব।এহন পার্কের দিকে থাকলে হেব্বি ইনকাম অইতো।"
ঐদিকে এখন যাওয়া যাবে না। সেই টহল পুলিশ এখনো আছে সেখানে। যাওয়াটা বিপজ্জনক। দুপুরের দিকে এক টহল পুলিশের ডিউটি শেষ হয়ে নতুন পুলিশ আসে। তখন যাওয়া যেতে পারে। পুলিশের ডিউটি শেষ হতে এখনো অনেক সময় বাকি। তাই সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য মনস্থির করে তারা। কিন্তু কী করবে সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না । যদিও ভিক্ষাই করবে। কিন্তু একই ধরণের ভিক্ষা সব জায়গায় চলে না। ভিক্ষার ধরণ পরিবর্তন করতে হবে। এসব শপিং মলের সামনে তারা সচরাচর আসে না। সিকিউরিটির লোকজন তাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া লোকজনের গাড়ির কাছে গিয়ে ভিক্ষা চাইতে গেলেও সিকিউরিটির লোকজন কোত্থেকে যেন চলে আসে। তাই বিকল্প পদ্ধতির চিন্তা করে তারা।
চলবে.....
*গলায় সোনার মেডেল ঝোলানো কাইল্যা লোক- উসাইন বোল্ট।*
দ্বিতীয় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ১:০৪